21 Oct

গুরু পণ্ডিত রাজেন্দ্র গঙ্গানিজির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন:প্রতিভা দাস


গল্পের সময় সাক্ষাৎকার

[পন্ডিত কুন্দনলাল গঙ্গানির পুত্র রাজেন্দ্র গঙ্গানি এই মুহূর্তে গোটা উপমহাদেশে কথক নৃত্যে এক শীর্ষস্থানীয় নাম। মাত্র ৪ বছর বয়সে নৃত্যে হাতেখড়ি জয়পুর ঘরানার এই শিল্পীর।কথক নৃত্যে তাঁর উদ্ভাবনী শৈলী ও অবদানের জন্য দেশে বিদেশে নানা সম্মানের পাশাপাশি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের কাছ থেকে ২০০৩ সালে  পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার ।২০২২ সালে  কলকাতায় ইজেডসিসিতে  ‘swarang’  আয়োজিত কথক ওয়ার্কশপ চলাকালে কথক নৃত্যের পাশাপাশি তাঁর শিল্পী জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন নৃত্য শিল্পী প্রতিভা দাস।]  

ওয়ার্কশপের এক ফাঁকে সাক্ষাৎকার

প্রতিভা দাসঃ  কথক নৃত্যে রাজেন্দ্র গঙ্গানিজি  মানেই একটা প্রতিষ্ঠান।আপনার বাবা বিখ্যাত কথক শিল্পী ছিলেন। অনেকে বলেন নৃত্যক্ষেত্রে আপনি তাঁকেও ছাপিয়ে গেছেন।এই উত্তরণ কীভাবে সম্ভব হল?

রাজেন্দ্র গঙ্গানিঃ আমার যে জার্নি, আমার যে যাত্রা তা সেই বাচ্চা বয়স থেকেই শুরু। আমি তখন ৩-৪ বছরের।আর সেই সময় একটা মজার ব্যাপার ঘটেছিল,তখন আমার বয়স ছিল ৫। আমার গুরু ছোট ছোট ঘুঙুর বেঁধে স্টেজে নামিয়ে দিয়েছিলেন। সেইসময় কী নাচ করেছিলাম মনে নেই কিন্তু মা বলেছিলেন, “তুমি পাঁচ বছরেই খুব সুন্দর করেছো।” আমার মনে হয়েছিল সেই সময়ে আমার জীবনে যেন আলাদা কিছু একটা হয়েছিল। ওই যে শুরুর শুরু সেখান থেকেই কিছু শিখে নেওয়ার ছিল।

প্রতিভা দাসঃ এই নৃত্যের যে পরম্পরা,তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল।কী রকম ছিল সেই পরিশ্রম?

পণ্ডিতজির সঙ্গে প্রতিভা দাস ও রিমঝিম বৃষ্টি

রাজেন্দ্র গঙ্গানিঃ নৃত্য সাধনার পরিশ্রম খুবই।আর আমার পরিশ্রম করাটা খুব মুশকিলেরও ছিল।It was very challenging for me – কারন আমাদের যে পরম্পরা ছিল তা মন্দিরের পরম্পরা।আর এই মন্দির থেকে মঞ্চের মধ্যের সময়টা অর্থাৎ মন্দির থেকে বড় শহরের মঞ্চে প্রবেশ করাটাই ছিল সবচেয়ে বড় মুশকিলের। কারণ সেই সময় জয়পুর বা স্থানীয় গ্রামের যে ছোট ছোট মন্দির প্রাঙ্গন ছিল সেখানেই প্র্যাকটিস হত। আর একটা কারণ হল,আমাদের পরম্পরায় যে গুরুজনেরা ছিলেন তাঁদের কয়েকজন আগেই সংসার থেকে চলে গেছেন এবং তাঁদের এই

পরম্পরার অনেক কিছুই চলে গেছে। গুরুর মুখের মাধ্যমে খুব কমই এই পরম্পরার মধ্যে বেঁচে ছিল। যেমন স্বর্গীয় গুরু শক্তিনারায়ন প্রসাদ দাদাজি ছিলেন আমার দাদা গুরু।স্বর্গীয় পন্ডিত সুন্দর প্রসাদ দাদাজির মতো কিছু ব্যক্তিত্ব এই পরম্পরা অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।তারপর আমার গুরু আমার বাবা পণ্ডিত কুন্দনলাল গঙ্গানিজি অনেক পরিশ্রম করে এই পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।আর তারপর থেকে কিছুটা দ্বায়িত্ব আমার কাঁধে এসেছে এবং সেই থেকে আমি এই পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্রতী হয়ে আছি।

প্রতিভা দাসঃ  আপনি কথক নৃত্যের প্রথম সারির মানুষ।সদ্য আমরা কিংবদন্তী শিল্পী বিরজু মহারাজকে হারিয়েছি।আপনি মহারাজকে কি নামে পরিচিত করবেন – নটরাজ নাকি নটবর? মহারাজজি আপনার জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিলেন?

ওয়ার্কশপের নানা মুহূর্তে

রাজেন্দ্র গঙ্গানিঃ সেটা একটা সময় ছিল যখন আমি খুব ছোট, আমি সেই সময়েই  গুরুজির ( আমার বাবা পন্ডিত কুন্দনলাল গঙ্গানিজি)  সঙ্গে দিল্লি গিয়েছিলাম।আমার বাবা আমার গুরু ছিলেন। আমি ভাগ্যবান ছিলাম এইজন্যই যে আমার কাছে গুরুজি বাবার চেয়ে গুরুই বেশী ছিলেন এবং  তাঁর ব্যবহারও সেইরকমই  ছিল। সেই সময় গুরুজি  দিল্লির কথক কেন্দ্র থেকে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সে কেন্দ্রের প্রধান হিসেবে। আমরা তখন যোধপুরে।গুরুজি যোধপুরেই কাজ করতেন।গুরুজি আমন্ত্রণ পেয়ে দিল্লি চলে এলেন।আমিও গুরুজির সঙ্গে ছিলাম।সেখানেই মহারাজজির সঙ্গে দেখা।

মহারাজজি এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি আমার পরিবারের মতই ছিলেন। যিনি আমাকে অনেক স্নেহ এবং আদর দিয়েছেন। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার বাবাই আমাকে মহারাজজির কথা বলেছিলেন। মহারাজজি আমাকে ওনার পরিবারের মনে করতেন এবং অনেক স্নেহ, ভালোবাসা ও আশীর্বাদ দিয়েছিলেন।আমিও মহারাজজিকে অনেক সম্মান করতাম।যতদিন মহারাজজি ছিলেন ততদিন আমাদের সম্পর্ক ছিল,আছে এবং থাকবে এবং ওনার প্রতি আমার সম্মান চিরকাল অটুট থাকবে।

প্রতিভা দাসঃ এখন তো রিয়েলিটি শোয়ের রমরমা।এই রিয়েলিটি শো শাস্ত্রীয় সংগীত/নৃত্যকে, শিল্পীকে এগোতে সাহায্য করছে নাকি অন্তরায় হয়ে দাড়াচ্ছে? আপনার কি মত?

ওয়ার্কশপের নানা মুহূর্তে পণ্ডিতজি -১

রাজেন্দ্র গঙ্গানিঃ  প্রথমত,যদি এই শব্দটার কথাই ধরা যায় তাহলে ‘রিয়েলিটি’ আসলে রিয়েল নয়।দ্বিতীয়ত যারা এই রিয়েলিটি শো করাচ্ছেন তাঁরা আর্ট বা শিল্পর  জন্য কিছুই করছেন না। দে আর সেলিং –  অর্থাৎ তাঁরা কলা (আর্ট) বিক্রি করছেন।কলা আত্মার সঙ্গে মিশে থাকে। আর যদি কলা বিক্রি করা যেত তাহলে যে কেউই তা অনেক টাকার বিনিময়ে কিনে নিতে পারত।কিন্তু টাকার বিনিময়ে কেউ কারোর সংস্কৃতি কিনতে পারেন না, কেউ শিল্পও কিনতে পারেন না।কেনা যায় না।অনেক কিছুই আছে যা কেনা যায় কিন্তু যা দিব্য জিনিষ তা কখনও কেনা যায় না।

প্রতিভা দাসঃ আপনার পায়ে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, সেসময় জীবনে এক কঠিন অবস্থা পার করে এসেছেন।কিভাবে সেই কঠিন সময় আপনি পার করলেন? কারও জীবনে এমন ঘটনা হলে কিভাবে সামনে চলার পথে এগিয়ে যাবে সে?

রাজেন্দ্র গঙ্গানিঃ আমি ভাবলাম এটা একটা পরীক্ষা।এই পরীক্ষা ভগবান নিচ্ছেন।এটা ভগবানের চাওয়া।এমনটা কেন হল? আমি হাসতাম, আমি ভাবতাম, কোনও কোনও মানুষ বেঁচে থাকতে থাকতেই নিজের জীবনের এবং কারোর জীবনের উদাহরণ হয়ে ওঠে।আমি অ্যাক্সিডেন্টের পরও বেঁচে – এটাই আমার সান্তনা হয়ে দাঁড়ায়।আমি একজন নৃত্যশিল্পী।আমি হুইল চেয়ার থেকে সিঁড়ি দেখতাম – ভাবতাম আমি কীভাবে সেই সিঁড়ি উঠব?

ওয়ার্কশপের নানা মুহূর্তে পণ্ডিতজি -২

জীবন তো শেষ হয়ে যাচ্ছিল। অতটা পথ এগিয়ে আমার সবকিছু শূন্য হয়ে গিয়েছিল।আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না,হাঁটতে পারতাম না – নাচ করব কীভাবে? ( চোখে জল)

কিন্তু আমার হিম্মত ছিলেন আমার মা, সীতারা দেবী এঁরা। ছিলেন কিষান মহারাজজি, তবলা বাদক – যারা ডাক্তারদের ফোন করে বলতেন এবং আমাকে উৎসাহিত করতেন যে তোমাকে নাচতে হবে,উঠে দাঁড়াতে হবে।অনেকেই উৎসাহ দেন আমার প্রত্যাবর্তনের জন্য।আমার গুরু,আমার মা আমার সঙ্গে ছিলেন বলেই আমি সেই ক্ষমতা ফিরে পাই বলে আমার বিশ্বাস।

প্রতিভা দাসঃ একজন যদি শিল্পী হওয়ার জন্য এগোতে চান তাহলে তাঁর সামনে এগোনোর পথটা কীরকম হবে?

ওয়ার্কশপের নানা মুহূর্তে পণ্ডিতজি -৩

রাজেন্দ্র গঙ্গানিঃ দেখুন, জীবনে ইচ্ছাপূরণ করা কোনও হাতের সরষে আগুনে ফেলার মত নয়।সাধনা করতেই হবে।এই সাধনা কেমন হবে? প্রথমত নিজের রেওয়াজের সময় বের করা।যদি আপনাকে ৯টায় বেরোতে হয় তবে ৬টার সময় আপনাকে রেওয়াজ করতে হবে।যদি ৫টায় বেরোতে হয় তবে ৪টের সময় রেওয়াজ করতে হবে। সবার আগে নিজেকে সময় দিতে হবে।নিজের রেওয়াজের পর সব কাজ করা যায়।কিন্তু রেওয়াজ বাদ হলে সেই দিনে আর সময় ফিরে পাওয়া যায় না।খুবই মুশকিল এই সময় বের করা।এটা হল যে একদিন একটা কাজ করার পর আপনি রেওয়াজ করছেন, তাতে আপনার এনার্জি লেভেল অর্থাৎ ক্ষমতা অনেক কমে যায়।আসলে বাইরে গেলে নিজের ক্ষমতা অনেক কমে যায়।সাধনা করতে গেলে ক্ষমতার অর্থাৎ এনার্জির দরকার।আর এই এনার্জি সকাল সকালই পাওয়া যায়।অন্য কাজ আপনাকে ক্লান্ত করে তোলে।

প্রতিভা দাসঃ কলকাতায় জয়পুর ঘরানার নৃত্য চর্চা কিভাবে করা সম্ভব? আজকের ছোটরা কীভাবে এগোবে?

ওয়ার্কশপের নানা মুহূর্তে পণ্ডিতজি -৪

রাজেন্দ্র গঙ্গানিঃ আমি এটাই বলতে পারি যে ঘরানা তৈরি হয়ে গেছে।কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে কথক শিক্ষার কী হচ্ছে? কিভাবে হচ্ছে? কথক শিক্ষায় আপনি যত শিখবেন ততই তা আপনার মধ্যে থেকে যাবে।আপনি যদি বলেন আপনি এই ঘরানার,এই ঘরের তাতেও কোনও দোষ নেই। কারণ যে কোনও ঘরানার প্রাপ্তিই আপনার সঙ্গে বেঁচে থাকবে। কিন্তু আপনি যখন বিভিন্ন ঘরানার থেকে কিছু শিখতে চাইছেন তখন কিন্তু তা নেওয়ার,গ্রহণ করার ক্ষমতা আপনার থাকতে হবে।

কলকাতা বা বাংলার কথা যদি ভাবা যায় তাহলে বলব এখানে সব ঘরানার গুরুরা এসেছেন,শিখিয়েছেন।কোন ঘরানার কথক শিখলাম সেটা বড় নয়,জরুরী হল কথক শেখার সুযোগ পাওয়া। আমার এটাই বার্তা, যে যেকোনও ঘরানারই কথক শেখো না কেন তা ভাল করে শেখো আর তা ভালো করে জানো।

Tags: , , , , , , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ