ভন্তে জ্যাঠা ছিলেন সজ্জন মানুষ। ভন্তে নামেই পরিচিতিটা এত ব্যাপকছিল যে আসল নামটা আর কারও মনে পড়ে না আর। সাহেবদের মতো টকটকে ফর্সা কিন্তু ছোটখাটো চেহারার এই ভদ্রলোক জেলা সদরের কালেকটরেটে ক্লার্কের চাকরি করতেন। সেই সুবাদেপাড়ার লোকের হাজারটা ঝামেলার কাজ করে দিতে হত তাঁকে। মফঃস্বল শহরের প্রতিটি বাড়িতেই জমি জমা অথবা বসত বাড়ির খাজনা দেওয়ার ঝক্কি থেকে নানা ধরণের সমস্যায় মুশকিল আসান ছিলেন ভন্তেজ্যাঠা। আপনি এটা একটু দেখে দেবেন- শুধু এইটুকু কথা তাঁর সামনে গিয়ে বললেই শশব্যস্ত হয়ে সেই কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিতেন তিনি। ঘরে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, এক কন্যা ও দুই পুত্র নিয়ে সংসারে প্রাচুর্য ছিল না তাঁর। তবু এই সব উপকারের বিনিময়ে টাকা নেওয়ার কথা কোনও দিন ভাবেননি তিনি, তাঁর বিরুদ্ধে এসব নিয়ে পাড়াতেও কোনও কথা শোনা যায়নি। ভালো মানুষ ভন্তে জ্যাঠার একটাই দোষের কথা সবাই বলত। সেকথা পরে আসছে।
প্রত্যেকদিন সকালে একটা থলে হাতে বাজারে যেতেন ভন্তে জ্যাঠা। এই যাওয়ার পথে পাড়ার লোকজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে কত কথাই যে হত। ছোটদের দেখলেই লম্বা ঝুল পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে বার করে আনতেন একটা করে লজেন্স। সকালে ভন্তে জ্যাঠাকে দেখলেই তাই ছোটগুলো ইচ্ছে করে তাঁর সামনে চলে আসতো, লজেন্স পাওয়া যায় যে। এই লজেন্স বিলিয়ে, হাসি বিলিয়ে, মানুষের খবর নিয়ে বাজারে পৌঁছতে প্রায়ই সাইরেন বেজে যেত। সেসময় থানা থেকে সাইরেন বাজানো হত সকাল নটায়। বিমান হানার দূরতম সম্ভাবনা না থাকলেও সরকারি ব্যবস্থায় বিপর্যয় মোকাবিলায় ব্যবস্থাপত্র তৈরি রাখা হত। ওই সাইরেন মানে ভোঁ-টা শহরের মানুষের কাজে গতি আনত। যাহোক সক্কাল সক্কাল বাজারে বার হয়েও সেখানে পৌঁছতে এত সময় লাগায়, বাজারটা হত চোখ বন্ধ করে কোনও মতে। যতটা সমারোহ করে বাজারে যেতেন, ফেরার পথে তার কোনও চিহ্ন থাকত না। প্রায় দৌড়ে বাজার থেকে ফিরেই চান টান সেরে নাকেমুখে গুঁজে অফিস ছুটতেন। সাইকেলেই অফিস যেতে দেখত তাঁকে পাড়ার লোক। তবে সেপথেও আর সময় নষ্ট করতেন না ভন্তে জ্যাঠা।
জ্যাঠার তিন সন্তানই শহরের বড় স্কুলে পড়ত। মেধাবী ভালো ছেলে মেয়ে বলে তাদের সুনাম ছিল। পাড়ায় তাদের সমবয়সী ছেলে মেয়েরা যখন দাপিয়ে খেলা ধুলা করছে, তখন এই তিন ভাইবোন যেত লাইব্রেরিতে পড়ার বইয়ের খোঁজে। কোনও প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়নি ওই পরিবারে। মধ্যবিত্ত পরিবারে যেমন হয়, তেমনই সংসারটা চলত নেহাতই সাদামাঠা, অনারম্বরভাবে। ভন্তে জ্যাঠার বাড়িতে প্রচুর গাছপালা ছিল। গাছের পরিচর্যা করতেন কাকিমা নিজের হাতে। রোজ বিকেলে আটপৌড়ে শাড়ি পরা জেঠিমা দরজার একটা পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন -এই পর্যন্তই লোকে দেখত। সকলের সঙ্গেই হেসে কথা বলতেন, তবে সেটা হত রান্নাবান্না আর গাছপালা নিয়ে। কারও বাড়ির হাঁড়ির খবর দেওয়া নেওয়া করার অভ্যেসটা ছিল না তাঁর মোটেই। মেলামেশায় আন্তরিকতার মধ্যেও একটা দূরত্ব রাখতেন জেঠিমা। সেই দূরত্বের বাধা টপকে তাঁর সংসারের ভিতরের খবর কেউ জানতে পারত না। যাহোক প্রত্যেকদিন সন্ধ্যের মুখে আবার উল্টো মুখো সাইকেলে দেখা মিলত ভন্তে জ্যাঠার। সাইকেলেই বাড়ি ফিরতেন।
এমনই শান্ত সুভদ্র জ্যাঠাকে নিয়েও মাঝে মাঝে খুবই অস্বস্তিতে পড়তে হত তাঁর পরিবারকে। সেই সব সময় দূর থেকে তাঁকে আসতে দেখলে পাড়ার ছোটদের সরিয়ে নিয়ে যেত মায়েরা। তখন আর ভন্তে জ্যাঠা নন, সবাই বলত ভন্তে মাতাল। মদ খেয়ে চুর হয়ে টলমলে পায়ে বাড়ি ফিরতেন সাহেবের মতো টকটকে রঙের ছোটোখাটো চেহারার মানুষটা। শুধু কি টলোমলো পা, চিৎকার করে কোনও দিন গান গাইতেন, কোনওদিন অদৃশ্য কারও সঙ্গে বকা বকি করতেন মাতাল ভন্তে। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন জেঠিমা, তাঁকে দেখেই শান্ত হয়ে আসতেন জ্যাঠা, হাত ধরে জেঠিমা তাঁকে ভিতরে নিয়ে যেতেন। পাড়ার লোকজন কিছু না বললেও, জেঠিমা এবং তাঁর ছেলেমেয়েদের নিশ্চয় খারাপ লাগত জ্যাঠার এই আচরণ।
হয়তো সেকারণেই সকলের সঙ্গে মেলামেশায় দূরত্ব বজায় রাখতেন ওঁরা। তবে সেই এক-আধ রাতের মাতালকে আর দিনের বেলা খুঁজে পাওয়া যেত না। আবার সকাল হতে বাজারের থলে আর পাঞ্জাবির দু প্যাকেট ভরে লজেন্স নিয়ে হাসিমুখে এগিয়ে আসতেন ভন্তে জ্যাঠা। লজেন্স বিলিয়ে, হাসি বিলিয়ে, লোকজনের খবর নিয়ে বাজারে যেতে আবার সেই ভোঁ বেজে যেত।
হঠাৎ একদিন দুম করে মারা গেলেন সেই সাহেবের মতো টকটকে গোলাপী ফর্সা রঙের ছোটখাটো চেহারার মানুষটি। চাকরি থেকে অবসর নিতে তখনও তার অনেক দেরি ছিল, তার আগে জীবন থেকেই অবসর পেয়ে গেলেন । বাড়িতে ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক। সকাল হতেই খবর পেয়ে প্রতিবেশীরা এসে পড়েন। ভন্তে জ্যাঠার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পরে, আস্তে আস্তেপাড়ার লোকের মনে ফিকে হয়ে গেলেন সেই সজ্জন মাতাল মানুষটি। ভন্তে জ্যাঠার পরিবারে দিন বদল হয়, দুই ছেলে সরকারি অফিসার পদে চাকরি পাওয়ার পরে। ততদিনে মেয়েও একটি স্কুলে চাকরি পেয়ে চলে যায় দূর শহরে। তখনও প্রতিটি বিকেলে পরিপাটি সাজে জেঠিমা দাঁড়িয়ে থাকতেন দরজার একটা পাল্লা ধরে, যেন কার প্রতিক্ষায় রয়েছেনতিনি। যাহোক এরমধ্যেই শহরে অনুষ্ঠান করতে আসেন বিশিষ্ট এক সঙ্গীত শিল্পী, ঠুমরি গানে যাঁর দেশজোড়া খ্যাতি। প্রবীণা শিল্পীর ছোটবেলা কেটেছিল এই শহরেই, এখানে এসে তাই অনেক পূরনো মানুষের সঙ্গেই দেখা করেন তিনি। পৌঁছে যান ভন্তে জ্যাঠার বাড়িতেও। জ্যাঠা নেই শুনে দরজা থেকেই বিদায় নিচ্ছিলেন, জেঠিমা ছুটে এসে হাত ধরে তাঁকেভিতরে নিয়ে যান। ঘরের মধ্যে দুই প্রবীণা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন কয়েক মূহূর্ত ভন্তে জ্যাঠার ছবির সামনে। কয়েক বছরপরে সেই শিল্পী আবার যখন শহরে আসেন, তখন আর ভন্তে জেঠিমা ও নেই, তাঁদের বাড়িটিও বিক্রি করে ছেলেরা চলে গিয়েছে অন্য শহরে। সেই সময় এক ঘরোয়া আসরে নিজের কথা বলতে গিয়ে প্রথিতযশা শিল্পী ধীরে ধীরে বলেন, ভালোবাসতে জানত ভন্তে। মুখে বলেনি, তবে বুঝতে পারতাম। তখন বয়স কম, তাই পাত্তা দিইনি। সুরের টানে শহর ছেড়ে আমি চলে যাওয়ার পরেও আমার খোঁজ রাখত, তা জানি। ভেবেছিলাম, নিজে একবার দেখা করে ক্ষমা চাইব, হয়নি.. প্রবল ব্যক্তিত্বের আড়ালে ডুব দিলেন শিল্পী। এভাবেই জানা হয়ে গেল কেন মাতাল হয়ে যেতেন জ্যাঠা এক একদিন।
Tags: গল্পের সময় ব্লগ, ভন্তে জ্যাঠা, মিতালী মিত্র
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।