ভাষা-শহিদ
কে জানত একটা কথা থেকেই এত ঝামেলার সৃষ্টি হবে।
পটাই মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে গদাইকে বলেছে – অত ভাবার কিছু নেই।ভাল লাগলে বলে দে-আই লেবু।
ব্যস ওখানেই শুরু হল নতুন বিপ্লব।এলাকার দাপুটে নেতা ও কাউন্সিলর সত্যেনদাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ার মোড়েই ধরেছিল পটাইকে।দলের ছেলেদের সামনেই গরম নিতে আরম্ভ করল আর তারপরই শুরু হল মেয়ের বাবার ধমকানি – চেনো আমাকে? কানেকশন জানো? তোমার থোবড়া বিল্লা করে দিতে পারি একটা ফোনে।
দমার ছেলে নয় পটাই। কাউন্সিলর সত্যেনদার সামনে ঝুঙ্কুর বাবাকে বলেই দিয়েছিল – দেখুন, আমাকে চমকে খুব একটা লাভ নেই।একটা উঠতি বয়সের ছেলে।তার লাবারকে আই লেবু বলেছে। তো তাতে হয়েছেটা কি! আর তো কিছুই করে নি! এতেই এত টেম্পো নেওয়ার কি আছে?
ওর হয়ে আমি সরি বলে দিচ্ছি।হয়ে গেল। খেল খতম, পয়সা হজম।তবে এটাও জেনে জান আপনার মেয়েরও কিন্তু পিনিক মারার অভ্যেস আছে।খিল্লি ওই প্রথম করেছিল।তাই এত।
ঝুঙ্কুর বাবা দাঁত কিড়মিড় করে বলেছে- পিনিক মারা দেখবে? ওকে।আই উইল গিভ ইউ অ্যা লেশেন।
তুই থামবি – বলে সত্যেনদার ধমকে আপাতত চুপ করলেও পরে লোকটা চলে যেতেই সত্যনদার সামনেই বলেছে- বালের শিক্ষিত।
সত্যেনদার পাল্টা ধমক – মাইণ্ড ইওর ল্যাংগুয়েজ পটাই।ভাষা ঠিক কর।নইলে তাড়াব দল থেকেই।এত নোংরা ল্যাংগুয়েজ।পার্টির ইমেজ বলে একটা কিছু আছে তো নাকি রে! একে তো ইভ টিজিং এর কেস ।তার ওপর স্ল্যাং ইউস।কি বলবে বল লোকে।তোদের এই স্ল্যাং ইউজটা কি বাই বার্থ? তোরা ভদ্র সমাজে বসবাসের অযোগ্য। দলে তো বটেই।
পটাই চিৎকার করে বলল- ধূর বাল।ছাড়ো না।এই বালের ইংলিশ, যায় বোঝা না যায় পড়া।যারা বোঝে না,দের সামনে ঝেড়ে কি যে আনন্দ পাও কে জানে!এর চেয়ে বাল, হিন্দি অনেক ভাল। অন্তত বোঝা যায়।
গদাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল পটাই এর দিকে
পটাই চিৎকার করল- কি বাল? তাকিয়ে দেখছিস কি?
থতমত খেয়ে গদাই বলল- দেখছি না শুনছি।
কি শুনছিস ? বল না ? খেপে উঠেছে পটাই।
তোমার মাতৃভাষা- নরম গলায় বলল উচ্চমাধ্যমিক ফেল গদাই।একটু থেমে আরও নরম গলায় বলল আসলে বুঝতে চাইছি হিন্দি আর তোমার মাতৃভাষার পার্থক্যটা।
সত্যেনদা গদাই এর দিকে তাকিয়ে বললেন -‘বোঝার কোন চেষ্টাই কোর না গদাই।মাথার সব চুল টেনেও বুঝতে পারবে না, আমিও পারিনি।’
গদাই নিষ্পাপ কণ্ঠে প্রশ্ন করল- কোন বিষয়টা?
সত্যেনদার নির্লিপ্ত জবাব- এই একটা ভাষা শহীদ হয় কখন? অন্য ভাষার তাপে না ভুল ব্যবহারের চাপে?
একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট রিং ছাড়তে ছাড়তেই পটাই বলল- আমাদের এই মাতৃভাষার জোর জান? আমরা জানি।আমাদের সমাজ জানে।আমাদের এই ভাষার জোরেই কিভাবে ওই বালের শিক্ষিত সমাজের ইংলিশ মাড়ানো ধান্দাবাজদের চাপে বাপ বলাতে হয়।
সত্যেনদার ধমক এল – ওই ছোটলোকের ভাষার কোন দাম নেই।
চকিতে ঘুরে দাঁড়াল পটাই – শুধু দাম কখন বলতো? অন্যকে ভয় দেখাতে বা চমকাতে ? তাই না? যখন আমাদের ডাক পড়ে? মানে যখন আপনারা ডেকে নিয়ে যান, আরকি!
থতমত খাওয়া সত্যেনদার দিকে তাকিয়ে গদাই নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল – ঘাবড়াবেন না – কথা অমৃত সমান।কি বলেন?
………………
নিউ নর্মাল
আমাদের সাধনার ওপরে উঠলে দেখা যায়, উঁচু উঁচু পাহাড় ছোঁয়া মিনারখানা যেন আকাশে হেলান দেওয়া। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলেন ষাটোর্ধ সুখময় তপাদার।
– বলেন কি? আপনি সাধন মার্গের মানুষ বুঝি নি তো।
– না, না। সাধনা আমাদের ২০ জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীদের আবাসন। সেই চারতলা আবাসনের মাথায় উঠলে পাশেই দেখা যেত গঙ্গা।এখন গঙ্গার পাশে খেলনা গম্বুজের মতন ত্রিশতলা নতুন কমপ্লেক্স নিউ কোলকাতা।
– জানি একেবারে অত্যাধুনিক ব্যবস্থার অ্যাপার্টমেন্ট।আমার মেয়ের অফিসের বস্ বুক করেছেন একটি।মেয়েও বলছে আমাদের গঙ্গা দর্শনের পাঁচতলার ওপরের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে ওখানেই একটা বুক করতে।এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন প্রাতঃভ্রমণকারী নির্বেদ রায়।
– ওখানে সব ভাল। একটাই অসুবিধা, সবাই অচেনা। পনেরো কুড়ি হাজার মানুষ গোটা এলাকায়। পাঁচ হাজার মতন ফ্ল্যাট, ত্রিশতলা দশটা টাওয়ার।কে কার? এটাই বুঝি না।হয়ত বা বয়সটা বোঝায় না।এটাও হতে পারে।নিজের যুক্তিতে অটল সুখময়।
– আপনি গিয়েছিলেন কখনও?
– হ্যাঁ, আমার ভাগ্নী মুন কিনেছে, ২৮ তলায়। গেলাম, থাকলামও একদিন। ভাল বন্দোবস্ত।
– হবেই তো। কত বড় কর্পোরেটের ব্যাপার। খারাপ হবে কেন?
– না, তা নয়। সাধনার চারতলা আবাসনের সামনে দাঁড়ালে নিজেকে এত ছোট মনে হয় না কখনও। ওপরের বারান্দায় গেলেও না। কিন্তু মুনের চল্লিশতলা টাওয়ার নীচে দাঁড়িয়েও নিজেকে যা মনে হল ওর আঠাশতলার ব্যালকনিতে গিয়েও তাই মনে হল।
– কি?
– নিজেকে একটা বিন্দুর মতন।
– ওসব কিছু না। অত উঁচু তো। তাই ওরকম মনে হয়।
– না, আসলে আমার মনে হল, ওপর থেকে নীচে তাকালে মাটির পৃথিবীর মানুষগুলো বিন্দু হয়ে যাচ্ছে আর নীচে দাঁড়ানো মাটির পৃথিবীর মানুষের দল ছোট হতে হতে হয়তো একদিন চাপা পড়ে যাবে।
– সে কি! কি করে!
– দাপুটে উচ্চতার আগ্রাসী ক্ষুধার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হতাশা আর অভিমানে।
– সে তো পাহাড়ের সামনে দাঁড়ালেও হয় আমাদের তাই না? আবার পাহাড়ী উচ্চতা থেকে তাকালেও হয়।
– নো – নো।নেভার নেভার।প্রাকৃতিক উচ্চতা বা গুণগত উচ্চতা কোন মানুষকেই নীচু করে না বা ছোট করে না বাঁচার শর্তগুলোকে।
– তাহলে আপনি কোন উচ্চতার কথা বলছেন সুখময় দা?
– বৈভবের উচ্চতার কথা।
– কিন্তু এখন তো চেঞ্জিং সোসাইটির এটাই নর্মাল ডিমাণ্ড সুখময় দা। টু মেক অ্যা ডিফারেন্স বিটুইন কমন অ্যাণ্ড আনকমন ম্যান।
– কেন? কেন বলুন তো?
– সোসাইটির নর্মাল ডিমাণ্ডকে অ্যাবনর্মাল চাহিদার মুখে ফেলে আর একটা নতুন সোসাইটির বাজার তৈরির জন্য।
– কারা তৈরি করছে এই সোসাইটি আর বাজার?
– নিউ নর্মাল সোসাইটি আর তাদের বৈভবের দাপুটে সাপ্ল্যায়ার। যাদের উচ্চতার দাপটে ছোট হয়ে যাচ্ছে আমাদের চাহিদাগুলো বিন্দুর মতন।
Tags: দুটি গল্প, দেবাশিস মজুমদার
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।