এক
রণধীর চৌবে গ্লাসে আর এক পেগ হুইস্কি ঢেলে নিয়ে আমার খালি গ্লাসের দিকে ইঙ্গিত করে সুশীলের দিকে ফিরে বললেন, তখন আমি পালামৌ ডিসট্রিক্টের এস পি, বুঝলে। পালামৌতে, আমাদের সাবেকি বাড়ির দুমাইলের মধ্যে ডালটনগঞ্জের ডিসট্রিক্ট কোর্ট এরিয়াতে আমার অফিস। পুরো কেরিয়ারের মধ্যে সেই একবারের পোস্টিং-এই বাবা, মা, দাদা, বৌদি সকলের সঙ্গে বছর দুয়েক থাকার সুযোগ হয়েছিলো। তখনও তো বিহার ভাগ হয়নি। পালামৌ জেলার হেডকোয়ার্টার ডালটনগঞ্জ। ওই ছবির মতো সুন্দর শহরটার এখন কি যেন একটা নাম দিয়েছে…মনেও থাকে না ছাই !
আমি আমার গ্লাসে হুইস্কি আর জল ঢেলে বললাম, মেদিনিনগর !
– হ্যাঁ হ্যাঁ, মেদিনিনগর, মেদিনিনগর ! আমার আজকের কহানিটার মূল ঘটনাটা ওই মেদিনিনগরে থাকার সময়ই ঘটেছিলো। এই একটা কেস যার মধ্যে থেকে জেগে থাকা কিছু প্রশ্নের উত্তর আজও আমার কাছে অধুরা। সেই উত্তর খোঁজার জন্য কলকাত্তা পর্যন্ত দৌড়েছিলাম জানো ! সে কথায় পরে আসবো।
বলে চৌবেজি হাতের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিলেন।
আমরা দুজন আমাদের সিনিয়র বন্ধু ঝাড়খণ্ড পুলিশের রিটায়ার্ড অ্যাডিশনাল ডিজি রণধীর চৌবের বৈঠকখানায় প্রাত্যহিক সন্ধের আড্ডায় গল্প শুনছি। ।
চৌবেজি বিপত্নীক।
শ্বশুর শাশুড়ির মৃত্যুর পর বছর পাঁচেক আগে স্ত্রী মণিকার নামে উইল-করা পাটনার এই প্রাসাদোপম বিশাল বাড়িতে রিটায়ার করার পর সপরিবারে উঠে এসেছিলেন পালামৌয়ের এজমালি বাড়ি ছেড়ে।
বছর তিনেক আগে ক্যান্সারে ভুগে স্ত্রী মণিকাও চলে গেছেন।
একমাত্র ছেলে বিদেশে।
এ বাড়িতে চৌবেজি একা থাকেন, আর থাকে সর্বক্ষণের লোক বিরজু।
দারোয়ান, মালী, রাঁধুনি, ড্রাইভার এরকম তিনচারটে ঠিকে লোকও আছে।
হ্যাঁ…আছি আমরা দুজনও, প্রায় প্রতিসন্ধ্যায় নিয়মিত আড্ডাধারী, আমি নীরজ কুমার সিং, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পাটনা রিজিয়ন টু-এর এজিএম, আর আমার লঙ্গোটিয়া দোস্ত, পাটনা সেশন কোর্টের সাবজজ সুশীল দ্বিবেদী ।
ভূতপূর্ব বরিষ্ঠ আইনরক্ষক রণধীর চৌবেজির অফুরান গল্পের ভাণ্ডার আর তাঁর সেলারে
নানা ব্র্যান্ডের স্কচ হুইস্কির অঢেল জোগান আমাদের প্রাত্যহিক সন্ধ্যের গল্পের আসরটা জমজমাট করে রাখে।
চৌবেজি হুইস্কির গ্লাসে আর একটা ছোট চুমুক দিয়ে শুরু করলেন, প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা হবে। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে দিনটা ছিল বছরের শেষ সপ্তাহে, বড়দিনের তারিখ। ডালটনগঞ্জ শহরে সেকালে খ্রিস্টানধর্মী লোক অনেক ছিল, সবই প্রায় আদিবাসী, মধ্য আর নিম্নবিত্ত পরিবার। শহরের দুপ্রান্তে ছিল দুটো চার্চ। প্রতি বছর বড়দিনের সন্ধ্যের মুখে একটা বড়ো জলুস বার করতো খ্রিস্টানরা, প্রায় হাজার খানেক মেয়েপুরুষ, ব্যান্ডপার্টি, ঝাঁকি, ক্যারল গান, সব মিলিয়ে শহরবাসীদের জন্য সে একটা জমজমাট ব্যাপার। বলতে পারো একটা বাৎসরিক উৎসবের দিন ! একদিকের চার্চ থেকে সেই জলুস শুরু হয়ে শহর ঘুরে আর একদিকের চার্চে গিয়ে শেষ হতো । দুটো চার্চের মাঝের মাইল দুয়েক রাস্তার দুধারে শহরের আর আশেপাশের অঞ্চলের হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে জলুস দেখতো। সেই পারটিকুলার দিনটায় আমার একটা মেজর কাজ ছিলো, সেই প্রসেসন যাওয়ার সময় পুরো রাস্তাটায় টাইট পুলিশি বন্দোবস্ত করা, যাতে কোন আনওয়ান্টেড ল অ্যান্ড অর্ডার পরিস্থিতি না হয়। সেই ব্যাপারেই বড়দিনের সকালে দশটা নাগাদ একটা লাস্ট-মিনিট মিটিং ডেকেছিলাম আমার চেম্বারে। মিটিং চলছে এমন সময় একটা কনস্টেবল দরজায় এসে স্যালুট করে জয়হিন্দ বলে ভেতরে ঢুকে এলো। তারপর আমার পারমিশন নিয়ে সদর থানার এসএইচও-র কাছে গিয়ে তার কানে কানে কিছু বললো। কনস্টেবলের ফিসফিসানি কয়েক মুহূর্ত শুনেই প্রৌঢ় থানেদার, তার নামটা এখন আর মনে পড়ছে না, চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো, স্যার, নয়াতলি এরিয়াতে সকালে একটা খুন হয়েছে, ভিক্টিম এক মাঝবয়েসী পুরুষ। খুনি স্পটেই ধরা পড়েছে, লোকাল লোকেরা ধরে ফেলেছে খুনের অস্ত্রসমেত, একটা মেয়ে। আমি মেয়েপুলিশ আর হাবিলদার পাঠানোর ব্যবস্থা…
আমি থানেদারকে বাধা দিয়ে বললাম, একটা মেয়ে খুন করেছে ! নয়াতলি জায়গাটা কোথায় ?
– শহরের প্রায় বাইরে কোয়েলের পাশে একটা বস্তি স্যার। ওদিকটায় অনেকগুলো ছোটখাটো হাঁস-মুরগির পোলট্রি আছে। ওই বাড়ির ক্যাম্পাসেই সব ছাউনি লাগিয়ে ব্যবসা করছে। আমি তাহলে থানায় চলে যাই স্যার ?
আমি মাথা নাড়লাম। থানেদার তো চলে গেলো তাড়াতাড়ি পুলিশ পাঠিয়ে হাতেনাতে ধরা-পড়া সেই মেয়েখুনিকে অ্যারেস্ট করার ব্যবস্থা করতে। মিটিং শেষ হয়ে গেলো কিছুক্ষণের মধ্যে । ইন্সপেক্টাররা সব যে যার অফিসে ফিরে গেলো। আমি ডিএসপিকে বলে দিলাম এসএইচও-র অফিসে খবর দিয়ে রাখতে যে পুলিশ নয়াতলি থেকে ফিরলে আমার সঙ্গে যেন দেখা করে। শহরের একটা ইম্পরট্যান্ট উৎসবের দিনে সক্কালবেলায় একটা মেয়ে এক পুরুষকে খুন করলো, তারপর নিশ্চয়ই অকুস্থল থেকে পালাবার চেষ্টা করেনি। তাই খুনের অস্ত্রসমেত ধরা পড়েছে। এই সব মিলিয়ে খুনের ঘটনাটা আমার কাছে একটু আলাদারকম মনে হয়েছিলো।
দুই
চৌবেজি থেমে গেলেন।
বিরজু ঢুকলো একটা ট্রে-তে বাওলভর্তি চিকেন পকোড়া নিয়ে।
বিরজু বেরিয়ে যাওয়ার পর সাবজজ সুশীল একটা পকোড়া তুলে মুখে দিয়ে বলে উঠলো, মলেস্টেশন কেস কি?
রণধীর চৌবে গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে সুশীলের দিকে ফিরে বললেন, আমিও সেটাই ভেবে নিশ্চিত হওয়ার জন্যেই এসএইচও-কে আগাম এত্তেলা দিয়ে রাখলাম।
আমি বললাম, তারপর কি হল চৌবেজি ?
চৌবেজি বললেন, জ্বলজ্যান্ত দিনের আলোয় খুনের কেস, তার ওপর খুনি একটা লোকাল দেহাতি মেয়ে । অ্যারেস্ট করার সময় আবার কোন অশান্তি না হয় এসব ভেবেই বোধহয় এসএইচও নিজেই অকুস্থলে চলে গিয়েছিলো মেয়েপুলিশ সঙ্গে নিয়ে। ঠিকই করেছিলো। কিন্তু প্রাথমিক তদন্ত সেরে খুনি আসামিকে লকআপে ঢুকিয়ে দিয়ে এসে সে আমার কাছে এসে যা রিপোর্ট দিলো, আমার তো আগে ভেবে রাখা সব হিসেব উলটোপালটা হয়ে গেলো।
সুশীল বেশ কৌতূহলের গলায় বললো, কিরকম কিরকম !
– ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ? ভিক্টিম কি স্বামী ? চৌবেজি কিছু বলার আগেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
রণধীর চৌবে আমার দিকে তাকালেন।
তারপর বললেন, না না, তাহলে তো জলদি একটা বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারতো। যে লোকটা খুন হয়েছে সে নাকি নয়াতলি এরিয়াতে নতুন, আগে তাকে কখনো দেখা যায়নি। লোকাল লোকেরা অন্তত সেরকম বলেছিলো। মেয়েটা বঁটি দিয়ে, হাতিয়ারটা একটা ধারালো বঁটি ছিল, ওই বাঙালিরা যা দিয়ে মাছ, সবজি এসব কাটে না সেই জিনিস, তাই দিয়ে ঘাড়ে গলায় কোপ দিয়েছিলো কয়েকবার। তাতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লোকটা ওই ঘরের দাওয়ায় পড়েই মারা যায়। পুলিশ মৃতদেহের পকেট থেকে যা কাগজপত্র পেয়েছিল, যতদূর মনে পড়ছে, তাতে জানতে পেরেছিল লোকটার নাম অবধেশ কুমার । পরে অবশ্য ছানবিন করে জানা গিয়েছিলো ওই অবধেশ ছিল অরিজিন্যালি হাজারিবাগের বাসিন্দা, ওই খুন হয়ে যাওয়ার বছরখানেক আগে ডালটনগঞ্জে এসে একটা ডিমের আড়ত করার চেষ্টা করছিলো বোধহয়। পুলিশ তার বন্ধ দোকানঘর খুলিয়ে খালি ভর্তি অনেক ডিমের ক্রেট ছাড়া আর কিছু পায়নি । আশপাশের দোকানিরাও সেই রকম বলেছিলো। অবধেশ কুমারের সঙ্গের ব্যাগে বেশকিছু টাকা পাওয়া যায়। পুলিশের নিশ্চিত অনুমান ছিল ডিমের বরাতের আগাম দেওয়ার জন্য টাকা নিয়ে অবধেশ সেদিন সকালে নয়াতলির পোলট্রি মহল্লায় গিয়েছিলো। কারণ পুলিশ তদন্তে জানা যায় খুনের ঘটনার কিছুক্ষণ আগে সে আর এক বাড়িতে গিয়ে, মনে হচ্ছে দশ বারো ক্রেট ডিমের বরাত দিয়ে অ্যাডভান্স টাকা দিয়ে এসেছিলো।
সুশীল বললো, আর খুনের মোটিভ ?
চৌবেজি হাতের গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিলেন।
তারপর সুশীলের দিকে তাকিয়ে বললেন, সেখানেই তো রহস্য ! এমন একটা ঘটনা, আজও মনে আছে, খুশি সাবর, ওই মেয়েটার নাম। সে ছিলো একটা পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সের গৃহবধূ, বছর দশেকের একটা ছেলে তার, স্বামী কানহা সাবরের সঙ্গে দুজনে মিলে পোলট্রি চালায় । অবধেশকে তো সে আগে কোনদিন দেখেইনি । আমি প্রথমে তোমার মতো, প্রাইমা ফেসি, সেক্সুয়াল বদতমিজির অ্যাংগেলেই ভেবেছিলাম। কিন্তু দশ বছরের ছেলেটা কাছাকাছি উঠোনেই ছিল, খেলা করছিলো বোধহয়। সে তো কিছু দেখেনি বলেছিল। তারপর হঠাৎ মায়ের ওইরকম খুনখারাবি মূর্তি আর তারপর একটা অচেনা লোককে বঁটি দিয়ে বারবার আঘাত করা দেখে ওই-ই প্রথমে চিৎকার করে ওঠে। আর বস্তির এরিয়ায় ঢুকে মলেস্টেশনের মতো কিছু করতে চাওয়া পাগল ছাড়া কারুর মাথায় আসবেনা। তাছাড়া ঘটনার পর থেকে ওই খুশি নাকি একেবারে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল, চোখের মণিদুটো চারদিকে ঘুরছে, পাগলের মতো দৃষ্টি, প্রায় প্রলাপের মতো এক কথা বার বার করে বলে যাচ্ছিলো। তবে একদম ভায়োলেন্ট ছিল না, মেয়ে পুলিশের সঙ্গে পুরো কোঅপারেট করেছিলো। লকআপে ঢুকেও সে ক্রমাগত বিড়বিড় করছিল, বাংলা লবজে !
– বাংলায় ! আমরা দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম।
– হ্যাঁ ! পুরো বাংলায় ! খুব স্ট্রেঞ্জ…না ? ওর হাজব্যান্ড পরে পুলিশকে বলেছিল ওর বৌ কস্মিনকালেও বাংলা মুলুকে যায়নি, কোন রিস্তেদারও ওখানে থাকে না। আর নয়াতলি একটা দেহাতি আদিবাসী বস্তি, সেখানে কোন বাঙালি পরিবার থাকে না যে খুশি তাদের কাছ থেকে কিছু শিখবে !
সুশীল বললো, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার তো ! তা বাংলায় মেয়েটা কি বলছিলো আপনার মনে আছে চৌবেজি ?
– থাকবে না ! তোমাদের একটু আগে বললাম না এই ঘটনাটার রহস্য আমাকে এতোটা ভাবিয়েছিলো যে আমি ছুটি নিয়ে কোলকাতায় দৌড়েছিলাম ! সে কথায় পরে আসছি। আগে সুশীলের প্রশ্নের জবাবটা দিই।
বলে চৌবেজি হাতের গেলাসে একটা ছোট চুমুক দিলেন।
তারপর আমাদের দুজনের উৎসুক মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, থানায় একটা বাঙালি কনস্টেবল, বোধহয় ঝাড়গ্রামের নেটিভ ছিল। তাকে ডেকে আনার পর সে খুশি সাবরের বিড়বিড়ানি ট্রান্সলেট করে যা বলেছিল তাতে তো থানার সকলে একেবারে তাজ্জব, ক্লুলেস হয়ে গিয়েছিলো ! সেসব রিপোর্ট পেয়েই তো আমি ঠিক করেছিলাম এই আসামিকে আমি একবার দেখতে যাবো।
তিন
আমি বললাম, আপনি গিয়েছিলেন লকআপে ? কি বলছিলো মেয়েটা চৌবেজি ? আপনাকে কিছু বলেছিল ?
রণধীর চৌবে বললেন, গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে কি আবার কথা হবে ! সে তো আমার কোন কথার বা প্রশ্নের উত্তরই দেয়নি। সে আমার কথা শুনছিলো কি না তা-ও বুঝিনি। বেশ মনে আছে তার চোখদুটোর সেই এক অদ্ভুত দৃষ্টি, বুঝলে ! তোমার দিকে দৃষ্টি পড়ছে কিন্তু বোধহয় তোমাকে দেখছে না ! চোখের মণিদুটো কেবল এদিক ওদিক ঘুরছে ! আর যা বলছিলো বাংলায়…এতো বছর পরে হয়তো আমার ভাষার একটু ওদিক হতে পারে ! মেয়েটা একঘেয়ে সুরে বাংলায় যা বলছিলো, তার হিন্দি করলে হয়, ‘ইতনা হিম্মত ! বদতমিজ শোভা সিং কা ইতনা হিম্মত ! রাজকুমারী সত্যবতী কো ছুঁনে কা, ইজ্জত লেনে কা কোশিশ, ইতনা সাহস !
সুশীল থাকতে না পেরে বলে উঠলো, রাজকুমারী সত্যবতী ! শোভা সিং !
চৌবেজি বললেন, হ্যাঁ, তাইতো ! গজব কি বাত সব ! আরও শোনো, কখনো বলছে, ‘রাজা কৃষ্ণরাম কা লেড়কি কা ইজ্জত লে নে কা কোশিশ ? এক বার মরনে কা বাদ ভি তেরা হোশ নেহি আয়া ?
এই সব বলছে, আবার বলছে, ফির…ফির মারুঙ্গি। কিউ তুমলোগ হামারা হাত সে লে লি হাতিয়ার ? খুদ কো খতম করনা থা ! ইয়ে সব অজীব সি বাত বোল বোলকে ফির আওরৎ কি ফুট ফুটকে রোনা শুরু…সমঝো !
আমি বললাম, রাজা কৃষ্ণরামের মেয়ে সত্যবতী ! বাঙালি কোনো রাজা কৃষ্ণরাম !
সুশীল আমার দিকে একবার তাকিয়ে বললো, তারপর কি হোল চৌবেজি ?
– হবে আবার কি ! দেখো, খুনের হাতিয়ার, মানে ভিক্টিমের রক্তমাখা সেই বঁটিসমেত কালপ্রিট ক্রাইম সিনে ধরা পড়েছে, খুশির পোশাকে চারদিকে ভিক্টিমের রক্ত লেগে রয়েছে ! আইনের পরিভাষায় বলতে গেলে সে একেবারে ওপেন অ্যান্ড শাট কেস ! দুদিনে আদালতে চার্জশিট দাখিল হয়ে গেলো। তারপরেই ডাইরেক্ট দায়রা আদালতে চালান হয়ে গেলো অবধেশ কুমারের খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত খুশি সাবর।
আমরা দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম, তারপর !
-তারপর ? মুখে একটু হাসির ভাব করে চৌবেজি বললেন, তদন্ত আর শুনানি গিয়ে আটকে গেলো দুটো পয়েন্টে।
সাবজজ সুশীলের প্রমোশনের সময় বোধহয় এগিয়ে আসছে !
অতীব কৌতূহলের গলায় ও জিজ্ঞেস করলো, কিরকম, কিরকম ?
চৌবেজি সুশীলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এক, খুনের মোটিভ কি ছিল ! আর দুনম্বর হচ্ছে ঘটনার পরে খুশি সাবরের লাগাতার অসংলগ্ন আচরণ। ঘটনার প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা পরেও লকআপে ওর হাবভাব আচরণ দেখে আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি যে ওই দেহাতি মেয়েটা অভিনয় করছে। প্রথমে মোটিভের ব্যাপারটা দ্যাখো। অবধেশ কুমার লোকটা খুশির অপরিচিত, তাকে আগে কোনদিন দেখেনি। তাকে হঠাৎই খুন করতে যাওয়ার আপাতগ্রাহ্য কোন কারণ নেই. যদি না যৌন হেনস্থার মতো কিছু ঘটে। তবে খুশি সাবর সুশ্রী যুবতী মেয়ে, গায়ের রং কালো। কিন্তু দেহাতি আদিবাসী মেয়েদের যেমন হয় চটকদার আঁটোসাঁটো গড়ন, যাকে বলে উদ্ভিন্ন যৌবন। অবধেশ মুহূর্তের উত্তেজনায় স্থানকাল ভুলে একটা অপরিণামদর্শী কাজ করে ফেলতেই পারে। আর খুশির উকিল এই পয়েন্টটাকেই ধরে হাইলাইট করেছিল যে মলেস্টেশনের অ্যাটেম্পেটের এগেন্সটে সেলফ ডিফেন্সে খুশি এই কাজটা করে ফেলেছে। খুন করে ফেলাটা তার উদ্দেশ্য ছিল না।
– মলেস্টেশনের কোন প্রত্যক্ষদর্শী ? সুশীল জিজ্ঞাসা করলো।
– যতদূর মনে পড়ছে সেরকম সাক্ষী তো কেউ ছিল না। তবে পড়শিদের কেউ কেউ প্রায় সেই সময়েই অকুস্থলে পৌঁছে খুশির হাত থেকে বঁটিটা কেড়ে নেয় । তার তখন রণরঙ্গিণী মূর্তি, জামাকাপড় বিস্রস্ত, মানে শাড়ি সেমিজের ঠিক নেই। অবশ্য ততক্ষণে ভিকটিমের যা হবার তা হয়ে গিয়েছে । আমি ক্রাইম সিনের ছবিগুলো পরে দেখেছিলাম। আজও মনে আছে। গলায় ঘাড়ে দুতিনটে ফ্যাটাল ডিপ উন্ড ছিল। স্পট ডেথ ডিউ টু এক্সেস ব্লিডিং । রক্ত ছিটকে ছিটকে এসে খুশির জামাকাপড়ে প্রচুর জায়গায় দাগ লেগেছিলো !
আমি বললাম, দায়রা আদালতে কি হলো তাহলে ?
– শুনানিটা অতো সিম্পল হলো না হে নীরজ ! আমার কৌতূহল তো ক্রমেই বাড়ছিলো। বিশেষ করে খুশির মুখ থেকে ওই কৃষ্ণরাম, সত্যবতী আর শোভা সিং, এই নামগুলো শোনার পর থেকে। মামলাটার খোঁজখবর রাখছিলাম আইও সাব-ইন্সপেকটরের মারফৎ। বলে রেখেছিলাম প্রত্যেক শুনানির পর আমাকে রিপোর্ট দিতে। এসপি নিজে ইন্টারেস্ট নিচ্ছেন তার তদন্তে। সে গর্বিত আইও চারমাস ধরে শুনানির পয়েন্ট বাই পয়েন্ট আমাকে খবর দিয়ে গেছে।
সুশীল বললো, বুঝতে পারছি চৌবেজি, এই খুনের ঘটনাটা আপনাকে কতোটা নাড়া দিয়েছিলো। এতোগুলো বছর পরেও দেখছি সবকিছু আপনার ডিটেলে মনে আছে!
রণধীর চৌবে একদৃষ্টে সুশীলের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক মুহূর্ত।
তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের গ্লাসটা ভরতে ভরতে আমাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আমরা হাত নেড়ে বারণ করাতে নিজের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, সুশীল, এটা কিন্তু গড়পড়তা একটা সাধারণ খুনের ঘটনা ছিল না। শোনো তো ধৈর্য ধরে, তুমি তো জজ, বিচারের ডাইলেমাটা কিছুক্ষণ পরে নিজেই বুঝতে পারবে।
চার
রাত হয়ে যাচ্ছে ।
এতো বার্তালাপ হলে তো গল্পটা আজ আর শেষ হবে না !
আমি সুশীলকে চোখের ইশারায় চুপ করে থাকতে ইঙ্গিত করলাম ।
চৌবেজি বলে চললেন, সরকারি উকিল তো খুনের মোটিভ ঠিকমতো এসটাবলিশই করতে পারলো না। আর উলটোদিকে, মলেস্টশন আটকাতে সেলফ ডিফেন্সের জন্য অসতর্কে খুন, অভিযুক্তের উকিলের এই আর্গুমেন্টটা বোধহয় জাজের মনে ধরেছিল। এখন দ্বিতীয় পয়েন্টটা হচ্ছে খুশি সাবরের অসংলগ্ন আচরণ ! কোর্টে সে প্রায় কথাই বলেনি। শুনানির পুরো সময়টা ঘোমটা-টানা মাথা নীচু করে চুপ করে বসে থাকতো। উকিলের কথা ছাড়ো, কোর্টে জাজেরও কোন প্রশ্নের জবাব নেই। মাঝে মাঝে মাথা তুলে বিড়বিড় করে সেই এক বাংলায় কথা…আমাকে ছোঁয়ার সাহস ! শোভা সিংয়ের এতো হিম্মত ! এখন এই পয়েন্টটা ধরে ডিফেন্স উকিল তো কয়েকজন প্রতিবেশীকে সাক্ষী এনে হাজির করলো, খুশি সাবরের নাকি এরকম হয় মাঝে মাঝে। খুব উত্তেজিত হলে মাঝে মাঝে এরকম অসংলগ্ন আচরণ করে। হয়তো সেগুলো সাজানো সাক্ষী ছিলো। কিন্তু খুশির উকিল ওইসব সাক্ষ্য বেস করে জোরালো যুক্তি দেখালো, অবধেশ কুমারের মলেসটেশনের চেষ্টা থেকে অভিযুক্তের সেইসময় ওর অ্যাকিউট ট্রমার অ্যাটাক হয়েছিলো এবং তার ফলে সাময়িকভাবে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সেলফ ডিফেন্স করতে গিয়ে হাতের কাছে যা অস্ত্র ছিল তাই দিয়ে কয়েকবার অবধেশকে আঘাত করে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই আঘাতে অবধেশ কুমারের মৃত্যু ঘটে…কাল্পেবল হোমিসাইড নট অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার, আইপিসি সেকশন থ্রি জিরো ফোর।
সুশীল বললো, যাবজ্জীবন বা দশ বছর !
আমি আর চৌবেজি দুজনেই সুশীলের দিকে তাকালাম।
তারপর চৌবেজি হাতের গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে বললেন, প্রথম পর্যায়ের শুনানি কমপ্লিট হওয়ার পর জাজ তো নির্দেশ দিলেন খুশি সাবরের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড বসুক, তিনজন ডাক্তারের বোর্ড, রাঁচির মেন্টাল অ্যাসাইল্যামের দুজন সিনিয়র সাইকিয়াট্রিস্ট আর সাইকোলজিস্ট ডাক্তার আর গভর্নমেন্ট জেনারাল হসপিটালের মেডিক্যাল সুপারিন্টেনডেন্ট। পনেরো দিনের মধ্যে কোর্টে রিপোর্ট পেশ করতে হবে। জেল হেফাজতে চলে গেলো খুশি সাবর।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তা সেই মেডিক্যাল বোর্ড তো বসেছিলো নিশ্চয়ই। রিপোর্টে কি বলেছিলো ?
– এতো বছর বাদে ঠিক লাইন বাই লাইন তো মনে নেই, তবে সেই ইন্টারেস্টিং ইউন্যানিমাস রিপোর্টটা যেটুকু মনে আছে সেটা নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করছি। আনডারলাইং মূল ফাইন্ডিংটা ছিল যে খুশি সাবর সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। এর কারণ হতে পারে অভিযুক্তের প্রতি ভিকটিমের কোন জবরদস্তি অনৈতিক আচরণ যার জন্য ইন্টেন্স স্ট্রেস ও ট্রমার কারণে খুশি সাবরের সাময়িক মানসিক বৈকল্য উপস্থিত হয়েছে। ডাক্তারি পরিভাষায় এটা হচ্ছে ডিআইডি বা ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার। মানে, সুশীল, অন্যভাবে আমরা যাকে বলি মাল্টিপল পারসোন্যালিটি ডিসঅর্ডার। মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্ত হচ্ছে খুশি সাবর এখন অ্যাকিউট ডিআইডিতে আক্রান্ত এক মানসিক রোগী, ঠিকমতো চিকিৎসা হলে সময়সাপেক্ষে সে ভালো হয়ে যেতে পারে কিন্তু সময়সীমা বলা সম্ভব নয়।
আমি বললাম, এ তো ডঃ জেকিল এন্ড মিঃ হাইড সিনড্রোম ! আমি জানি চৌবেজি, সুশীল এসব পুনর্জন্ম, জন্মান্তর, আত্মার অস্তিত্ব কিছুই বিশ্বাস করে না। কিন্তু কম বয়েসে স্টিভেনশনের ওই বইটা পড়ার পর আমি পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছিলাম চৌবেজি। জাতিস্মর হয় কেউ কেউ, তাদের মধ্যেও নাকি এই সিনড্রোম দেখা যায়।
রণধীর চৌবে আমার কথা বেশ মন দিয়ে শুনলেন।
আমি থেমে গেলে বললেন, মেডিক্যাল বোর্ডের ওই রায়ের মোতাবিক আইপিসির ধরাছোঁয়ার বাইরের সেই দ্বিতীয় অজানা পারসোন্যালিটি সেযাত্রা খুশি সাবরকে কোনরকম কঠিন শাস্তি থেকে প্রাথমিকভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। বিচারকের হয়তো ডিফেন্সের মলেস্টেশন অ্যাটেম্পটের আর্গুমেন্টটা জোরদার বলে মনে হয়েছিলো। কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী তো ছিল না। খুশি সাবরের সেই…’মেরে কো ছুঁনে কা এইসা হিম্মৎ’…বিনা শপথের ওই বিড়বিড়ানিকে আইনের চোখে এভিডেন্স হিসেবে ধরা যায় কি না কে জানে ! যাই হোক বিচারক রায় দিলেন অভিযুক্ত খুশি সাবর যে অবধেশ কুমারকে মারাত্মক ভাবে আঘাত করে তার মৃত্যু ঘটিয়েছে এটা প্রমাণিত। তবে খুশি সাবর দুর্ঘটনা ঘটানোর সময় থেকে সার্বিকভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সরকার পক্ষের উকিল খুনের মোটিভ সন্দেহাতীত ভাবে এসটাব্লিশ করতে পারেননি। তাই এই মুহূর্তে পেনাল কোডের ধারা অনুসরণ করে শাস্তি বিধানের বদলে খুশি সাবরের এইসময় বিশেষ রকম মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন। সেই কারণে আদালত খুশি সাবরকে আপাতত রাঁচির সরকারি মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দিচ্ছে। এইসঙ্গে আরও নির্দেশ দিচ্ছে হাসপাতাল সুপারিন্টেনডেন্ট একমাস অন্তর কোর্টে আসামীর মানসিক অবস্থার স্ট্যাটাস রিপোর্ট দাখিল করবে। রিপোর্ট খতিয়ে দেখে কোর্ট পরবর্তী নির্দেশ দেবে।
সাবজজ সুশীল বললো, ব্যস ! গল্প শেষ !
রণধীর চৌবে বললেন, আরে, সবর করো ! ইয়ে তো কহানি কা পহেলা চ্যাপ্টার খতম হুয়া !
পাঁচ
আমি বললাম, তারপর কি হলো চৌবেজি ? অ্যাকিউট ডিআইডি পেশেন্ট খুশি সাবর কি আলটিমেটলি ঠিক হয়ে গিয়েছিলো?
– আমার তো প্রথম থেকেই কেসটা আলাদারকম লেগেছিল। তারপর ওই রাজা কৃষ্ণরাম আর রাজকুমারী সত্যবতী, তার ওপরে এক শোভা সিং ! মাঝে মাঝেই ভাবছিলাম এরা সব কারা ! খুশির সঙ্গে এদের কি কোন সম্পর্ক আছে ? ভাবতে ভাবতে মাস দুয়েক বাদে ঠিক করলাম কাঁকের অ্যাসাইল্যামে যাবো, খুশির অবস্থাটা দেখতে। চলে গেলাম একদিন। গিয়ে দেখলাম একেবারে স্বাভাবিক না হলেও খুশিকে সেই শুনানির সময় থেকে বেটার মনে হলো। কারণ সেই ইনকমিউনিকেডো ব্যাপারটা প্রায় নেই। কোন প্রশ্ন দুবার তিনবার জিজ্ঞাসা করলে বেশ কিছুক্ষণ পরে উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সব জবাব বাংলায়…আর ওই সব আজিব কথা…আমি সত্যবতী, আমার বাবা কৃষ্ণরাম। আমি তো বর্ধমানে থাকি। আমাকে কে বাঁচালো ? এখানে আমাকে কে আনলো…এই সব ! খবর নিয়ে জানলাম গত দুমাসে মাসে কয়েকবার ইলেকট্রিক শক দেওয়ার পর অস্থির ভাবটা অনেক কমেছে । প্রশ্ন করলে কখনো কখনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে । কিন্তু ওইটুকুই ! ও নাকি খুশি সাবর বলে কাউকে জানে না। স্বামী কানহা, ছেলে দেখা করতে এলে নাকি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। তাদের চেনার কোন ভাব নেই ওর চোখেমুখে। যে ডাক্তার দেখছেন তিনি অবশ্য খুব আশার কথা জানালেন। বললেন, মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার নাকি একটানা বেশিদিন থাকে না। খুশি সাবরের ক্ষেত্রে তাঁর মনে হয়েছে এটা একটা রেয়ার বড়ো রকমের অ্যাটাক। সময় লাগবে কিন্তু নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে। ও বেশ তাড়াতাড়ি ইম্প্রুভ করছে। এরকম ভাবে চললে তিন চার মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবার চান্স আছে।
চৌবেজি থামতেই সুশীল বললো, তারপর কি হলো ? আপনি যে বলছিলেন কোলকাতায় গিয়েছিলেন !
-সেই তো ! কৌতূহল তো আমার ছিলোই, অ্যাসাইলাম ভিজিট করার পর একটা জবরদস্ত ক্লু পেলাম !
– বর্ধমান ? চৌবেজি আর কিছু বলার আগেই একনিঃশ্বাসে বলে উঠলাম।
রণধীর চৌবে আমার দিকে তাকালেন, একদম ঠিক বলেছো ! নামগুলো পাওয়া গিয়েছিলো আগেই, এখন একটা লোকেশনও পাওয়া গেলো ! ওয়েস্ট বেঙ্গলের একটা জেলা তো বর্ধমান, আমি জানতাম ! পরের মাসে তিনদিনের ছুটি নিয়ে সোজা চলে গেলাম কোলকাতায়। আমার জোশটা বোঝো !
– তারপর, বর্ধমানে গেলেন ? সেখানে কিছু খবর পেলেন ? সুশীল বললো।
– না, বর্ধমানে যাইনি, মানে যেতে হয়নি। আমার এক বাঙালি আইপিএস বন্ধুকে যাবার আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলা স্টেটে ইংরেজ আমলের রিজিওনাল রাজারাজড়াদের ইতিহাস খুঁজতে হলে কোথায় যেতে হবে। সে বলে দিলো, তুমি সোজা কোলকাতায় আলিপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে চলে যাও। ওখানকার লাইব্রেরিয়ানরা টেরিফিক ইনফরমেশন ব্যাঙ্ক ! তোমার যা ইতিহাস দরকার, ওঁরা তোমাকে হেল্প করে দেবেন। ব্যস ! যা শোনা সেই কাজ ! কোলকাতায় পৌঁছে ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে গিয়ে একজন বয়স্ক লাইব্রেরিয়ানকে পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম বর্ধমান রাজপরিবারের ইতিহাসের কোন অথেনটিক বই আছে কি না । নীরজ, সুশীল বললে বিশ্বাস করবে না, আমাকে বসতে বলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা ঢাউস আদ্যিকালের পুরনো বই এনে হাজির করলেন ! বললেন, এতে বর্ধমানের রাজপরিবারের ইতিহাসের সবকিছু পাবেন। বইয়ের নামটা এতোদিন পরেও মনে আছে হে, বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার – বর্ধমান ! লেখকের নাম কোন এক সাহেব, পিটারসন, ১৯১০ সালে ছাপা হয়েছে ।
আমরা দুজনে তো কৌতূহলে টানটান হয়ে শুনছি ।
সুশীল বললো, তারপর ? কিছু পেলেন সে বইয়ে ?
– পাবো না মানে ! সে বই তো বর্ধমান জেলার বেদ হে ! গেজেটে খুঁজে খুঁজে বর্ধমান রাজপরিবারের ইতিহাসের চ্যাপ্টার খুললাম ! ব্যস, কয়েক পাতা পড়তেই পেয়ে গেলাম রাজা কৃষ্ণরামের ঠিকুজি-কুষ্ঠি ! মোটামুটি ১৬১০ সালে পাঞ্জাবী ক্ষত্রী সঙ্গম রাইয়ের প্রতিষ্ঠিত বর্ধমান জমিদারির ষষ্ঠ পুরুষ ছিলেন রাজা কৃষ্ণরাম। তিনি ১৬৭৫ থেকে ১৬৯৬ সাল অবধি বর্ধমানের রাজ্যপাট সামলেছিলেন ! জমিদার হয়ে শুরু করে ঔরংজেব তাকে ১৬৮৯ সালে রাজার ফরমান দেন। এই রাজা কৃষ্ণরামেরই একমাত্র মেয়ে ছিল রাজকুমারী সত্যবতী।
বললাম, আরেব্বাস ! এ তো ভেরি ইন্টারেস্টিং, চৌবেজি। তারপর কি করলেন, ডালটনগঞ্জ ফিরে এলেন?
সুশীল একটু অধৈর্যসুরে বলে উঠলো, আহা, তুই থাম না একটু ! চৌবেজি, আর ওই শোভা সিং ? সে লোকটা কে, কোথা থেকে এলো ?
রণধীর চৌবেজি হাতের গ্লাসটা সুশীলের দিকে তুলে বললেন, রাইট ইউ আর ! কৃষ্ণরামের প্রোফাইল পেয়ে যাবার পর আমার ঠিক এই কথাটাই মনে হয়েছিলো। গেজেট আর একটু ঘেঁটে রাজা কৃষ্ণরামের মৃত্যুর হদিস করতে গিয়ে শোভা সিংকে পেয়ে গেলাম ! রাজা কৃষ্ণরামের হত্যাকারী শোভা সিং !
ছয়
আমাদের দুজনের মুখ থেকে প্রায় একসঙ্গে বেরিয়ে এল, হত্যাকারী !
– হুম ! সেকালে তো ব্রাদার বিজিত রাজাকে বাঁচিয়ে রাখার নিয়ম ছিলো না ! শোনো না, কৃষ্ণরামের বর্ধমান রাজ্যের মধ্যেই চিতুয়া আর বরদা বলে দুটো পাশাপাশি বর্ধিষ্ণু করদ জমিদারি ছিল। রাজপুত সর্দার শোভা সিং ছিল এই জমিদারির মালিক, কৃষ্ণরামকে বার্ষিক কর দিতো। তারপর ১৬৯৬ সালে পাশের জমিদারির মালিক এক আফগান সর্দার রহিম খানের সঙ্গে মিলে শোভা সিং রাজা কৃষ্ণরামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বর্ধমান রাজ্য আক্রমণ করে। যুদ্ধে কৃষ্ণরাম পরাজিত হয়। শোভা সিং পরিবারসমেত রাজাকে বন্দী করে সবাইকে খুন করে। বাঁচিয়ে রাখে কেবল সুন্দরী রাজকুমারী সত্যবতীকে। আর সত্যবতীর দাদা রাজপুত্র জগৎরাম কোনমতে পালিয়ে যায়। তারপর একরাতে শোভা সিং যখন সত্যবতীকে বলাৎকার করার চেষ্টা করে তখন সত্যবতী তার ঘাঘরার মধ্যে লুকোনো ছুরি দিয়ে শোভা সিংয়ের ঘাড়ে গলায় বারবার আঘাত করে তাকে ওইখানেই খুন করে।
চৌবেজি একটু থামতেই সুশীল প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে, ঠিক যেভাবে খুশি অবধেশ কুমারকে খুন করেছিলো !
চৌবেজি সুশীলের দিকে এক মুহূর্ত তাকালেন।
তারপর ধীর গলায় বললেন, সত্যবতী শোভা সিংয়ের সেক্সুয়াল অ্যাসল্টে নিজে অপবিত্র হয়েছে মনে করে শোভা সিংকে হত্যা করার পরে ওই ছুরি দিয়েই আত্মহত্যা করে ।
কয়েক মুহূর্তের জন্য আমরা সবাই চুপ।
ঘরের মধ্যে কেবল সিলিং ফ্যানের মৃদু আওয়াজ ।
তারপর আমি নীচু স্বরে বললাম, কিন্তু অবধেশ যে খুশির সঙ্গে কোন জবরদস্তি, কোন যৌন হেনস্থা করেছিলো সেটা তো নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হয়নি…এক্সসেপ্ট, অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় খুশির চিৎকার…আমাকে ছোঁয়া…এতো বড়ো হিম্মৎ !
এবার রণধীর চৌবে ধীরে ধীরে বললেন, তা অবশ্য নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে প্রাথমিক জাজমেন্ট তো খুশির পক্ষেই ছিল।
আমি বললাম, রহস্য তো প্রায় ভেদ হলো বলা যায়। চৌবেজি, কোলকাতা থেকে ফিরে এসে আপনি কি কাঁকের অ্যাসাইলামে আবার গিয়েছিলেন ?
-গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পর দিন দশেক পর একদিন সকাল সকাল কোয়ার্টার থেকে রওনা হলাম। কাঁকেতে যখন পৌঁছোলাম তখন সেখানে ইনমেটদের বিশ্রামের সময়। লোহার শিক-দেওয়া দরজার ওপাশে ভেতরের দিকে সিমেন্টের বেদির ওপরে কম্বলের বিছানায় খুশি সাবর, পেছন ফিরে শুয়ে আছে। আমি খুব নীচুস্বরে আস্তে ডাকলাম, রাজকুমারী…রাজকুমারী সত্যবতী। খুশি ঝটিতি পিছন ফিরে উঠে বসলো। আমার ডিউটির পোশাক পরা ছিলো। অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল একবার। তারপর শিকের দরজার কাছে এগিয়ে এসে একেবারে পরিষ্কার গলায় হিন্দিতে বললো, আপনিই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন ? আমি আরও ধীরে বললাম, সত্যবতী, তুমি অবধেশ কুমারকে খুন করলে কেন ? আমার কথা শুনেই খুশির চোখ যেন জ্বলে উঠলো, এক মুহূর্তে ও যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলো। জ্বলন্ত চোখদুটো আমার চোখে রেখে বললো, ও শোভা সিং। আমার বাবাকে মাকে খুন করেছে। তারপর আমার ইজ্জত লুঠতে এসেছিলো। বলতে বলতে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাসে তখন তার বুকটা ওঠানামা করছে । আমার থেকে দূরে সরে গিয়ে বদ্ধ বাঘিনীর মতো দ্রুত পায়চারি করতে লাগলো সেলের এদিক থেকে ওদিক। আমি তো তখন ডেসপ্যারেট, একটু গলা তুলে বললাম, সত্যবতী, তুমি তো আগে কখনো ওকে দেখোনি। ও যে শোভা সিং সে তুমি চিনলে কি করে ? সত্যবতী, নাকি খুশি সাবর, আবার আমার সামনে চলে এলো, লোহার শিক দুহাতে শক্ত করে ধরে আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে হিসহিস করে বললো, মসসা, নাকের তলায় ওই মসসা ! ওই মুখ আমি কি করে ভুলবো ! শয়তান ! আমার মুখের কাছে ওর ওই ঘেন্নার মুখ শয়তানটা নামিয়ে এনেছিলো…এতো হিম্মৎ ওর ! রাগে খুশি সাবরের দেহ তখন কাঁপছে। মুখ ঘুরিয়ে হনহন করে আবার সেলের ভেতর দিকে চলে গেলো। আমিও ওখান থেকে চুপচাপ সরে এসে খুশিকে যে ডাক্তার দেখছিলেন তাঁর রুমে গেলাম। ডাক্তার বললেন, খুশি তো বহত ইম্প্রুভ কর গয়ি, জ্যাদা টাইম তো ঠিকঠাকই রহতি হ্যয়। কোর্টকো রেগুলার রিপোর্ট দে রহা হু, ঔর থোড়া বেহতর হোনেসে মাহিনা ভরমে ইনকি ছুটি কর দেঙ্গে ।
সুশীলের মুখ দেখে মনে হল কিছু ভাবছিল, বললো, মসসা ! মানে তিল, আঁচিল !
চৌবেজি ক্লিষ্ট হেসে বললেন, হ্যাঁ ! তিনশো বছরের পুরনো মানুষ শোভা সিংয়ের নাকের নীচে আঁচিল বা তিল ছিল কিনা সেটা জানার তো কোন উপায় ছিল না । তবে ডালটনগঞ্জের অফিসে ফিরে ক্রাইম সিনের ছবিগুলো আবার দেখেছিলাম…অবধেশ কুমারের নাকের তলায় একটা বড়ো আঁচিল ছিল !
রণধীর চৌবে হাতের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিলেন।
তারপর স্বগতোক্তির মতো বললেন, নাকের তলায় ওই মসসাটা না থাকলে সেদিন অবধেশ কুমার কি খুশির হাত থেকে বেঁচে যেতো ? কে জানে !
সাত
তিনজনেই চুপ ।
কিছুক্ষণ পরে সুশীল ধীরে বললো, খুশি সাবর তো প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো চৌবেজি, কেসটা কি রিওপেন হয়েছিলো ?
রণধীর চৌবে একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে ম্লান হাসলেন।
তারপর বললেন, নাহ ! কোর্ট আর সে সুযোগ পায়নি। আমি সেদিন কাঁকেতে খুশিকে দেখে আসার দিন তিনেক পরে আসাইলামের মেডিকেল রুমে রুটিন পরীক্ষার সময় সকলের অলক্ষ্যে খুশি টেবিল থেকে একটা সারজিক্যাল স্ক্যালপেল তুলে নিয়ে নিজের গলায় বারবার ফ্যাটাল আঘাত করে সুইসাইড করে।
ঘরের মধ্যে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা।
কয়েক মুহূর্ত পরে সেই নৈঃশব্দের মধ্যে চৌবেজির শান্ত অস্ফুট স্বর যেন ভেসে ভেসে এলো, তিনশো বছরের দুর্ভাগা ইতিহাসের বৃত্ত তো সম্পূর্ণ হয়ে গেলো সুশীল, কিন্তু কে যে আত্মহত্যা করলো, রাজকুমারী সত্যবতী না খুশি সাবর, সেটা জানার কোন উপায় থাকলো না হে !
[ বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
Tags: Galper Samay, shorts story, Siddharth Sannyal, মসসা, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।