বাতাসে শিউলিফুলের গন্ধ। নিশ্চয় চামেলিদের গাছে ফুল ধরেছে। আমাদের বাড়ির পেছন দিকে রান্নাঘরের পাশে একটা শিউলিগাছ ছিল। শোঁয়াপোকা হয় বলে বছর দুয়েক আগে কেটে ফেলা হয়। রান্নাকরা ডালে একটা শোঁয়াপোকা পড়ে-ছিল। সরলাপিসি আমাদের রান্না করে। সেই বলল গাছটা কাটিয়ে ফেলার কথা। বড় বাটি ভরতি পুরো ডালটা ফেলা গেল। দেখা গিয়েছিল তাই, নাহলে কারও পেটে চালান হলে বিপদ ঘটত। গাছটা কেটে ফেলার সিদ্ধান্তে আমার বেশ মনখারাপ হয়ে-ছিল। মা বলেছিল, জীবন থেকে কত কীই ছাড়তে হয় তো একটা শিউলিগাছের উচ্ছেদে মনখারাপ করা বোকামি। আমাদের বাড়ির উলটো দিকে আমার প্রাণের বন্ধু চামেলিদের বাড়ি। ওদের গাছে শিউলি ফুটলে মাঝেমধ্যে কুড়িয়ে এনে কাচের ডিশে সাজিয়ে রাখি। কখনও চামেলিও এনে দেয়।
সেই দুপুর থেকে আমি বাড়িতে একা তা তো চামেলি জানে। ও আসবে বলেছিল। এখনও আসেনি। হয়তো হঠাৎ মলয়-দার তলব পেয়েছে। কলেজে ফার্স্ট-ইয়ারে পড়ার সময় থেকে সাংবাদিক মলয় বসুর সঙ্গে ওর প্রেমের সম্পর্ক। সে অবধি আমি নিত্যদিন ওদের ছোট বড় অতিতুচ্ছ রাগ-অনুরাগের ঘটনা তথা সংলাপের শ্রোতা। কখনও কদাচিৎ সিনেমায় রেস্টুরেন্টে ওদের সঙ্গী হয়েছি। চামেলির বাড়িতে ওর প্রেমের কথা জানাজানি হয়ে গেলেও আমার বাড়িতে এখনও তা জানে না। আমি মাকে বলতে পারতাম, কিন্তু বলিনি। প্রেম করার ব্যাপারে মায়ের বড় বেশি গোঁড়ামি। আসলে আমার ছোটমাসি নিজের পছন্দে বিয়ে করে অসুখী হয়েছে তাই মায়ের ধারনা হয়েছে প্রেম করে বিয়ে করলে সুখ হয় না। ফুগটা যে কত পালটে গেছে এখন তো আকচার অমন হচ্ছে আর বেশির ভাগ যুগলই সুখে দাম্পত্য জীবন যাপন করছে তা আর মাকে কে বোঝাবে। মায়ের খুড়তুতো বোনের মেয়ে নিজের পছন্দে সুপাত্র বরণ করে ড্যাংডেঙিয়ে আমেরিকা চলে গেল তখন তো খুলিতে গদগদ। একটু বড় হওয়ার পর থেকে বারেবারে মায়ের সতর্ক বাণী যেন প্রেম করার দুর্মতিনা হয়, যথাসময়ে আমাকে সুপাত্রে অর্পণ করা হবে। কথা শুনে মনে হয় সাত রাজ্য ছুঁড়ে আমার জন্যে রাজপুত্র খুঁজে আনবে। মায়ের নিষেধ শিরোধার্য করেই যে আমি প্রেমের পথে পা বাড়াইনি তা নয়। আসলে আমার জীবনে এঅবধি প্রেমে পড়ার মতো তেমন কারো অবির্ভাব ঘটেনি। মাস তিনেক হল আমার এমএ পরীক্ষা শেষ হয়েছে আর তারপর থেকেই মা বাবা আমাকে পাত্রস্থ করার উদ্যোগে তৎপর হয়ে উঠেছে।
এই যে আজ দুপুর থেকে আমি বাড়িতে একা রয়েছি তার কারণ মা বাবা আমার জন্যে পাত্র দেখতে গেছে। সোদপুরে পিসির বাড়ি যাবে, তারপর কাছেই অন্য একটা বাড়িতে পাত্র দেখতে যাবে। পিসির বড় ছেলে অমিতদা ঘটকের ভূমিকায়। তার প্রাণের বন্ধু সৌম্যব্রত খড়গপুর আইআইটি থেকে পাশ করা দ্যুতিমান হীরকখণ্ড। সেই হীরকপাত্রে মামাতো বোন আমাকে অর্পণ করার প্রয়াসে অমিতদা তৎপর। পাত্রের সব কিছুই দারুণ ভালো, শুধু একটাই ত্রুটি দর্শনধারী নয়। পাত্রের গুণের বিব-রণে মোহিত হয়ে মা বাবা পাত্র দেখতে গেছে। মা বিচার করে পাত্রের আর্থিক অবস্থা, বাবা বিচার করে বিদ্যাবুদ্ধি আর পাত্রী কামনা করে রূপ— এমনটাই নাকি বিজ্ঞজনের অভিমত। প্রসঙ্গ যখন আমার বিয়ের তো আমার মন চঞ্চল হওয়াটা কি দোষের?
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে খেল। চামেলি তো জানে আমি একা রয়েছি। দুজনে একটু রসাত্মক কথা বলা যেত। না, চামেলি এল না। মা বাবা ফিরে এসে কী রিপোর্ট দেবে ভাবতে ভাবতে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সরলাপিসি এসে বার বার ডোর-বেল বাজিয়ে আমার ঘুম ভাঙায়। ও বলল, অসময়ে ঘুমলে, দেখবে শরীর কেমন ম্যাজম্যাজ করবে।
বললাম, অনেকক্ষণ বাড়িতে একা একা ছিলাম তো, তাই চুপচাপ থাকতে থাকতে ঘুম এসে গেল।
তা টিভি দেখলেই পারতে।
সন্ধে উতরে বাবা মা ফিরল। ওদের মুখের ভাব দেখে কিছু বোঝা গেল না। আমি তো লজ্জার মাথা খেয়ে কিছু জানতে চাইতে পারি না। কিছু বলবে নিশ্চয়। মনে মনে অপেক্ষায় থাকলাম। রান্নার পাট সেরে সরলাপিসি চলে গেলে মা বাবা মুখ খুলল। মানুষ তারা খুব ভালো। সজ্জন। সৌম্যব্রতর বিদ্যেবৃদ্ধি আচরণ চাকরি সবই ভালো। কিন্তু ওই একটাই ত্রুটি, দেখতে একেবারেই ভালো নয়। মোটামুটি চলনসই দেখতে হলেও কথা ছিল।
পরের দিন চামেলি এসে বলল, কাল তো আসব আসব করেও আসা হল না। মায়ের বান্ধবী এসেছিল।
ও, তোর সেই গীতামাসি।
হ্যা, গীতা মাসি আর তার মেয়ে বুলবুলি।
আমি ভাবলাম মলয়দার তলব পেয়ে তুই-
না, তা নয়। আজ সকালে ফোনে ওর সঙ্গে ঝগড়া হল।
আবার ঝগড়া।
কী সব অবান্তর কথা বলে, আমার মাথা গরম হয়ে যায়। তোর আমিতদার ঘটকালি কেমন হল? যেমন শুনেছি সেইমতো চামেলিকে রিপোর্ট দিলাম। পাত্র কুদর্শন, বাবা মা বাতিল করেছে।
চামেলি বলল, তোর কী মত?
ওমা! আমার আবার কী মত! আমি তো তাকে দেখিইনি।
মাস দুয়েক পরেই আমি সৌম্যব্রতকে দেখলাম। অমিতদার বিয়ে উপলক্ষে পিসির বাড়ি চারদিন ছিলাম। আইবুড়ো ভাতের দিন সকালে যাই আর ফিরি ফুলশয্যার পরের দিন সকালে। ওই ক’দিনে আমি সৌম্যব্রতকে বেশ কয়েকবার দেখ-লাম। অমিতদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় আইবুড়ো ভাতের দিনও এসেছিলেন। অবশ্য অফিস করে রাতে আসেন। বিয়ের দিন তিনি বরযাত্রীর দলে ছিলেন, তারপর বিয়ের দিন। মামাতো বোন সনম আইবুড়ো ভাতের দিনই চিনিয়ে দিয়ে বলেছিল, ওই যে উনি সৌম্যদা, যার সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা হয়েছিল।
ক’দিন সৌম্যব্রতকে আমি দেখলাম, তিনিও আমাকে দেখলেন। মনে হল তিনি কোনোভাবে জেনেছিলেন আমিই সেই পাত্রী যার মা বাবা তাকে দেখতে গিয়ে রিজেক্ট করেছে। আমাকে বেশ লক্ষ করছিলেন, আমিও তা করেছি। তবে তাঁর ভাব ছিল কুণ্ঠিত বিনীত। বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হল। আমার মন তাঁকে জরিপ করছিল। মাঝারি হাইট, হাড়চওড়া দোহারা চেহারা, রঙ যথেষ্ট কালো, মুখের গঠন চৌকো ধরণের। টিকলো নাকের প্রতি আমার বেশ দুর্বলতা আছে। সৌম্যব্রতর ভোঁতা নাক আকারে একটু বেশি বড়। ভুরু জোড়ায় চুলের আধিক্য, ঠোঁটজোড়া বেশি পুরু তবে বিসদৃশ বলা যায় না। কান দুটো খাড়া আর বড়। অমন কান নাকি সৌভাগ্যের চিহ্ন। সত্যি একেবারেই দর্শনধারী নয়। চোখ দুটো উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত, দেখার মধ্যে ভালো বলতে এইটুকুই। সত্যি একেবারে দর্শনধারী নয়। এই মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হলে সকলেই বলত, বর দেখতে খারাপ। মা বাবা নিশ্চয় বুঝেছে ওই পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিলে আমি কেঁদে ভাসাতাম।
বিয়ে বাড়িতে সামনাসামনি বেশ কয়েকবার দেখা হলেও তাঁর সঙ্গে আমার কোনো বাক্য-বিনিময় হয়নি। তবে অন্য-দের সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে দেখেছি। কথা বলার ভঙ্গীতে বোঝা যায় শিক্ষিত মার্জিত মানুষ। পিসির বাড়িতে সৌমাব্রতর সম্মান সমাদর ভালোই। বুঝলাম সেটা তার বিদ্যেবুদ্ধি আর ওজনদার চাকরির খাতিরে।
ক্লাস টেনের পড়ুয়া সনম আহ্লাদি ঢঙে বলল, সৌম্যদার সঙ্গে তোমার বিয়ে হলে কী যে ভালো হত, একটু যদি দেখতে ভালো হত, বড্ড যে বাজে দেখতে। তোমার মত সুন্দরীর অমন বর ভাবাই যায় না।
আমি বললাম, তোর সৌম্যদা অসুন্দর এটা ঠিক, তবে আমি সুন্দরী নই, বলতে পারিস সুশ্রী।
সৌম্যদা কিন্তু তোমাকে খুব লক্ষ করছিল।
যা! কী যে বলিস!
বিয়েবাড়ি থেকে ফেরার পরের দিন চামেলি এল বিয়ের গল্প শুনতে। আমি সবিস্তরে বিবরণ দিলাম। সত্যি চারদিন ধরে কী মজাই না করেছি। অনেক কিছু বলা হলেও একজনের কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু প্রাণের বন্ধু চামেলির কাছে তা বলতে পারছিলাম না। তবে চামেলিই বাড়ি ফেরার সময় গেটের কাছে দাঁড়িয়ে প্রসঙ্গটা তুলল, তোর অমিতদার বন্ধু সেই যে সৌম্য-ব্রত নাকি, বিয়েবাড়িতে নিশ্চয় এসেছিলেন?
বললাম, হ্যাঁ, এসেছিলেন তো। অমিতদার খুব বন্ধু তো।
প্রায় রোজই আসতেন।
দেখতে কী সত্যিই পাতে দেওয়ার মতো নয়?
না, দেখতে ভালো নয়। তবে কী জানিস –
মানে?
চামেলির কাছেও কেন যে আমার লজ্জা করছিল! মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম, দেখতে ভালো নয় শুধুমাত্র এই কারণে বিয়ের পাত্র হিসেবে তাকে বাতিল করাটা মানতে পারছি না।
চামেলি হাসিতে উথলে বলল, তুই মাসিমাকে সে কথা বলেছিস?
যা! আমি মাকে কী বলব!
চামেলি আমার গাল টিপে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, বাতিল সম্বন্ধে নতুন করে ঘটকালির দায়িত্বটা আমিই নিলাম। তুই সত্যিই রাজি তো?
লজ্জার মাথা খেয়ে আমি বল বললাম- রাজি। রাজি। রাজি।
Tags: Galper Samay, Rama Ghosh, shorts story, রূপাতীত রমা ঘোষ গল্প
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।