30 Sep

ফিরে দেখা – দেখি নাই ফিরে

লিখেছেন:চিন্ময় ভট্টাচার্য


ফিরে দেখা দেখি নাই ফিরে, চিন্ময় ভট্টাচার্য

ফিরে দেখলাম। তবে বড্ড দেরিতে। অথচ  ঘরেই ছিল সে, এতকাল। ভালো করে নজরই করিনি। সেই যে.. তা সবে অবোধ আমি, অবহেলা করি… এতকাল অবহেলাই করেছি। পরধন লোভে মগ্ন হয়েছিলাম কিনা, তা জানি না, তবে অবহেলা করেছি। কতটা অবহেলা করেছি, তা বোধগম্য হল, দেখি নাই ফিরে শেষ করার পর। রামকিঙ্কর বেইজের জীবন নিয়ে লিখেছেন সমরেশ বসু। এক কিংবদন্তীর তুলি, কাগজ, রেখা ধরা পড়েছে আরেক কিংবদন্তীর কলমে, লেখায়। জীবনী সম্পূর্ণ করতে পারেননি সমরেশ। লেখা মাঝপথেই থেমে গেছে সমরেশ বসুর অকাল প্রয়াণে। এত বছর পর তা ফিরে দেখলাম, এ লেখাকে কোনভাবেই বইয়ের সমালোচনা বলা যাবে না। বরং লেখা না বলে অনুভব বলাই ভালো। দেখি নাই ফিরে পড়ার পর আমার মুগ্ধতা, আমার অনুভবই বলার চেষ্টা করছি মাত্র।

জীবনী বললাম বটে. তবে উপন্যাসের মতোই গভীর, থ্রিলারের মতোই টানটান সমরেশ বসুর লেখা। কোথাও মনে হয় না কারোর জীবনী পড়ছি। জীবনী অনেক সময়েই ক্লান্তিকর হয়ে পড়ে তথ্যের ভারে। কারণ বিখ্যাত কোন মানুষের জীবনী সত্যের কাছে বাধা পড়ে থাকে, ইচ্ছেমতো তাকে মোচড় দেওয়া যায় না। সিরিয়ালের মতোই প্রতি মোড়ে রহস্য, রোমাঞ্চের উত্তেজনা আনা যায় না। জীবনীকারকে অনুগত থাকতে হয় শুধু সত্যের প্রতিই। সে নিয়ম ভাঙেননি সমরেশ। কোথাও কোন সত্যের অপলাপ হয়নি, তথ্যবিকৃতি হয় নি। হলে সে একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হতো। প্রথমত, কাহিনীর প্রথম থোকে শেষ পর্যন্ত থাকেন রামকিঙ্কর স্বয়ং।  তাঁর সঙ্গেই থাকেন নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সুরেন কর, শান্তিদেব ঘোষ, সগরময় ঘোষ, সে সময়ের শান্তিনিকেতন, সে সময়ের শান্তিনিকেতনের আবাসিক ছাত্র-ছাত্রী এবং মাস্টারমশাইরা। এবং থাকেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এ বাংলায় বসে বাংলা ভাষায় এইসব মানুষের সম্বন্ধে কোথাও কোন তথ্য বিকৃতি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা আশা করি পাঠককে মনে করিয়ে দিতে হবে না। এইসব মানুষদের সঙ্গী করে, তথ্যে অনুগত থেকে, কারোর জীবনী লেখা বড় সহজ কথা নয়। অথচ কি অবলীলাক্রমে তাঁদের নিয়েই মসৃণ এই জীবনী লিখেছেন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই কথাশিল্পী। বাঁকুড়ার মাটি থেকে এক নাপিতের ঘরের ছেলের রামকিঙ্কর বেইজ হয়ে ওঠার কাহিনিই ধরা পড়েছে সমরেশের কলমে। আর তা করতে গিয়ে এক শিল্পীর মনের অভ্যন্তর খুলে ধরেছেন ভরা হাটের মাঝে, তাঁর এই উপন্যাসে। আর ধরা পড়েছেন নন্দলাল।

এই উপন্যাস না পড়লে আমি এমনভাবে চিনতে পারতাম না মাস্টারমশাই নন্দলালকে। চিনতে পারতাম না মানুষ নন্দলালকে। যিনি ছাত্রদের ছবির সাবজেক্ট বেছে নেওযার, আঁকার মাধ্যম বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেন। যিনি অনায়াসেই স্বীকার করতে পারেন ছাত্রর কাজ মাস্টারমশাইকে ছাপিয়ে গেছে, ছাত্রদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে নতুন কোন সৃষ্টিতে মেতে উঠতে পারেন, একসঙ্গে কাজ করার পর পুরো টাকাই ছাত্রদের পাওনা বলে বিলিয়ে দিতে পারেন যিনি ছাত্রদের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন এবং নিজের অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও রামকিঙ্করকে তেল রংয়ে কাজ করার স্বাধীনতা দেন যিনি, তাঁর নাম নন্দলাল বসু। নন্দলাল বসুর মতো শিল্পী হতে গেলে যে দরাজ, বিশাল এক মন লাগে, তা উপন্যাসে কোথাও বলে দেননি সমরেশ বসু। কিন্তু উপন্যাস পড়তে পড়তে তা অনুভব করেন পাঠক। ওইরকম এক নন্দলাল বসুই যে পারেন রামকিঙ্কর বেইজের মতো এক শিল্পীর শিক্ষক হয়ে উঠতে, তা বোঝা যায় এই উপন্যাস পড়তে পড়তে। সে সময়ের শান্তিনিকেতনও ছবির মতো ধরা পড়ে আমাদের সামনে। আর তাতেই ভয় দ্বিগুণ চেপে বসে মনের ভেতর, যখন আজকের শান্তিনিকেতনের কথা মনে পড়ে। যখন মনে পড়ে, অমর্ত্য সেনের জমি বিতর্কে শান্তিনিকেতনের উপাচাযের্র বক্তব্য, যখন মনে পড়ে পৌষ মেলা নিয়ে রাজনৈতিক দলের মাতব্বড়ি। যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে পৌষ উৎসবের সূচনায় বিশ্বভারতীর উপাচার্যের পাশেই হাঁটেন খুনের মামলায় অভিযুক্ত অতি বিতকির্ত রাজনৈতিক নেতা, বেদনায় ভরে যায় মন। সমরেশ বসুকে কোথাও শান্তিনিকেতনের কোন ব্যাখ্যা দিতে হয়নি। ঐতিহাসিক চরিত্ররা যেভাবে আসেন, যেভাবে গানের মতো দিনযাপন করেন, তাতে কোথাও কিছু দাগিয়ে দিতে হয়না। ফুটনোটে ব্যাখ্যা করতে হয় না। সে কারণেই সমরেশের লেখা রামকিঙ্করের জীবনী এত সুরেলা, পড়তে পড়তে মনে হয় অমল ধবল পালে মন্দ্রমধুর হাওয়া…।

আর রবীন্দ্রনাথ। বাইরের শৃঙ্খল যত কঠিন হয়, ভেতরের বাঁধন ততোই আলগা হয়। গান, কবিতা, প্রবন্ধে একাধিকবার বলতে চেয়েছেন তিনি। শুধু লিখেই থেমে যাননি। তাঁর স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে তা রূপায়ন করেছেন। শান্তিনিকেতন মানে শুধু খোলামেলা পরিবেশে প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে গাছের তলায় পড়াশোনাই নয়, রবীন্দ্রনাথ এই খোলা হাওয়া ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আবাসিকদের হৃদয়ে।

ছাত্র ছাত্রীদের বিরোধিতা করার সাহস যুগিয়েছেন, বিদ্রোহ করার প্রশ্রয় দিয়েছেন। কোথাও কোন কঠোর নিয়ম রাখেননি, মনের দরজা খুলে রাখার স্বাধীনতা দিয়েছেন।  পাঁচিল তুলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন ঘিরে ফেলতে হয়নি, ছাত্র ছাত্রীরা আপনিই বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবেসেছেন।  সমরেশ বসুর অসম্পূর্ণ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি স্বল্প। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ এবং সুনিবিড় ছায়ায় ঢাকা। মনে হয়, আজকের দিনে, অসহিষ্ণুতা, বিরোধী মতকে অঙ্কুরেই বিনাশ করাই যখন স্বাভাবিক, তখন রবীন্দ্রনাথই হয়ে উঠতে পারে আমাদের সকলের শান্তির আশ্রয়।

[বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2025 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ