সকালে রোজকার প্রথামতো গুরুগ্রামের সেক্টর ৫৬-এর নির্জন রাস্তায় দুজনে হাঁটছি….বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে…. মেজাজটাও বেশ মানানসই…..সপ্তাহান্তটা কিভাবে সুভালাভালি কাটানো যায় তাই নিয়ে দুজনের মধ্যে একটা মতান্তর প্রায় পেকে উঠেছে……এমন সময় হঠাৎ রাস্তার পাশের রাধাচূড়া গাছ থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের একজন খ্যাঁচম্যাচ মুখভঙ্গি করে নেমে এসে আমার বাঁহাত ধরে ঝুলে পড়লো…..হঠাৎ একিরে বাবা !! সেই না দেখে সেদলের আর একজন সদস্য তীরবেগে পাশ থেকে এসে অর্ধাঙ্গিনীর পা ধরে……বোধ হয় ক্ষমাভিক্ষা করতে লাগলো……তারপর যা হলো তাকে সাদা নারান গাঙ্গুলীয় বাংলায় বলে ‘কাকস্য পরিবেদনা’ !! যাই হোক আমার শূন্যে উপর্যুপরি পদাঘাত, কিছু লোষ্ট্রনিক্ষেপ ও স্ত্রীর তীক্ষ্ণ চিৎকারে পূর্বপুরুষগণ বিচিত্র মুখভঙ্গি ও অমানুষিক শব্দপ্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করলো ! অপাঙ্গে দেখি শাখামৃগপ্রবরের অমানবিক করমর্দনের দুশ্চেষ্টায় আমার দক্ষিণ বাহুমূলে নখরাঘাতে প্রায় দেড় ইঞ্চি প্রমান রক্তনিশান আর আমার অর্ধাঙ্গিনী এই ক্ষণযুদ্ধে বিনা ক্ষয়ক্ষতিতে জ্বাজ্জল্যমাণ !
বাড়িতে ফিরে স্ত্রী উবাচঃ….”বাড়িতে টেডভ্যাক আছে…..লাগিয়ে দিচ্ছি ! কিন্তু তোমার এন্টিরেবিস ইনজেকশন নিয়ে নেওয়া উচিত……কারণ সবসময়-ই তো আমার সঙ্গে খিঁচিয়ে খিঁচিয়ে কথা বলো….রোগের সিম্পটম দেখা দিয়েছে কিনা সময়মতো বুঝতে পারবোনা..হে হে হে” !
পঁয়তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গিনীর এহেন হৃদয়হীন কথায় আমি গোমড়ামুখে টেডভ্যাক নিয়ে বসে থাকলাম…ইনজেকশনের ব্যথা বাঁদরামির নখরাঘাতের থেকে বেশী মনে হতে লাগলো !
চব্বিশ ঘন্টা কেটে গেছে……কোথাও কোনো ব্যত্যয় নেই……আজ সকালে আমাদের কলোনির মধ্যেই সন্তর্পণে ( ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’…হেথায়-ও ) প্রাত্যহিক ঘোরাঘুরি সম্পন্ন হলো ! কেবল আজ সকালের ব্রেকফাস্ট-এ ……সাধারণতঃ খাই-ই না……খুব উৎসাহের সঙ্গে একটা পুরো কলা খেয়ে নিলাম……কেন ঠিক বুঝতে পারছি না !
সন্ধ্যে রাস্তার প্রচন্ড ট্রাফিকের মধ্যে গাড়ি চালাতে চালাতে এখন সুকান্তর মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে ! কাল থেকে ও মনে করে রেখেছিল আজ সকালে উঠেই ফেসবুকে একটা জবরদস্ত স্ট্যাস্টাস দেবে মাকে নিয়ে, মানে মাতৃজাতির ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি তাদের অবিরল মমতা নিয়ে ! আর অফিস থেকে লাঞ্চের সময় বেরিয়ে গিয়ে কিনে আনবে মা’র জন্য কোনো একটা সুন্দর গিফট ! সত্যি, গত দুদিন ধরে ফেসবুকে মাদার্স ডে নিয়ে যা চলছে ! সুকান্তর মনে হচ্ছে এই দেশের সব মায়ের ছেলেমেয়েরা কি এই ফেসবুকের আর আর্চির দোকানের অপেক্ষায় ছিল এতদিন, যাতে করে তারা নিজেদের মায়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা ঢাক পিটিয়ে প্রচারের দরবারে হাজির করতে পারে !
কিন্তু কাল রাতে হেডকোয়ার্টার থেকে আসা একটা ই-মেল্ সুকান্তর সব হিসেব গুলিয়ে দিল ! সেই যে কাল রাত নটার পর থেকে তার মন জুড়ে ছিল এম ডির একদিনের কলকাতা ভিজিট আর ইন্সপেকশন……এই একটু আগে এয়ারপোর্ট-এ তাঁকে বাই বাই করা পর্যন্ত সুকান্তর মাথায় আর কিছুই ছিল না ! সারাদিনের প্রচন্ড ব্যস্ততার পর এই এখন বাড়ি ফেরার সময় তার মনে পড়ল আরে আজ তো মাদার্স ডে……মার জন্য তার আগে থেকে প্ল্যান করা কাজগুলো তো কিছুই করা হয়নি, না দিয়েছে কোনো চাবুক স্ট্যাটাস, না কিনেছে গিফট…….ছি ছি এখন বড়ো খারাপ লাগছে সুকান্তর, অপরাধী লাগছে নিজেকে !
গরমটাও আজ পড়েছে খুব ! নিজের ঘরে ঢুকে এসি আর ফ্যানটা একসঙ্গে চালিয়ে দিল সুকান্ত ! ক্লান্ত লাগছে খুব….একটু জিরিয়ে নিয়ে মার ঘরে যাবে, ভাবলো সে ! খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুতেই সারাদিনের পরিশ্রমে চোখটা কখন লেগে গেছে বোঝেনি সুকান্ত…….চটকাটা ভেঙে গেলো মাথায় একটা কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে……মা কখন খাটের কিনারে এসে বসেছেন …..রোজকার মতো ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ! সুকান্ত পাশ ফিরে মার দিকে মুখ ফিরিয়ে মা-র হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে বললো…..’মা জানো আজকের দিনটাকে বলে মাদার্স ডে’……মাতৃ দিবস ! আজ তুমি নয়…আজ হচ্ছে আমার দিন…..তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আর মমতা প্রকাশের দিন……বলো আজ তোমাকে কি……’ সুকান্তর কথার মাঝেই ওর সত্তর বছরের বিধবা মা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাই না কি রে ! তা কবে থেকে এটা শুরু হল’ ?……এই বলে উনি হাসিমুখে আবার সুকান্তর মাথার চুলে বিলি কাটতে লাগলেন ! সুকান্ত কয়েক মুহূর্ত চুপ করে মায়ের মুখের দিকে দেখলো তারপর আবার চোখ বন্ধ করে মার হাতটা নিজের হাতে মধ্যে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো !
একধারে জঙ্গল। তারপাশে ছোট্ট একটা নদী। ছোট বড় পাথরের গা দিয়ে বয়ে চলেছে তিরতির করে।
পূব দিকে যখন সূর্য ওঠে, ভোরের ঝিরঝিরে বাতাস জাগে, গাছগুলোর পাতায় পাতায় কাঁপন ধরে। পাখীদের চিকিরমিচির শুরু হয়।
তখন সে নদীতে কোথাও হাঁটুজল, কোথাও গোড়ালী পর্যন্ত। নদীটার সঙ্গে তার খেলা চলে কিছুক্ষণ। লাফাই ঝাঁপাই খেলা। নদীটাও যেন খুশীতে ঝিলমিল করে।
তারপর রোদ্দুর যখন একটু গরম হয়, তখন মায়ের সাথে সে যায় জঙ্গলে। কাঠকুটো কুড়োতে। জঙ্গলের ধারে এই ঝুপড়িটায় শুধু মা আর মেয়ে। মা সারা দিন ধরে চুবড়ি বানায়। তখন সে মায়ের কাছে বসে কাজ দেখে আর খানিক খেলা করে – একলাই।
খেলা তার অনেকরকম। রঙীন প্রজাপতি আর কাঠবিড়ালীদের পেছনে ছোটাছুটি করা, গাছের ডাল ধরে দোল খাওয়া অথবা মাটি আর নুড়ি সাজিয়ে ঘর বানানো।
খেলতে খেলতে রোজ সে দ্যাখে মেঠো রাস্তা দিয়ে গাঁয়ের লোক চলেছে পশ্চিম পানে। মেয়ে, পুরুষ, বাচ্চারা সকলে দল বেঁধে। দূরের গঞ্জে জন খাটতে। সন্ধে হলে তারা ফিরবে। মেয়েটার তখন বাবার কথা মনে পড়ে। বাবাও কাজের খোঁজে চলে গিয়েছে অনেক দিন আগে। আজও ফেরেনি। বাবা আদর করে তার নাম রেখেছিল তিতি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। মা বলে আঁধার হলে জঙ্গলে যেতে নেই। রাত হয়। দূরে একটা শুকনো তালগাছের মাথায় চাঁদ দেখা দেয়। তারাগুলো চেয়ে থাকে। মেয়েটার ভয় লাগে। মায়ের কোলের কাছে সে আরও ঘন হয়ে শোয়। তখন ভাল লাগে।
এমনি করেই সে বড় হচ্ছিল। একদিন জল আনতে গিয়ে দেখলো নদীর ওপারে এসেছে অনেক লোক অনেক গাড়ি আর দৈত্যের মতো বড় বড় যন্ত্র।
তারপর নদীর ওপারে তৈরি হল বড় বড় বাড়ি, দোকান, বাজার। এল কত লোক।
এরপর এক দিন মা তার মারা গেল। গাঁয়ের কিছু লোক এসে মায়ের দেহটাকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পুঁতে দিল। আর মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে গেল পশ্চিমের গঞ্জে জন খাটতে।
তারও পরে মেয়েটা এসে পড়লো এক জঙ্গলে, যেখানে আঁধার হয়না। এই জঙ্গলের নাম শহর। মেয়েটার এখন নাম বসন্তকুমারী। তার মুখ দিয়ে এখন সর্বদা কুৎসিত গালিগালাজ বের হয়। খদ্দেররা হিহি করে হাসে।
আর সেই নদীটা? বড় বড় বাড়ী দোকান বাজারের ময়লা জল নদীটায় পড়ে, নদীটা নর্দমা হয়ে গেছে।
রবিবার আমাদের কাজের ছুটি। কী করব ভাবছি ,বিশাখার ফোন এল, চলে এস শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। রবিবার খোলা থাকে। বুধবার ছুটির দিন। বিশাখা সংগীত বিভাগের অধ্যাপক। গানের গলাও বেশ চমৎকার । বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত যখন গায়,বিভোর হয়ে যায় গানের মধ্যে। চারপাশের শ্রোতারাও তখন তার গানের মধ্যে ডুব দেয়। বিশাখার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল একটা ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ শিবিরে। ক্লাসের শেষে সব বন্ধুরা যখন হোটেলের ছাদে বসে আড্ডা দিতে ব্যস্ত, সে সময় বিশাখা আসে ধীর লয়ে।ওঁর হাঁটার অপরূপ ছন্দ ও সুন্দর মুখশ্রী দেখে কেমন যেন একটা ভাললাগা তৈরি হয়ে গিয়েছিল প্রথম দর্শনেই। একেই কী বলে ‘লভ কামস এট ফার্স্ট সাইট’? একটা নয়, পরপর পাঁচটা।ওর গলায় গান শুনে আমাদের সকলেরই কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল। রাতের খাবার যে খেতে হবে সবাই ভুলে গিয়েছিলাম। বেয়ারা এসে জানাতেই সবার খেয়াল হল।খাবার খেয়ে বিছানা নিলে কি হবে ঘুম আর আসতেই চায় না। বিশাখার মুখটা ঠিক মনের বাঁধানো ফ্রেমে পাকাপোক্তভাবে সেট হয়ে গেছে।ইতিমধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে।আলাপচারিতা থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলাম আমরা। সময়ের ব্যবধানে আজ বিশাখার ফোনটা পেয়ে আর দেরি করলাম না।চলে গেলাম শান্তিনিকেতনে। বিশাখা সঙ্গে নিয়ে বসল আম্রকুঞ্জের এক ছাতিমতলায়। প্রখর দাবদাহের মধ্যেও আম্রকুঞ্জের বয়ে যাওয়া শীতল সমীরণে, আহা কী প্রাণের আরাম! পাশে বসে বিশাখা গেয়ে উঠল ,’এই লভিনু সঙ্গ তব ,সুন্দর হে সুন্দর।’
আমাদের পাড়ার কানাইদা ছিল স্টার ফুটবলার। তখন প্রখ্যাত ফুটবলার মেওয়ালাল সবে অবসর নিয়েছেন। কানাইদা দেখতে যেমন মেওয়ালালের মত ছিল, তেমনি ভাল ফুটবলও খেলত। মেওয়ালালের মতই খেলার সময় পরত লাল হাফ প্যান্ট, আর গায়ের রঙটাও ছিল তার কুচকুচে কালো। মাঠের রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে আমরা স্কুল পড়ুয়া ছেলের দল খেলা দেখতাম। আমাদের কাছে কানাইদা ছিল সেদিনের মেওয়ালাল।
বল নিয়ে প্রতিপক্ষের গোল পোস্টের দিকেযখন কানাইদা পাঁই পাঁই করে ছুটে যেত, তখন আমরা উত্তেজনায় শরীর টানটান করে সম্ভাব্য গোলের জন্য চেঁচিয়ে উঠে উৎসাহ দিতাম, “গোওওওওওল, কানাইদা গোওওওল”। কানাইদা মানে গোল হতেই হবে।
খেলা শেষে কানাইদা যখন মাঠের কোনায় তার ঘামে ভেজা জার্সি খুলে ঘাম নিংরাতো, আমরা ছেলের দল কানাইদার পেশী ঝলকানো শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম নির্নিমেষ। কানাইদা জেলা ভিত্তিক ফার্স্ট ডিভিশনে ফুটবল খেলত। কলকাতার বড় টিমগুলোতেও সুযোগ পেয়েছিল।
আমরা বড় হলাম। কলেজে উঠতে খেলার মাঠটা জীবন থেকে অনেক দূরে চলে গেল। কানাইদার খোঁজ আর রাখতাম না। বছর দশেক পর বাড়ি গেছি ছুটিতে। থলে হাতে ঝুলিয়ে রেল মাঠের পাশে, মুরগির দোকানে। যার দোকান, সে আমার একসময়ের খেলার সাথীও বটে। আমার সাথে এটা সেটা বাক্যালাপ করতে করতে সে ডিপ ফ্রিজ থেকে মুরগি বার করে ওজন করে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ‘বারো পিস কর’। যাকে পিস করতে বলা হল, সেই লুঙ্গি পরা খালি গা লোকটি একমনে কাঠের গুঁড়ির উপর মুরগি কেটে একটা পাত্রে রেখে থলে বন্দী করে আগে বাড়িয়ে দিচ্ছে। লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি। জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ভাল তো?’ ঘাড় নেড়ে তো দিলাম, তবু চিনি না। লোকটা মুরগি টুকরো করতে করতে বলল, “এখন থাকো না তো এখানে। শুনেছি দিল্লীতে……”।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল কানাইদা। হ্যাঁ সেই কানাইদা, যে একদিন রেল মাঠে বাতাসকে হেলায় উড়িয়ে ছুটে যেত প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট লক্ষ করে আর আমরা ‘কানাইদা গোল, কানাইদা গোওওওওওল’ করে গলা ফাটাতাম। এখন তার গায়ে রক্তের ছিটেয় ফুটবল মাঠের কাদার দাগগুলো চাপা পড়ে গেছে।
বিয়ের পাঁচ বছরপর তানিয়াকে নিয়ে এই প্রথম বেড়াতে আসা। মেঘ পাহাড়ের সহবাসে পশ্চিম ঘাটের অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত জায়গা এই “খান্ডালা ” । বৃষ্টিতে ধুলোমাখা পাহাড়ি শহরটা ধুয়ে ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেছে ,পাহাড়ের গায়ে যেন ঘন সবুজাভ চাদর । মনে হচ্ছে যেন নতুন বিয়ের পর হানিমুনে এসেছে ওরা । তানিয়াকেও আজ বড় সুন্দর দেখাচ্ছে ।
গরম গরম পকোড়া আর কফি খেতে খেতে বিনায়ক টিভি দেখছিল , হঠাৎ নজর গেল তানিয়া সোফা থেকে উঠে সোজা বেডরুমে ঢুকে লাইটটা অফ্ করে দিল । বিনায়ক আওয়াজ দিল “ কি হল তানিয়া ? ”
আগেও এমন ঘটেছে বহুবার , সবার সামনে জানা হয়নি । এমন হলে রাতেও তানিয়াকে স্বাভাবিক লাগত না , বিছানার একধারে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকত ,“ ভালো লাগছে না বিনায়ক ” বলে বিনায়কে দূরে সরিয়ে দিত । আজ বিনায়ক নাছোড়বান্দা …
“ কি হয়েছে , মাথা ধরেছে ? খুলে না বললে কি করে বুঝব বলো ।” আজ যেন অন্য তানিয়াকে খুঁজে পেয়েছিল সে , উচ্ছল হাসিখুশি,এত সহজে সব হারিয়ে যাবে !বলল,“ কি হল… মুখ তোলো … দেখি… খুলে বলো প্লিজ ” ।
হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল তানিয়া , “ আমি তোমাদের হারাতে চাই না , তোমরা ছাড়া আমার কেউ নেই , যদি ঘৃণা করো , আমি নিজেকে শেষ করে দেব ” ।
“ কি বলছ তানিয়া , আগেও দেখেছি তুমি এমন করেছো , কিন্তু কেন ? আমার উপর ভরসা নেই ? তোমার মনের কথা জানার কোন অধিকার নেই আমার ? ”
জীবনের গোপন ও ভয়ঙ্কর কথাগুলো তানিয়া বলতে লাগল…“ সেদিন শরীর খারাপ শুনে দিদুনকে মা দেখতে গিয়েছিল , সেইদিনই দিদুন মারা যায় আর মা চার দিন ওখানে আটকে যায় । আমি তখন ক্লাশ এইটে । যে বাবা আমার বিধবা মা ও আমাকে গ্রহণ করেছিল, সেই … আমি চীৎকার করি… মিনতি করি … , মাকে বাবা মেরে ফেলবে বলেছিল … তবুও মা ফিরে এলে সব বলেছিলাম , মা প্রচন্ড মারধোর সহ্য করেছিল … জ্বলন্ত সিগারেট মার পিঠে গুঁজে দিয়েছিল লোকটা , হোস্টেলে পাঠিয়ে মা ঐ মদ্যপ লোকটার লালসা থেকে বাঁচায় আমায় ”।
শরীরটা কাঁপছিল তানিয়ার । বড় অসহায় লাগছিল , বিনায়কের। কষ্ট হচ্ছিল । ভাবছিল ঘরেও মেয়েরা সুরক্ষিত নয় ? কত সময় কেটে গেছে খেয়াল নেই ,শক্ত করে বিনায়কের হাতটা ধরে তানিয়া যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে । বিনায়ক তাকে বোঝাতে পেরেছে এতে তার কোন দোষ নেই , জীবনে এমন অনেক আকস্মিক ঘটনা ঘটে যাকে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে হয় ।
জানলাটা খুলতেই অপূর্ব এক হাল্কা শীতল হাওয়া ঘরটায় ঢুকে পড়ল। তানিয়া ঘুমোচ্ছে , বিনায়ক ওর কপালে চুমু খেয়ে বেডসাইডে রাখা টেলিফোনটা থেকে ডাক্তার বন্ধুর নম্বরটা ডায়াল করল ।
অন্যদের মতো সিনেমা, স্বভূমি বা গঙ্গার ধারে নয়, সপ্তর্ষি আর লাবণী সাধারণত দেখা করে কাছাকাছি কোনও রেলস্টেশনে। টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ভাড়ার তালিকায় চোখ বোলাতে বোলাতে যে স্টাশনের নামটা ভাল লাগে, মনে হয়, এখানে গাছ আছে, আকাশ আছে, ফুরফুরে হাওয়া আছে, সেখানকার টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়ে।
আজও ওরা এসেছিল তেমনই একটি জায়গায়। ফেরার জন্য টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছিল। তার পর কী মনে হল, সপ্তর্ষি বলল, চলো না, রেল লাইন ধরে কিছুটা হাঁটি। ওর কোনও কিছুতেই কোনও আপত্তি করে না লাবণী। বলল, চলো।
দুজনে হাত ধরাধরি করে রেল লাইনের পাটাতনে পা ফেলে ফেলে এগোতে লাগল। দুজনেই দেখল, দূরে একটা আলো। লাবণী বলল, ট্রেন আসছে। সপ্তর্ষি বলল, আসুক। আমরা যদি সত্যিই বাকি জীবনটা এই ভাবে একসঙ্গে থাকতে চাই, দেখবে, ক’বিঘত আগে হলেও ট্রেনটা ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে। আসুক ট্রেন, ভয় পেয়ো না।
এ কী! কোথায় গেল! সপ্তর্ষি দেখল, তার পাশে লাবণী নেই। এদিকে নেই, ওদিকে নেই, সেদিকেও নেই। ট্রেনটা একেবারে সামনে। মাত্র ক’হাত দূরে। তবে এই লাইনে নয়, অন্য লাইনে।
ক্যামেরাখানা বহুদিন পর হাতে নিল জয়ন্ত সান্যাল । তখন মোবাইল এর এমন রমরমা ছিলনা । উঠতে বসতে মানুষ ছবি তুলত না । কাজেকম্মে ফটোগ্রাফার ডেকে ছবি তোলানো হত । জয়ন্ত’র বরাবর ছবি তোলার সখ । সামান্য মাইনের চাকরির পাশাপাশি সখের ফটোগ্রাফিটা সে পার্ট টাইম পেশায় পরিণত করেছিল । এতে বাড়তি দু’পয়সা সংসারে আসত । বনানীও তাই আপত্তি করেনি ।
সেদিন আট বছরের ছেলেটার জন্মদিন ছিল । নুন আনতে তখন পান্তা ফুরিয়ে যায় , এমন ছিল তাদের অবস্থা । ইচ্ছে থাকলেও তিলুর আর পাঁচজন বন্ধুদের মত জাঁকজমক করে জন্মদিন পালন করতে পারত না জয়ন্ত । বনানী যথাসাধ্য চেষ্টা করে এই দিন একটু ভালোমন্দ ছেলের পাতে তুলে দিত । সঙ্গে থাকত এক বাটি সুস্বাদু পায়েস । তাই নিয়েই তিলুর খুশির অন্ত থাকতনা ।
বনানী বাপ ছেলেকে সাজিয়ে গুছিয়ে খেতে দিত । জয়ন্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে রসিকতা করত , “ তিলু তোর অনারে আমার ও কেমন ভালোমন্দ জুটে যাচ্ছে দেখ !” তিলু মিটিমিটি হাসত । কিন্তু আট বছরের জন্মদিনে হঠাৎ শান্ত ছেলেটা আবদার করে বসল , “ বাবা আমার কিন্তু জন্মদিনের উপহার চাই”।
“কী চাই বাবা ?” সস্নেহে ছেলের মাথায় হাত বোলায় জয়ন্ত । বনানী একটু শঙ্কিত হয় । জয়ন্ত চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে । ছেলে এমন কিছু চাইবেনা সে জানে ।
ক্যামেরাটা টেবিলের উপর ছিল । সেদিকে ইঙ্গিত করে তিলু বলে ওঠে, আমার ছবি তুলে দিতে হবে । ছেলের আবদার শুনে জয়ন্ত হো হো করে হেসে ওঠে । খাওয়াদাওয়ার শেষে খান দুই ছবি তুলেই ক্যামেরা গুছিয়ে জয়ন্ত রেখে দেয় । কিন্তু তিলুর আরো ছবি চাই । জয়ন্ত ফিল্ম খরচের ব্যাপারে অতি সাবধানী । পরশু দিন পরেশ মণ্ডলের মেয়ের আইবুড়ো ভাতে ছবি তুলতে হবে । ছবি পিছু টাকা পাবে । নতুন ফিল্ম কেনা মাসের শেষে সম্ভবও না ।
ছেলে মুখ ভার করে চোখে জল নিয়ে স্কুলে চলে গেল। ছেলের শুকনো মুখটা দেখে বাপের বুকটাও মোচড় দিয়ে উঠল । সেও শুকনো মুখে অফিস বেরিয়ে গেল ।
ফিরল সন্ধ্যে বেলায় বাস এক্সিডেন্টে ছেলের তালগোল পাকানো দেহটা নিয়ে । সকালে জানতেই পারেনি , বাঁচিয়ে রাখা ফিল্মগুলোই রাত বাড়লে তিলুর জন্য খরচ করতে হবে !
লা ইওরোনা ( গুয়াতেমালা)
[‘লা ইওরোনা’ একটি পৃথিবী বিখ্যাত জনপ্রিয় লাতিন আমেরিকান ভৌতিক লেজেন্ড। পৃথিবীতে একটি ভৌতিক লেজেন্ড নিয়ে এত সংখ্যক প্রচলিত গল্পের নজির পৃথিবীতে বিরল। স্প্যানিশে ‘llorona’ শব্দের অর্থ হল- ‘ক্রন্দনরতা মহিলা। ]
মারিয়া নামে একটি মেয়ে ছিল। তার স্বামী কিছুদিনের জন্য যখন বাইরে যায়, সেই সুযোগে তার সাথে একজন যুবকের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে তাদের খামারের দেখাশুনো করতো। কিন্তু একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়- তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফল স্বরূপ মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয় এবং জন্মানোর সাথে সাথেই মেয়েটি তাকে নদীর জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলে।
শোনা যায় এই ‘ইওরোনা’-ই হল মারিয়ার বেদনার্ত আত্মা- সাদা বা কালো রঙের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। সাধারণত নির্জন রাস্তায়, নদী, লেক, ঝরনার ধারে তাকে দেখা যায়। তবে তার মুখটি পুরোপুরি চুলে ঢাকা থাকে। আবার কেউ কেউ বলে তার মুখটি একটি ঘোড়ার মুখের মত। কেউ তার চোখের দিকে তাকালে বা তার সাথে কথা বললে তার মৃত্যু নিশ্চিত।
আরও একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। যখন কেউ ভাবে যে ইওরোনা তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, আসলে সে তখন তার থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে, আবার যখন কেউ দেখে যে ইওরোনা অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে, আসলে সে তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
ইওরোনা তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত আত্মা হিসেবে রাত্রিবেলা ঘুরে বেড়ায় আর ‘আমার ছেলে কোথায়?’ বলে কাঁদতে থাকে।
কথিত আছে, ইওরোনা যখন চিৎকার করে কাঁদে, সাথে সাথে তুষার ঝড় ওঠে। এই ভয়ঙ্কর কান্না শুনলেই খুব সাহসী লোকেরও ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে যাবে। একবার এই ভয়ার্ত কান্না শুনলেই সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ দু বারে না হলেও তৃতীয়বার ইওরোনা জিতবেই। কারণ তৃতীয় বার তার কান্না শুনলেই ভয়ে তার রক্ত সাথে সাথে জমাট বেঁধে বরফে পরিণত হয়ে যায়। এমন বহু মানুষ আছেন যারা এই ইওরোনাকে দেখেছে বা তার ভয়ার্ত কান্না শুনেছে।
সেইবো ফুলের গল্প (আর্জেন্টিনা)
প্রাচীন লোকগাথা অনুযায়ী পারানার তীরে আনাই নামে একটি মেয়ে বাস করতো। মেয়েটি দেখতে ছিল খুব কুৎসিত ও কঠোর স্বভাবের। তবে মেয়েটি খুব সুন্দর গান গাইতো। গরমকালের বিকেলবেলায় যখন সে দেশাত্মবোধক বা ঠাকুর দেবতার গান গাইতো, গুয়ারানী সম্প্রদায়ের লোকেরা মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনতো। গানের মধ্যে দিয়েই তার স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেত।
একদিন হঠাৎ স্পেনীয় সাদা চামড়ার লোকেরা তাদের দেশে অনুপ্রবেশ করে, সেখানকার সব কিছু ধ্বংস করে দেয়, স্থানীয় লোকেদের মেরে ফেলে। তাদের জমি, জায়গা স্বাধীনতা সব কেড়ে নেয়।
একদিন স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে তাকেও তারা বন্দী করে নিয়ে যায়। সারা রাত সে ঘুমতো না, শুধু কাঁদতো। একদিন এক রক্ষী রাতে ঘুমিয়ে পড়লে সে সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই রক্ষী জেগে উঠে তাকে যখন বাধা দিতে যায়, তখন সেই রক্ষীর বুকে ছোরা বসিয়ে দিয়ে সে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেই মৃত্যুপথযাত্রী রক্ষীর চিৎকারে অন্যান্য স্পেনীয়রাও জেগে যায় এবং আনাইকে ধরার জন্য তারা বেড়িয়ে পড়ে। অবশেষে আনাই তাদের হাতে ধরা পড়ে যায়। মৃত রক্ষীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য তাকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আনাইকে তারা একটি গাছের সাথে বেঁধে আগুন লাগিয়ে দেয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই আগুনের শিখাটি যেন তার কাছে পৌঁছুতেই চাইছিল না। আনাই কোনও কথা বলল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে সব সহ্য করলো। তার মাথাটি একদিকে হেলে গেল। এরপর একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো- আগুনের শিখাটি যখন ওপর দিকে উঠতে লাগলো, আনাই একটি গাছে রুপান্তরিত হয়ে গেল।
পরের দিন ভোরবেলা সেই সাদা চামড়ার সৈনিকেরা একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল- সেখানে একটি অতীব সুন্দর গাছ তার উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের পাতা আর ভেলভেটের মত লাল ফুলে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং চারিদিকে সে তার অপরূপ শোভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেন দুঃখের মাঝে সাহস ও শক্তির মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
[ডিসেম্বর, ১৯৪২-এ এই ‘সেইবো’ (Erythrina crista-galli) ফুলকে আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুলের মর্যাদা দেওয়া হয়। এই টকটকে লাল বর্ণ হল সমৃদ্ধির প্রতীক।]
”যাচ্ছেতাই” শব্দটা যথেষ্ট নয় বলেই মনে হচ্ছিল রচনার। একটা ঘটনা ঘটলেও ঠিক ছিল। তা নয় পরপর, একতার পর একটা। নিজের উপরই ভরসা কাটছিল। ঠিক কথা সংসারে চলতে গেলে সমস্যা আসবেই। কিন্তু তা বলে এরকম। জ্যোতিষের কথাটা মনে এল – “মাথা ঠাণ্ডা রাখুন কটা দিন।” তারপর মনে হল দূর ও সব ফালতু। ওরা ফেরেববাজ। পাথর দিয়ে জীবন ঘোরালে তো সব ভিখিরিদের সরকার থেকে সাবসিডি দিয়ে পাথর পরিয়ে দিলেই দেশের দারিদ্র্য দূর হয়ে যেত।
তবু…………… নিজেই নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসল।
আশ্চর্য না? এই হাতেই রক্তপ্রবাল পরে আছে আর মনে মনে ধ্বংস করছে নিজেকে। একবার মনে হল – বিচ্ছেদ আবেদনটা না করলেই পারত। এখন এসব যুক্তি অর্থহীন। তবু মনকে হাতড়াচ্ছিল। কষিয়ে নিচ্ছিল যুক্তিগুলো। যেমন মানুষ নিজের কাজের সাপেক্ষে করে থাকে। একটা সময় পর্যন্ত করে। তারপর করে না, ছেড়ে দেয় সময়ের হাতে। রচনাও তাই করতে বাধ্য হল মনের তাগিদে। বা বলা ভাল জেদের তাগিদে।
উকিলের পাঠানো কাগজটা টেনে নিয়ে কলমটা মুখে চেপে দুবার কামড়াল। মনটাকে দাতার যুক্তিতে দাঁতে চাপল। অবশেষে সইটা করছিলই… হাতের মোবাইলটা বাজনা ধরল।
বোতাম চাপার পরেই, ওপাশে কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা –
কিছু মনে কোরো না, এত বছরের অভ্যেস, না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না।
“কখন ফিরেছ? খেয়েছো তো?”
শ্রীরামপুর বাগবাজার রুটের একটা তিন নম্বর বাস শ্রীরামপুর স্টেশন সংলগ্ন স্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। সামনের দিকে ড্রাইভারের সিটের পিঠোপিঠি লেডিস সিটের এক কোণে বসেছেন এক বৃদ্ধা মহিলা। মহিলার পরনে কিছুটা মলিন সাদা থান, হাতে একটি মানানসই পুঁটুলি। বোঝা যায় কোন নিম্নবিত্ত প্রান্তিক পরিবারের প্রবীণ সদস্যা। আমাদের মধ্যে যারা স্ট্যান্ড থেকেই বাসে উঠেছে তাদের অনেকেই খেয়াল করছে এক যুবক এসে মহিলাকে বাসে তুলে দিয়ে গিয়েছিল, যে সম্ভবত ওঁর পুত্র।
বাস ছাড়ার সময়েই উনি কন্ডাক্টারকে বলে দিয়েছিলেন ‘মাসীর বাড়ি’ স্টপেজ এলেই যেন ওঁকে বলে দেওয়া হয়। এর পরমুহূর্ত থেকে যখনই বাস কোথাও দাঁড়াচ্ছে তিনি প্রশ্ন করছেন –‘হ্যাঁ বাবা, মাসীর বাড়ি আইলো’?
প্রায় বার দশেক প্রশ্নটি করবার পর কন্ডাক্টার বলল –‘মাসীর বাড়ি দেরি আছে ঠাকমা, এখনো বটতলাই আসে নি, আপনি চুপ করে বসুন, ঠিক সময়ে বলে দেবো’।
এই উত্তরে একটু সময় চুপ করে থাকলেন বটে কিন্তু তারপরেই আবার তিনি আগের মত শুরু করলেন –‘হ্যাঁ বাবা, মাসীর বাড়ি আইলো’?
বাসের অন্য প্যাসেঞ্জাররা তখন মজা পেয়ে মিটিমিটি হাসছে।
কন্ডাক্টার চটে গিয়ে খেঁকিয়ে উঠে বলল –‘অত বকবক না করে চুপ করে বসুন তো ঠাকমা, একদম কথা বলবেন না। সময় হলে ঠিক নামিয়ে দেব’।
কন্ডাক্টারের এই মেজাজ দেখে থতমত খেয়ে একেবারে চুপ করে গেলেন সেই বৃদ্ধা। বাস চলতে থাকলো নিজস্ব গতিতে। কিন্তু কন্ডাক্টার ভুলে গেল ওই মহিলার কথা। বাস যখন মাসীর বাড়ি স্টপেজ ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে তখন আমরা হইহই করে বাস থামালাম। এতবার বলার পরেও বৃদ্ধাকে ঠিক যায়গায় না নামানোর জন্য প্রচুর তিরস্কার করলাম। কন্ডাক্টার মহিলাকে ওইখানেই নামিয়ে দেওয়ার তাল করছিল। আমরা সবাই গলা তুলে বললাম ‘তা হবে না। বাস ঘুরিয়ে আবার এক স্টপ পিছনে নিয়ে যেতে হবে এবং ওই মাসীর বাড়িতেই মহিলাকে নামিয়ে দিতে হবে’। জনতার মেজাজ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ড্রাইভার গাড়ি ঘোরালো। নির্দিষ্ট যায়গায় এসে দাঁড়াবার পর কন্ডাক্টার বলল –
‘মাসীর বাড়ি এসে গেছে ঠাকমা, নামুন’।
ঠাকমার মধ্যে নামার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। তিনি পুঁটুলি থেকে একটি হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি বের করে কয়েকটি গুলি মুখে ফেলে গ্যাঁট হয়ে বসে রইলেন।
‘কি হল নামুন, মাসীর বাড়ি তো এসে গেছে’।
ঠাকমা বললেন – ‘আমি তো বিশালক্ষী সড়কে নামবো, কোন্নগরে। আমার ছেলে বলেছিল মাসীর বাড়ি আইলে এই হোমিপ্যাথি ওষুধের চারটে দানা খেয়ে নিতে। তাইজন্যে জিগ্যেস করছিলুম বারবার’!
অপ্রয়োজনীয়
ও তখন গবেষণা করছে। স্টাইপেন্ড যা পায় তাই দিয়ে দুজন কেন একজনেরও ঠিকমতো চলে না। আমার চাকরিটাই একমাত্র ভরসা। সেই ভরসাতেই বিয়েটাও হয়ে গিয়েছিল।
ওর এখন অধ্যাপনা, শতরঞ্চি, কফিহাউস, সাহিত্যসভা। সংসারে যা কিছু প্রয়োজনীয় সব মোটামুটি আছে। শুধু আমার চাকরিটা অপ্রয়োজনীয় সাব্যস্ত হয়েছে।
সাময়িক
এখন আর ব্যথা নেই। শুধু মনে আছে আঘাতটা জোরেই লেগেছিল। আর কান্না পায় না। শুধু মনে পড়ে বড্ড কষ্ট হয়েছিল। এখন আর আফশোসও হয় না। শুধু মনে হয় মস্ত ভুল হয়েছিল।
কথাগুলো শুনে তো ও অট্টহাস্য করে উঠেছিল। সত্যিই তো! বিয়ের মতো খেলো কথা পাড়া কি উচিৎ হয়েছিল? না হয় গত রাতে দেহের প্রতিটা রোমকূপ চিনত। তাই বলে মুখটাও সকালে মনে রাখতে হবে?
নেপথ্যে
-আপনার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান কার? আপনার বাবার না স্বামীর?
-দুজনেরই কিছু কিছু ভূমিকা হয়তো আছে। মায়ের কথা বাদ দিলেন?
– আপনার মা তো যত দূর জানি হাউজওয়াই ছিলেন। উনিও কি আপনাকে বিজ্ঞানী হতে অনুপ্রাণিত করেছেন?
-মায়েদের থ্যাংকলেস ভূমিকাটা ঠিকঠাক পালিত না হলে কারও পক্ষেই কিছু হয়ে ওঠা সম্ভব হোত না। এই ভূমিকাটা এতটাই অযাচিত ভাবে আসে যে আমরা সেটাকে উল্লেখ করার যোগ্য মনে করি না।
– তাহলে কি মাকেই সবার ওপরে রাখতে চান?
– আর দুজনের কথাও বলতে হয়। বিজয়াদি আর মলিণা। ওরা না থাকলে ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরবার আমি সামলে উঠতে পারতাম না। গবেষণা চালিয়ে যাওয়া তো দূর, চাকরিও ছেড়ে দিতে হোত। সব সফল মহিলারই সাফল্যের পেছনে এরাই নেপথ্যচারিণী।
একবার জানালার সামনেটায় দাঁড়ালো পার্থ। আটতলার উপরের জানালা। সকাল থেকে নিম্নচাপ। জানালার কাঁচের পাল্লা খুলতে বেশ দাপুটে হাওয়া দিল। নীচে ঝুঁকে দেখলো অফিস ক্যাম্পাসের রাস্তার আলো জ্বলছে। এদিক ওদিক জল জমেছে অল্প অল্প। পিছনে ঘুরে দেখল পার্থ, অফিসের কিউবিকলগুলো। ফাঁকা। বসের ঘরে তখনও আলো আছে। বস হয়তো একমনে ফেসবুক করছে। একটা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু গভীর শ্বাস ফেলল পার্থ। জানালার পাল্লাটা ধরে বেয়ে উঠল। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলো। পূর্ণার মেসেজ এসেছে, কখন ফিরবে জিগেস করেছে। জানালার উপরে দাঁড়িয়েই লিখলো ‘দেরি হবে, খেয়ে নিও’। গ্যালারি গিয়ে তিন্নির ছবি দেখলো একবার। এক রত্তি মেয়েটা বুঝবে না। বাবাকে বোঝার আগেই বাবা কই? বড্ড অপরাধী মনে হলো পার্থর হঠাৎ নিজেকে। একবার ভাবলো আর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে সবাই জেনে যাবে। পূর্ণার ওপর অনেক ঝড় ঝাপটা যাবে। পূর্ণা নিশ্চই সামলে নেবে। পূর্ণার সাথে প্রথম আলাপের কথা মনে পড়ে গেল। সেই কলেজ,তারপর ক্যাম্পাসিং, পূর্ণা আগেই চাকরি পেল। তারপরে পার্থ। একসাথে ব্যাঙ্গালোর। বাড়ীতে লুকিয়ে ব্যাঙ্গালোরে লিভ ইন। তারপর কলকাতায় ফিরে বিয়ে। এর মধ্যে দুটো কোম্পানি বদল করেছে পার্থ। আচ্ছা পুলিশ কি সন্দেহ করবে? পূর্ণার সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে কিনা খুঁজবে? পার্থর পরকীয়া খুঁজবে নিশ্চই! নাকী বসকে জেরা করবে ? মিলিদি বড্ড নিরীহ মানুষ। ভয় পেয়ে যাবে নাতো ! নাহ অফিসের বিট্টূ, অনিন্দিতারা সামলে দেবে নিশ্চই। আচ্ছা, তিন্নি…
“নাহ!!”
“নাহ!!”
মন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে! নাহ! আর না! আর ভাবা যাবে না!!
খানিক পরে ছুটে এসেছিল সিকিউরিটি। আধঘন্টার মধ্যে পুলিশ। খোঁজ পেতেই অফিসে জড়ো হলো কলিগরা; বাড়িতে আত্মীয়, বন্ধু, পুলিশ।
— কী?
— কী হয়েছিল?
— কেন?
— কিভাবে??
— ইশ!
— পার্থরতো বউ-বাচ্চা, দামী চাকরি, নতুন ফ্ল্যাট! কেন?
— এরকম হাসিখুশি মিশুকে পার্থ!! কেন?
— আচ্ছা ব্লু-হোয়েল না কী বেরিয়েছে? সে সব নাতো??
— ধ্যাৎ এতো বড়োলোক!
— আচ্ছা তবে কি দু-নম্বরি লাফরা? অন্য কেসফেস?
— আচ্ছা দাদা ও পাড়ার ওই ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের কেসটা কী?
— আচ্ছা দাদা কেসটা ঠিক কী?
— আচ্ছা পুলিশ কোনো ক্লু পেল?
— পুলিশ গুলো কোনো কম্মের না!
— আচ্ছা দাদা কেন? আপনারা তো দেখতেন রোজ! কিচ্ছু বুঝতে পারেন নি?
— আরে আমরা তো সেটাই ভাবছি! কিছুতো আঁচ করা যায়!
পুলিশ এখনও খুঁজছে?
পাড়াও এখনও খুঁজছে!
পূর্ণা, তিন্নি, বিট্টু, অনিন্দিতা, মিলিদি, অফিস ক্যাম্পাসের সিকিউরিটি সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এমনকী দেখুন, আমি আপনিও ভাবছি কেন? কারণটা কি? আসল গল্পটা ঠিক কী ছিল?
সবাই ভাবছি! সবাই খুঁজছি!
কেন? কারণটাকি?
আর পার্থ?
বিজ্ঞাপনটা আরতি দেখেনি। দেখলে কিছুতেই আজ আর শোভনকে বাড়ির বাইরে যেতে দিতনা সে। ভাঙনধরা গরাদের গ্রিলে মাথা রেখে অচেতনেই বলে উঠল তার ঠোঁটদুটো— “ভালো হোক”। মস্তিষ্ক চোখ বোজে। তার জমাট শূন্যতা জুড়ে শ্লেষের হাসি। “আর ভালো!”
বিজ্ঞাপনটা নেহাতই সাদামাটা। একটা বাচ্চাছেলে বারবার পড়ে যাচ্ছে সাইকেল থেকে আর তার বাবা তাকে আবার তুলে দিচ্ছে সাইকেলে— যতক্ষণ না প্যাডেল আপনা হতেই ঘুরতে শুরু করে। ‘ফাদার্স ডে’ উপলক্ষে কোনো অ্যাড। কিন্তু সেই সময়ই ওপরের অ্যাণ্টেনাটা নড়ে গিয়েছিল খানিক। পাখিটাখি হবে হয়তো। ঝিলঝিল করে গিয়েছিল পর্দা ওই কয়েক সেকেণ্ডই। আরতি আর বসেনি তারপর। সোফা ছেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল গরাদের সামনেটায়।
সাইকেলটা কখনোই কেনা হয়নি তার। না নিজের জন্য, না শোভনের জন্য। আরতি মেয়ে, তাই তার বাবা কোনো সাইকেল কিনে দেয়নি তাকে। দাদাই ডবলক্যারি করত সবসময়। শোভনের অবশ্য ওসব বায়না কখনই নেই। তাই তার আজকের চলে যাওয়াটাও স্ট্রেচারে শুয়েই। অ্যাম্বুলেন্সে। যেমনটা হয় আর কি! ওর বাবাই অবশ্য এগিয়ে দিতে গেছে তাকে আশ্রমের গেট ওবধি। সিস্টারের নিষেধ— বাকি পথটুকু ওনারাই আগলাবেন জরভরত ওই ছেলেকে— অবশ্য যে কটা দিন ওর আয়ু রয়েছে ততদিনই! ওর মধ্যে আর প্যাডেল ঘোরানো শিখবেনা ছেলেটা – বলেই দিয়েছেন ডাক্তার।
দরজায় খুট করে আওয়াজ — শোভনের বাবা বুঝি ফিরল। টিভিতে তখন আবার ফিরে এসেছে সেই বিজ্ঞাপন —থমকে গিয়ে দুজোড়া অন্ধকার জোট বাঁধে ঘরে। বিড়বিড় করে আরতির ঠোঁট, “ওকে ওরা মানুষ করবে। ওরাই পারবে। আমরা খরচ জোগাতাম কোত্থেকে?”
মস্তিষ্ক সায় দেয় এবার —“সেই, এ ছেলে যে সন্তানসুখ দিতেও অপারগ।কেনই বা খরচ বহন করতাম এই পঙ্গু মাংসপিন্ডের? মা বাবারা স্বার্থপর হয় বইকি!”
শোভনের বাবা, নাঃ, ওর স্বামী জল চায় একগ্লাস – সোফায় শরীরটা ছেড়ে দেওয়ার আগে।
“ এক্ষুনি দিচ্ছি ” বলে অন্যমনস্ক ভাবে চোখে লাগানো সমুদ্রের কলটাই খুলে দেয় এবার আরতি অচিরেই।
Tags: অণু গল্প পাঠ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।