আমাদের মধ্যে অনেকেরই বানান ছিল সৃষ্টিছাড়া। শংকর কখনো চাঁদ লিখত না, লিখত চাদ। সে ‘জ্যোৎস্না’ কথাটির অদ্ভূত এক বানান লিখত যা দেখলে রাজশেখর বসু মশাই নিশ্চয়ই মূর্ছা যেতেন। শংকর চন্দ্রবিন্দুকে তার অভিরুচি অনুযায়ী ব্যবহার করত, তোয়াক্কা করত না কারও। খোকা কাপড়কে করত কাপর, বেড়িয়ে আসাকে লিখত বেরিয়ে আসা। বলত, সে কাঠ বাঙাল, তার ‘র’ আর ‘ড়’ ঠিক থাকে না। এই দোষ সে প্রুফ দেখতে দেখতে আর আমাদের ধমক খেতে খেতে শুধরে ফেলেছিল। বরেনও বানানে পাকা ছিল না। সে বলত, আমি ভাই সাইন্স আর অঙ্কের মাস্টার, তোমাদের অত কারেক্ট বানান আমার আসে না,। এই রকম আরও আছে, বাহুল্য বোধে বাদ দিচ্ছি। তবে একটা কথা ঠিক, বাংলা বানান নিয়ে আত্মশ্লাঘা অনুভব করার কারণ বেশির ভাগ লেখকেরই নেই। আমার তো নয়ই। মহা মহা পণ্ডিতও গোলমাল করে ফেলেন যেখানে সেখানে, আমরা তো ছার।
এই বানান নিয়ে একটা মজার গল্প শুনেছিলাম। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মশাই একবার কোনো একটি লেখায় ‘তরবারি’ কথাটির বানান লিখেছিলেন ‘তরবারী’। একবার নয়, একাধিকবার। কাজেই অনবধান বশত সেটা হয়নি। যে প্রেসে লেখাটি ছাপা হচ্ছিল তারা তাদের নিয়ম মতন প্রথম প্রুফটি দেখে যতটা সম্ভব পরিচ্ছন্ন করে পরের প্রুফটি লেখককে পাঠাত। সুনীতিকুমারের ‘তরবারী’কে প্রুফ রিডার ‘অরবারি’ করে দিলেন। যথারীতি প্রুফ গেল সুনীতিকুমারের কাছে। পরের দিন পালে বাঘ পড়ার অবস্থা। সুনীতিকুমার নিজেই ছাপাখানায় এসে হাজির। রীতিমতো বিরক্ত হয়েছেন। কে করেছে এমন কাজ? সব ‘তরবারী’ ‘তরবারি’ হয়ে আছে? প্রুফ রিডার ছিলেন পিয়ারীমোহন দাশ, এক সময়ের নাম করা বিপ্লবী। পিয়ারীমোহন সবিনয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে আমি করেছি’। ‘আপনি করেছেন? কেন করেছেন?’ পিয়ারীমোহন যেন প্রস্তুতই ছিলেন। বিরাট দুই অভিধান বার করে বানানটা দেখালেন। সুনীতিকুমার যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তারপর হেসে ফেললেন, বললেন, ‘সে কি তরবারীতে হ্রস্বই। দেখুন তো, আমার যে দীর্ঘ-ঈ বলেই মনে হত। কোনোদিন খেয়াল করিনি। কিন্তু যাই বলুন তরবারিতে দীর্ঘ-ঈ না থাকলে মানায় না। বড় হালকা হয়ে যায় তরবারি। ওতে ঠিক মাথা কাটা যায় না’। বলে হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
সূত্র- বিমল করের ‘আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা’
…………………….
… নতুন গল্পটি লিখে মনে হল, আমি, আমার মনে যে মানুষগুলি আছে তাদের বাইরে এনে জীবন্ময় করে জীবনের হাটে মুক্তি দেওয়ার সোনার কাঠি পেয়েছি। গল্পটি লিখে তার নাম দিলাম ‘রসকলি’। আমাদের পূর্ণিমা তখনও চলছে। কিন্তু আগের গল্প ‘স্রোতের কুটো’ সম্পর্কে মন্তব্যের কথা স্মরণ করে এবং মন্দ কবির স্বভাবগত যশোলিপ্সার প্রেরণায় ওটিকে পূর্ণিমা-য় না-দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম বাংলাদেশের একখানি বিখ্যাত পত্রিকায়। ডাকটিকিট অবশ্যই দিলাম। এবং উদ্বিগ্ন চিত্তে দিন গণনা করতে লাগলাম। দিন পনেরো পর একখানি রিপ্লাই কার্ড লিখলাম। পনেরো দিন পর দু-ছত্রে জবাব এল – গল্পটি সম্পাদকের বিবেচনাধীন আছে। আবার মাসখানেক পর আর এক খানা রিপ্লাই কার্ড লিখলাম।
জবাব এল। সেই দু-ছত্রের জবাব, সম্পাদকের বিবেচনাধীন আছে। আবার লিখলাম চিঠি। আবার সেই এক জবাব। এক সই।
বোধ হয় সাত মাস কী আট মাস চলে গেল। মোটমাট আট থেকে দশখানি রিপ্লাই কার্ড আমি অক্লান্তভাবে লিখে গেলাম। তাঁরাও সেই একই জবাব দিলেন। আট মাস পর আমি আবার এলাম কলকাতায়, কাজ দু-চারটে ছোটোখাটো, তার মধ্যে ওটাও একটা। এবার স্বয়ং গিয়ে আপিসে হাজির হলাম। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম – আমার একটা গল্প –
– দিয়ে যান – ওখানে
– না। অনেক আগে পাঠিয়েছি।
– পাঠিয়েছেন? কী নাম আপনার? গল্পের কী নাম?
বললাম নিজের নাম, গল্পের নাম। তাঁরা একখানা খাতা খুলে দেখেশুনে বললেন, ওটা এখনও দেখা হয়নি। দেখা হয়নি? বিবেচনাধীন থাকার এই অর্থ? আমার ধারণা হয়েছিল – পড়ে দেখা হয়েছে – হয়তো কিছুটা ভালো লেগেছে – কিছুটা লাগেনি, সেইজন্য বিবেচনা করছেন – দেওয়া যায় কি না-যায়। তাছাড়া গল্পটি নিছক প্রেমের গল্প; পত্রিকাটির রুচি সম্পর্কে কড়াকড়ির একটা খ্যাতিও আছে; কটন ইস্কুলের মতো গল্পটিকে শায়েস্তা করে নেওয়ার বিবেচনাও এক্ষেত্রে অসম্ভব নয়। গল্প যে প্রকাশযোগ্য সে বিশ্বাস আমার ছিলই।
আজ এই উত্তরে মনে একটা ক্ষোভ জেগে উঠল। নতুন লেখক বলে তাঁর গল্পটা পড়েও দেখেননি? মনে পড়ে গেল মারাঠা তর্পণের লাঞ্ছনার কথা। ভাবলাম সাহিত্যসাধনার বাসনায় জলাঞ্জলি দিয়ে গঙ্গাস্নান করে বাড়ি ফিরে যাব এবং শান্ত গৃহস্থের মতো জীবনটা ধানচালের হিসেব করে কাটিয়ে দেব। আর বেঁচে থাক কংগ্রেস, ওরই মধ্য দিয়ে জেল খেটে কাটিয়ে দেব জীবন। বললাম, দয়া করে আমার গল্পটা ফেরত দিন।
– নিয়ে যান। দেখে নিন মশাই –।
অন্য একজন দেখেশুনে লেখাটা ফেরত দিলেন। আমি লেখাটা হাতে করে মধ্য কলিকাতা থেকে দক্ষিণ কলিকাতা পর্যন্ত হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। চোখে বার কয়েক সেদিন জল এসেছিল। ভাগ্যকে তখন মানতাম, ভাগ্যকেই সেদিন বার বার ধিক্কার দিলাম। বাড়ি চলে এলাম সেই রাত্রেই। গঙ্গাস্নান আর করা হল না।
সূত্র – আমার সাহিত্য জীবন – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ।। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
‘’’’’’’’’’’’’’’’’
…..অনুবর্তন যখন প্রথম সংস্করণ খুব দ্রুত নিঃশেষ হল, তখন দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপার সময় আমি স্বেচ্ছায় তাঁর প্রুফ দেখার ভার নিলুম। আমার দুর্বুদ্ধি – সবাই ওঁকে বলে ‘আনকনসাস’ লেখক – আমি প্রুফ দেখতে দেখতে এক জায়গায় একটি ছোট সেনটেন্স যোগ করলুম। মাত্র পাঁচ বা ছয় শব্দের, আর এক জায়গায় একটি ‘কিন্তু’। আমি জানতাম উনি রাগ করবেন না। তাই বই ছাপার পর যেদিন এলেন, আমি বেশ বুক ঠুকেই বললুম, ‘আপনাকে তো সবাই আনকনসাস আর্টিস্ট বলে, আমি এক জায়গায় একটি ছোট্ট সেনটেন্স ও একটি ‘কিন্তু’ শব্দ যোগ করেছি – আপনি ধরতে পারবেন?’ উনি দেখি বলে বই হাতে নিয়ে কয়েকটা পাতা দেখতে দেখতেই দেখিয়ে দিলেন, এই সেনটেন্স আর এই ‘কিন্তু’ আপনার। বলে একটু হেসে বললেন, ‘যতটা আনকনসাস এরা বলে ততটা নই’। তবে এর জন্যে যে আমার ওপর রাগ করেননি সেটা নিশ্চিত বুঝে নিশ্চিন্ত হলাম। যখন ওঁর দীর্ঘদিনের গবেষণার ফল অতি প্রিয় উপন্যাস ‘দেবযান’ ছাপা হচ্ছিল তখন – যে প্রেসে ছাপা হচ্ছিল, একদিন সে প্রেসের ম্যানেজার চিঠি লিখে পাঠালেন, ‘ম্যানাসক্রিপ্ট-এর মধ্যে একটি পৃষ্ঠা মিসিং, আপনি একবার সত্বর আসুন’।
ছুটতে ছুটতে গেলাম, আমার হাত দিয়েই পাণ্ডুলিপি গেছে। আর এক পৃষ্ঠা কি? ফুলস্কেপ হাফ সাইজের লম্বা কাগজ।
প্রেস ম্যানেজার বললেন, দেখুন যেমন দিয়েছিলেন, তেমনই ফাইলে বেঁধে রেখেছি – কিছু কিছু করে কম্পোজে দিই, এখান থেকে কখনো কিছু হারায়নি এখনো পর্যন্ত। নিশ্চয়ই উনিই কোথায় ফেলেছেন গোছাতে গোছাতে। লুজ শিটের এই অসুবিধে।
দুশ্চিন্তার শেষ রইল না। তখনই চিঠি লিখলুম, উনিও হন্তদন্ত হয়ে এলেন দু-দিন পরেই। আমি বললুম, ‘আপনি একটা কি দুটো দিন আমাদের বাড়ি থেকে মিসিং লিংক লিখে দিয়ে যান’।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এ কী হল বলুন দিকি, সত্যি লুজ শিটে লেখা ঠিক হয়নি। তাছাড়া মিলিয়ে দেওয়া উচিত ছিল’।
গেলেন প্রেস পর্যন্ত, বাকি কপি নিয়েও এলেন। উনি বসে চা ইত্যাদি খেয়ে গল্প করছেন, হঠাৎ বললেন, ‘গজেনবাবু, ওইটুকু আপনিই লিখে দেবেন, আমি চললুম, কল্যাণীর জন্য মন কেমন করছে’।
সর্বনাশ! আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
‘এ কী সম্ভব! আমার স্টাইল আপনার স্টাইল আলাদা। ও আমি পারব না। লোকে কি বলবে’।
‘ও যা হয় একটা করে দেবেন, আপনি আমার এত বই পড়েছেন হয়ে যাবে, আমি চললুম’।
এ-ই বিভূতিবাবু !*
অগত্যা করতে হল। ছাপার ১৬/১৭ পংক্তি লিখে যোগ করেছিলুম। ভয় ছিল, যতই যা বলুন, এই বইটি ওঁর খুব প্রিয় – মানে এই বিষয় বলেই – এখনো তা আছে। বিভূতিবাবু পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘এই তো। আমিই তো বুঝতে পারছি না। আমি জানি যে’।
(এই ভরসাতেই অনশ্বর বই লিখতে লিখতে উনি যখন চলে গেলেন, বৌদি আমাকে ডেকে বললেন, ‘এটা আপনি শেষ করে দিন, আপনি পারবেন’। কিন্তু সত্যিই পারলুম না। দেবযান এক জিনিস, এ অন্য। গলদঘর্ম হয়ে কোনোমতে দুটো ইনস্টলমেন্ট লিখে দিয়েছিলুম। আর পারলুম না। সাবধানে – ওঁর মতো শব্দ, কী ভাবে সাজাতেন তিনি হলে, এত ভেবে ভেবে লেখা সম্ভব নয়।)
সূত্র –গজেন্দ্রকুমার মিত্র, শতবার্ষিকী সংকলন। ‘কাজভূষণ্ডীর আলাপচারি’ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ
* বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
Tags: 'লেখালিখি' জীবনের গল্প
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।