দীর্ঘকাল পূর্বে (১৯৩৩) মানুষের জীবনতত্ত্ব-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পুনরাবৃত্তি করেছিলেন এই চিরন্তন সত্যবাণী – “জনসংঘের শ্রেষ্ঠ রূপ প্রকাশ করবার জন্যে তার রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের প্রশস্ত ভূমি না পেলে জনসমূহ পৌরুষবর্জিত হয়ে থাকে। সমস্ত জাতি বৃহৎ জীবনযাত্রায় তার থেকে বঞ্চিত হলে ইতিহাসে ধিককৃত হয়।” সুখের বিষয় ইতিহাসের সেই ধিক্কারের আঘাতে বহুকালের সুপ্তিমগ্ন ভারত সহসা জেগে উঠে জড়তার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে স্বরাষ্ট্রের অধিকার অর্জন করেছে আপনার অন্তর্নিহিত একতা ও সুবিপুল সংকল্প-বলে। স্বরাষ্ট্রের অধিকারে বিকশিত হয় একটা জাতির পৌরুষশক্তি, আর স্বভাষার আশ্রয়ে প্রকাশিত হয় তার আত্মার মহিমা। স্বভাষার বৃহৎ ভূমিতে হাজার শিকড় মেলবার সুযোগ না পেলে জাতীয় চিত্ত টবে-লালিত বনস্পতির মতো খর্বকায় ও গৌরব-বর্জিত হয়ে থাকে, ফলফুল বিতরণের সার্থকতা থেকেও হয় বঞ্চিত। স্বরাষ্ট্রের অধিকার কেড়ে নিয়েছি বিদেশীর হাত থেকে। কিন্তু স্বভাষার অধিকার কেড়ে নিতে পারি নি অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে – সে শত্রু লুকিয়ে আছে আমাদের অন্তরের বিদেশী শিক্ষার মোহময় বেশে। নিজের মনের অন্তরালে থেকে যে সংস্কার মিত্ররূপে শত্রুতা করে, তাকে সহজে চেনা যায় না। তার প্রচ্ছন্ন বৈরাচারকে প্রতিহত করাও দুঃসাধ্য হয়। এইজন্যই যে বাঙালিজাতি স্বরাষ্ট্রের অধিকার লাভের জন্য দীর্ঘকাল বধ-বন্ধনের অপরিসীম দুঃখবরণে কুন্ঠিত হয় নি, স্বভাষার অধিকার লাভের জন্য সেই বাঙালিজাতির সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার আভাসমাত্রও দেখা গেল না, বরং ইংরেজির মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য বারবার কারাবরণের প্রচেষ্টাই দেখা গিয়েছে। অথচ এই বঙ্গভূমিরই পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরা স্বভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠাই জন্য সংঘবদ্ধভাবে লড়াই করেছে, অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। ফলে স্বাধীন পূর্ববাংলায় মাত্র দশ বৎসরের প্রচেষ্টাতেই শিক্ষার সব স্তরে এবং সর্ববিধ সরকারি ও বেসরকারি কাজকর্মে, এক কথায় জাতীয় জীবন-চর্যার সর্বক্ষেত্রে, স্বভাষার পূর্ণাধিকার প্রায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তা বলে ইংরেজি ভাষা-শিক্ষা তথা ইংরেজি ভাষা-বাহিত বিদ্যাচর্চা সেখান থেকে নির্বাসিত হয় নি। আর, এ দিকে আমরা সুভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইও করি নি এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের পশ্চাদ্গামিতার জন্য লজ্জাবোধও করি না। এই মানসিক অসাড়তাই সব চেয়ে শোচনীয়।
কিন্তু পরাধীনতার দুঃসময়েও রবীন্দ্রনাথ অন্ততঃ শিক্ষায় ও জাতীয় মননক্ষেত্রে স্বভাষাকে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবার কথা বারবার বলে গেছেন। অথচ তাঁর কথা বারবারই ‘ইংরেজি-শিক্ষার মন্ত্রমুগ্ধ কর্ণকুহরে অশ্রাব্য’ বলে গণ্য হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় তাঁর তিরোধানের চল্লিশ বছর পরে আমাদের অবাধ স্বাধীনতার যুগেও ইংরেজি-শিক্ষার মায়ামুগ্ধ মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না, সে মানসিকতার কাছে রবীন্দ্রনাথের আকুল আবেদন এখনও সমভাবে অশ্রাব্য ও অগ্রাহ্য হয়েই রয়েছে। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রবাণীর অপব্যাখ্যাও এখন আর বিরল নয়। শিক্ষাদানে ও বিদ্যাচর্যায় মাতৃভাষার গুরুত্ব কতখানি, এবিষয়ে রবীন্দ্র-ভাবনার বিশদ পরিচয় দেওয়াই এই পুস্তকের অন্যত্ম প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু বর্ত্মানের তর্ককোলাহলে এ বিষয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই এই পুস্তকে। তাই এখানে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন।
১৮৮৩ সালে, মাত্র বাইশ বছর বয়সে, শিক্ষায় ইংরেজি ও বাংলায় আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – “ইংরেজিতে যাহা শিখিয়াছ, তাহা বাংলায় প্রকাশ কর, বাংলাসাহিত্য উন্নতিলাভ করুক ও অবশেষে বঙ্গ-বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক। ইংরাজিতে শিক্ষা কখনই দেসের সর্বত্র ছড়াইতে পারিবে না”। – এই উক্তি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, তিনি ইংরেজি ভাষা শেখার বিরোধী তো ছিলেনই না, বরং ইংরেজি শিক্ষালব্ধ জ্ঞানকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতেই আগ্রহী ছিলেন। অর্থাৎ শিক্ষার উঁচু পর্যায়ে ইংরেজি শিখতে হবে জ্ঞান আহরণের জন্য এবং সে জ্ঞানকে বাংলায় প্রকাশ করে একদিকে সমৃদ্ধ করতে হবে নিজের সাহিত্যকে আর অন্যদিকে বাংলাবিদ্যালয়ের যোগে সে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বসাধারণের মধ্যে। বোঝা যাচ্ছে – সর্বজনীন লোকশিক্ষার বাহন হবে বাংলা; তবে এ পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষা যেমন প্রত্যক্ষতঃ বারিত হয় নি, তেমনি উঁচু পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হলেও সকলের পক্ষে আবশ্যিক বলেও নির্দিষ্ট হয় নি। ১৮৮৩ সালের এই অবস্থান থেকে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে একটুও সরে যান নি। পরবর্তীকালে এই উভয়বিধ শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁর মতামত স্পষ্টতর ও পূর্ণতর হয় মাত্র। উঁচু পর্যায়ে শুধু ইংরেজি কেন, ফরাসি, জরমান প্রভৃতি সমৃদ্ধ ভাষা শিখলে আরও ভাল হয়, এ কথাও তিনি বলেছেন বারবার। তবে শিক্ষার ও গবেষণার উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত বিদ্যাচর্চার একমাত্র বাহন হওয়া চাই বাংলা (অবশ্য বাংলাদেশে), আর যদি এখনই তা সম্ভব না হয় তবে অগত্যা সাময়িকভাবে বিকল্পে ইংরেজি বা বাংলা – এই ছিল তাঁর সুদৃঢ় অভিমত। আর যারা ইংরেজি ভাষা যথাযথভাবে আয়ত্ত করতে অক্ষম, শিক্ষাজগৎ থেকে তাদের নির্বাসিত করার, অর্থাৎ তাদের ললাটে চিরমূর্খতার ছাপ মারার, পক্ষপাতী তিনি একেবারেই ছিলেন না। ইস্কুল পর্যায়ের যদি কারও ইংরেজি ভাষা শেখার অক্ষমতা বা অনিচ্ছা প্রকাশ পায় তবে তাকে ইংরেজি ছাড়াই অন্যান্য বিষয়ে বিদ্যার্জনে পূর্ণ অধিকার দেবার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। বস্ততঃ যার যতটুকু মেধা তাকে ততটুকু বিদ্যা অর্জনের সুযোগ দেওয়াই তো সুস্থ জনকল্যাণ-চিন্তার পরিচায়ক। আর, লোকশিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ইংরেজি শিক্ষা অনাবশ্যক বলেই মনে করতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত লোকশিক্ষা-সংসদের পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচিই তার প্রমাণ। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ অভিমত অতি সংক্ষেপে অথচ সুশৃঙ্খল্ভাবে বিবৃত হয়েছে স্যাডলার কমিশনের প্রতিবেদনে।
এবার আসি স্কুলশিক্ষার প্রসঙ্গে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের কথা। এটি লোকশিক্ষা-প্রতিষ্ঠন রূপে পরিকল্পিতও হয় নি, পরিচালিতও হয় নি। উচ্চশিক্ষালাভের সোপান হিসাবেই এর আবির্ভাব। তাই এর শিক্ষাক্রম থেকে ইংরেজি বর্জনের চিন্তাও আসে নি প্রতিষ্ঠানের মনে। তাছাড়া, রবীন্দ্রনাথ এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের মনের মতো করে গড়বার সুযোগও পান নি কখনও। কারণ এখানকার পাঠ শেষ করে ছাত্রদের পাস করতে হত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা। ইংরেজিতে ভাল দখল না থাকলে প্রবেশিকা পরীক্ষার উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব ছিল না। এখানে অন্ততঃ ছয়-সাত বৎসর পড়ে দুটি অতি মেধাবী ছাত্র আমাদের ইস্কুলে এসে ভরতি হল নবম শ্রেণীতে। আমার সহপাঠী হিসাবে তাদের সঙ্গে আমার যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতা হয় তা অব্যাহত ছিল তাদের জীবনান্তকাল পর্যন্ত। দুই বৎসর তাদের সঙ্গে পড়ে খুব ভালো করেই জেনেছি শান্তিনিকেতন ইস্কুলে ইংরেজি-শিক্ষার মান আমাদের সরকারি জিলা স্কুলের (কুমিল্লা) মানের চেয়ে কিছুমাত্র কম ছিল না। এই গেল উপরের দিক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম মেনে সমান তালে না চললে এখানে বাইরের ছাত্র খুব কমই আসত। নীচের দিকেও তাই। প্রাথমিক স্তর থেকেই ইংরেজি না শেখালে সেই যুগে কেউ এখানে ছেলে পাঠাতেন না। এসব কারণে পাঠক্রম নিরূপণে রবীন্দ্রনাথের হাত-পা বাঁধা ছিল। কাজেই শান্তিনিকেতনে অনুসৃত পাঠক্রমের প্রসঙ্গ তুলে রবীন্দ্রকথিত শিক্ষাদর্শের প্রতিবাদ করলে তাঁর প্রতি সুবিচার করা হয় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাচিন্তা প্রসঙ্গে নিজের বিদ্যালয়ের কথা যে খুব কমই বলেছেন, এটা অহেতুক নয়। নিজের ইচ্ছানুরূপ শিক্ষাক্রম রচনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি, তৎকালীন নানা প্রতিকুল সামাজিক প্রভাবে! বিশ্বভারতীর আরও নানা বিভাগেই তাঁর ইচ্ছা ও চিন্তা প্রতিফলিত হতে পারে নি ওই একই কারণে।
তাহলে রবীন্দ্র-প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির বিশিষ্টতা বাকি রইল কি? রইল বই কি, অনেক কিছুই বাকি রইল। পাঠ্যপুস্তক-নির্বাচন ও শিক্ষাদান-প্রণালী, ছাত্রশিক্ষক-সম্পর্ক, চরিত্রগঠন ও জীবনচর্যার আদর্শ, প্রত্যেক ছাত্রের ব্যক্তিগত মেধা-বিকাশের আনুকুল্য ইত্যাদি। একমাত্র শিক্ষাদান-প্রণালী ছাড়া অন্য কোনো বিষয় বর্তমান গ্রন্থের বিবেচ্য নয়। বিদেশী শাসনাধীন ভারতে শিক্ষার সব স্তরে সব শিক্ষণীয় বিষয়েরই বাহন ছিল একমাত্র ইংরেজি ভাষা আর সে ভাষা শিখতে হত শিক্ষার প্রথম স্তর থেকেই। এই অস্বাভাবিক ব্যবস্থার ফলে একদিকে দেশব্যাপী জনশিক্ষার পথ অবরুদ্ধ হল আর অন্যদিকে দেশের অসংখ্য লোক উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল। ব্যাপক সুশিক্ষার অভাবে সমগ্র দেশের জনশক্তি তথা মনঃশক্তি বিকাশের কোনো সুযোগ থাকলো না। এই অশিক্ষাজনিত শক্তিহীনতাই বিদেশী শাসন-ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী হবার সহায়তা করেছে। এ কথা সত্য যে, এই কালে আমাদের দেশে অনেক মনস্বী ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু তা হয়েছে বিদেশী শিক্ষাব্যবস্থার গুণে নয়, হয়েছে ওই কৃত্রিম শিক্ষাব্যবস্থার বাধা লঙ্ঘন করে বহির্জগত থেকে আধুনিক জ্ঞানসম্পদ আহরণের প্রতিভাশক্তির গুণে। শিক্ষাব্যবস্থা যদি স্বাভাবিক তথা মেধাবিকাশের অনুকূল হত তাহলে ওই সময়ের মধ্যেই দেশে আরও অনেক বেশি শক্তিমান প্রতিভাধর ব্যক্তির আবির্ভাব হত। যা হোক, এসব কারণেই রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ অনেকেই ইংরেজির পরিবর্তে মাতৃভাষাকেই সর্ব স্তরে সব শিক্ষার, এমন কি ইংরেজি ভাষা শিক্ষারও বাহন করার প্রস্তাবকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে শিক্ষার নিম্নস্তরে (একেবারে প্রথম স্তর নয়) ইংরেজিও শেখাবার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল অভিভাবকদের আগ্রহে ও কালের দাবি মেটাবার প্রয়োজনে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি শেখাবার প্রণালীটা দিলেন বদলে, বাংলাকেই করলেন তার বাহন। কেননা, ইংরেজি যখন শেখাতেই হবে তখন সহজ স্বাভাবিক প্রণালীতেই শেখানো উচিত। কিন্তু বাংলাভাষার যোগে ইংরেজি শেখাবার উপযোগী বই তখন ছিল না। এজন্যই তাঁকে প্রথম ইংরেজি-শিক্ষার্থীদের উপযোগী বেশ কয়েকখানি পাঠ্যপুস্তকও লিখতে হয়েছিল। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণ হয় না যে, রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাশিক্ষার একেবারে গোড়া থেকেই ইংরেজি-শেখার পক্ষপাতী ছিলেন। বরং তার বিপরীত কথাই বারবার বলেছেন নানা উপলক্ষে। এই বইগুলির দ্বারা শুধু এটুকু প্রমাণ হয় যে, যে বয়সেই ইংরেজি শেখা আরম্ভ হোক এই প্রণালীতে শেখালেই ইংরেজি ভাষা সহজে ও স্বল্প সময়ে আয়ত্ত করা যাবে। আমিও তাই মনে করি। বস্তুতঃ আমি আমার বড় দুই কন্যাকে ইংরেজি শেখাতে শুরু করেছিলাম বাংলা-শিক্ষা অনেকখানি পাকা হবার পরে, শুরু করেছিলাম ‘ইংরেজি-সোপান’ (দুই খণ্ড) ও ‘ইংরেজি শ্রুতিশিক্ষা’ বই দিয়েই। তাতে সুফল পেতে দেরি হয় নি। (আমার অন্য ছেলেমেয়েদের শিক্ষারম্ভ হয় শান্তিনিকেতনেই।) এইজন্যই আমি মনে করি ‘ইংরেজি-সোপান’ প্রভৃতি সবগুলি বই পুনঃ-প্রকাশিত হওয়া এবং অনুরূপ আরও নূতন নূতন বই রচিত হওয়া উচিত দেশের ইংরেজি-শিক্ষার্থী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। তাতে দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার দ্রুততর হবে, কল্যাণ বৈ অকল্যাণ হবে না।
আজকাল আর-এক প্রশ্ন শোনা যায় – রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় ইংরেজি পড়েছিলেন কিনা। তিনি জন্মেছিলেন যে কালে, সেকালে দেশে চলছিল ইংরেজি-শিক্ষার প্রবল জোয়ার। আর যে পরিবারে তাঁর জন্ম সে পরিবার ছিল তৎকালীন শিক্ষাসংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। দ্বারকানাথ ও দেবেন্দ্রনাথ উভয়েই ছিলেন ইংরেজি বিদ্যায় অভিজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথের দাদাদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের ইংরেজি শিক্ষার কথা কারও অজানা নয়। আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তো শুধুই ইংরেজি নয়, ফরাসি সাহিত্যে ছিলেন কৃতবিদ্য। এই পরিবারে শুধু ছেলেদের নয়, মেয়ে-বউদেরও সযত্নে ইংরেজি শেখানো হত। এই পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি শিক্ষার স্পর্শলেশ-মুক্ত ছিলেন, এমন কথা কি কেউ ভাবতে পারেন? তাঁর নিজের লেখা থেকেই জানা যায়, বাড়ির পাঠশালায় অল্পকাল পড়ার পরেই তাঁকে ইংরেজি-ইস্কুলে ভরতি করা হয়। কিন্তু তাঁর শিশুমনে ইংরেজি শিক্ষার ছাপ পড়বার আগে অতি অল্প বয়সেই তাঁকে ভরতি করা হয় ‘নর্মাল স্কুল’ নামক বাংলা-বিদ্যালয়ে। এই ইস্কুলে তাঁকে ‘দীর্ঘকাল’ বাংলা শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ। এইজন্য উত্তরকালে তিনি তাঁর ‘সেজদাদার উদ্দেশ্যে সকৃতজ্ঞ প্রণাম’ নিবেদন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর স্পষ্ট মন্তব্য এই (‘জীবনস্মৃতি’, বাংলাশিক্ষার অবসান) – “ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতেছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিল। …… বাঙালির পক্ষে ইংরেজি-শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই”। কিন্তু নর্মাল স্কুলের শিক্ষা সম্পূর্ণ করার অর্থাৎ ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা পাস করার সুযোগ তিনি পান নি। কারণ তিনি যখন ইস্কুলে উচ্চতম ক্লাসের (‘ছাত্রবৃত্তি-ক্লাসের’) এক ক্লাস নীচে পড়ছিলেন, তখন তাঁর পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ একদিন আকস্মিকভাবে তাঁর ও তাঁর দুই সহপাঠীর (সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ) বাংলা পড়া বন্ধ করে দিলেন। কারণ সত্যপ্রসাদ সৌজন্যরক্ষার আগ্রহে বুদ্ধির দোষে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘প্রাকৃত বাংলায়’ কথা না বলে ‘সাধু গৌড়ীয় ভাষায় বাক্যবিন্যাস’ করেছিলেন। তাতেই দেবেন্দ্রনাথের মনে হল বাংলা-বিদ্যালয়ে পড়ার ফলে তাঁদের বাংলাভাষা তার বাংলাত্বকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে এ কথা স্বতঃই মনে হয়, এ ভাবে হঠাৎ তাঁদের বাংলাশিক্ষা বন্ধ না করলেই বোধ হয় ভালো হত। কারণ সত্যপ্রসাদ ও দেবেন্দ্রনাথ, দু-জনেরই ভুল ধারণার ফলে রবীন্দ্রনাথের বাংলাশিক্ষার পালা এমন হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। তার ফলও যে ভালো হয় নি তা জানা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ থেকেই। তাঁর বাংলাশিক্ষা যথারীতি সমাপ্ত করার সুযোগ পেলে বালক রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাবৃদ্ধি আরও পাকা হত কি হত না তা বলা যায় না; কিন্তু নর্মাল স্কুল ও ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষার ঐতিহাসিক গৌরব যে বাড়ত তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
রবীন্দ্রনাথের বাংলাশিক্ষার পালা হঠাৎ শেষ হয়ে যাবার পরে তাঁকে (এবং তাঁর দুই সহপাঠীকে) বেঙ্গল একাডেমি নামের এক ‘ফিরিঙ্গি স্কুলে’ ভরতি করে দেওয়া হল। এ বিষয়ে তাঁর উক্তি এই (‘শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ’ – “ইংরেজি-বিদ্যালয়ে প্রবেশের অনতিকাল পরেই আমি ইস্কুলমাস্টারের শাসন হতে ঊর্দ্ধশ্বাসে পলাতক।” তা সত্বেও তাঁর ইংরেজিশিক্ষা বাড়িতেই চলতে থাকে তাঁর গৃহশিক্ষক, পিতা ও দাদাদের সযত্ন চেষ্টায় এবং তাঁর নিজের আন্তরিক আগ্রহে। তাঁর এই ইংরেজিশিক্ষার বিবরণ টুকরো-টুকরো ভাবে ছড়িয়ে আছে তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থের নানা অধ্যায়ে। বর্তমান প্রসঙ্গে দুটি-মাত্র তথ্য (‘নানা বিদ্যার আয়োজন’) স্মরণীয় – “বাংলাশিক্ষা যখন বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে তখন আমরা ইংরেজি শিখিতে আরম্ভ করিয়াছি। …… প্যারি সরকারের প্রথম-দ্বিতীয় ইংরেজি পাঠ কোনোমতে শেষ করিতেই আমাদিগকে মকলকস কোরস অফ রিডিং শ্রেণীর একখানা পুস্তক ধরানো হইল।” এ ভাবেই রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি-শিক্ষা শুরু হয়েছিল গৃহশিক্ষক অঘোরবাবুর কাছে। তখন তাঁর বয়স ছিল এগারো বা বারো বছর। ‘শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ’ প্রবন্ধে নর্মাল স্কুলের শিক্ষা-প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন – “শিক্ষার আদর্শ ও পরিমাণ বিদ্যা হিসাবে তখনকার ম্যাট্রিকের চেয়ে কম দরের ছিল না। আমার বারো বছর বয়স পর্যন্ত ইংরেজি বর্জিত এই শিক্ষাই চলেছিল।” এই প্রবন্ধেই অন্যত্র বলা হয়েছে – “অন্ততঃ এগারো বছর বয়স পর্যন্ত আমার কাছে বাংলাভাষার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না”। এই দুই উক্তি থেকে মনে হয়, নর্মাল স্কুলে বাংলা-শিক্ষার পালা শেষ হবার একবছর আগেই তাঁর ইংরেজি শেখা শুরু হয়েছিল গৃহশিক্ষক অঘোরবাবুর কাছে। আধুনিক কালের হিসাবে তখন তিনি ছিলেন ইস্কুলের অষ্টম মানের ছাত্র।
সবশেষে তাঁর আর-একটি উক্তি (‘শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ’) স্মরণ করছি – “ভাগ্যবলে অখ্যাত নর্মাল স্কুলে ভরতি হয়েছিলুম। তাই বুঝেছি – মাতৃভাষায় রচনার অভ্যাস সহজ হয়ে গেলে তারপরে যথাসময়ে অন্য ভাষা আয়ত্ত ক’রে সেটাকে সাহসপূর্বক ব্যবহার করতে কলমে বাধে না”।
কেউ কেউ মনে করেন ইংরেজি-শিক্ষার গুণেই তিনি সে ভাষা প্রয়োগে অসাধারণ নৈপুণ্য অর্জন করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে কিন্তু মনে করতেন, যথারীতি ইংরেজি-শেখার ভালো সুযোগ না পেয়েও তিনি যে দেশে-বিদেশে অনায়াসেই ইংরেজি ভাষা প্রয়োগ করে এসেছেন তার মূলে আছে ভালো বাংলা-শেখার প্রবর্তনা। এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের কথা এই – “ইস্কুল-পালানো অবকাশে যেটুকু নিজের খুশিতে ব্যবহা্র করে থাকি। তার প্রধান কারণ – শিশুকাল থেকে বাংলাভাষায় রচনা করতে আমি অভ্যস্ত। ……… আমার ইংরেজি-শিক্ষার সেই আদিম দৈন্য সত্বেও পরিমিত উপকরণ নিয়ে আমার চিত্তবৃত্তি কেবল গৃহিণীপনার জোরে ইংরেজি-জানা ভদ্রসমাজে আমার মান বাঁচিয়ে আসছে। নিশ্চিত জানি, তার কারণ – শিশুকাল থেকে আমার মনের পরিণতি ঘটেছে কোনো ভেজাল-না-দেওয়া মাতৃভাষায়।” তাঁর সুস্পষ্ট উক্তির পরে এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণের আর কোনো অবকাশ থাকতে পারে বলে মনে করি না।
Tags: education, Rabindranath Tagore, প্রবোধচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।