যদি বলি ঈশ্বরচন্দ্র এক নম্বরের একগুঁয়ে ছিলেন তাহলে বোধহয় তা মোটেই অতিশয়োক্তি হবেনা। কারণ তাঁর স্বভাবে ওই গুনটি না থাকলে তখনকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা পালন করতে পারতেন না। যে সমাজে নারী জাতির বাইরে বেরোনোয় মানা ছিল সেই সমাজে তিনি একের পর এক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাছাড়া বাল্যবিবাহ, কুলীন প্রথা ইত্যাদি নানা কুপ্রথা প্রচলিত ছিল সমাজে। বাল্য বিবাহের সংগে জড়িত ছিল বাল্য বৈধব্য। বাল্য বিধবাদের পুনর্বিবাহ সংঘটিত করার জন্য আইন পাশ করার সুপারিশ করেছিলেন বিদ্যাসাগর এবং সে কাজে সাফল্য লাভ করেছিলেন। এই ধরনের একগুঁয়ে মানুষের অভিমানী হওয়াটাও বিচিত্র নয়। তাঁর অভিমানের প্রকাশ দেখতে পাই পিতাকে লিখিত বিদ্যাসাগরের এক চিঠিতে। তিনি লিখেছেন –
“সাংসারিক বিষয়ে আমার মত হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপ্রনে যত্ন করিয়াছি, কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি সে বিষয়ে কোন অংশে কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। যে সকলকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা পায়, সে কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারে না – প্রাচীন এই কথা কোনো ক্রমেই অযথা নহে, সংসারী লোকে যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষা করে, তাহাদের একজনেরও অন্তঃকরণে যে আমার উপর দয়া ও স্নেহের লেসমাত্র নাই সে বিষয়ে আমার অনুমাত্র সংশয় নাই। এরূপ অবস্থায় সাংসারিক বিষয়ে লিপ্ত থাকিয়া ক্লেশ ভোগ করা নিরবচ্ছিন্ন মূর্খতার কর্ম। যে সমস্ত কারণে আমার মনে এরূপ সংস্কার জন্মিয়াছে, আর তাহার উল্লেখ করা অনাবশ্যক”।
কেন এত অভিমান তা অনুধারন করতে ফিরে যেতে হয় ঘটনাচক্রের অন্দরমহলে। সমাজের জন্যে তো তিনি কম কিছু করেননি। করেছেন আত্মীয় স্বজনের জন্যেও। তবুও তাঁকে কেন বীরসিংহ গ্রাম ছাড়তে হল? চলে যেতে হল বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে?
প্রথমে তিনি শাস্ত্র অধ্যয়ন করে জানলেন বিধবা বিবাহ শাস্ত্র বিরুদ্ধ নয়। সমাজে বিধবা বিবাহ চালু করার মানসে আইন পাশ করানোর জন্য তৎকালীন ইংরেজ সরকারের দ্বারস্থ হলেন। অনেক চেষ্টা চরিত্র করার পর লর্ড বেন্টিক কর্ত্তৃক ১৮৫৬ সালের ২৬ শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। আইনটির নাম Act XV of 1856, being an act to remove all legal obstacle to the marriage of Hindu Widows.
ঠিক হয় অগ্রহায়ন মাসের ১০ তারিখে আইন সম্মতভাবে প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হবে। পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী কালীমতী দেবী।
এদের বংশপরিচয় কী? উভয়েই সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান।
শ্রীশচন্দ্র ন্যায়রত্ন ভট্টাচার্য মহাশয় রামধন তর্কবাগীশ ভট্টাচার্য মহাশয়ের পুত্র। রামধন তর্কবাগীশ মহাশয় অদ্বিতীয় রূপে কথকতার ব্যবসা করতেন। সাত-আটশো ভদ্র ব্রাম্ভণ তাঁহার বাড়ীতে অন্নভোজন করতেন। শ্রীশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য সংস্কৃত কলেজে সর্বশাস্ত্রে পন্ডিত। সরকার তাঁহাকে সুপন্ডিত জেনে কয়েক জেলায় পন্ডিতকর্মে নিয়োগ করেন ।
পাত্রী কালীমতী দেবী শ্রীমতী লক্ষ্মীমনি দেবীর বিধবা কন্যা। লক্ষ্ণীমনির পিতার নাম আনন্দচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি শান্তিপুরের নাম করা ব্যক্তি। লক্ষ্ণীমনি দেবীর স্বামীর নাম ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়। তিনি বর্ধমানের পলাশভান্ডার একজন মহৎ ব্যক্তি। ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায় বহু অর্থ ব্যায় করে হরমোহন ভট্টাচার্য্যের সহিত কালীমতীর বিবাহ দেন কন্যার চার বছর বয়সে। হরমোহন ভট্টাচার্য্যের পিতা রুক্মিনীপতি ভট্টাচার্য্য। হরমোহনের বাড়ী কৃষ্ণনগরের বাহিরগাছি গ্রামে। পাত্র অতি নাম করা বৎশের সন্তান। নবদ্বীপ রাজবংশের মাল্যবর গুরুগোষ্ঠী। কালীমতী ছয়বৎসর বয়সে পতিহীনা হন। লক্ষ্মীমনি পিতা ও স্বামীর সমস্ত বিষয় প্রাপ্তা হন। তাঁহার এবং কন্যার দুই তিন সহস্র টাকার গহনা ও ছিল। লক্ষ্মীমনি দুঃখিনী নহেন। একমাত্র কন্যা শিশুবয়সে বিধবা হওয়াতে, কন্যার বৈধব্য তাঁকে যন্ত্রনা দিত। দিবারাত্রি কান্নাকাটি করতেন। যখন বিধবাবিবাহের আন্দোলন হতে থাকল তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেন রাজবিধি চালু হলে কালীমতীর পুনরায় বিবাহ দেবেন। যখন বিধবাবিবাহ আইন পাশ হল তখন লক্ষ্মীমনি গন্যমান্য ব্যাক্তিদের কাছে জানালেন উপযুক্ত পাত্র পেলে কালীমতীর বিবাহ দেবেন। কন্যার ভাগ্যে শ্রীশচন্দ্র পাত্রও জুটে গেল।
কিন্তু অগ্রহায়ন মাসের ১০ তারিখে বিবাহ সম্পন্ন হতে পারলনা শ্রীশচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের মাতা ঠাকুরানীর বাধায়। তিনি বললেন “শ্রীশচন্দ্র যদি বিধবা বিবাহ করেন তাহলে তিনি ছুরি দিয়া গলা কাটিয়া আত্মহত্যা করিবেন”। সেই কারনে ১০ তারিখ তো গেলই , ১৫ তারিখেও বিবাহ সম্পন্ন হল না। পরে শ্রীশচন্দ্র মাতাকে শান্তনা দিয়ে এবং ভাইদের অনুমতি নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ২৩ শে অগ্রহায়ন (৭ই ডিসেম্বর) সম্ভ্রান্ত হিন্দু বংশে বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হল। ঐ বিয়েতে তখনকার দিনে খরচ হয়েছে প্রায় দশহাজার টাকা।
অবশ্য বাংলার প্রথম বিধবা বিবাহ শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের নয়, ডিরোজিও শিষ্য ইয়ংবেঙ্গলের সদস্য রাজা দক্ষিনারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের। পাত্রী বর্ধমানের বিধবা রানী বসন্তকুমারী দেবী।
বিদ্যাসাগরের হস্তক্ষেপে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিধবা বিবাহ করার পর দিনই মধুসূদন ঘোষ বিধবা বিবাহ করেন। পাত্রীর নাম থাকমনি।
১৮৫০ সাল থেকে চেষ্টা করে বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আইনটি চালু করাতে পেরেছিলেন ১৮৫৬ সালে। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ এই ১২ বছরে বিদ্যাসাগর নিজেই ৬০ জন বিধবার বিয়ে দেন এবং এর জন্যে খরচ হয়েছিল তখনকার দিনে ৮২ হাজার টাকা।
এত কান্ডের পরেও একটি বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে আত্মীয়দের সংগে বিদ্যাসাগরের মনোমালিন্য হয়। পাত্র কেচকাপুর স্কুলের প্রধান পন্ডিত শ্রীযুক্ত মুচিরাম বন্দোপাধ্যায়, বাড়ি ক্ষীরপাই। পাত্রী শ্রী কাশীনাথ পালধির কন্যা শ্রীমতী মনোমোহিনী দেবী। বাড়ি কাশীগঞ্জ।একসময় ক্ষীরপাহী নিবাসী হালদার বাবুরা ছিলেন বিধবা বিবাহ বিরোধী। উক্ত বিবাহের সংবাদ অবগত হয়ে হালদার বাবু বিদ্যাসাগরের কাছে সকাতরে প্রার্থনা জানান মুচিরামের এই বিবাহ যেন না হয়। বিদ্যাসাগর হালদার বাবুর প্রার্থনা পূরন করতে রাজি হন। অগত্যা মনোমোহিনীকে বিদ্যাসাগরের বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হয়। তিনি কাছেই সনাতন বিশ্বাসের বাড়ি আশ্রয় নেন। সেখানে মনোমোহিনী কে নিয়ে যান বিদ্যাসাগরের আত্মীয় ভ্রাতা দীনবন্ধু ন্যায়রত্নের পুত্র গোপাল চন্দ্র, রাধানগরের কৈলাশ চন্দ্র মিশ্র এবং বিদ্যাসাগরের আর এক ভাই ঈশান চন্দ্রের পরামর্শে। শম্ভুচন্দ্র( শম্ভুচন্দ্র, দীনবন্ধু, ঈশানচন্দ্র তিন ভাই) আর রাধানগরের চোধুরীবাবুদের নায়েব উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের কাছে বসেছিলেন। বিদ্যাসাগরের ইচ্ছায় শম্ভুচন্দ্র লোক পাঠিয়ে সনাতন বিশ্বাসকে ডেকে পাঠালেন। সনাতন বিশ্বাস তাঁর বাড়ি থেকে মনোমোহিনীকে বের করে দিতে রাজি হলেন না। উমেশচন্দ্র সনাতনকে বললেন, তোমরা এর মাসোহারা খাও, এর একটা কথা শুনলে না? সনাতন বিশ্বাস উত্তর দিলেন, আমরা পুরুষানুক্রমে কৈলাশ মিশ্রের বাড়িতে চাকরি করে আসছি। তিনি নিজে আমাকে এই মাত্র বললেন, ‘তুমি মেয়েটিকে তোমার বাড়িতে রাখো, কারো কথায় বের করে দিও না। আমি কাল সন্ধ্যার আগে এসে এই বিধবার বিবাহ দেব। আমি কোনমতে তাঁর কথার অবাধ্য হতে পারব না। বরং যে ক’টাকা মাসোহারা দিয়েছেন তা ফেরৎ দিতে রাজি আছি।’
গোপালচন্দ্র এবং ঈশানচন্দ্র চাঁদা করে এই বিবাহের আয়োজন করলেন। বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল। ১২৭৬ সালের আশ্বিনে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা লিখছে, সম্প্রতি জাহানাবাদের একটি বিধবা বিবাহ হইয়াছে। বর কোচকাপুর হাই স্কুলের প্রধান পন্ডিত শ্রীযুক্ত মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, নিবাস ক্ষীরপাই। পাত্রী কাশীগঞ্জ নিবাসী শ্রী কাশীনাথ পালাধির কন্যা শ্রীমতী মনোমোহিনী দেবী।
পরবর্তীকালে ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিদ্যাসাগরের নামে অভিযোগ করেন, “মুচিরামের বিবাহের সময় উক্ত বিবাহ ন্যায্য এবং শাস্ত্র সম্মত স্বীকার করিয়াও বিধবাবিবাহ বিদ্বেষী ক্ষীরপাই নিবাসী হালদার বাবুদের অনুরোধে (বিদ্যাসাগর) পশ্চাৎপদতার ও কাপুরুষতার পরিচয় দিয়া ক্ষান্ত হয়েন নাই বরং ঐ সময়ে তিনি ঐ বিবাহের প্রতি যারপরনাই বিদ্বেষভাব পোষন করিয়াছেন”।
বিবাহের পরদিন সকালে বিদ্যাসাগর ঈশানচন্দ্রকে বললেন, ঈশান কেন তুমি বিবাহ দেওয়ালে, এতে আমার বড় অপমান হয়েছে।
ঈশান বললেন, কৈলাশ মিশ্র ও আমি গত পরশু আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, এই বিধবাবিবাহ ন্যায্য কিনা? আপনি উত্তর দিয়েছেন, এ শাস্ত্র সম্মত স্বীকার করি, কিন্তু হালদারবাবুদের মনে দুঃখ হবে। লোকের খাতিরে এই সকল বিষয়ে ক্ষান্ত হওয়া আপনার মত মানুষের পক্ষে দোষের কথা।
বিদ্যাসাগর রাগ করে বললেন, তুই কি এখনো সেইরূপ দুর্মুখ আছিস এবং এইরূপই কি চিরকাল থাকবি?এরপরই বিদ্যাসাগর চিরদিনের জন্য বীরসিংহ ত্যাগ করলেন।
কলকাতায় আসার সময় ভাইদের আর সম্ভ্রান্ত গ্রামবাসীদের বললেন, ‘তোমরা আমাকে দেশত্যাগী করালে’।
এরপর জীবনে আর কোনদিন বীরসিংহ যাননি। জীবন শেষ করেছেন কর্মাটারে।
অনেক ভাল কাজ করার পরেও হালদার বাবুদের কথায় কেন যে মুচিরামের বিয়েটা ভেঙে দিতে যাচ্ছিলেন তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। শম্ভুচন্দ্র, দীনবন্ধু, ঈশানচন্দ্র গোপাল চন্দ্র, কৈলাশ মিশ্র, সনাতন বিশ্বাসরা তাঁর এই কাজ মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা এই বিবাহ সুসম্পন্ন করেছেন আর তাতেই তাঁর মর্যাদায় ঘা লেগেছে। অভিমানে সারা জীবনের জন্য তিনি দেশছাড়া হয়েছেন।
তথ্য সহায়তাঃ দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর- ইন্দ্রমিত্র
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।