গল্পের সময় ডেস্কঃ নিজের ভেতর কোনও দুঃখ না থাকলে কোনও লেখক পরিপূর্ণ লেখক হয়ে উঠতে পারেন না – এমনটাই বিশ্বাস করতেন সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়।একটি বিখ্যাত সংবাদপত্রের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেছিলেন – দুঃখ আছে বলেই তো লিখি। সত্যিই সারাটা জীবন অনেক রকমের দুঃখের সঙ্গে লড়াই করে কাটিয়ে গেছেন মানুষটা। দেশভাগ হতেই ছিন্নমূল মানুষ হয়ে চলে আসেন এখানে। বেঁচে থাকার, জীবনকে টেনে নিয়ে চলার জন্য সে এক লড়াই। দেশভাগ, চোখের সামনে সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া, এপার বাংলা–ওপার বাংলা, মানুষের সম্পর্ক এসব নিয়েই অমৃত পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিলেন ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’। প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া পড়ে যায় পাঠক মহলে। পরবর্তীকালে এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে প্রকাশিত বিখ্যাত সব সাহিত্যকর্মের মাঝে জায়গা করে নিয়েছে। তার আগে তিনি লিখেছেন ‘সমুদ্রমানুষ’ উপন্যাস। লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। তার লেখালিখি সাহিত্যের জগতে পরিচিতি এনে দিলেও সেভাবে সুস্থিতি দেয়নি। তাইতো লেখালিখির সঙ্গেই একটা সময় প্রবলভাবে করতে হয়েছে অর্থ উপার্যনের চিন্তা। করেছেন শিক্ষকতার চাকরি, জাহাজে কোলবয়ের চাকরি, কাশিমবাজার রাজবাড়িতে চাকরি, কালার প্রিন্টিং প্রেসে চাকরি, যুগান্তর পত্রিকায় সাব এডিটরের চাকরি। এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছেন – সংসার খরচের জন্য টাকার দরকার – তাই লিখতে হতই। কেউ লিখতে বললেই বলতাম কত টাকা পাব? … রেশনের টাকা এসেছে লেখা থেকেই। এই কষ্টই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। এমনকি সিনেমার খবরে ভরপুর ‘যৌবন’, ‘উল্টোরথ’, ‘জলসা’ পত্রিকাতেও।
নিজের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে সাহিত্যিক বিমল করের বড়সড় উৎসাহ ছিল বলে বারবার স্বীকার করেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বিমল করই ‘ আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা’ গ্রন্থে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন – ‘অতীনের কাছে গল্প শুনেছি তার বাড়ি ছেড়ে পালানোর। তখন আর কতই বা বয়েস, উনিশ কুড়ি বড় জোর। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকতে পারেনি, আবার ফিরে এসেছে। খুঁজে বেড়িয়েছে আশ্রয় আর অন্নসংস্থানের উপায়। হরেক রকম অভিজ্ঞতা তার তখন, কখনও ধূপ বিক্রি, কখনও চায়ের স্টলে কাজ, কখনও কোন ব্যান্ডেজের কাপড় তৈরি করা, তাঁতীদের সঙ্গে তাঁত চালানো।এই করেই জীবন চলতে লাগল; তারপর খানিকটা আচমকা, বরাত জোরে ঢুকে গেল কিসের এক জাহাজী ট্রেনিংয়ে। সেখান থেকে চড়ল জাহাজে, জলে ভাসল। কোল-বয়ের চাকরি, মানে যাকে সোজা বাংলায় বলে বেলচা করে কয়লা বোঝাইয়ের কাজ। এই জাহাজ অতীনকে গোটা না হোক অর্ধেক পৃথিবী ঘুরিয়েছে। তার বেশিও হতে পারে। মাসের পর মাস তার কেটেছে জলে। সমুদ্র তাকে কোন সান্তনা দিয়েছে কে জানে। তবে অজস্র জিনিস দেখেছে অতীন যা সাধারণ বাঙালী ঘরের ছেলের সাধারণত দেখা হয় না।’
সত্যিই মানুষের জীবনকে দেখার অন্যরকম চোখ ছিল অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেই চোখ, সেই অনুভব দিয়েই একের পর এক লিখে গেছেন ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’, ‘দেবীমহিমা’, ‘জনগণ’, ‘মানুষের ঘরবাড়ি’র মত মন, সমাজ, নারী-পুরুষের যৌনতার প্রসঙ্গ উঠে আসা উপন্যাস।
বিমল কর লিখেছেন ‘অতীনের প্রথম গল্প যা দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তার নাম আমার মনে পড়ছে না। বোধহয় গল্পটির নাম ছিল ‘রূপক মাত্র’। তবে ওর বেশ কিছু গল্প, যেমন ‘এক বর্ষার গল্প’, ‘রাজার টুপি’ গোড়ায় গোড়ায় যা লিখেছে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। সত্যি বলতে কী, একেবারে অন্য স্বাদের লেখা। মাঝে মাঝে মনে হয়, ও কি বিভূতিভূষণের চেলা। লেখার মধ্যে ফড়ুই গাছ, পিটকিলা গাছ, বোন্না, লটকন, টুনিফুল – শুধু গাছ পাতা ফুল আর পাখি।’
আবার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন ‘… আজ অতীনের সাহিত্যিক হিসেবে প্রচুর খ্যাতি। কোনো কোনো বই – সকলেই জানেন, যত প্রশংসা পেয়েছে, তার সমসাময়িক অনেক লেখকের বই তেমনটি পায়নি। ধরে নেওয়া যাক অতীনের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসটির কথা, কিম্বা ‘অলৌকিক জলযানে’র কথা। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ অতীনের সেরা লেখা বলে অনেকেই মনে করেন। আমার নিজেরও মনে হয়। অতীনের এই লেখাটা যেন তার ভেতর থেকে উঠে এসেছে। আমরা যাকে বলি ভর পাওয়া লেখা, নীলকণ্ঠ হল তাই। এর মধ্যে অতীনের সত্তা ডুবে আছে।’
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।