১
শিঞ্জিনী ক্লাস ইলেভেনে সদ্য ভর্তি হয়েছে। ইলেভেনের একমাত্র স্টুডেন্ট যাকে বাড়ির লোক দিয়ে যায়-নিয়ে যায়। ও শান্তশিষ্ট। কিন্তু চাউনিতে অনেক কোলাহল। হাসলেই গালে টোল খায়। আর সেটা দেখতে গিয়ে আলাপ এপি-জিপির ফর্মূলা ভুল করে। শিঞ্জিনীকে আরও অনেকে দেখে — বিশেষ করে সাহিল। ক্লাসের ফার্স্ট বয়। দাঁতটা সামান্য উঁচু। রোগাপ্যাংলা চেহারা। সবাই বকমামা বলে ডাকে। ওর লোলুপ চোখে নজরদারি করতে গিয়ে আলাপ ঝুপ করে ওর মনের ভিতরে ঝাঁপ দেয়। দেখে, সাহিল শিঞ্জিনীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। কানাঘুষোয় শুনেছে শিঞ্জিনী আগে শিলিগুড়ি থাকত। ওর বাবা ট্র্যান্সফার হয়ে কলকাতায় ফিরেছে। তাই শিঞ্জিনীর এ-ই স্কুলে ভর্তি হওয়া। শিঞ্জিনী দেখতে সুন্দর বলেই হয়ত বাড়ির লোক এত সতর্ক। যার জন্য ইচ্ছে থাকলেও ওর সাথে জমিয়ে আলাপ করার মওকা পায় না আলাপ। হাফ-ইয়ারলি এগজামে ধেড়িয়েছে। বাড়িতে কথা শুনেছে। বুঝেছে এভাবে চলবে না। একটা এসপার ওসপার করতেই হবে। শিঞ্জিনীকে ফেসবুকে সার্চ করে দেখেছে, পায়নি। ক্লাসে কখনো-সখনো মুহূর্তের জন্য একলা পেলেও ঝট করে ওসব কথা বলার মত সাহস আলাপের নেই।
বইয়েই পড়েছিল, এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়্যার। নাম্বারটা পেল সৌমির কাছ থেকে। জানত ক্লাসের মধ্যে একমাত্র সৌমির সঙ্গে ওর নিয়মিত যোগাযোগ, সুতরাং সৌমির কনট্যাক্ট লিস্টে নিশ্চই শিঞ্জিনীর নাম্বার থাকবে। একদিন সৌমির মোবাইলটা দেখার ছুতোয় নাম্বারটা ঝেড়ে নিল।
বাড়িতে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দুরু দুরু বুকে শিঞ্জিনীর নামটা বার করল, কিন্তু কল করতে পারল না। বলতে গিয়ে যদি খোরাক হয়ে যায়! মাথায় এল, হোয়াটস অ্যাপ! বলার চেয়ে লেখা সহজ। তোতলানোর কোনও সিন নেই। শব্দ ও ভাষার সিঁড়ি সাজিয়ে পৌঁছে যাবে ওর কাছে। এমন কিছু লিখবে যা শিঞ্জিনী বারবার পড়বে ও ভাববে। তখন খারাপ ছেলে বলে দাগিয়ে দিতে পারবে না। অনেক কাটাকুটি ও যোগবিয়োগের পর টাইপ করল– শিঞ্জিনী আমি আলাপ। তুই হয়ত মেসেজটা পেয়ে অবাক হবি। যদি ভুল কিছু করে থাকি প্লিজ মাইন্ড করিস না। তোকে আমার ভালো লাগে। তোকে দেখার পর থেকে ভালো করে ঘুম হয় না। পড়াশুনোতেও মন নেই। উত্তরের অপেক্ষায় থাকব। আর হ্যাঁ প্লিজ কাউকে বলিস না, সৌমিকেও না। প্লিজ!
পাঠিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত থেকেই বুকে ঢিব-ঢিব শব্দ। আফ্রিকার জংগলে জংলী মানুষগুলো ড্রাম পেটাচ্ছে যেন। ব্লান্ডার করল না তো! উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে রইল মোবাইলের স্ক্রিনে। জোড়া টিক চিহ্ন নীল হয়ে গেছে। হোয়াটস-অ্যাপ দেখাচ্ছে, শিঞ্জিনী ইজ রাইটিং….। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা শব্দ। হোয়াটস-অ্যাপের নোটিফিকেশন টোন। এত জোরে আগে কখনও শোনেনি আলাপ। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা জিফ। টাচ করতেই একটা লাল রঙের হার্ট ছোট থেকে বড় হয়ে শেষে খন্ড-খন্ড হয়ে সারা স্ক্রিন জুড়ে ফুল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। আনন্দে ফোনটা ঠোঁটের মধ্যে চেপে চুমু খেল আলাপ। শিঞ্জিনী এত তুরন্ত সাড়া দেবে তার কাছে আশাতীত। আবার টাইপ করল, থ্যাংক ইউ শিঞ্জিনী! আবার একই রিপ্লাই এল– একটা হার্ট ছোট থেকে বড় হয়ে যাচ্ছে, তারপর ফেটে যাচ্ছে, ফুল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আলাপের অ্যাদ্দিনের গুমোট মনে মুহূর্তেই বাতাসের আনাগোনা। অনেকদিন বাদে ফাটাফাটি ঘুম হল।
পরদিন শিঞ্জিনী যথারীতি ডানদিকের রো-তে দ্বিতীয় সারিতে সৌমি ও অলিভিয়াদের পাশে বসেছিল। আলাপ সাধারণত তৃতীয় সারিতে পাশের রো-তে বসে। ডানদিকে তাকালেই শিঞ্জিনীকে একটু পিছন থেকে দেখতে পায়। শিঞ্জিনী মনোযোগী ছাত্রীর মত পড়া শুনছিল। আর ওর কানের পাশের একটা-দুটো চুল জানলা দিয়ে বয়ে আসা বাতাসে পাক খেতে খেতে মাঝে মাঝে ওর গালে বসে তিরতির করে কাঁপছিল। পিরিয়ডের ফাঁকে পলকের জন্য বেণী দুলিয়ে আলাপের দিকে চোখ ফেলল। চোখাচোখি হতেই মুচকি হাসল। আলাপও হাসল। সংযম ছিল সেই হাসিতে, কারণ ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি মার্কেটে ছাড়বে না আলাপ। যদিও মনে তখন খুশির তুফান। বুকের মধ্যে পাইনের বনে ঝোড়ো হাওয়ার শ-শ শব্দ।
পরদিন শিঞ্জিনী হঠাৎ অ্যাবসেন্ট। ওকে দেখতে না পেয়ে ছটফট করছিল আলাপ। বাড়ি ফিরে মেসেজ করল–এলি না কেন?
উত্তর পেল না। সারা সন্ধ্যা অপেক্ষা করল। মন খারাপ হলেই খোলা ছাদে গীটার বাজায় আলাপ। গীটারে সুর তুলল, এলভিস প্রিসলে! আই ক্যান্ট হেল্প ফলিং ইন লাভ..। সারারাত ছটফট করল। ভোরের দিকে চোখের পাতায় মিল হল। সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠেই দেখে শিঞ্জিনীর মেসেজ। আবার সেই জিফ। রাতের কষ্ট নিমেষে উবে গেল।
তাড়াতাড়ি স্কুলে পৌঁছে গেল। সবাই এল একে একে। শিঞ্জিনী আবার এল না। টিফিন পিরিয়ডে ভাবছিল সৌমিকে একবার জিজ্ঞেস করে। আলাপ ওকে ক্লাস ওয়ান থেকে চেনে। খুব ভালো বন্ধু আলাপের, কিন্তু ভীষণ ছ্যাবলা টাইপের। বললেই ক্যাচটা মাটিতে পড়তে দিত না–কী ব্যাপার আলাপ? ড্রিংকিং ড্রিংকিং সিংকিং ওয়াটার? হা-হা হি-হি করে এমন সিন-ক্রিয়েট করত, তার থেকে না করাই ভালো। মুখ হাঁড়ি করে বাড়ি এল।
মেসেজ করল–আর ইউ ওকে শিঞ্জিনী ?
উত্তরে আবার সেই জিফ, সেই হার্ট!
পালটা মেসেজ করল–শিঞ্জিনী প্লিজ বল তুই আসছিস না কেন?
উত্তর এল। জিফ।
শিঞ্জিনী কিছুতেই একটা শব্দও খরচ করছে না। খালি একই জিফ পাঠিয়ে যাচ্ছে। ও আলাপকে নিয়ে মজা করছে না তো! কিন্তু শিঞ্জিনীকে দেখে কখনই মনে হয় না ও এমন করতে পারে। রোল নাম্বার টুয়েন্টি সিক্স কল করার আগে মধুমিতা ম্যাম একবার ওইদিকে তাকালেন– যেখানে শিঞ্জিনী বসে। তারপর সরাসরি টুয়েন্টি সেভেন কল করলেন। ম্যামের হাবভাব দেখে মনে হল উনি যেন জানতেন শিঞ্জিনী আসবে না। তবে ও কি কোথাও বেড়াতে গেছে? কিন্তু এই অসময়ে তো সচরাচর কেউ যায় না। শিঞ্জিনী কি স্কুল ছেড়ে দিল? তাই-বা দেবে কেন! সামনেই তো অ্যানুয়াল। ও স্পষ্ট করে কেনই বা বলছে না? আলাপের মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। সাহিল, ডিসুজাদের মুখের জিওগ্রাফিও বেঁকেচুরে অস্ট্রেলিয়া। এত কষ্টেও এ-ই ভেবে একটু মজা পাচ্ছিল আলাপ যে, ওরা যখন জানতে পারবে শিঞ্জিনী ইতিমধ্যেই আলাপের সাথে এনগেজড তখন ওদের মনের অবস্থা কী হবে!
শিঞ্জিনী এরপরও বারো দিন স্কুলে আসেনি। ওর অনুপস্থিতি এবার আর আলাপের একার সমস্যা নয়। ওকে নিয়ে সারা ক্লাসেই গুঞ্জন। কী হয়েছে ওর? কেউই সঠিক বলতে পারছে না। সৌমি বলল ও নাকি শিঞ্জিনীকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। কিন্তু নো রিপ্লাই। এই বারোদিন ধরে আলাপও ওকে অনেক মেসেজ করেছে কিন্তু শিঞ্জিনী উত্তর দেয়নি। মরিয়া হয়ে ফোনও করেছিল। ধরেনি।
২
সোমবার আশায় আশায় স্কুলে গেছে আলাপ। সেদিন ফেব্-ফর্টিন। ভ্যালেন্টাইন ডে। ওর পকেটে লেকমার্কেট থেকে কেনা একটা ছোট্ট গিফট। গোল্ড প্লেটেড হার্ট রিং। ছোট্ট লাল রঙের ভেলভেট বক্সের ভেতর। পকেটে রুমালে মোড়া ছিল। সুযোগ মত ওকে দিয়ে দেবে। কিন্তু স্কুলে পৌঁছেই খবরটা পেয়ে আলাপ প্রায় সংজ্ঞাহীন। শিঞ্জিনী নেই। নেই মানে নেই। আর কোনওদিন আসবে না। হাজার ডাকলেও না। কেমিস্ট্রির পলাশ স্যার পড়াবার ফাঁকে ফাঁকে জোকস বললে সবাই হাসবে, কিন্তু শিঞ্জিনীর ফর্সা গালে টোল পড়বে না। ম্যাথ স্যার যখন বোর্ডে অঙ্ক লিখে ক্লাসে টাস্ক দেবেন তখন সবাই ডেস্কের উপর মাথা ঝুঁকে লিখবে। শিঞ্জিনী মাথা ঝুঁকে লিখবে না, ওর ক্যাডবেরি কালারের চুলের বেণী ওর শিড়দাঁড়া বেয়ে চেয়ারের তলায় হারিয়ে যাবে না। শিঞ্জিনীর মোবাইল থেকে আর কোনওদিন ভালোবাসার জিফ আসবেনা।
ক্লাস টিচার মধুমিতা ম্যাম ধরা-ধরা গলায় বললেন, ওর হার্টে একটা প্রোবলেম ছিল। মাসলগুলো কাজ করত না। প্রায়ই ব্রিদিং প্রোবলেম হত। ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার দরকার ছিল। একটা হার্টের জন্য ওর পেরেন্টস হন্যে হয়ে গেছে। পায়নি। দিন দশবারো আগে ওরা চেন্নাইতে গিয়েছিল। ডাক্তাররা মেডিসিন দিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতায় ফিরেই লাস্ট ফ্রাইডে অল-অফ-এ-সাডেন ফেল করে গেল। বেল বাজলে আমরা শিঞ্জিনীর জন্য স্কুলের সবাই এক মিনিট নীরবতা পালন করব।
আলাপের উঠে দাঁড়াবার মত শক্তি ছিল না। কোনরকমে দাঁড় করিয়েছিল শরীরটা। মুখ নিচু করে ছিল। এতদিনে পরিষ্কার হল কেন শিঞ্জিনীর বাবা-মা শিঞ্জিনীকে দিয়ে যেত, নিয়ে যেত। বুকের ভিতরে একটা ডাইনোসর দাপাদাপি করছে, মনে হচ্ছে বুকটা চৌচির হয়ে যাবে। সৌমি শব্দ করে কাঁদল। ম্যাম বললেন, চিলড্রেন প্লিজ স্টপ উইপিং। বি কাম!
একটু থেমে ম্যাম বললেন, এই সমাজটা যদি বুঝত মৃত্যুর পর শরীরটা দাহ করে বা কবর না দিয়ে ডোনেট করলে আর একজন মানুষ সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারে। একটা হার্ট পেলেই তো আমরা শিঞ্জিনী কে এভাবে —বলেই ম্যাম নিজেও রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন।
ম্যামের কথা শুনতে শুনতে আলাপ মাদাম তুঁসোর মিউজিয়ামের কোনও মূর্তি হয়ে যাচ্ছিল। ম্যাম বললেন, ওয়েল হাউ মেনি অফ ইউ উড লাইক টু ডোনেট ইয়োর বডি?
সবাই হাত তুলল। আলাপ বাদে। আলাপের হাতে শক্তি ছিল না। ওর দিকে ম্যাম তাকাতে ওর নিথর হাতে একটু যেন শক্তির সঞ্চার হল। অনেক কষ্টে উঠে গেল উপরে।
–ভেরি গুড!
ম্যাম পড়ালেন না। শিঞ্জিনীকে নিয়েই কথা হল। ওর বাড়ি যাদবপুরে। সৌমি ম্যামকে বলল, ও শিঞ্জিনীর বাড়িতে যেতে চায়। ম্যাম বললেন, প্রিন্সিপ্যাল অ্যালাউ করলে আমার কোনও আপত্তি নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আলাপ লক্ষ করল সাহিল অ্যাবসেন্ট। আলাপ বলল, আমিও যাব। আলাপ আর সৌমি প্রিন্সিপ্যালের কাছে গেল। প্রিন্সিপ্যাল স্যার এককথায় অনুমতি দিয়ে দিলেন।ওরা দুজন তড়িঘড়ি ছুটল যাদবপুর।
৩
ইব্রাহিমপুর রোডে একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি। একফালি বাঁধানো উঠোন। সেই উঠোনে হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। বাড়ির সামনে একটি পানের দোকান। এফএম রেডিয়োতে হালকা ভল্যুমে গান বাজছে। নীল-রঙা বাড়িটার দিকে ভালো করে চাইতেই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠল।
–কিরে চ! সৌমির কনুইয়ের গুঁতোয় সম্বিৎ ফিরল আলাপের।
কলিংবেল বাজানোর বেশ খানিকক্ষণ বাদে যে ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন তাকে আলাপ চিনতে পারল। শিঞ্জিনীর বাবা। শিঞ্জিনীকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে একবার-দুবার দেখেছে। ভদ্রলোক ওদের স্কুল ড্রেসের দিকে এক পলক তাকালেন। তারপর শান্তভাবে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ড্রয়িংরুমে ঢুকেই অবাক হল আলাপ। সাহিল বসে আছে সোফায়। মাথা নিচু করে। আলাপ আর সৌমি কোনও কথা না বলে ওর পাশে বসে পড়ল। মাঝে মাঝে পাশের কোনও ঘর থেকে একটা চোরা কান্নার ক্ষীণ সুর ভেসে আসছে। কিছু শব্দও ভেসে আসছে। ওরা অনুমান করল ইনি শিঞ্জিনীর মা হবেন।
–সাহিল তুই কখন এসেছিস? সৌমি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে নিল।
সাহিল মাথা নিচু করে জবাব দিল–মিনিট দশেক।
শিঞ্জিনীর বাবা একটি টুল নিয়ে ওদের সামনে এসে বসলেন। অদ্ভুতরকম শান্ত দেখাচ্ছে ওঁকে। কে বলবে ওঁর মেয়ে গত পরশু মারা গেছে!
সৌমিই মুখ খুলল–আঙ্কল আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে …কথাটা শেষ করতে পারল না–শিঞ্জিনী আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল..।
–অ্যাই মেয়ে কেঁদো না। শিঞ্জিনী আমারও বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। কাঁদলে আমার সোনা কষ্ট পাবে–শিঞ্জিনীর বাবার গলাটা বুজে এল–শিঞ্জিনী জানত, হার ডেজ আর নাম্বারড। ও তাই কাউকে দুঃখ দিতে চাইত না। তোমরাও ওকে দিয়ো না।
আঙ্কেলের কথা শুনে সজল চোখে চাইল আলাপ। আঙ্কেল পালটা দৃষ্টি দিলেন। প্রশ্ন করলেন, তোমার নাম?
— আলাপ।
–আচ্ছা!
এক মুহূর্ত নীরব থেকে আঙ্কল বললেন– তোমার কথা বলত শিঞ্জিনী ।
আলাপ সৌমির সামনে একটু লজ্জা পেয়ে গেল। কিন্তু তার থেকেও বেশি ভয় পেল। ওর কথা কী বলত শিঞ্জিনী ? ও কি তবে ওর বাবাকে সব কথা বলে দিত?
উনি যেন আলাপের মনের কথা পড়ে ফেললেন। বললেন, তুমি ঠিকই ভাবছ, শিঞ্জিনী আমায় সব বলত। কিচ্ছু লুকতো না।
–আঙ্কল আমি আন্টির সঙ্গে একটু দেখা করি? সৌমি বলল।
–হ্যাঁ শিয়োর।
সৌমি উঠে যেতেই আঙ্কল আলাপের দিকে আবার তাকালেন।
–শিঞ্জিনী তোমাদের যে হার্টগুলো পাঠাত সেগুলো আমাকে দেখাত।
তোমাদের মানে? চমকে গেল আলাপ। শিঞ্জিনী কি তাহলে ওকে ছাড়াও অন্য কাউকে হার্ট পাঠাত?
আঙ্কল বলে চলেছেন, শিঞ্জিনী নেট থেকে শুধু হার্ট ডাউনলোড করত। ওর অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসর্ডার ছিল। ওকে আমরা নিউরো সাইক্রিয়াট্রিস্টকেও দেখাতাম।
আলাপ একবার সাহিলের দিকে চাইল। ও নিচের ঠোঁটটাকে ওর উঁচু দাতের মধ্যে চেপে মুখ নিচু করেই বসে আছে। সাহিলকে দেখে কোনও কারণে আলাপের মায়া হল।
–সাহিল, আলাপ আমি তোমাদের দুজনের কাছেই অ্যাপোলজি চাইছি। চেন্নাই থেকে ফেরার পর যখন ও ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল আমাকে বলেছিল–তোমাদের যেন আমি ওর মোবাইল থেকে একটা মেসেজ করে দিই। তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না। বিশ্বাস করো এত ছোটাছুটি করছিলাম সময় পাইনি। তাই এখন করে দিচ্ছি কেমন!
কোনো অজ্ঞাত কারণে সাহিল আর আলাপ দুজনেই একসাথে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিল। ওদের সামনেই আঙ্কল একটা মোবাইলে টাইপ করতে থাকলেন।
–কথাগুলো আমি টাইপ করছি, কিন্তু এ-টু-জেড শিঞ্জিনীর, বিশ্বাস করো, একটা শব্দও আমার নয়। টাইপ করতে করতেই আঙ্কল বললেন। তারপর পাঠিয়ে দিয়ে ওদের মুখের দিকে তাকালেন। আঙ্কলের মুখে মেঘ-চেরা সোনালী রোদের মত স্বস্তির আলো। আলাপের পকেটে মোবাইলটা বেজে উঠল। সাহিলেরও। আলাপ আর সাহিল চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। আলাপ বার করবে কিনা ভাবছিল।
–আরে হেজিটেট করছ কেন? গার্ল ফ্রেন্ডের মেসেজ!.. খোলো। কাম অন!
আলাপ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল আঙ্কেলের মুখে। ধীরে ধীরে হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে দিল। সাহিলও বার করল।
দেখল একটা নতুন মেসেজ। এই প্রথম কিছু শব্দ, কিছু কথা যা শিঞ্জিনীর নাম্বার থেকে এসেছে।
–শরীর খারাপ। তাই যেতে পারছি না। জানি মিস করছিস। আমিও তোকে। ভালো থাকিস।
সঙ্গে একটা জিফ। টাচ করতেই একটা ছোট্ট গাঢ় লাল রঙের হার্ট ক্রমশ বড় হতে হতে মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ফুল হয়ে।
বাঁদিকে চোখ পড়ল আলাপের। দেখল সাহিলের স্ক্রিনেও ফুল ছড়িয়েছে শিঞ্জিনীর হার্ট। সাহিল একটা পাথরের মত বসে দেখছে। আলাপের একটু কৌতূহল হল। ওর মনের ভিতরে ঝাঁপ দিল। দেখতে পেল, ওর ভেতরে আলাপ নিজেই বসে আছে।
আলাপ ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। রুমালে মোড়া হার্ট-রিংটা হাত দিয়ে পরখ করল। অস্থির মনের ভেতরে একটা চিন্তা এল। গিফটটা ফেরত নিয়ে যাবে না। আঙ্কেলের হাতে দিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে আঙ্কেলকে দেখতেই অবাক হয়ে গেল। যাঁকে একটু আগে এত ধীর স্থির মনে হচ্ছিল সেই আঙ্কেল তখন বাচ্চার মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আলাপ বুঝল শিঞ্জিনীর বেস্টফ্রেন্ডের কষ্টটা।
Tags: তাপস রায়, ভ্যালেন্টাইন ডে
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।