।। এক ।।
ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে একটা রিক্সা নিলেন আরতি । বরাবর তাই করেন । সোজা গিয়ে জি.টি.রোড ধরে বাঁদিকে যেতে হয় । প্রায় কুড়ি মিনিট পর ডানদিকে দেখা যাবে এককালের বিখ্যাত আর অধুনা টিমটিম করে চলা ডানলপ কারখানার গেট । তারপর আরো খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকের কাঁচা রাস্তা দিয়ে দশ মিনিট। রাস্তার ধারে মস্ত একটা হোর্ডিং । বড়ো বড়ো করে লেখা ” শান্তিনিলয় “।
লাল সুরকিঢালা পথটুকু পেরিয়ে রিক্সা এসে থামলো অফিসঘরটার কাছে । আরতি নামলেন। সঠিক ভাড়া মিটিয়ে বললেন, ” ঠিক আছে ভাই”। তারপরসোজাওপরের সিঁড়ি উঠে গেলেন । হাতে ছিল ছোট একটা ব্যাগ আর কাঁধের শান্তিনিকেতনি ব্যাগে অল্প কিছু জিনিস।
তাই কাউকে সাহায্য করতে দেননি । এই বাষট্টি বছর বয়সেও যথেষ্ট ফিট । বয়েস শরীরে বা মনে তেমন কামড় বসায়নি । মাঝে মাঝে ভারি চুলটা একটা আলগা হাতখোঁপা করে ঘাড়ের ওপর রেখে দেন । সবমিলিয়ে বেশ একটা নয়নসাবলীল স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব চেহারায় ফুটে ওঠে । এখানে সবাই তাকে ভালবাসে , একটু সমীহও করে ।
দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দার এক প্রান্তে আরতির ঘর । সোজা দোতলায় গিয়ে দেখলেন সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন সুবিমলবাবু । সুবিমলবাবুর বয়স বর্তমানে আটষট্টি । কর্মজীবনে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড়ো অফিসার ছিলেন । তিন বছর হলো অবসর নিয়েছেন । প্রায় দশ বছর আগে স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে। একমাত্র ছেলে এখন আমেরিকা প্রবাসী। দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই । সুবিমলবাবুর এখন আর বিশেষ পিছুটান নেই । কলকাতার বাড়ি বন্ধ করে দু’ বছর হলো এখানে চলে এসেছেন । খুব প্রাণখোলা , উদার, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ । প্রকৃতিপ্রেমী। বলেন, ” এখানে জানলা খুললেই চোখের সামনে বিস্তীর্ণ ধানখেত । বুকভরে নি:শ্বাস নেওয়া যায়। এই বয়সেও ওনার দীর্ঘ সুঠাম চেহারা , চোখ দুটো ভাবুকের মতো । সব মিলিয়ে বেশ সুপুরুষ ।
সুবিমলবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ” ওয়েলকাম ব্যাক । কিন্তু কী ব্যাপার ম্যাডাম ? তিন-চার দিন বলে বারোটা দিন কাটিয়ে এলেন। বোন ছাড়ছিলোনা বুঝি ?”
– অনেকটা সেইরকমই বলতে পারেন।
– ঠিক আছে । এদিকে অনেক খবর আছে ।
বিকেলে চা খেতে খেতে কথা হবে।
সুবিমলবাবু নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন । বিকেল হয়ে গেছে । এখানকার নিয়ম অনুযায়ী ঠিক পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সব ঘরে ঘরে চা পৌঁছে দেওয়া হয় । মালতীর সব নখদর্পণে । কে চিনি ছাড়া, কার এক চামচ লাগে, কার দুধ চিনি স্বাভাবিক । মালতী মনে মনে হাসে কারণ আজকাল, দুধ চিনি সমেত চা খাবার মানুষ কয়েকজন মাত্র আছে । তার মধ্যে একজন কমে গেছে । সে ছিলো একতলায় বারো নম্বর ঘরের মনিকামামী । শেষবারের মতো এখান থেকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো চন্দননগর না চুঁচুড়া কোথায় যেন । আর ফেরা হয়নি । যাবার আগের দিনও দুধ আর বেশি করে চিনি মেশানো ঘন চা খেয়েছিলেন।
বিকেলে ঘরের দরজা খোলাই ছিলো আরতির। এখানে তিন বছর হয়ে গেলো চলে এসেছে । এই শান্ত , গাছপালায় ঘেরা পরিবেশ তাকে অনেক বেদনা ভুলতে সাহায্য করেছে । আরো আগেই চলে আসতে পারতো । তাদের ডিভোর্সটাও দেখতে দেখতে বারো বছর হয়ে গেলো ।
– কী ভাবছেন একা একা, মনটন খারাপ ?
আরতি একটু অন্যমনস্ক ছিলেন । হঠাৎ এই প্রশ্নটা আশা করেননি । সৌজন্যমূলক অথবা নির্ধারিত মাপের বাইরে এই কৌতুহলে একটু অবাক হলেন বটে কিন্তু মনে মনে খুশিও হলেন। মুখে হাসি নিয়ে বললেন ,
– না তেমন কিছু নয় । বসুন , এখানকার কীসব
অনেক খবরাখবর আছে বলছিলেন ।
কথার মাঝখানে মালতী এসে হাজির। আরতি দুজনের চা-টাই এঘরে দিতে বললেন । আরতি আসার সময় কলকাতা থেকে বেশ কিছু সন্দেশ নিয়ে এসেছিলেন । বরাবর এটাই করেন । সবাইকে দিতে হবে । প্যাকেট খুলে দুটো সুবিমলবাবুর দিকে বাড়িয়ে বললেন ,
– নিন্ , দুটোতে আপনার সুগার এমন কিছু
বাড়বেনা । তবে আপনার ফেভারিটটা এবার
আনতে পারিনি ।
মালতী দুজনের চা নিয়ে এলো ।
গরম চা আর সন্দেশ ভালোই লাগছিলো । বিকেল শেষ হয়ে পশ্চিমের আকাশে একটু লাল আভা । সুবিমলবাবু বলতে লাগলেন ,
– হ্যাঁ , এবার এখানে পূজোর সময় ” শ্যামা ”
নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করার প্রস্তাব নিয়ে আজই
আলোচনা হবে । আমাদের দুজনের জন্যে
সবাই অপেক্ষা করছে , মানে মূলত আপনার
জন্যেই বলতে পারেন । গতবারের মতো
এবারও পুরো দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে।
– ঠিক আছে , কিন্তু সমস্যাটা কোথায় ?
– সমস্যাটা আমার । বজ্রসেনের গানগুলি নাকি
আমাকেই গাইতে হবে ।
আরতি জানেন সুবিমলবাবু যথেষ্ট ভালো গাইতে পারেন । তাঁর ভরাট গলায় বজ্রসেনের গান খুব ভালোই জমবে । তাই বেশ উৎসাহেই বললেন।,
– আমি বলতে পারি এ ব্যাপারে আপনার থেকে
ভালো গায়ক এখানে কেউ নেই । আপনি
রাজি হয়ে যান প্লিজ ।
সুবিমলবাবু হেসে ফেললেন । উনি জানেন আরতি এককালে ভালো নাচতে পারতেন । গতবারে যখন সবাই মিলে ‘ চণ্ডালিকা ‘ করেছিল তার সব দায়িত্ব ও পরিচালনার ভার ছিলো তারই । তবে নাচের জন্যে এখানে কাউকে পাওয়া সম্ভব নয় বলে দশ নম্বরের অসীম রায়ের এক ভাইঝি যে চন্দননগরে থাকে,
সে আর তাদের দু-চার জন বন্ধুকে আনতে হয়েছিলো । তাদের নিয়ে সব মহড়া আরতির নির্দেশনাতেই চলতো ।সেই সময় তার উৎসাহ দেখার মতো ছিলো । টগবগে , উচ্ছল,প্রাণবন্ত। সুবিমলবাবু লক্ষ্য করতেন আরতি যেন তখন নিজেকে আবার আবিষ্কার করতো । তার থেমে যাওয়া জীবনের জলাশয়ে নতুন প্রাণের স্পন্দন। একটু চুপ করে রইলেন তিনি । আরতির দুই ভ্রুর মাঝখানে ছোট্ট একটি টিপের দিকে চোখ পড়ে গেলো । আরতি আবার জিজ্ঞাসা করলেন ,
– কই, বললেন না তো আপনার সমস্যাটা ঠিক
কোথায় ?
আরতির জিজ্ঞাসু চোখের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিপাত করলেন সুবিমলবাবু । বললেন ,
– ম্যাডাম , কেন বুঝতে পারছেন না এই বয়সে
কোন আবেগে আমি গাইবো ‘ হৃদয়ে বসন্ত
বনে যে মাধুরী বিকাশিল ‘ ।
দুজনেই একসাথে শব্দ করে হেসে ফেললেন।
‘ শান্তিনিলয় ‘ শুধুই শান্তির নয় , আনন্দেরও বটে। মালিক আশীষ ভৌমিকের দৃষ্টিভঙ্গি খুব আধুনিক । এখানে একজন ডাক্তার রোজ একবার করে বসেন । সকলেরখোঁজখবরনেন। যদিস্পেশালিস্টেরকাছেপাঠাতেহয়তখনসবব্যবস্থাতিনিইকরেন । এখানেপ্রত্যেকঘরযথেষ্টপ্রশস্ত, এ্যটাচড্ বাথরুম , টয়লেট , সব সুন্দর । সকালের প্রাতরাশ থেকে শুরু করে দুপুর এবং রাতের খাবার সব ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় আবার কেউ ইচ্ছে করলে ডাইনিংরুমে গিয়েও খেতে পারেন । কেউ এটাকে ‘ বৃদ্ধাবাস ‘ বা ‘ ওল্ড এজ হোম ‘ ইত্যাদি বললে আশীষ ভৌমিক অপছন্দ করেন । বলেন জীবনের বেশিরভাগটা একভাবে
কাটিয়ে শেষের দিকটা অন্যভাবে কাটানো যায় । এটাও আনন্দের । তাই এখানকার আবাসিকরা প্রতি বছর নৃত্যনাট্য , বর্ষামঙ্গল , সাহিত্যসভা করে থাকেন ।
আরতি এসে সান্ধ্য মিটিং-এ যোগ দিলেন । তার আগে কলকাতা থেকে নিয়ে আসা মিষ্টি সবাইকে খাওয়ালেন । একটু পরে সুবিমলবাবু আসতেই শুরু হলো আগামী দূর্গাপূজার সময় তিনদিন ধরে যে প্রোগ্রাম হবে সেটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা । একদিন শুধু গান । আবাসিকরা ও তাদের আত্মীয়রাও এতে যোগ দেন । যেমন অসীম রায়ের ভাইঝি ও তার কিছু বন্ধু । কমল সেনগুপ্ত , অনিমেষ লাহিড়ী , কনিকা মাসিমা , একতলার একপ্রান্তে বড়ো একটা ঘর নিয়ে থাকা সবার প্রিয় অঞ্জলীদি আর মিতবাক কিন্তু অমায়িক রায়বাবু । দোতলায় থাকেন ডিভিসির প্রাক্তন চিফ ইন্জিনিয়ার মি: বাসু ও তাঁর স্ত্রী মিনতিদি । সারাদিন ঘরে শুয়ে বই পড়ে যান যে মাসীমা তিনিও, অর্থাৎ আজ সবাই প্রবল উৎসাহে জড়ো হয়েছেন এই সান্ধ্য মজলিসে । এসেছেন আরো অনেকে , কেউ বাদ নেই ।
ঠিক হলো ‘ শ্যামা ‘র সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে একদা সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী নন্দিতার ওপর । এখনো সে সুন্দর গাইতে পারে । বজ্রসেনের গান গাইবেন সুবিমলবাবু । তাঁর আপত্তি সবায়ের সম্মিলিত দাবীর সামনে খড়কুটোর মতো ভেসে গেলো । এই দাবিতে সবচাইতে সোচ্চার ছিলেন আরতি – এটা সুবিমলবাবুর ভালোই লাগলো । পুজোর আর বেশি দেরি নেই । তাই পরদিন থেকেই প্রতিদিন রিহার্সাল শুরু করতে হলো ।
একটা একটা করে দিন চলে যায় । তারপর সপ্তাহ তিনেক পরেই বাতাসে পুজোর গন্ধ । ঠাকুর আসবে চন্দননগর থেকে । ‘শান্তিনিলয়’ সরগরম ।
বিকেলের চা প্রায় রোজ সুবিমলবাবু খেতে আসেন আরতির ঘরে । তখন অনেক গল্প হয় । আরতি জানে যে সুবিমলবাবুর পড়াশোনা এবং জ্ঞানের পরিধি খুব কম নয় । কাব্য সাহিত্য থেকে সঙ্গীত – সবেতেই তাঁর অনায়াস ভ্রমণ । তাই বিঠোফেন থেকে শুরু করে আলোচনা চলে যায় ব্রাউনিং ছাড়িয়ে ডেনভার , তারপর বৈষ্ণব-পদাবলী ছুঁয়ে থামে একেবারে রবীন্দ্রনাথে । তখন এই মানুষটির বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো জ্বলজ্বল করে । আরতির দৃষ্টি সেইখানে আটকে যায় । গল্প করাটা শেষ হলে একসঙ্গে দুজনে রিহার্সালে যান । গোটা অনুষ্ঠানের সব দায়িত্ব আরতির ।
পুজোর কয়েকদিন আগে । আরতি লক্ষ্য করলো পরপর দুদিন সুবিমলবাবু চা খেতে এলেননা । আরতি খবর নিয়ে জানতে পারলেন তাঁর জ্বর এসেছে । তিনদিনের দিন আস্তে আস্তে তাঁর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন । প্রথমটা একটু দ্বিধা হচ্ছিল । অনেক ভেবে একটা নক্ করলেন ।
ভেতর থেকে আওয়াজ এলো ,
– খোলা আছে , চলে আসুন ।
আরতিকে ঢুকতে দেখে প্রথমে অবাক আর একটু পরে খুশিতে মন ভরে গেলো । বললেন,
– আমার এমন কিছুই হয়নি । আপনি আবার
কষ্ট করে…
আরতি এই কথার বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না । সোজা বিছানার কাছে এসে বলে উঠলেন ,
– দেখি , জ্বরটর কেমন বাধিয়ে বসেছেন ।
কথাটা বলেই সুবিমলবাবুর কপালের ওপর নিজের হাতটা রাখলেন । এতো কাছে দাঁড়ানোর জন্যে সুবিমলবাবু তাঁর শরীরের থেকে আসা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ পেলেন। একপলক তাকিয়ে অন্যদিকে মুখটা সরিয়ে নিলেন । আরতি বললেন ,
– ডাক্তারবাবুর কথামতো ঠিকঠাক ওষুধ
খাচ্ছেন তো ? পরশু কিন্তু স্টেজ রিহার্সাল।
গানগুলো দরকার হলে আর একবার
ঝালিয়ে নেবেন । বেশি পড়বেননা । বিশ্রাম
না নিলে আমি কিন্তু খুব রাগ করবো ।
এই উদ্বেগের জন্যে সুবিমলবাবু মনে মনে খুশিই হলেন । শরীর খারাপ হলে শেষ কবে কে উদ্বিগ্ন হয়েছিল মনে করতে পারলেননা । একমাত্র ছেলে আকাশ গত দুবছর হলো আমেরিকায় । আসার জন্যে বারবার বলে বটে ।
সুবিমলবাবু ফিরে আসেন বর্তমানে । বলেন ,
– না না , বিশ্রাম তো নিতেই হবে । গানগুলো
ঠিকঠাক গাইতে হবেনা ?
নির্দিষ্ট দিনে ‘ শ্যামা ‘ অভিনীত হলো । প্রচুর মানুষ এসেছিলো । আবাসিকদের সংখ্যাও কম নয় । সেইসঙ্গে তাদের আত্মীয় বন্ধুরা , তাছাড়া যারা কাছাকাছি থাকে । এই অনুষ্ঠান সবায়ের ভালো লাগলো । বিশেষকরে সুবিমলবাবুর ভরাট গলায় বজ্রসেনের গান উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের মুগ্ধ করলো ।
।। দুই ।।
বেশ কিছুদিন ‘ শান্তিনিলয় ‘র শান্ত নিভৃত জীবনে বিশেষ কোনো স্পন্দন জাগলোনা । সকালে যে যার ঘরে চা , তারপর ব্রেকফাস্ট । বেশিরভাগ মানুষরাই ওপরের ডাইনিং হলে লাঞ্চ ও ডিনার সেরে নেন ।
তবে বিকেলের চা প্রায় রোজ সুবিমলবাবু খেতে আসেন আরতির ঘরে । তখন অনেক গল্প হয় দু’জনের । বিকেল হলেই আরতি দরজাটা খুলে রাখেন । বিশেষ কারো পদশব্দের প্রতীক্ষায় থাকেন কি ? তখন নিজের মনকে একটু শাসন করেন । অনেকটা বয়স হয়ে গেছে । এ বয়সে কারো পদশব্দের প্রতীক্ষা , কারো উপস্থিতিতে উতলা হওয়া – এসব ছেলেমানুষি ঠিক নয় ।
তবু এই মানুষটি সামনে বসলে মনকে উজাড় করতে ভালো লাগে, তাই চেষ্টাকৃত গাম্ভীর্য ভেঙে একটু একটু করে তার ঝঞ্ঝাতাড়িত , সন্তানহীন , স্বামীর কাছে অবহেলিত জীবনের নানা খুঁটিনাটি অনেকটা বলে ফেলেছেন ।
প্রতিদিনের এই আসর সবাই লক্ষ্য করে । একটু চাপা গুঞ্জন যে নেই তা নয় ।
সুখেদুখে কেটে গেলো আরো কিছুদিন ।
এরমধ্যে দোতলার মি. বাসু সস্ত্রীক বিদেশে ঘুরে এলেন । অনিমেষ লাহিড়ী অসুস্থ হয়ে ‘শান্তিনিলয়’র নিজস্ব গাড়িতে কলকাতার একটা নার্সিং হোমে ভর্তি হতে গেলেন । আবার ফিরেও এলেন । কমল সেনগুপ্তর আসানসোলে ভায়ের কাছে এক সপ্তাহ ঘুরে আসা হয়ে গেলো ।
পরপর চারদিন সুবিমলবাবু চা খেতে এলেননা । মাঝখানে কয়েকদিনের জন্যে কিছু ব্যক্তিগত কাজে কলকাতায় গেলেন ।
পাঁচদিন পরে আরতি চলে এলেন সুবিমলবাবুর ঘরে । এসে দেখলেন টেবিলের ওপর অনেক কাগজ ছড়ানো । চেয়ারে বসে কিছু লিখছেন । আরতিকে দেখেই মুখটা খুশিতে উজ্জল হয়ে উঠলো । গলায় উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন ,
– কী ব্যাপার ম্যাডাম । কেমন আছেন বলুন ।
– আমিতো সেটাই জানতে এসেছি । কী ব্যাপার
মশাই , দেখা নেই কেন ? আমার আগেই
আপনি প্রশ্ন করলেন ।
একটু চাপা অভিমান হয়তো ছিলো যা দুজনের সম্মিলিত হাসিতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো ।
আবার গল্প শুরু হলো । সুবিমলবাবু হঠাৎ বলে উঠলেন ,
– আচ্ছা বলুনতো দু’জন মানুষের প্রেম কি
এতো তীব্র হতে পারে যে তারা সমাজের
লক্ষণরেখার পরোয়া করবেনা ।
আরতি মাথা নিচু করে বসে রইলো । কিছু জবাব দিলোনা ।
সুবিমলবাবু উঠে দাঁড়ালেন । বললেন ,
– যাবেন না , বসুন । আমি মালতীকে দুকাপ
কফি দিতে বলে আসি ।
উনি বেরিয়ে যাবার পর আরতি দেখলেন টেবিলের ওপর কাগজে কিছু লেখা রয়েছে । দেখলেন রবীন্দ্রনাথের একটি উদ্ধৃতি । লেখা রয়েছে ,
রুক্ষ দিনের দু:খ পাইতো পাবো
চাইনা শান্তি , সান্ত্বনা নাহি চাবো
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি,
ছিন্ন পালের কাছি
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব –
তুমি আছ , আমি আছি ।
কফি নিয়ে মালতী হাজির । ধীরে ধীরে কফিটা খেয়ে কিছু না বলে আরতি বেরিয়ে গেলেন ।
।। তিন ।।
‘ শান্তিনিলয়’ চুপচাপ । সবার মন ভারাক্রান্ত । সুবিমলবাবু চলে যাচ্ছেন আমেরিকায় ছেলের কাছে । বরাবরের জন্যে নয় অবশ্য । বলেছেন কয়েকমাস ।
সব গোছানো হয়ে গেছে । এবার যাত্রা । পরপর পাঁচদিন বিকেলে চায়ের সময় অপেক্ষা করেছেন আরতি । এলেননা সুবিমলবাবু । আহত অভিমানে ঘরে বসে আরতি একা একাই ঠান্ডা চা খেয়েছেন । অন্য সময়ও কোনো কারণেই দেখা করলেন না ।
যাবার সময় এসে গেলো । একে একে সবায়ের কাছে বিদায় নিচ্ছেন । মজা করে বললেন ,
– আবার আসিব ফিরে , এই শান্তিনিলয়ে
আপনাদের কাছে ।
আরতি ঘরেই ছিলেন । বাইরে গাড়ি স্টার্ট দেবার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন । ততক্ষণে গাড়ি চলে গেছে ।
‘ শান্তিনিলয় ‘র প্রাত্যহিক কাজকর্ম ঠিকঠাক চলছে । প্রতিদিনের সান্ধ্য জমায়েত হচ্ছিলো । আশীষ ভৌমিক সকলের খোঁজখবর নিয়মিত নিয়ে যাচ্ছেন । মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা যেখানে অজস্র ফুলের গাছ রয়েছে তার থেকে খানিকটা দূরে ‘ শান্তিনিলয় ‘র আরো একটা ব্লক তৈরির কাজ চলছে ।
আরতি একমাসের জন্যে তার বোনের বাড়ি চলে গেলেন ।ফিরে আসার পর জানলেন তাঁর নামে একটা চিঠি এসে পড়ে আছে । ম্যানেজারের কাছ থেকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন । দেখলেন আমেরিকা থেকে লেখা । সাবধানে খুলে পড়া শুরু করলেন :
আরতি ,
কিছুদিন থেকেই নিজের মনের মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলছিলো । তুমিতো বোঝো নিজের কথা বলতে না পারলে কেমন যন্ত্রণা হয় । তাই এই চিঠিটা লিখে নিশ্চয়ই কোনো অন্যায় করছিনা , অন্তত বিবেকের কাছে তো নয়ই । ভাবলাম যা সত্য , যা স্বাভাবিক তাকে স্বীকার করতে লজ্জার কী আছে ।
জীবনে অনেক সময় কোনো বিরল মূহুর্তে কিছু অনুভূতির জন্ম হয় যা নি:শব্দে ফুল ফোটার মতো , তার গন্ধে ভরে ওঠে শ্বাস-প্রশ্বাস । বয়সের অনুশাসন তুচ্ছ করে আমাদের মন আবিষ্কার করে পাতার আড়ালে বসে আছে কোনো রঙ্গিন পাখি , সময়ের শ্যাওলার নীচে সে বুঝতে পারে জলজপ্রাণের অস্তিত্ব । তখন তার অবুঝ মন শুনতে পায় গোধূলিবেলায় কোনো পাখির বিরতিহীন ডাক । আরতি , সব ভালোবাসাই পরিণতির দিকে যায়না , সম্ভবও নয় ।
এখানে ফিরে আসতে আমার মাসচারেক বাকি আছে । শান্তিনিলয় আমার মনকে কোনো এক সুখের বাঁধনে বেঁধেছে । আমি জানি সেখানে থাকলে রোজ অন্তত একবার করে তোমার সঙ্গে দেখা হবে । তোমার সান্নিধ্যের নিভৃত উচ্চারণ আমার মনকে আলোকিত আর সমৃদ্ধ করে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে – আমার এটাই এক পরম প্রাপ্তি।
ভালো থেকো ।
– সুবিমল
চিঠিটা হাতে নিয়ে আরতি অনেকক্ষণ বসে রইলেন । তার চোখে শ্রাবণের ধারা । সামনের বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ।
Tags: অনিলেশ গোস্বামী, গোধূলি মন
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।