কফি মাগের ধোঁয়া প্রিয় ঋতুর।তাই আজ সকালেও ধোঁয়ার দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে ছিল সে।শুধু মেঘ-কুয়াশার ধোঁয়া নাকি মাগের কোনটা যে ওর বেশী পছন্দের ও এই ৩০ টা বসন্ত পেরিয়ে আজও বোঝেনা।সকালে একটা শীত-শীত ভাবে কলকাতায় যে আমেজটা পেত ও,এখানকার ঠান্ডাটা যে তার চেয়ে আলাদা—শুধু ঠান্ডা নয় সবকিছুই, সেটা ও বোঝে।তবু মন মানেনা…
সকাল থেকে চারিদিকে অন্যরকম পরিবেশ,ছোটবৌদি থেকে ফুলকাকু,বড়জেঠিমা থেকে দাদাভাই সক্কলে বাগবাজারে ঋতুদের বাড়িতে।প্রতিবারই আসে সবাই পিতৃপক্ষের জলদানে তর্পণ করে দেবীপক্ষের শুভসূচনায় মেতে উঠতে।বাগবাজার ঘাটে এতবছর ঋতুও গেছে সবটা চাক্ষুষ করতে,তবে এবারতো সে কলকাতাতেই নেই।
ভিকির ছবিটা একমনে দেখছিল ঋতু।আগের বছরও ওরা একসাথে অনেক লড়াই করেছিল।এবছর কেইবা আছে ওর পাশে!এই ছবি আর স্মৃতি ছাড়া!ভিকির বাড়িতে সকলে তো নিমরাজিই হয়েছিল,কিন্তু ঋতু পারেনি যৌথ পরিবারের ভাবনা বদলাতে!
ওরা স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটি একসাথে কাটিয়েছে,প্রথমদিকে অসুবিধে হলেও পরেরদিকে পাত্তা দিতনা লোকের কথায়। অর্থনীতিতে বরাবরই সফল ভিকি,আর ঋতুর বিষয় ছিল বাংলা।ভিকি সব হিসেব মিলিয়ে ব্যালান্স শিট তৈরিতে পারদর্শী ছিল। শুধু জীবনের হিসেবটাই…….
কাগজে যেদিন খবরটা বেরিয়েছিল,ঋতু সারাদিন খাওয়া-দাওয়া না করে শুধু ভিকির ছবির দিকে চেয়ে মনে মনে বলেছিল, “জিজীবিষা মানে জানতে চাইতিস আমার থেকে,বাঁচার এত শখ ছিল তোর তবু কেন করলি? আর একটা বছর পারলি না লড়াইটা করতে, দেখ আমরা জিতে গেছি।”
ঋতুর বাড়িতে এখন সবাই কথা বলে ঋতুকে নিয়ে।না – ভুল বুঝতে পেরে কিনা তা ঋতু নিজেও জানেনা,ও শুধু জানে আদালত ৩৭৭ ধারাকে বৈধতা দিয়েছে।
ঋতু তার ডায়েরি খুলে বসে আবারও…
সেদিন—যেখানে তার পাতার পর পাতা শুধুই তথ্যগুলো জড়ো করে রাখা…
দ্বাদশ শতকে সঙ্কলিত ‘পদ্মপুরাণ’এ পুরুষের নারী হয়ে ওঠার বিকল্প ভাবনা স্থান পেয়েছে।অর্জুন থেকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও স্বেচ্ছায় নারী হয়ে যান এই সংস্কৃতিতে।তামিলনাড়ুর কোভাগাম অঞ্চলে শ্রীকৃষ্ণ মোহিনী রূপ ধারণ করে বালক ইরাবানকে দাম্পত্যের স্বাদ দেন।আজও তামিলনাড়ুর কোভাগাম অঞ্চলে ইরাবানের পুজো হয়। ভক্তের আকাঙ্ক্ষা পূরণে পার্থসারথি নিজেই নারীরূপ ধারণ করেন,এটাই ভারতীয় ঐতিহ্য।ঋগ্বেদের ঐতিহ্যেও সাযুজ্যপূর্ণ এই ব্যবস্থা।ঋগ্বেদের অন্যতম প্রধান দেবতা অগ্নির বাবা নেই। দুই মা: পৃথিবী এবং স্বর্গ।ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলে ২৮ নম্বর সূক্তের তৃতীয় শ্লোক: “হে জ্ঞানবান অধ্বর্যু! তুমি ঊর্ধ্বমুখ অরণিতে অধোমুখ ধারণ করো; তৎক্ষণাৎ গর্ভবতী অরণি অভীষ্টবর্ষী অগ্নিকে উৎপন্ন করিল।“
ঋতু জানে আজ ওকে বাড়িতে বারবার মনে করবে কিন্তু একজনও ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবে না।
শেষ ডিসেম্বরেই যেদিন ভিকিকে ডেকে ঋতুর মা-বাবা অপমান করেছিল,সেদিন আর বাড়ি ফেরা হয়নি ওঁর।ঋতুর মোবাইলে ভিকির বাড়ি থেকে বাইক অ্যাকসিডেন্টের খবরটা এসেছিল। মেনে নিতে পারেনি ঋতু…সব ছেড়ে ৩ মাসের মাথায় দার্জিলিং চলে এসেছিল একটা চাকরি যোগাড় করে…
তাই আজ সকাল থেকেই ও আনমনা…ঋতু জানে ওর জীবনে আর জিজীবিষা নেই।এই শব্দের অর্থ যখনই ভিকি জানতে চাইত ঋতু ওকে জড়িয়ে ধরে উত্তর দিত, “জিজীবিষা মানে বাঁচার ইচ্ছে।”
এসব ভাবনার মাঝেই ওর ফোনটা বেজে ওঠে ,ও ফোন ধরতেই ওপার থেকে অচেনা কন্ঠে “ঋতুরাজ কথা বলছ?” হুম বলছি…….
“আমি সংকল্প,তোমাদের ক্লাসমেট ছিলাম ইউনিভর্সিটিতে।”
আমার নম্ৱর…অবশ্য বদলাইনি….
“ভাগ্যিস নম্ৱর বদলাওনি তুমি, ৩৭৭ এর পর অনেকবার ফোন করব ভেবেও করা হয়নি,আমি তোমার সবটুকুই জানি।এবার পুজোয় আসবে কলকাতায়?”
আসলে জীবন বাঁচতে শেখায়…লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়।ঋতুরাজ পুজোয় কাশফুল দেখেছিল-ঢাকের শব্দও শুনতে পেয়েছিল সংকল্পের সাথে বেড়িয়ে,তবে আরোও একটা বছর পর।৩৭৭ অর্থাৎ সমকাম আইনি স্বীকৃতি পেয়েছিল,তবে ঋতুর বাড়ির লোকজনদের মননে পরিবর্তন এসেছিল আরো কিছুটা পরে।
Tags: জিজীবিষা, মধুরিমা রায়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।