ঔপনিবেশিক যুগে স্বদেশভাবনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কার ইত্যাদি বাস্তব উপাদানগুলি। অথচ সাহিত্যক্ষেত্রে স্বাদেশিকতার মূল ভিত্তি ছিল বিশুদ্ধ আবেগ। এপ্রসঙ্গে সতীনাথ ভাদুড়ীর নাম আলোচনায় আনলে সর্বাগ্রে মনে পড়বে তাঁর মনন–প্রধান যুক্তিনিষ্ঠা এবং দূরদৃষ্টির অনন্যতাকে। বিশেষ করে স্মরণে রাখতে হয় রাজনৈতিক আন্দোলনে সতীনাথের অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন। অথচ মুক্ত স্বদেশে এই নিগ্রহ সহ্য করবার পুরস্কার হিসাবে প্রশাসনিক ক্ষমতাভোগের সুযোগ যখন এল, সতীনাথ নিস্পৃহচিত্তে এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। এই নিরাসক্তি তাঁর লেখকসত্তার তথা তাঁর সমগ্র জীবনদর্শনের মূলে ছিল।
ফলে তিনি যখন স্বাধীন ভারতে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষজনের কিংবা সরকারি আমলা – অফিসারদের অর্থ লোলুপতা, আপন স্বার্থসিদ্ধিতে জনসাধারণের বিশ্বাস ও সারল্যের সুযোগ নিয়ে তাদের প্রতারণা করার ছবি আঁকছেন ‘গণনায়ক’ গল্পে, মুনিমজী ও ইজারাদার সাহেবের চরিত্রদুটি একেবারে অনাবৃত হয়ে যাচ্ছে। দেশভাগ আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশভাগের বেদনা বা উদ্বাস্তু জীবনের সংকট নিয়ে বহু সংবেদনশীল গল্প লেখা হয়েছে, সতীনাথ ‘গণনায়ক’ গল্পে ঘটনার অন্যপিঠে আলো ফেললেন। পূর্ণিয়া জেলা সংলগ্ন বিহার ও বাংলার বর্ডারে আরুয়াখোয়ার হাটে দেশজোড়া অনিশ্চয়তা আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে আবার সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বকে মূলধন করে নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধি করছে। ইজারাদার সাহেব গোপালপুর থানাকে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে কলকাতায় কমিশনকে টাকা খাওয়াতে অনেক টাকা চাঁদা তোলেন। মুনিমজী তাঁরই দেওয়া পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ জমা করতে থাকেন, কেননা, ‘হিন্দুস্তানে পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ রাখা বারণ।’ আর মনে মনে ভাবেন ‘এগুলি নিয়ে কাল যেতে হবে তিতলিয়ার দিকে। … সেখানে বেচতে হবে এই পাকিস্তানি ঝান্ডাগুলো, আর সেখানে যোগাড় করতে হবে সেখানকার অপ্রয়োজনীয় হিন্দুস্থান পতাকাগুলি। একই জিনিস দু’দুবার করে বেচবেন।’ অগণিত সাধারণের দুশিন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে তাদের পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া মুনিমজীর অন্তরে হীন স্বার্থবুদ্ধিজাত হিসাব–নিকাশের পালা চলতে থাকে ‘… একটি খদ্দেরের টুপি আগেই কিনে রাখলে, বোধ হয় আর একটু সুবিধা হত … হয়তো হিসেবে একটু ভুল হয়ে গিয়েছে। যাকগে, রামজী যাকে যা দেন তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত।’ দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে যারা ব্যবসায় নামতে পারে তাদের অর্থলোলুপ চেহারাটি লেখক একেবারে নিরাবরণ করে দিচ্ছেন !
ক্ষমতালোলুপ জনপ্রতিনিধিদের যেনতেন প্রকারে ভোটারদের মনোরঞ্জন ক’রে ক্ষমতায় টিকে থাকতে ঔৎসুক্য দেখি ‘চরণদাস এম এল এ’ কিংবা ‘করদাতাসংঘ জিন্দাবাদ’ গল্পে। স্বাধীন দেশের জনপ্রতিনিধি চরণদাস দীর্ঘ চার বছর বাদে নিজের ভোটকেন্দ্রে ঝোলা আর কম্বল হাতে এসে পৌঁছেছেন জনসম্পর্ক বাড়াবার উদ্দেশে। এসে দেখছেন তাঁর নিজের দলের কর্মীরাই তাঁকে আর মান্য করছে না বরং তাঁকে নিয়ে নানা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছে। জনতারও তাঁর কাছে কোন চাহিদা নেই। তাঁকে একরকম উপেক্ষা করেই সবাই দৌড়চ্ছে স্বামিজীর আশ্রমে। শেষ পর্যন্ত এইসব ভোটারদের আনুকূল্য পেতে নির্লজ্জ ভন্ড জনউপাসক চরণদাস ধর্মগুরুর সাহায্য নিচ্ছেন। সোজা সেন্সাস অফিসার মৌলবিসাহেবের পা দুখানা জড়িয়ে ধরে প্রার্থনা জানাচ্ছেন এই বলে ‘মৌলবিসাহেব, আজ সকালে আপনি স্বামী সহস্রানন্দের আশ্রমে গিয়েছিলেন লোক গণনার কাজে। … সেখানে আশ্রমের বাসিন্দাদের গোনবার সময় স্বামীজিকেও গুণে ফেলেছেন। আপনার ফাইলে মানুষদের মধ্যে থেকে নামটা কেটে দিতে হবে। তিনি তো মানুষ নন, তিনি যে দেবতা, তিনি যে ভগবান !’ বোঝা যায় একদিকে ভোট – বৈতরণী পার হতে ধর্মের ভেকগ্রহণে দ্বিধাহীন, অন্যদিকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারি আধিকারিকের পদচুম্বনেও কুন্ঠাহীন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সেবক এইসব আত্মমর্যাদাশূন্য ‘মায়লেজী’দের সমস্ত সংশ্রব ঘৃণাভরে কেন সতীনাথ একদিন বর্জন করেছিলেন। স্বাধীন দেশে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার মহান কৃতিত্ব জাহির ক’রে নেতা হয়ে ওঠার গল্প ‘করদাতাসংঘ জিন্দাবাদ’। এখানে স্পষ্টতা পায় জনসেবক নেতৃত্বের প্রকৃত আগ্রহ কেবল নিজ স্বার্থসিদ্ধিতে। বিদ্যেবুদ্ধিহীন মন্ত্রীর কারণে প্রশাসনিক বিড়ম্বনার গল্প ‘পরকীয় সন্ ইন ল’। সাহেবরামের মত অপদার্থ মানুষজন শুধু পবন অনুকূল থাকার জোরে এদেশের মন্ত্রী হয়ে যান এবং পরবর্তীতে তাঁর কথায় ও কাজে যখন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, তখন মন্ত্রীমহোদয় অম্লানবদনে নিজের বক্তব্য অস্বীকার করেন। সাহেবরামের এই বোধবুদ্ধিহীন আচরণ কিংবা নির্লজ্জ মিথ্যাচারিতার বর্ণনার মধ্যে দিয়ে লেখক এই শ্রেণীর প্রতি তীব্র বিদ্রূপের চাবুক হেনেছেন। আবার ‘মা আম্রফলেষু’ গল্পে কর্মবিমুখ সরকারি কর্মচারিদের আলস্য ও অভব্যতা ছাড়াও উচ্চপদস্থ আমলার সরকারি নিয়মরীতিকে নিজের সুবিধামত ব্যবহারের যথেচ্ছাচারিতার চিত্র তুলে ধরেছেন তা যেমন বিশ্বস্ত তেমন আস্বাদ্য হয়েছে। বন্যাত্রাণে সংগৃহীত টাকা সরকারি আমলাতন্ত্রের হাতে পড়ে নয়ছয় হওয়ার কথা আছে ‘তিলোত্তমা – সংস্কৃতি – সংঘ’ গল্পে।
ঔপনিবেশিক ভারতে বিদেশি প্রভুর অমানবিক অত্যাচার (‘আন্টাবাংলা’), তাদের ভয়ে অধস্তন কর্মচারিদের সদাসর্বদা তটস্থ থাকার ছবিটা (‘জোড়–কলম’) স্বাধীন দেশের অফিস – আদালতে যে একটুও পাল্টায় নি, তারই বিশদ বর্ণনা ‘পদাঙ্ক’, ‘অনাবশ্যক’, ‘সাঝেঁর শীতল’, ‘তবে কি …’ ইত্যাদি গল্পে পাওয়া যায়। ‘আন্টাবাংলা’ গল্পে খররৌদ্রে দুহাতে ইট নিয়ে আমৃত্যু দাঁড়িয়ে থাকা বিরসার প্রভুভক্তি কিংবা তার নাতি বোটরার প্ল্যান্টার্স ক্লাবের প্রতি অন্ধ আনুগত্য যেমন বিস্ময়কর, তেমন তাদের পরিণতি ততটাই মর্মান্তিক ! ‘জোড়–কলম’ গল্প থেকে জানতে পারি উৎকোচ দান ও গ্রহণের পরম্পরা ইংরেজ আমল থেকেই প্রচলিত ছিল। দুর্নীতির দায়ে ধরা পড়া এক্সাইজের সাব–ইনস্পেক্টর আর ম্যাজিস্ট্রেটের নাজির প্রভূত খানাপিনার আয়োজনে ইংরেজ কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেটকে সন্তুষ্ট ক’রে বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন। ‘এক ঘন্টার রাজা’ গল্পে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিককে দন্ডমুন্ডের কর্তা ভেবে ঘাটমালিকের তোষামুদি, পরে ভুল ভাঙলে তার বিব্রতমুখ -এসবই গল্পে কৌতুককর পরিস্থিতি তৈরি করে।
এরসঙ্গে ব্যবসায়ীদের স্বার্থপরায়ণ চরিত্রের প্রকাশ ঘটে ‘করদাতাসংঘ জিন্দাবাদ’ গল্পে। করফাঁকি দিতে উৎসুক সম্পন্ন মানুষজন মিলে এই সংঘ বা দল গড়েছেন। যেভাবে তাঁরা ফাঁকি দেওয়ায় নির্লজ্জ কৃতিত্ব দাবি করেছেন তা যুগপৎ ঘৃণা ও কৌতুক উদ্রেক করে। আবার ‘মুনাফা ঠাকরুণ’, ‘জাদুগন্ডি’, ইত্যাদি গল্পে ব্যবসারীদের ন্যায়নীতিহীন মুনাফাপ্রিয়তার পরিচয় ফুটে উঠেছে। নিজের নামে কুৎসা যখন বাজারে হৈ হৈ ক’রে বিক্রি হচ্ছে তখন তাতে আদৌ বিচলিত না হয়ে শেঠজী সেখান থেকে লাভ তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। এই ব্যবসায়ী পরিবারের সমস্ত সদস্য মায় তাদের বিশ্বস্ত কর্মচারি অন্যকে বঞ্চিত ক’রে নিজে লাভবান হওয়ার সাধনায় ব্যস্ত, অথচ ধরা পড়লেও আদৌ লজ্জিত হয় না কারণ এভাবেই তারা মুনাফা ঠাকরুণের সেবা ক’রে চলে। ‘জাদুগন্ডি’ গল্পে মালিকপক্ষের বিপন্ন শ্রমিকদের সম্বন্ধে নির্মম উদাসীনতা যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি মানুষের মনের গভীরে অবস্থিত কুসংস্কারের ছবি ফুটে ওঠে। এমনই অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কারের ছবি পাই ‘ভূত’, ‘বমি–কপালিয়া’, ‘পরিচিতা’ প্রভৃতি গল্পে, যেখানে মানবমনের বিচিত্র চেহারাটা ধরা পড়ে।
সতীনাথ গ্রাম্য অশিক্ষিত সহজ সরল মানুষের ছবি এঁকেছেন ‘গণনায়ক’, ‘চরণদাস এম এল এ’ প্রভৃতি গল্পে। তবে প্রকৃতিক দুর্যোগের পটভূমিতে গ্রাম ভারতের সার্থক রূপদান করা গল্প ‘বন্যা’য় প্রকাশ পেল মানুষের মনের গহনে অবস্থিত লোভ–লালসা, ঈর্ষা–বিদ্বেষ প্রভৃতি আদিম রিপুগুলি। বিপন্নতার দিনে মানুষ বহুকালের শত্রুতা ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফেলে তারা পরস্পরের পরম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হয়। আবার বিপদ কেটে গেলে হিংসা বিদ্বেষ মাথাচাড়া দেয়ার যে ছবি লেখক আঁকলেন তা পুরোপুরি সমাজবিজ্ঞানসম্মত। অন্যপক্ষে স্বাধীন দেশে ভৈরো নাট ও ভুট্নীদের নিজস্ব ভূখন্ড ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার গল্প ‘রথের তলে’। জেল ফেরত ভৈরোর কাছে সবই অচেনা লাগে, মনে মনে সে আবার তাই জেলে, তার চেনা জগতে ফিরতে চায়।
সতীনাথ যখন পুরাণ–আশ্রয়ী গল্প ‘স্বর্গের স্বাদ’ লিখছেন, সন্ধান দিচ্ছেন পৌরাণিক সমাজে আর এক লাঞ্ছিত, ভাগ্য–বিড়ম্বিত নারী অপালার জীবনযন্ত্রণার। যদিও এগল্পে শেষপর্যন্ত দেবরাজ ইন্দ্র প্রদত্ত প্রেমের স্বীকৃতিতে এক অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় অপালা ! আবার ‘ব্যর্থ তপস্যা’ গল্পে আধুনিক ভারতের অধিবাসী হয়েও মনেপ্রাণে পৌরাণিক জগতে বসবাসকারী ধর্মবিশ্বাসে অন্ধ এক দম্পতির দেখা মেলে। এই পৃথিবীতে কল্কিদেবের আবির্ভাবের পথ সুগম করার মিশন নিয়ে ঐ বৃদ্ধ দম্পতি হয়তো তাঁদের অসমাপ্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সবার অলক্ষ্যে।
এভাবেই বিভিন্ন গল্পে নানা দৃষ্টিকোণের আর্শিতে গল্পকার সতীনাথ ধরিয়ে দিচ্ছেন বহুকৌণিক ভারতীয় সমাজটিকে। অধিকাংশ গল্পই ব্যঙ্গ বিদ্রূপের তিক্ত রসে জারিত। লেখক স্বয়ংও হয়তো ভৈরো নাটের মতই সময় সময় অনুভব করেছেন এ তাঁর আকাঙ্ক্ষিত স্বদেশ নয়। তাই তাঁর আপাত নিরাসক্তির মধ্যেও কখনো ক্রোধ, কখনো বেদনা বাহিত নৈরাশ্য আমাদের আচ্ছন্ন করে।
[ প্রবন্ধটি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আয়োজিত ২২ – ২৩শে মার্চ, ২০১২ তারিখে অনুষ্ঠিত ‘কথাসাহিত্যে স্বদেশ – সন্ধান : বিশ শতক’ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রে পাঠিত।]
দেবাশিস মল্লিক
কবি ও প্রাবন্ধিক। সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা-অধ্যাপনা। বর্তমানে সিঙ্গুর কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান প্রকাশিত কবিতার বই – নক্ষত্র খামারের গল্প(১৯৯৬),পাখির সামান্য আকাশ(২০০১)। সম্পাদিত পত্রিকা –ঋতভাস ও শ্রী।
Tags: দেবাশিস মল্লিক, সতীনাথ ভাদুড়ী
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।