‘বিশুদা, ও বিশুদা, এবার তো মই থেকে নামো। নাইন আপ-এর সময় হয়ে গেছে…ঢুকবে পনেরো মিনিটের মধ্যে। তোমার কি খেয়াল নেই ?’
তরুণ সাহা ঠাকুরের মণ্ডপের ভেতর থেকে চিৎকার করে বললো ।
যাকে ডাকাডাকি করা হলো তিনি হচ্ছেন ঝুমরী তিলাইয়ার সর্বজনীন বিশুদা, মধ্যবয়সী বিশু চক্রবর্তী ।
এই মুহূর্তে সে বাইরের প্যান্ডেলের গেটে একটা মই লাগিয়ে আমপাতা আর শোলার রঙ্গীন কদমফুলের মালার শেষ অংশটা লাগাচ্ছিলো ।
আজ পঞ্চমীর সকাল ।
‘আজকালকার ছেলেছোকরারা এইসব বোঝে না । আজকে সকালের মধ্যে এইসব ছোটোখাটো কাজগুলো শেষ না করে ফেললে শেষ পর্যন্ত বাদ পড়েই থাকবে । কালকের থেকে চারদিন কতো অন্য বড়ো বড়ো কাজের ভিড় ।’
বিশুদা কদমফুলের মালার পুরোটা টাঙিয়ে মইয়ের শেষ ধাপ থেকে লাফিয়ে নামলো।
‘মনে ঠিকৈ আসে তরুণ…ভুলুম ক্যান। দ্বাইর ঘট, মায়ের ঘট, ঠাকুরের সাঁদমালা, সশীষ ডাব, নারকেইল, দশকর্মার জিইনিসপত্তর সব আইজকের নাইন-আপে আসবো কইসে না মাসী । আমি এই যাই গিয়া । তুমার সাইকেলডা দ্যাও তো । গাড়ী লাগনের আগেই পৌছাইবো..সিন্তা কইরো না ।’
বিশু চক্রবর্তী তরুণ সাহার সাইকেল নিয়ে ঝটিতি মণ্ডপ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো কোডার্মা স্টেশনের দিকে । কোলকাতা থেকে আসছে আজ দুর্গাপুজোর অনেক জিনিসপত্র। নাইন -আপ থেকে নামিয়ে নিতে হবে।
বিহারের এই আধাশহর ঝুমরী তিলাইয়াতে বারোয়ারী দূর্গাপুজো বলতে এই একটাই।
স্থানীয় বাঙালীরা বলে ‘আড্ডিবাংলোর দুগগোপূজো’ । শুরু হয়েছিলো স্বাধীনতার বেশ আগে থেকেই। আশেপাশের পাঁচ সাত মাইলের মধ্যে, এমনকি কোডার্মা সদর মহকুমা শহরেও কোনো দূর্গা পুজো হয়না । আশেপাশের বসতি, শিবসাগর, ডোমচাঁচ এমনকি দশ মাইল দূরের গঝান্ডি থেকেও বাঙালীরা এই পুজো দেখতে আসে ।
পুজোর দিনগুলোতে সারাদিন মণ্ডপে বৌ বাচ্চাদের নিয়ে ভিড় জমিয়ে রাখে। সন্ধ্যেয় থাকে যৎকিঞ্চিৎ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । সেসব দেখে পুরী হালুয়া খেয়ে যে যার বাড়ীতে ফিরে যায় ।
রাতের খেপ মারার জন্য পুজোমণ্ডপের বাইরে তাই এই কদিন লেগে থাকে শহরে বাতিল করা বৃদ্ধ এম্বাসাডর আর জিপগাড়ীর ভীড় ।
সেই বারোয়ারী পুজোর এবছর সন ১৩৭০-এ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে । সে বড়ো কম কথা নয় ।
সেই কবে কোলকাতার সম্পন্ন বাঙালী আঢ্য পরিবার থেকে একজন দূরদর্শী বঙ্গসন্তান বিহারের এই নগন্য গ্রাম ঝুমরী তিলাইয়ার মাটিতে পা রেখেছিলো মাইকা খনি থেকে ব্যবসা করার আশায় ।
সঙ্গে এলেন আর এক বন্ধু পরিবার সামন্তরা।
কথায় বলে বাঙালী যেখানে যায় সাথে করে নিয়ে যায় দুর্গাপুজো আর কালিবাড়ী। এখানেও তার অন্যথা হলো না।
পারিবারিক সূত্রে শাক্ত হওয়াতে সামন্তরা বাড়ীর সামনেই জমি কিনে ছোট করে প্রতিষ্ঠা করলো কালিবাড়ী । আর আঢ্য পরিবার থেকে তাদের বাংলোর সামনের প্রশস্ত অঙ্গনে শুরু হলো দুর্গাপুজো, ঝুমরী তিলাইয়াতে তাদের আস্তানা গাড়ার কয়েক বছরের মধ্যেই ।
সেই শুরু হয়েছিল ‘আড্ডিবাংলোর দুগ্গোপুজো’ । সে গত শতাব্দীর প্রথম দশকের কথা ।
তারপরে কয়েক দশকে আড়েবহরে বেড়ে সেই তিলাইয়া গ্রাম ক্রমে হয়ে উঠেছে এক আধা-শহর । কোডার্মা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যোগ হয়েছে বাড়তি লাইন ।
মাইকা খনির ক্রমবর্ধমান রমরমায় বসতিও বেড়েছে কয়েক গুণ । ভাগ্য অণ্বেষণে ঝুমরী তিলাইয়াতে মানুষজন এসে জুটেছে সারা প্রদেশ থেকে ।
ব্যবসা বেড়েছে নানারকম । আর সেসব ব্যবসার খুঁটিনাটি কাজে, বিশেষ করে হিসেবপত্তর রাখার কাজে, মধ্য-শিক্ষিত অথচ সহায়সম্বলহীন বাঙালীকুল দশকের পর দশক ধরে এখানে এসে পড়েছে একঘর দুঘর করে ।
গড়ে উঠেছে বন্ধুভাবে আবদ্ধ একটা নাতিক্ষুদ্র বাঙালী সমাজ । তাতে যেমন আছে বিভিন্ন মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীর গদিতে কাজকরা বিশু চক্রবর্তীর মতো কিছু নিম্নবিত্ত বাঙালী, তেমনি স্কুলের শিক্ষক, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার, ব্যাংক, রেল পোস্টাপিসের কর্মচারী, ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী, ছোটোখাটো ভাতের হোটেল, ধাবা আর খুচরো দোকানের মালিকেরা।
তিন চারটি ধনবান ব্যবসায়ী বাঙালীঘর এই সমাজটাকে ধরে রেখেছে বৃহৎ পরিবারের বড়ো কর্তাদের ভূমিকা নিয়ে । শহরের সংকীর্ণমনা আভিজাত্যের গর্ব সেখানে সৌভাগ্যক্রমে অনুপস্থিত । এইরকমই দুই আঢ্য সামন্ত পরিবারের উদার দাক্ষিণ্যে আর যাবতীয় মধ্যবিত্ত প্রবাসী বাঙালীর মাসাধিক সময় জুড়ে অক্লান্ত শ্রমদানে এই দুর্গাপুজো বছরের পর বছর চলতে থাকছে নিজের গতিতে।
তার গায়ে লেগে গেছে ঝুমরী তিলাইয়ার বাৎসরিক গর্বের অনুষ্ঠানের তকমা ।
এই গল্পে বিশুদা, ফরিদপুরের বাঙাল বিশু চক্রবর্তী প্রধান চরিত্র ।
অথচ আপাতদৃষ্টিতে এই নিম্নবিত্ত মানুষটির কোনো গল্পের প্রধান চরিত্র কেন পার্শ্বচরিত্র হওয়ার যোগ্যতা নেই বলেই মনে হবে ।
স্বাধীনতার পরপরই বর্ডার পেরিয়ে কলকাতা থেকে ধাক্কা খেয়ে স্ত্রী ও এক কোলের শিশুপুত্র নিয়ে খুব সাধারণ ঘরের মানুষ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী চলে এসেছিলো এই তিলাইয়া গ্রামে ।
তার পকেটে ছিল রামপ্রসাদ রাজগড়িয়ার নতুন মাইকা খনির একটা নগন্য চাকরি । মাড়বার থেকে এসে কোলকাতায় জমিয়ে-বসা আজন্ম ব্যবসায়ী মাড়োয়ারী পরিবারগোষ্ঠীদের জন্য বাঙালীরা বরাবরের ভরসাস্থল । তাই সেই স্বাধীনতা-উত্তর বাজারে মাসিক পঁচাত্তর টাকায় রাজগড়িয়া মাইনস-এর গুদামবাবুর চাকরী জুটিয়ে কলকাতা থেকে তিলাইয়াতে চলে আসতে বিশু চক্কোত্তির খুব একটা অসুবিধা হয়নি ।
তার পরে এক যুগ কেটে গেলেও বিশুবাবুর, তিলাইয়ার বাঙালী সমাজের সর্বকার্য্যক্ষম বিশুদার, আর্থিক অবস্থার বিশেষ কিছু হেরফের হয়নি ।
সময়ে আর একটি পুত্রের আবির্ভাব হয়ে পরিবারের মাপ বেড়েছে ।
তার ওপর কয়েক বছর আগে ঝান্ডাচকের পেছনের রাস্তায় সস্তা পাট্টায় একটুকরো জমি কিনে ইটের দেওয়াল আর খাপরার চালের দু-কামরার বাড়ী করতে গিয়ে ওপার বাংলা থেকে আনা টাকাপয়সা আর সামান্য গয়নার পুঁজিও নিঃশেষ ।
উপরন্তু কোম্পানীর মালিকের কাছে হয়ে গেছে প্রচুর ধার ! দশ-বারো বছরে মাইনে কিছুটা বাড়লেও কাটাকুটি হয়ে চক্কোত্তি ঘরেতে যেকটি টাকা আসে তাতে কোনোরকমে লজ্জা নিবারণ করা গেলেও শৌখিনতার কাছা-কোঁচা দেওয়া চলে না ।
সে যাই হোক তিলাইয়া বাঙালী সমিতির যেকোনো কাজেকর্মে কিন্তু বিশুদাকে নাহলে চলে না ।
সর্বদা হাসিমুখ আর ফরিদপুরী বাঙালভাষার বুলি নিয়ে বিশু চক্রবর্তী সব কাজে হাজির ।
সমিতির বাৎসরিক দুর্গাপুজো,সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নববর্ষের অনুষ্ঠান আর দোল-হোলি এসব তো আছেই । এছাড়া বাঙালী সমিতির সদস্যদের বাড়ীর পারিবারিক অনুষ্টান আর কাজেকর্মেও সর্বজনীন বিশুদা প্রায় নারায়ণ শিলার মতো অপরিহার্য্য।
কেবল সামন্ত বাড়ীর বাৎসরিক কালীপুজোর জমকালো অনুষ্ঠানে তিলাইয়ার আর সব বাঙালীর মতো বিশুদারও সব কাজ থেকে ছুটি ।
মাইকার খনি থেকে লাগাতার লাভ করে সামন্তবাবুরা এখন নানান ব্যবসায় টাকা লাগাচ্ছেন ।
কথায় বলে টাকায় টাকা আসে । সামন্ত পরিবারের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে এখন মাইকা, কাপড় আর জমিজমার কেনাবেচায় ।
ছোট কালীমন্দির বড়ো হয়েছে । মন্দিরের সামনের জমিতে সামন্তদের তিনতলা বসতবাড়ীতে এখন ঘরে ঘরে কলকাতা থেকে চলে আসা আত্মীয় পরিজনের মেলা । সামন্তকর্তা সবাইকে জুড়ে নিয়েছেন তাঁর ব্যবসার সঙ্গে । সামন্তবাড়ীর কালীপুজো এখন হয় মহাসমারোহে । ভাড়া-করা স্থানীয় কাজের লোকে প্যান্ডেল ভরে থাকে । কোনো ব্যাপারে খরচার খামতি নেই । দুর্গাপুজোর টানা খাটুনির পর তিলাইয়াবাসী বাঙালীদের জন্য সামন্তদের এই কালীপুজোর অনুষ্ঠান একরকমের নির্ভার আরাম করার আর ‘নেমন্তন্ন’ খাওয়ার অনুষ্ঠান ।
তাদের বৌ বাচ্চাদের কাছে সেজেগুজে মাঝরাত অবধি পুজোর মণ্ডপ জমজমাট করে রাখার একটা বাড়তি আনন্দ ।
ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল মাসীর লোক মধু একেবারে তৈরী হয়ে । দু-তিন মিনিট স্টপেজের মধ্যে দশ বারোটা ছোট বড়ো ব্যাগ আর বস্তা নামানো সোজা নয় ।
তবে মধুর জন্য এটা প্রায় রোজকার ব্যাপার । কোলকাতা থেকে ঝুমরী তিলাইয়াতে যত দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র আসে তার সিকিভাগের অর্ডারই তো থাকে মাসীর কাছে ।
এ ছাড়া ব্রেকভ্যান থেকে প্রায় রোজই নামে একটা মাছের ঝুড়ি । হ্যাঁ, মাসীই তিলাইয়ার বাঙালীদের গত একদশকের বেশী সময় ধরে মাছ খাইয়ে যাচ্ছে ।
কোডার্মা-ঝুমরী তিলাইয়ার ব্যবসা জগতে এই সর্বজনীন মাসী করুণাময়ী দেবী এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ।
হাওড়া শিয়ালদা স্টেশনের মালবাবু আর কুলিদের কাছে বহু পরিচিত এই মধ্যবয়সী মহিলাটি শোনা যায় ব্যবসা শুরু করেছিল একযুগেরও আগে ডোমচাঁচ-এর সাহেবী কলোনীতে ।
সেখানে যোগান দিতে হতো কলকাতা থেকে নিয়ে আসা কারণবারি । ডোমচাঁচ-এ সেসময় সাহেবী আর দেশী আধা-সাহেবীদের ভিড় । মাইকা খনির কোম্পানীগুলো চারপাশে সবে জেঁকে বসছে । খনি থেকে চাপ চাপ মাইকার চাঙ্গড় তুলে এনে বস্তাবন্দী হয়ে ডোমচাঁচ-এর নিলামের বাজারে চলে যাচ্ছে ।
নিলামে কেনা সেই মাইকার বস্তা ঝুমরী তিলাইয়াতে এসে আঢ্য আর সামন্ত বাবুদের গুদামজাত হচ্ছে ।
প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের অনামী ঝুমরী তিলাইয়া গ্রামটা তখন দ্রুত ভারতের খনিজদ্রব্যের মানচিত্রে উঠে আসছে । ঝুমরী তিলাইয়ার ধূসর ধুলোভরা রাস্তাগুলোর ধারে ধারে তখন দেখা যাচ্ছে এক নতুন ধরনের কাজ নিয়ে বসে থাকা দিন-রোজগারী স্থানীয় মানুষজনের ভিড় ।
তাদের দুপাশে দুটো করে ঝুড়ি আর হাতে একটা ধারালো ছুরি । একদিকের ঝুড়ি থেকে অপরিস্কার মাইকার টুকরো তুলছে আর সেই টুকরোর চারপাশের ফাটাফুটো জায়গাগুলো ছুরি দিয়ে কেটে বাদ দিয়ে পরিষ্কার মাইকার টুকরো ওপাশের ঝুড়িতে ফেলছে । ঝুড়িপিছু ওজন করে হাতে হাতে মজুরীর পয়সা ।
ওদিকে সেই অভ্রের গুঁড়ো ছড়িয়ে গিয়ে তিলাইয়ার ধুলোর রাস্তা রাতের প্রথম জ্যোৎস্নায় অপার্থিব হয়ে যাচ্ছে । আর পরিত্যক্ত বাতিল অভ্রের টুকরোতে বিশাল স্তুপ গড়ে উঠছে লাট্টু মহারাজের আটাচাক্কির পাশের খোলা মাঠে । জ্যোৎস্নাআপ্লুত পূর্ণিমার রাতে সে যেন এক হীরের পাহাড় ।
দিনের আলোয় ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সেই অভ্র-পাহাড়ে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে তার চূড়ায় ওঠার সে যে কি আনন্দ ।
এইরকম একটা সময়েই বোধহয় করুণাময়ী মাসী তার সাপ্লাই-এর ব্যবসা শুরু করেছিলো ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিলাইয়ার বসতি বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে । বিভিন্ন ধরণের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মানুষজন এসে ডেরা বেঁধেছে বিহারের এই দ্রুত বদলে যাওয়া গ্রামটিতে ।
মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদার যোগান দেওয়ার তাগিদে জমে উঠেছে নানারকমের দোকানপাট ।
তার সঙ্গে সঙ্গে মাসীও তার ডোমচাঁচের বোতল-ব্যবসা ক্রমশ গুটিয়ে নিয়েছে ।
তিলাইয়ার খুচরো ব্যবসায়ী আর বাঙালী মানুষদের কাছে কালে কালে মাসী হয়ে উঠেছে তিলাইয়াতে বসে বসে কলকাতার হরেক রকমের জিনিসপত্র কেনাকাটা করার এক সহজ উপযোগী মাধ্যম ।
মাসীর কাছে ‘অর্ডার’ দিলে কি না পাওয়া যাবে…মরসুমী ইলিশমাছ থেকে শুরু করে বারোয়ারী পুজোর ঘটের সশীষ ডাব পর্যন্ত ।
মধু প্লাটফর্মে নেমে ছোট বড়ো বস্তা আর থলে গুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছে এমন সময় পিঠে একটা চাপড় খেয়ে ঘুরে দেখলো বিশুদা ।
‘হেই মোদো, সমিতির বোরা থইল্যা কি আসে ক’দিনি । সাইকেলে আসবো তো ? সব ঠিকঠাক গুছায়ে আনছস তো ?
মধু দুটো হাতল-ওলা বড়ো চটের ব্যাগ সাবধানে আলাদা করলো ।
‘এই দুটো…সব ঠিক লিস্টিমতো আছে । সাবধানে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে নিও বিশুদা…ওজন বেশী নয় তবে মাটির ঘট, সরা এসব আছে তো । তাও গুনতিতে দু-তিনটে বেশীই আছে…যদি ভেঙে যায়…তখন কোথায় পাবে এখানে ? মাসীর সবদিকে খেয়াল থাকে ।’
‘সেডা ঠিক কইছস । নাহক নিজে ব্যাবাক সামাল দ্যায় কি কইরা এই ঝন্ঝাটের ব্যাবসাখান ।’
বিশু চক্রবর্তী সাবধানে বড়ো থলে দুটো হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে স্টেশনের সাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে এগোল ।
দশকর্মার জিনিসগুলো নিয়ে বিশুকে এখন প্যান্ডেলের পাশে আড্ডিবাংলোর আউটহাউসে যেতে হবে ।
সেখানে একটা ঘর প্রতি বছর ব্যবহার করা হয় পুজোর জিনিসপত্র রাখার জন্য । আরেকটা ঘরে রান্না হয় ভোগ । আর আউটহাউসের পেছনে ছাউনির নীচে তিনদিন ধরে পংক্তিভোজনের রান্নাবান্না চলে মণ্ডপের প্রত্যেক দর্শনার্থীর জন্য । রোজ অন্তত শদুয়েক লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা !
জিনিসপত্র আউট হাউসের ঘরে নামিয়ে রেখে বিশুকে এক্ষুনি আবার ছুটতে হবে সামন্তবাড়ী ।
প্রতি বছরেই সামন্ত বাড়ি থেকে প্রতিমার জন্য মানত-করা বস্ত্র আসে । সেসব এসে গেছে দুদিন আগেই ।সামন্তগিন্নী কলকাতা থেকে পুরো পরিবারের জন্য পুজোর বাজার করে ফিরেছেন পরশু । সঙ্গে এনেছেন দুর্গা লক্ষী সরস্বতীর জরিপাড় ঝকঝকে সিল্কের শাড়ী, কার্তিক গণেশের নরুনপাড় ফাইন ধুতি । আর কলাবৌয়ের জন্য এসেছে লালপাড় কোরা খোলের ফাইন মিলের শাড়ী ।
মণ্ডপের পেছনের চালায় হরু কুমোর কাল সন্ধেয় প্রতিমায় চক্ষুদান করে ঠাকুরের গায়ে ঘামতেল চড়িয়ে দিয়েছে ।
আজ অনেক কাজ হরু কুমোরের।
ঘামতেল শুকিয়ে গেলেই সকাল সকাল শুরু করে দিতে হবে ঠাকুরের পোশাক পরানোর কাজ । তাতে খাটনি আর কারিগরি দুটোই লাগে ।
আড়েবহরে প্রমাণ সাইজের শাড়ী ধুতি কুঁচি কোঁচা দিয়ে মাটির মূর্তিকে পরানো সোজা কাজ নয়, তাতে দক্ষতা থাকা চাই ।
এরপরে আঠা দিয়ে লাগাতে হবে ঠাকুরদের সোলার সাজ, এক এক করে । তুঁতে দিয়ে ফোটানো এক জামবাটি নীল-সবুজ ময়দার আঠা তাই তৈরী হয়ে পড়ে আছে এক কোণে । সাজ পরাতেও লাগবে বেশ কিছুটা সময় ।
তবে প্রতিমার সব অস্ত্রশস্ত্র ষষ্ঠীর সকালে আড্ডিকর্তা নিজের হাতে লাগাবেন । আড্ডিবাংলার বারোয়ারী পুজোর এইটাই প্রতিবছরের নিয়ম ।
বিশু চক্রবর্তী সামন্তবাড়ী থেকে ধুতি শাড়ীর বড়ো থলেটা নিয়ে বেরিয়ে এলো ।
তরুনের সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলাবার আগে প্যাকেটের ভেতরের কাপড়গুলো দেখবার লোভ সামলাতে পারলোনা সে ।
দামী শাড়ীগুলো আর ধুতি দুটোর ওপর হালকা করে হাতটা বুলিয়ে নিতে গিয়ে অজান্তেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুকের অন্তঃস্থল থেকে ।
নিজের বাড়িতে পুজোর বাজার এবছর হয়নি বললে কম বলা হয় । মাসের খাই-খরচ চালিয়ে বাড়ীর সকলের জন্য কাপড় জামা কেনার টাকা আলাদা করে বার করতে পারেনি বিশু চক্রবর্তী ।
গদী থেকে ‘তৌহার’-এর জন্যে যেটুকু পাওয়া গেছে সেই টাকা দিয়ে বৌয়ের একটা মন্দের-ভালো শাড়ী আর ছেলে দুটোর একটা করে রেডিমেড রঙ্গীন পাঞ্জাবী কিনে দিয়েছে । নিজের জন্য কিছু হয়ে ওঠেনি ।
অবশ্য যদি কিছু কিনতেও পারে বিশু, পুজোর চারদিনের উদয়াস্ত কাজকর্মের চাপে নতুন কাপড়জামা পরে নিয়ম রক্ষা করারও সময় থাকে না তার ।
ছেলেদুটোর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বিশু বলেছে পুজোর মণ্ডপের অতো মানুষের ভীড়ে তাদের পুরোনো ধুতি কারুর নজরে পড়বে না ।
তবে সামন্ত বাড়ির কালিপুজোর রাতে পরবার জন্য বাবা তাদের জন্য নিশ্চয়ই নতুন ধুতি আনবে। একথা শুনে চক্রবর্তী গিন্নী তার দিকে জিজ্ঞাসার চোখে তাকিয়েছে । দৃষ্টিতে যেন একটু মৃদু ভর্ৎসনা…’কেন ছেলে দুটোকে মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছো ?’
বিশু চক্রবর্তী জানে তার পকেটের অবস্থা বৌয়ের অজানা নয় । মাসমাইনের বেশ কিছুটা টাকা গদীতেই থেকে যায় এই দুকামরার ঘরের ধার শোধ করতে ।
মুদিখানার জিনিসপত্র আসে দুর্গাদার দোকান থেকে মাসকাবারী ব্যবস্থায় । অবরে সবরে ছেলেদুটোর সাধ মেটাতে গিয়ে প্রতিমাসেই আবার কিছু বাড়তি ধার হয়ে যায় সেই দুর্গাদার কাছেই । যেমন মাস দুয়েক আগে হলো ।
বর্ষা তখন সবে কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়ে বিহারে ঢুকেছে । তিলাইয়ার সম্পন্ন বাঙালীঘরের জন্য মাসীর মাছের ঝুড়িতে তখন প্রায় রোজই শেয়ালদা থেকে দুতিনটে ইলিশ মাছ আসছে !
স্কুলের বাঙালী বন্ধুদের কাছে প্রায়ই সে গল্প শুনে শুনে ছেলেদুটো অবুঝ বায়না ধরেছিলো তারাও ইলিশ মাছ খাবে । মায়ের লাগাতার তর্জন বকুনিও তাদের দমাতে পারেনি । শেষমেশ বৌয়ের ভর্ৎসনার চোখ উপেক্ষা করে বিশু ছেলেদের কথা দিয়েছিলো যে শিগগীরই ওদের পেট ভরে ইলিশ মাছ খাওয়াবে ।
সেই কথা রাখতে গিয়ে বিশুর বাঁহাতের একমাবদ্বিতীয়ম ফিনফিনে সোনার আংটিটা দুর্গাদার দোকানে বাঁধা পড়ে আছে ।
কাজের জায়গায় আঙুলের ওপর হাতুড়ি পড়ে গিয়েছিলো এই অজুহাতে আঙুলে কাপড়ের পট্টি বেঁধে রেখেও বিশু শেষরক্ষা করতে পারেনি । ছেলেদের চোখের আড়ালে রাতের অবসরে বৌ ফোঁপাতে ফোঁপাতে আঙুলের পট্টি খুলে দিয়েছিলো । বৌকে জড়িয়ে ধরে বিশুকে আবার কথা দিতে হয়েছিলো তিনমাসের মধ্যে টাকা জোগাড় করে ওই আংটি দুর্গাদার কাছ থেকে সে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবে।
সে সুযোগ এখনও আসেনি । আর বিশু বেশ জানে এই পুজো পার্বনের বাড়তি এটা সেটা খরচার মাসগুলোতে সে তো হওয়ার নয় ।
তবে বিশুর সঙ্গে কালনা-দাঁইহাটের দূর্গা করের প্রায় দশ বছরের জানাশোনা । দুজনে প্রায় একই সময়ে তিলাইয়ার মাটিতে পা রেখেছিলো । তাই দোকানে জিনিসপত্র নিতে এলেও বিশু লজ্জা পাবে ভেবে দুর্গাদা আংটি প্রসঙ্গে কোনো কথা তোলে না !
সে জানে হাতে টাকা এলেই বিশু সঙ্গে সঙ্গে আংটি ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে ।
ঘামতেল মাখানোর পরে সাবেকী ধরণের টানা টানা দুই চোখ আর তৃতীয় নয়ন নিয়ে হালকা হলুদ বরণ মায়ের মুখ একেবারে চকচক করছে । একচালার দুর্গাপ্রতিমা তাঁর পুত্রকন্যা নিয়ে মণ্ডপের বেদীতে ওঠার জন্য তৈরী হয়ে যাবে আজ রাতের মধ্যেই ।
ঠাকুরের কাঠামোর পিছন দিকে একটা উঁচু টুলের ওপর উঠে হরু কুমোর রঙ্গীন চালচিত্রের অংশগুলো পরপর লাগাচ্ছিল । নীচে দাঁড়িয়ে ওর ছেলে, একটা একটা করে চালচিত্রের টুকরো হাতে তুলে দিচ্ছে । বিশুকে দেখতে পেয়ে হরু প্রতিমার পিছন থেকে বলে উঠলো,
‘ও বিশুদা ! তোমার হাতের প্যাকেটে কি…ঠাকুরের কাপড়চোপড় এনেছো নিশ্চয়ই ? রাখো রাখো, ওই চেয়ারটার ওপরে রাখো । এটা শেষ করেই কাপড় পরানোর কাজে হাত দেব ।’
বিশু ভাবে কলকাতার কুমোরটুলির হরু কুমোর তো এখানে ঠাকুর গড়তে আসছে বোধহয় সেই বিশবছর ধরে ! শুনেছে সামন্তদের বুড়োকর্তা প্রথম বহাল করেছিলেন ! বিশু চক্রবর্তীর থেকে অন্তত পনেরো বছরের বড়ো হরু কুমোর বিশুকে ‘বিশুদা’ বলে ডেকে ডেকে বোধহয় ব্রাহ্মণের সম্মান দেয়…অন্যমনস্ক হয়ে বিশু চক্রবর্তী এইসব ভাবতে থাকে।
ভাৱতে ভাবতে তার প্রতিমার মুখের দিকে দুচোখ গিয়ে পড়ে ।বিশু দেখে ত্রিনয়নী মা দুর্গা তাঁর মাথার পিছনে শিবের উজ্জ্বল রঙ্গীন পটচিত্র নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন ।
ও জানে কাল রাতে হরু কুমোর কাচা কাপড় পরে শুদ্ধমনে মায়ের চক্ষুদান করেছে ।
বিশু এটাও জানে যে শাস্ত্রমতে মাটির প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠায় চক্ষুদান হচ্ছে প্রথম ধাপ যা সম্পূর্ণ হয় অষ্টমী-নবমীর সন্ধিপুজোর পুণ্যসময়ে । অজান্তেই বিশুর দুচোখ বুজে যায়, হাতদুটো জোড়া হয়ে বুকের মাঝে উঠে আসে, চোখ বুঁজে সে বিড়বিড় করতে থাকে,
‘বসন পরো মা…তুমি তোমার বসন পরো । আমি তো ছেলেদের বচ্ছরকার নতুন কাপড় কিনে দিতে পারিনি । উপায় নেই জেনেও তবু ওদের মুখ চেয়ে কথা দিয়েছি । তুমি তো সব জানো মা । বিপত্তারিণী, এই বিপদ থেকে বেরোনোর পথ তুমি আমাকে দেখাও। ছেলেদের কাছে এই অক্ষম নির্ধন বাপের মিথ্যেবাদী হওয়ার লজ্জা থেকে বাঁচাও তুমি !’
বিড়বিড় করতে করতে বিশুর বন্ধ দুচোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে হরু কুমোর আর তার ছেলে অবাক হয়ে এ দৃশ্য দেখতে থাকে ।
মাটির প্রদীপ পাওয়ার কোনো অসুবিধে নেই বিহারের কোনোখানে । এদেশে প্রদীপকে বলে দিয়া । দীপাবলীর আগ দিয়ে বাজারে, রাস্তার ধারে দিয়া-র ঢের লেগে যায়, সঙ্গে বিক্রি হয় তিসির তেল বড়ো বড়ো টিনের ক্যানেস্তারাতে। যার যেমন দরকার দিয়া আর তেল কিনে নিয়ে যায় ।
দেওয়ালীর রাতে পুরো তিলাইয়া দিয়ার আলোয় সেজে ওঠে ।
সন্ধিপুজোর একশো আট প্রদীপের জন্য তাই মাসীকে অর্ডার দেওয়ার দরকার পড়ে না ।
ঠাকুরের বেদীর সামনে কলাগাছের বাসনার ওপরে একশো আটটা বড়ো দিয়ার সারি তেল ভর্তি করে সলতে লাগিয়ে সাজানো রয়েছে ।
বেশী করে তেল দেওয়া বেশ বড়ো বড়ো প্রদীপ । সন্ধি পুজোর মহার্ঘ সময়টুকুতে কোনো প্রদীপ যেন নিভে না যায় ।
সন্ধিপুজোর দিয়া জ্বালাতে পারলে নাকি সবরকমের সুখ আর সমৃদ্ধি পাওয়া যায় ! কুমারী মেয়ের ভালো বিয়ে, বন্ধ্যার সন্তান আর নির্ধনের হয় ধন !
তাই এই বেশী রাতেও অনেক মেয়ে- বৌরা সব সার বেঁধে হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে পুরোহিত ঠাকুরের নির্দেশের জন্য তৈরী । ইঙ্গিত পেলেই এক এক করে প্রদীপ জ্বালাতে শুরু করবে । সেই লাইন ঠিক করার দায়িত্বেও রয়েছে বিশু চক্কোত্তি !
‘সব্বাই ঠিক কইরা লাইনে খারান, এক লাইন..এক লাইন…ধাক্কাধাক্কি কইরেন না ।’
লাইনের প্রথমেই ভারী চেহারার আড্ডি গিন্নী পরিবারের দুই বৌকে নিয়ে । পেছনেই দাঁড়িয়ে সামন্ত পরিবারের বড়ো বৌ । তার পেছনে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার মজুমদার বাবুর তিন কিশোরী মেয়ে, গায়ে দামী কাপড়ের একই ডিজাইনের ফুলহাতা জামা । লাইনের পেছন থেকে মলিনা কাকিমার খরখরে মন্তব্য,
‘ওলো মায়ের পূজার দিনে এমোন পারা পুরাহাতা জামা পরস ক্যান ?’
ছোটজন দুই দিদির সঙ্গে চোখাচোখি করে ! তারপর বিব্রত মুখে জবাব দেয়,
‘ওই…আমাদের ঠান্ডা লেগে যেতে পারে তো…তাই ।’ বলে দিদিদের দিকে আবার ভর্ৎসনার চোখে তাকায়…ভাবখানা এই, ‘এবার দ্যাখ, মাকে বলেছিলাম কিনা এই জামাগুলো পরতে বোলো না…এখন কথা শোনো ।’ দিদিরা চুপ করেই থাকে…কি আর বলবে ।
মলিনামাসীকে কিন্তু থামানো যায় না,
‘তদেরই ক্যাবল ঠান্ডা লাগে রে !’
এবার আসরে নামেন সামন্তদের বড়ো বৌ । পিছন ফিরে মজুমদার কন্যাত্রয়ের করুণ মুখগুলোর দিকে একঝলক তাকিয়ে হাসিমুখে বলেন,
‘আহা ওদের অমন করে টুকছো কেন মলিনা ? ওরা হচ্ছে ডাক্তারবাড়ীর মেয়ে ! ওরা তো আমাদের থেকে বেশী সাবধান হবেই ।’
তিন ডাক্তারকন্যা সামন্তগিন্নীর দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে থাকে।
সামন্তবাড়ী হচ্ছে এই পুজোর বেসরকারী ছোটতরফ ! তাই কথাবার্তার মধ্যে সেবাড়ীর মালকিনের বাধিত অনুপ্রবেশে কথা আর এগোয় না, মলিনামাসী চুপ করে যান ।
ইতিমধ্যে পুরোহিতমশাইয়ের সবুজ সংকেত পেয়ে আড্ডিগিন্নী কষ্ট করে নীচু হয়ে প্রথম প্রদীপটি জ্বালিয়ে দেন । পুণ্যকামী স্ত্রী-কন্যার লম্বা লাইন ধীরে ধীরে এগোতে থাকে ।
সন্ধিপুজোর আরতির কর্ণভেদী বাজনা এই মাঝরাতে বোধ হয় পাঁচমাইল দূর থেকে শোনা যাচ্ছে !
কোলকাতা থেকে আসা প্রতিবছরের নিয়মিত দুই ঢাকি, ঢুলী আর কাঁসির সঙ্গে জোট বেঁধেছে স্থানীয় এক কাড়া-নাকাড়া পার্টি । সব মিলিয়ে জগঝম্প শব্দতরঙ্গের সে এক বিপুল সমাহার !
ধুনোর ঘন ধোঁয়ায় প্রতিমা, আরতি-রত পুরোহিত, তন্ত্রধারক সকলকেই আবছা দেখা যাচ্ছে।
সন্ধিপুজোর এই রাতেও প্রায় শখানেক মহিলা-পুরুষ হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে । প্রায় সকলেরই চোখ বন্ধ ! ভক্তিভাবের সঙ্গে কিছুটা ধুনোর ধোঁয়ার কারণেও বটে ! অনেকেই মা-মা করে স্বগতোক্তি করছে ।
এই ভীড়ের মধ্যে বিশু চক্কোত্তি এককোণে দাঁড়িয়ে, খোলা চোখে একদৃষ্টে সে মা দুর্গার মুখের দিকে তাকিয়ে।
এই পুণ্য সময়ে মায়ের মাটির প্র্রতিমাতে তো প্রাণের অধিষ্ঠান হয় ! বিপদত্তারিণী মা কি তাহলে এই মুহূর্তে বিশুর প্রাণের আকুতি, তার একাগ্র প্রার্থনা শুনতে পাচ্ছেন ?
বিশুর চোখ এক অদ্ভুত আবেগে বন্ধ হয়ে গেলো । কতক্ষণ ওই ভাবে কেটেছে তার খেয়াল নেই ।
হঠাৎ সব বাজনার আওয়াজ থেমে যেতে চোখ খুললো সে। সবাই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণামে ব্যস্ত ।
তার দৃষ্টি সোজা গিয়ে পড়লো মায়ের মুখের ওপর…এক মুহূর্তের জন্য তার সারা শরীরে একটা শিহরণ..বিশ্বনাথ চক্রবর্তী যেন স্পষ্ট দেখতে পেলো আড্ডিবাংলোর মা দুর্গা তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন !
দশমীর দুপুর। পান, সিঁদুর আর সন্দেশ দিয়ে মায়ের সপরিবার বরণ সারা হয়ে গেছে ।
একচালা প্রতিমা বেদী থেকে নামিয়ে রাখা ! পেছনের চালচিত্র খুলে ফেলা হয়েছে।
বেশ কিছু স্থানীয় মেয়েপুরুষ এখন এই শেষ বেলায় মায়ের প্রতিমাকে প্রদক্ষিণ করে প্রণাম করতে এসেছে । এখানে দশমীর দুপুরের এটাই দস্তুর । ঠাকুরের সামনে রাখা প্রনামীর থালাও ভরে উঠছে নানারকম মুদ্রায় ! ওদিকে সধবা বাঙালী মহিলারা একে অপরকে সিঁথি আর হাতের নোয়ায় সিঁদুর ছুঁইয়ে মুখে মিষ্টি দিতে ব্যস্ত ।
আর অবিবাহিত মেয়েরা মনের আনন্দে সিঁদুর মাখছে আর অন্যকে মাখাচ্ছে।
কাড়া-নাকাড়ার দলের ছুটি হয়ে গেছে।কলকাতার ঢাকিরা বাজাচ্ছে বিজয়া দশমীর চেনা ধুন…ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন ।
বিশুদা এখন একটা কাজের লোকের ওপর বাঙালী হিন্দিতে হাঁকডাক করছে ।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেদীর চারপাশের চারপাশে জমে-ওঠা ফুল, মালা, বেলপাতার আর সরা খুরির ঢেরকে বস্তাবন্দী করতে হবে । বেদীর সামনের পুরো জায়গাটা পরিষ্কার করে রাখতে হবে ।
সন্ধ্যের পরে এখানেই ফরাস পাতা হবে । শান্তির জল নিতে সকলে একজোট হবে ।
তারপরেই শুরু হবে শুভ বিজয়া, বড়োদের প্রণাম আর সমবয়সীদের মধ্যে কোলাকুলি ।
সামন্তদের বড়ো ট্রাকটা ধীরে ধীরে মণ্ডপের ভেতরে প্রতিমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো ।
সূর্য ঢলতে শুরু করেছে পশ্চিমে ।
এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা পুরোনো মাইকার খাদে বছরের পর বছর বর্ষার জল জমে একটা বিরাট দীঘির মতো হয়ে গেছে । বাঙালীরা বলে খাদান-দীঘি ।
বেশ কিছু বছর ধরে আড্ডিবাংলার দুর্গা প্রতিমা ওই খাদান-দীঘিতে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে ।
ঠাকুরের কাঠামোতে একটা মোটা লম্বা দড়ি বেঁধে পাঁচ ছজন শক্তপোক্ত মানুষ প্রতিমা নিয়ে কোমরজলে নেমে পড়ে।
তারপর প্রতিমাকে তিনপাক ঘুরিয়ে নেবার পর মূর্তির মুখ আকাশের দিকে করে ধীরে ধীরে জলে নামিয়ে দেয় । দড়ির অন্য দিকটা দীঘির পারে একটা খোঁটায় বাঁধা থাকে । কদিন পরে কাঠামোটাকে টেনে পারে উঠিয়ে আনার জন্য ।
তিনজন লোক আগে উঠে গেলো ট্রাকে ।
কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে অক্লান্তভাবে ‘আসছে বছর আবার হৰে’ চেঁচিয়ে যাচ্ছে ।
নীচে থেকে কয়েকজন কাঠামো ধরে প্রতিমা উচুঁ করে তুলে ট্রাকে তুলে দিলো ।
এবার ঢাকি, ঢুলী আর তাদের কাঁসি-বাজানো ছোট ছেলেটা উঠলো।
এরপর ফটাফট সবাই উঠতে লাগলো । তরুণ, মলয় আর বিকাশ টেনে টেনে সবাইকে তুলছে ।
প্রতিমার বেদীর পাশ থেকে বিশু হাঁক লাগালো, ‘ওরে তরুণ, সব ছুট বাচ্চাগুলার বাপে উঠসে কিনা খেয়াল রাখস কিন্তু ।’ বিশুদা নিজে তো ড্রাইভারের পাশে বসবে । প্রতি বছরে ভাসানযাত্রায় ওটাই তার পার্মানেন্ট সীট !
বিশাল খাদান-দীঘির জল শান্ত টলটল করছে । চারদিক একেবারে সুনসান ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আলো মরে গিয়ে সন্ধে নেমে আসবে । দীঘির ওপারে এখন কমলা রঙের নরম সূর্য ।
দীঘির জলের ওপর তার আলোর একটা হালকা ছটা । আশপাশের বন্ধ্যা উঁচু নিচু জমিতে প্রচুর কাঁটাঝোপ আর দূরে জংলী গাছের নিবিড় সারি ।
এদিকটায় বসতি প্রায় নেই । ইঁটের খোয়া দেওয়া একটা রাস্তা চলে গেছে মাইল কুড়ি দূরের তিলাইয়া বাঁধের দিকে । সে রাস্তা থেকে একটা সরু ধুলো পথ দিয়ে কিছুটা এলেই এই দীঘি ।
ঠাকুর নামিয়ে এখন শেষবারের মতো বাচ্চাদের নাচ চলছে ঢাকের চেনা বোলের সঙ্গে !
দুটো বড়ো ধুনুচি মাটিতে নামানো…ধুনো আর গুগগুলের সুগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
একমাস ধরে লাগাতার পরিশ্রমের পর বিশুর শরীর এখন ক্লান্ত,মন কেমন যেন শূন্য…চারপাশে যা ঘটছে কিছুই যেন তার মনে কোনো দাগ কাটছে না !
তরুণ, অসীম, বিকাশরা কয়েকজন ধুতি মালকোঁচা দিয়ে প্রতিমার কাঠামো ধরে উঁচু করে ধীরে ধীরে জলে নামতে থাকলো ! বিশুদা বিশুদা করে ডাকাডাকিও করলো ওরা !
বিশু জলে নামলোনা, পাড়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো !
জলের মধ্যে প্রতিমা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে ! মায়ের মুখ সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার আগে বিশুর হঠাৎ আবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো…মনে হলো মা বিপত্তারিণী দুর্গা যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন ।
শহরে ঢোকার মুখেই ট্রাক থামিয়ে বিশু নেমে পড়লো । এখান থেকে তার বাড়ী দশ মিনিটের হাঁটা পথ । ট্রাকের পেছনদিকে গিয়ে সে বললো,
‘তরা চিন্তা করস না, আমি সান্তিজলের আগে ঠিক গিয়া পড়ুম !’
ট্রাকের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যেতে না যেতেই বিশু চক্রবর্তী জোরে হাঁটা লাগলো উল্টোদিকে !
খাদান-দীঘি এখান থেকে প্রায় একমাইল রাস্তা, জোরে হাঁটলে মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে যাবে ।
খাদান দীঘির জলের রং এখন ধীরে ধীরে কালো হয়ে উঠছে ।
সূর্যাস্তের শেষ আভাটুকু রয়ে গেছে ধূসর রঙের আকাশে । দীঘির পাড়ে, সরু কাঁচা রাস্তায় জনমানবের চিহ্ন নেই । চারিদিক শব্দহীন । কেবল দূরের জংলী গাছগুলো নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রয়েছে নীরব সাক্ষীর মতো ।
চারিদিকটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে ধুতিটা মালকোঁচা দিয়ে এইবার বিশু জলের মধ্যে নামলো । কোমরজলে দাঁড়িয়ে কাঠামো-বাঁধা দড়িটা ধরে টানতে লাগলো ও !
মা দুর্গার হাসির অর্থটা একটু আগেই বুঝতে পেরেছে বিশু চক্রবর্তী !
এখন তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করে ফিরতে হবে । ওর বাড়িতেও কার্তিক গণেশ অপেক্ষা করে আছে যে !
Tags: বিপত্তারিণী, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
Chandan Saha on October 14, 2019
Nice picturisation of a Durga puja in a small place in rural areas. A person like Bishuda is everywhere, who serves with full dedication. Character of Bishuda is potraited in a unique way. Such write reminds our childhood time in Durga puja, spent in small town. Thanks to the esteem writer to place such write up encompassing many incidences in Puja time so lucidly.
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।