(মৃদুল দাশগুপ্তের এই পাঠ-প্রতিক্রিয়াটি ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮, শিশির মঞ্চে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ৭৯-তম জন্মদিনে পঠিত হয়েছিল)
আজ এই সন্ধ্যায় কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঊনবিংশতম জন্মদিনে, কবির স্মরণসভায়, তাঁর কবিতা সম্পর্কে আমাকেও কিছু বলার প্রশ্রয় দিয়েছেন স্মরণ কমিটির উদ্যোক্তারা, এজন্য আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি, কবিতার গভীর নানা তত্ত্ব, তার রূপ, কলা, বিভাব নানান ব্যাখ্যান নিয়ে গত কয়েক বছরে এই বিশেষ দিনটির সান্ধ্যোজ্জ্বল সভায় যাঁরা বলেছেন, আমি তাঁদেরই এক অকৃতী ছাত্র। আমি প্রতি বছর এই সভার আলোচনায় সমৃদ্ধ হয়েছি বটে, কিন্তু সেই সারি থেকে আমার মতো অস্থির কবিতা পড়ুয়াকে এবার একেবারে আলোচকের আসনে তুলে এনে উদ্যোক্তারা এক দুর্ঘটনাই বাঁধিয়ে দিয়েছেন। কাণ্ডারীর বদলে নৌকা চালাবার দায়িত্ব রাখালকে দিলে যা হয়।
হয়তো স্মরণ কমিটির উদ্যোক্তারা এবার চাইছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় সাধারণের মতামত। সেই বিবেচনায় দ্বিধাসঙ্কোচেও রাজি হয়েছি। উনি আমাদেরই কবি। ওই ছবির দিকে তাকিয়ে, মনে জোর এনে, জলে নেমে পড়েছি। আপনারা সুধী শ্রোতৃমণ্ডলী, কবিতাকুহকের যাত্রীসকল, আপনারা তা সহ্য করবেন, আমি নতমস্তকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
তাহলে শুরু করা যাক এক রূপকথাই। আমার বাল্যের, কৈশোরের সে রূপকথা আমার একার নয়। যেন, আজ থেকে সেই অনেক অনেক বছর আগে অথচ যেন এই সেদিন, ভারতেতিহাসের এক গ্রন্থিসময়ে, এই পূর্বপ্রান্তে দিনবদলের স্বপ্নতাড়িত তামাম জনতার মাঝে এক অক্লান্ত চারণ ঘুরে ঘুরে শুনিয়ে ছিলেন তাঁর গান, তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রাজনীতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, কবিতা করেনি। কবিতাজনতার স্বপ্নও মুছে যায়নি।
বাম-মার্গিতায় তখন তারুণ্যের জৌলুস ছিল। কমরেড শব্দটি আজকের দিনের মতো কৌতুকী হয়ে ওঠেনি। স্মরণ করা দরকার, ষাট দশকের সেই শেষভাগে আমাদের রাজনৈতিক বন্ধুরা, পূর্বজদের ভ্রূকুটিতে দেখেছিলেন, সন্দেহ করেছিলেন, চিহ্নিতও। তাঁরা আঘাত করেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক প্রথাবদ্ধতায়, তছনছ করেছিলেন ব্যবস্থা। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমার সময়সঙ্গী কবিরাও তাঁদের প্রাথমিক উদ্ভাসে, বর্ণালির অপরূপ ছটায় নতুন কবিতার ভাবাদর্শে ছিলেন মুক্তিকামী। অগ্রজদের অবাধে তাঁরা গ্রহণ করেননি। প্রকাশ্যে আজ একথা বলতে কুণ্ঠা নেই, আমরা, আহত প্রজন্মের কিশোরতরুণেরা সেদিন গ্রহণ-বর্জন বিষয়ে যাচাইয়ের নির্মমতা সময়ের কাছ থেকেই অর্জন করেছিলাম। অথচ সেই সত্তর দশকের উন্মেষকালে তিন দশক উজিয়ে এসে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেন আমাদের আগলে ধরতে চেয়েছিলেন। আলো, আগুন, ভস্মের সেই আলোড়নহীন সময়কালে কবিতাশ্রয়ী প্রতিবাদী মানুষটিকে কেবলই আমাদের মনে হয়েছে, উনি আমাদের সখা। আমার ভাবতে ভাল লাগে, তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া হাত আমরা গ্রহণ করেছিলাম। মনে রাখা দরকার, ১৯৬৮, ৬৯, ৭০ সালের সেই উদ্ভাসিত সময়ে বাংলা কবিতার আদিগন্ত শ্যামলভূমিতে তিরিশ চল্লিশের দশকের দেবদূতরা কেউ কেউ সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু আমরা তো তখন অভিভাবকত্বকে তাচ্ছিল্যই করেছিলাম। তাছাড়া, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো তাঁরা কেউ মাটিতে, আমাদের এত কাছে নেমে আসেননি। এ প্রসঙ্গে বলি, কবি অরুণ মিত্র তখন ছিলেন প্রবাসী, ওই সময় তাঁর কবিতার সঙ্গে তেমন পরিচিতও ছিলাম না। শেষ সত্তরে, আশির দশকে গোড়ায় তিনিও আমাদের বন্ধুতা অর্জন করেছেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আজ তিনি এ-সভায় আসতে পারেননি। আমি ওই চিরতরুণ কবির আরোগ্য কামনা করছি।
আমাদের কিশোর বয়স থেকেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে আমাদের সাথী হয়ে উঠেছিলেন, আমরাও মেনেছিলাম ইনি আমাদের, আমি আজও তার দুটি-একটি সাবুদ দেখাতে সক্ষম। বলা দরকার সত্তর দশকের ছোট পত্রিকাগুলিতে অঘোষিত এক সতর্কতা জারি ছিল। অগ্রজদের রচনাদি এসব পত্রে সাধারণত প্রকাশিত হত না। এমনই একটি অগ্নিগর্ভ পত্র হাওড়ার প্রিতম মুখোপাধ্যায়, অরণি বসু সম্পাদিত ‘উলুখড়’-এ সম্ভবত ১৯৭২-এ প্রচ্ছদেই ছাপা হয়, পুনর্মুদ্রণ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘লেনিন শতবর্ষে’ কবিতাটিঃ
কবর থেকে উঠে এলেন
সামনে মহৎ সভা
অবাক হয়ে দেখেন তিনি
ভাষণ দিচ্ছে বোবা!
আরও অবাক, শুনছে যারা
জন্ম থেকেই বধির তারা
যে মুহূর্তে মুখ ফেরালেন
হাঁ হতোস্মি বলে
লক্ষ খোঁড়ার মিছিল গেল
তাঁকেই পায়ে দলে।
ছাত্রবয়সে ‘উলুখড়’-এর এই কবিতাটি পড়ামাত্র আমার মুখস্থ হয়ে যায়, যত্রতত্র বন্ধু জমায়েতে আমি এই কবিতাটি শুনিয়ে তাদের মুখচোখে কবির প্রতি সমর্থন লক্ষ করেছি। মফস্বলী পানশালায় শ্রমী জনতার মৌতাতে, কখনও রিকশাচালকের মজলিশে, আমি কবিতাটি বারংবার শুনিয়ে, তাঁদের নিজস্ব ধরনের সহর্ষ মুগ্ধতা লক্ষ করেছি। মাত্র বিশ-পঁচিশ বছরে যুগ পরিবর্তন ঘটেছে, তাই আজকের কূপবদ্ধতায় এসব অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, সেজন্য আমি গোড়াতেই বলেছি এ হল গিয়ে, রূপকথা।
‘উলুখড়’ পত্রিকার ওই সংখ্যাটি আমার এলোমেলো বইপত্রের স্তূপে চটজলদি খুঁজে পাইনি, কিন্তু সাবুদ হিসেবে নিয়ে এসেছি এই লাল পুস্তিকা দুটি —
(দুটি পুস্তিকা প্রদর্শন, দুটিরই আকার অর্ধ-ডিমাই। প্রচ্ছদ রক্তবর্ণ। তাতে সাদা হস্তাক্ষরের হরফে ছাপা।)
এই পুস্তিকা দুটি ১৭/১৮ বছর আগেকার। আকার আকৃতি, প্রচ্ছদের রং ইত্যাদি দেখে গেরিলা ধাঁচের উদ্যোগ বলেই বোঝা যাচ্ছে। ‘এই সময়ের রাজনৈতিক গদ্যপদ্য’ নামে এই লালপুস্তিকা দুটি পরপর বের হয়েছিল১৯৮১, ৮২ সালের বইমেলায়। বিতরণের জন্য। ‘কৃষ্ণপক্ষ’ পত্রিকার উদ্যোগে, কবি রণজিৎ দাশের সম্পাদনায়। সত্তরের কবি লেখকদেরই রচনার বারুদে ঠাসা। এর মলাটেও কিন্তু বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। সখ্যতার সাবুদ। আফ্রিকার লোকগাথার সেই অনুবাদ…প্রতুল মুখোপাধ্যায় যে কবিতাটি গান করেছেন —
হে ছোকরা চাঁদ
হেই জোয়ান চাঁদ
(দু এক কলি গাইবার চেষ্টা)
পুস্তিকা দুটির ভেতরেও রয়েছে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। আমাদেরই কবিতার সঙ্গে। যেন আমাদের সঙ্গে তিনি আজও বসে আছেন। যেন আমাকে এখনও বলছেন, তুমি একটা বিড়ি খাবা?
সে বিড়ি ফুরোয়ও না, নেভেও না।
আজ থেকে ৫৫ বছর আগে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘গ্রহচ্যুত’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কবির বয়স তখন ২৪। রবীন্দ্রনাথ সবে প্রয়াত হয়েছেন। যুদ্ধ, ধ্বংস, মারীর দুঃসহ দিনগুলিতে জেগেছে প্রতিরোধের, মুক্তির প্রয়াস। প্রগতির নতুন দিনের হাওয়ার মাতনও সেদিনের বাংলা কবিতায়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই সূচনা, আর আজ এই শতাব্দীপ্রান্ত — কবিতা পড়ুয়া হিসেবে শুরু করার বিচারে আমার স্থান বিবেচনা করতে পারি ওই ৫৫ বছরের মাঝখানটিতে। বস্তুত ১৯৬৭-৬৮-৬৯ সালে যে লেখাগুলি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, অরুণ ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘উত্তরসূরি’ পত্রে আমি কিশোর বয়সে তা পড়ে ফেলতে থাকি। ১৯৭০-৭১ সালগুলি দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। এরপর বন্দীহত্যা, গণহত্যা, বস্তুত একটি প্রজন্ম ধ্বংস করে দেবার ষড়যন্ত্রপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে বুদ্ধিজৈবিক মূকবধির ধূর্ততার ভেতর কেবল তাঁর , কেবল তাঁরই ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী এবং বেদনাবাহী কণ্ঠটি চিনতে আমাদের ভুল হয়নি। তাঁর প্রতিবাদী কবিতায় কাব্যিক কুয়াশার আত্মরক্ষী বর্ম ছিল না। তাই তিনি আমাদের আপনজন হয়ে উঠেছেন।
‘রক্তমাংস’ পত্রিকায় সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে আমার নিকট অগ্রজ কবি কালীকৃষ্ণ গুহ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত নিজের একটি কাব্যগ্রন্থ (রক্তাক্ত বেদীর…) সম্পর্কে জানিয়েছেন, হুবহু তা তুলে দিচ্ছি –
“…সেই সময় চোখের সামনেই অনেকের লেখার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ব্যাপারে ছিল। তাঁদের মতো লিখতে চাইতাম। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রথম জীবনে তাঁর লেখা পড়ে আমি খুব আলোড়িত হই। মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার অতিঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং সারা জীবন ওঁর লেখা আমার ভাল লাগত। আমার মনে হয়, তিনি আমাদের মধ্যে অত্যন্ত বড় মাপের কবি ছিলেন, বিশুদ্ধ কবি ছিলেন।”
কালীকৃষ্ণ গুহ আরও বলেছেন, “…যদিও অনেকে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে রাজনৈতিক কবি হিসেবে নির্ধারণ করেন এবং বস্তুতই প্রচুর রাজনীতির লোকেরা, বিশেষ করে অতিবামপন্থী রাজনীতির লোকেরা একসময় তাঁদের কবি বলে ওঁকে মানতেন। কিন্তু আমি মনে করি, রাজনৈতিক কবিতায় থাকে না। আশ্চর্য বিমূর্ততা ছিল ওঁর কবিতায়, যা আমাকে আকর্ষণ করেছে।”
কালীকৃষ্ণ গুহ কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর যে নৈকট্যের ঋণ স্বীকার করেছেন, আর আমি যে সখ্যতার কথা বলছি, বিনীতভাবে বলি, তা কিছু বা ভিন্ন ধরনের। ১৯৬৯-৭০-৭১, সময়ের ঘোরেই আমাদের কৈশোর সহসা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিল। সূচনামাত্রেই সত্তর দশকের কবিতা বহুধা ও বর্ণময়, আমার সময়সঙ্গীরা সেইসময় থেকেই রঙিন ও অপরূপ। উদ্ভাসের সেই আগ্নেয় অস্থিরতায় কবিতার বিশুদ্ধতা হয়তো আমরা বিনষ্ট করেছি। পূর্বজদের অনুসরণের সাধ হয়নি আমাদের। এই যে সুব্রত (১), আজ যিনি পুরস্কৃত হলেন, আমাদের এই সঙ্গী নিজস্ব-দুর্ঘট পটুত্বে মহাকাশীর দক্ষতাই অর্জন করেছেন। তাঁকে অভিনন্দন।…যা বলছিলাম, আপন আপন দিশাভ্রষ্টতাতেই আমরা ছিলাম দশদিকেরই, আজও কি নই পথসন্ধানী? তা সত্ত্বেও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের নিকটজন হলেন কী করে? আমাদের ক্ষতবিক্ষত দেখে বিচলিত, ব্যথিত হয়েছিলেন তিনি। তারুণ্যের স্পর্ধায় হয়েছিলেন উজ্জীবিতও। আমরা সমাদরে তাঁকে সঙ্গী মেনেছিলাম।
সেদিন, সেই অভাব অনটন আকালের মফস্বল, মন কেমন করে ওঠা এক বালকের হাতে পত্রপত্রিকা পুস্তিকায় উড়ে উড়ে এসেছিল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। হ্যারিকেন হাতে করে সে বালক পড়তে যেত, তারই সমবয়সী, তারই মতো ক্লাস সেভেনের এক ছাত্র নুরুল সে বার কোথায় যেন কেরোসিনের দাবিতে গুলি খেয়ে মরে গেল…আর সারা বাংলায়, তাদেরও ছোট শহরে ক্লাস সেভেনের ছেলেরা হরতাল-মিছিলে নেমে দুম করে কয়েকটা দিনেই বড়ো হয়ে গেল, দেওয়ালে দেওয়ালে লিখতে লাগল রূপকথা, সে এক রূপকথাই। এই রূপকথার মধ্যেই সে পড়েছিলঃ
একজন কিশোর ছিল একদম একা
আরও একজন ক্রমে বন্ধু হল তার।
দুয়ে মিলে একদিন গেল কারাগারে
গিয়ে দেখে তারাই তো কয়েক হাজার।
রিষড়া রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে যেদিন গুলি চলল, স্কুল মাঠের একপ্রান্তে পুলিশের গুলি খাওয়া ছেলেটা গোটা মাঠ দিব্যি হেঁটে এসে টিচার্সরুমে সিঁটিয়ে থাকা স্যারেদের বলল, দেখুন তো স্যার আমার কিচ্ছু লাগছে না, তাও কেন রক্ত বের হচ্ছে? — বলেই ছেলেটা ধপ করে পড়ে গেল। এ রূপকথা ছড়িয়ে পড়ল শ্রীরামপুর, চন্দননগর, কোন্নগরে, উত্তরপাড়া পেরিয়ে গেল হাওড়া, নদী টপকে কলকাতায়। রূপকথা উড়তে লাগল মালদা-মুর্শিদাবাদ পেরিয়ে পাহাড়তলিতেও। গুলি চলল কাকদ্বীপে, কৃষ্ণনগরে, শিলিগুড়ি, বারাসাতে, উত্তরপাড়া কলেজে — কোথায় না। জ্বলে উঠল লাল তরাই। আরও একটু বড় হয়ে সে কিশোর সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল, তাদের উত্তরপাড়া কলেজের কোথাও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেনঃ
রক্ত রক্ত শুধু রক্ত, দেখতে দেখতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়
শিক্ষক ছাত্রের রক্ত প্রতিটি সিঁড়িতে, ঘরে, চেয়ারে চৌকাঠে বারান্দায়।
দরজা ভাঙা, জানালা ভাঙা, ছাদের কার্নিশ ভাঙা আহত ছাত্রের
মাথা ঠুকে তারা খসিয়েছে ইঁট-সুর্কি। রক্তাক্ত মাথায়
কেউ লাফ দিয়েছে বিশ ফুট নিচে, কাউকে ছুঁড়ে দিয়েছে পুলিশ
রক্তবমি করে আজ হাসপাতালে এই বাংলার কিশোর গোঙায়!
এই তোমার রাজত্ব, খুনি। তার ওপর কী বাহবা চাও?
আমরাও দেখব, তুমি কতদিন এইভাবে রাক্ষস নাচাও!
কলেজের করিডোরে জনে জনে সে পড়ল এই কবিতাটি। তারা ছাত্ররা, সেদিন উল্লসিত হয়েছিল — ইনি আমাদের কথা লিখেছেন, ইনি আমাদেরই।
ঘটনার তাৎক্ষণিকতার এমনই অজস্র প্রতিবাদী কবিতা লিখেছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আজ প্রশ্ন তোলা যেতে পারে এই তাৎক্ষণিকতারই বিষয়ে। যেমন এই ‘উত্তরপাড়া কলেজ হাসপাতালে’ শীর্ষক কবিতাটি। অকুস্থলে থাকার কারণেই আমাদের, সেদিনকার উত্তরপাড়া কলেজের ছাত্রদের মাতিয়ে দিয়েছিল কবিতাটি। কিন্তু স্ম্রিতিবাহী আমাদের আজও তা ভাল লাগলেও, ১৯৮০-৮১ সালে জন্ম যাঁদের, আজ যাঁরা ১৮/১৯-এর তরুণ তরুণী, তাঁরা কীভাবে এসব কবিতায় উদ্বেল হবেন? ধীর বিবেচনায় আমি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় সময়োত্তীর্ণতার লক্ষণগুলিও ঠাহর করেছি। তিনি প্রেমেরও কবি, রূপমুগ্ধতার কবি। এমন কী তার তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক কবিতাগুলিতে তিনি বুলিয়ে দিয়েছেন চিরকালের রং। এই যেমন উত্তরপাড়া কলেজ হাসপাতাল কবিতাটির শেষ দুই পংক্তিতে। ‘আমরাও দেখব তুমি কতদিন এইভাবে রাক্ষস নাচাও।’ আজকের দিনে, ভিখারি পাসোয়ান (২) অন্তর্ধানজনিত ধূর্তামিতে ছায়ারাক্ষসদের নৃত্য তোমরা কি লক্ষ্য করছ না, এই সভায় যারা ১৮, ১৯, ২০?
মৃত্যুর পরই একজন কবির প্রকৃত পথপরিক্রমা শুরু হয়। যখন ‘কে তুমি পড়িছ বসি’, সেই পাঠক মেলে ধরে ধূসর পৃষ্ঠাগুলি। আর আচম্বিতে আবিষ্কার করে, এই তো এই কবিতাটিতে পাওয়া যাচ্ছে কবির নিঃশ্বাস। ‘তিনি জীবিত, তিনি জীবিত’ — তখনই হাঁটতে শুরু করেন কবি। স্মরণ কমিটির এই সভায় দাঁড়িয়েও আমার মনে হচ্ছে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোনও মূর্তি বা ছবি নন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ, পুস্তিকাগুলিতে এখনও শিরাধমনীতে রক্ত চলাচল করছে। তিনি নিজেই লিখেছিলেন, ‘জন্মদিন তবে শুধু অনুষ্ঠান, কবির বাহবা…আমি অদীক্ষিত কবিয়াল সভা নয়, শুধুই প্রার্থনা জানি, আর জানি অন্ধকার ধুয়ে দিয়ে বুকের মধ্যে যেই গান জাগে বারবার ঢেকে যায় শব্দহীন কুয়াশায়, অসহায়, নিয়তি আমার।’ — কবিতাকুহকের এই মায়াবী আলোছায়া বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অজস্র কবিতায়। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, ‘সমস্ত অর্থেই বাংলার সবচেয়ে প্রতিবাদী এই কবি’, কালীকৃষ্ণ গুহ তাঁর কবিতায় পেয়েছেন, ‘আশ্চর্য বিমূর্ততা’ — এ দুইই তাঁর সম্পর্কে সত্য। তা সত্ত্বেও যেহেতু তিনি আজ থেকে ২৫/৩০ বছর পূর্বে এক রূপকথার কিশোর তরুণদলের সহায় হয়েছিলেন, সেই সময়ের রাজনৈতিক কর্মীরা নাছোড় ভালবাসায় আজও দাবি জানিয়ে চলেছেন, উনি আমাদের, উনি কেবল আমাদেরই। এই সভায় আমার সমবয়সী, মৃদু অগ্রজ রাজনৈতিক বন্ধুদের কেউ কেউ উপস্থিত আছেন, স্মরণ কমিটিতেও থাকতে পারেন, আমি আবদারই করব, ওঁকে শিবিরমুক্ত করুন। উনি রাজনৈতিক কবি, বটেই তো। বামপন্থী কবি, নিশ্চিতই তাই। কিন্তু ওই দুটি অভিধাই তাঁর দুটি ফুটো গেঞ্জির মতো, তাঁর ধূলিধূসর পাঞ্জাবিতে কেবল ‘কবি’ পরিচয়টিই ফুটে আছে। রূপমুগ্ধ এই কবি লিখেছেনঃ
ভুবনেশ্বরী যখন শরীর থেকে
একে একে তাঁর রূপের অলঙ্কার
খুলে ফেলে,আর গভীর রাত্রি নামে
তিন ভুবনকে ঢেকে
সে সময় আমি একলা দাঁড়িয়ে জলে
দেখি ভেসে যায় সৌরজগৎ, যায়
স্বর্গ-মর্ত্য পাতাল নিরুদ্দেশে
দেখি আর ঘুম পায়!
ঘুমের দেশ থেকে এখন স্পষ্টই তাঁর নিঃশ্বাস ভেসে আসছে। হয়তো বা এই সভাঘরেও। তিনি যেতে চান আগামীর অনির্দিষ্ট আলোছায়ায়, রূপ অরূপের কুহকে। লাল-নিশানের বাহকেরা, আপনারা ওই অনির্দেশে আজ আর ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত? নইলে ওঁর পথ ছেড়ে দিন, অবাধে চলতে ফিরতে দিন ওঁকে।
শেষ করছি। আমি কিছু আজেবাজে বলিনি তো?
(১) কবি সুব্রত সরকার। ‘ঘন মেঘ বলে ঋ’ কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা। ১৯৯৮ সালের বীরেন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত।
(২) ভিখারি পাসোয়ান হুগলীর ভদ্রেশ্বর এলাকার ভিক্টোরিয়া জুটমিলের শ্রমিক-বস্তির বাসিন্দা। মধ্য নব্বই দশকে ওই জুট মিলে শ্রমিক আন্দোলনের সময় পুলিশ অভিযানে ‘নিখোঁজ’।
Tags: একটি রূপকথা, মৃদুল দাশগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।