লকডাউনের গল্প – এক
করোনার জন্য লকডাউনে ঘরের অনেকগুলো পড়ে থাকা কাজ সামলে নিচ্ছে অনুমিতা। আজ রান্নাঘরের র্যাকগুলো ঝেড়েমুছে পরিস্কার করে নেওয়ার দিন। তাকের ময়লা কাগজগুলো ফেলে দিয়ে নতুন কাগজ পাততে গিয়ে হঠাতই ওর হাতে উঠে এল সেই কাগজটা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজে বের হয়েছিল চিনের এক অসহায় বাবা ও তাঁর ছেলের মর্মান্তিক পরিণতির ঘটনা। হুবেই প্রদেশের হুজিয়াহ শহরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন ইয়ান জিয়াওয়েন। জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে হাসপাতালের আইসোলেশনে পাঠানো হয়। কিন্তু তাঁর বাড়িতে একা পড়ে থাকে তাঁর সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত কিশোর ছেলে ইয়ান চেং। ‘আমার প্রতিবন্ধী ছেলে খাবার-জল ছাড়া একা পড়ে রয়েছে ঘরে, কেউ সাহায্য করুন প্লিজ’ – চিনের সোশ্যাল মিডিয়ায় বারবার এই আবেদন করেন জিয়াওয়েন। কিন্তু ভয়ঙ্কর করোনা সঙ্কটে এক বাবার এই আর্তি কারও মনের বরফ গলাতে পারে নি। এক জায়গায় পড়ে থেকে, খাবার না পেয়ে, জল না পেয়ে তিলেতিলে মৃত্যু হয় মাতৃহীন কিশোর ইয়ান চেংয়ের।
এই খবর নাড়িয়ে দিয়েছিল চিনা প্রশাসনকে। চমকে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। সকালের কাগজে খবরটা পড়ে চোখের জল সামলাতে পারে নি অনুমিতা। সারাদিন দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিমাকে গুড্ডুর দিকে আরও ভাল করে নজর দিতে বলে চলে গেছিল অফিসে। তারপর প্রতিদিনের কাজে ভুলেই গেছিল ঘটনাটা। আজ হঠাৎ খবরের কাগজটা হাতে উঠে আসতেই কেঁপে উঠল বুকটা। ফেব্রুয়ারির কলকাতায় বসে যে শিহরণ টের পায়নি আজ এপ্রিলের লকডাউন ওর শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। করোনা সতর্কতায় প্রতিমাকে সবেতন ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপূর্বর অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত গুড্ডুর যাবতীয় দায়িত্ব অনুমিতাকেই নিতে হয়েছে। চারদিক থম মেরে থাকা দুপুরে অনুমিতা একছুটে পাশের ঘরে গিয়ে দেখল নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে গুড্ডু। মিউট করে রাখা টিভিটার ব্রেকিং নিউজে বলছে গোটা পৃথিবীতে করোনায় মৃত্যু সংখ্যা লক্ষ ছাড়িয়ে গেল, ভারতেও ক্রমশ বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। হঠাৎ ভীষণ শীত করতে লাগল অনুমিতার।
লকডাউনের গল্প – দুই
নীলা পিসির ফোনটা কাটতে রাখি রাখি করেও প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগল রক্তিমের। একথা সেকথার পর পিসিতো ফ্যাঁচ করে কেঁদেই ফেলল। বলল তোরা তো আর যোগাযোগই রাখিস না। অথচ তোর বাবা বকু বছরে দুটো-তিনটে করে চিঠি লিখতই লিখত।
এই অভিযোগ নতমস্তকে মেনে নেয় রক্তিম। বাবার মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কমিউনিকেট করার ব্যাপারটা কোনওভাবেই সামলে উঠতে পারে নি সে। বেসরকারি চাকরি, প্রোমোশন, ফ্ল্যাট, ছেলের এডুকেশন, বছরে ২টো ট্যুর এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই জীবন থেকে কীভাবে যেন উবে গেল ১৫টা বছর। ও ভাবে বছর ১৫ আগে এই এপ্রিলেই তো বাবা চলে গিয়েছিল। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে বাড়ি ভর্তি হয়ে গিয়েছিল মানুষজন,আত্মীয়স্বজনে। সবাই যাওয়ার সময় রক্তিমের পিঠে হাত রেখে বলেছিল – বাবাতো চলে গেল, তুই যোগাযোগটা রাখিস। সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়েছিল রক্তিমও।
কিন্তু তারপর দীর্ঘ ১৫ বছরে কয়েকটা মৃত্যু আর বিয়ের সংবাদ ছাড়া আর সেভাবে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি ও। আজ রক্তিমের সামনে খোলা বাবার সেই হলদে হয়ে যাওয়া পাতাছেঁড়া নোটবুকটা। লকডাউনে গত দুদিন ধরে বাসি বিস্কুটের মত নেতিয়ে পড়া এই খাতায়, বাবার কালি পেনে লিখে রাখা আধমোছা ঠিকানা থেকে ফোন খুঁজে খুঁজে যোগাযোগ করে চলেছে রক্তিম। অনেক ফোন নম্বরই আজ চালু নেই। ফোন দূরে থাক, গ্রামের পিন কোডটাই লেখা নেই কোনও কোনও ঠিকানায়। তবুও একে ওকে ফোন করে রক্তিম ঠিক খুঁজে পেয়ে যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত যোগসূত্রটা। বিকেল হলেই ওর ফোন খুঁজে নিচ্ছে সাঁইথিয়ার শ্যামমামা, কোলাঘাটের পিসতুতো দাদা অরিন্দম বা অন্য কাউকে। ফোনে রক্তিম জেনে নিতে চাইছে – আমরা ভাল আছি, তোমরা ভাল তো? মায়েরও মৃত্যু হয়েছে আজ বছর ২০ হল। ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে রক্তিমের চোখে বারবার ফিরে আসছে মাসি বা পিসিরা বাড়িতে এলে ছোটবেলার সেই হইচইয়ের দিনগুলো। বাবা বলত বাড়িঘর, গয়নাগাটি কিছুই তো থাকবে না, কিন্তু সুসম্পর্কের এই বেঁধে বেঁধে থাকাটাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবে। লকডাউনের অনন্ত ছুটিতে এই বিকেলেও পাশের ঘরে ঘুমিয়ে আছে বউ আর ছেলে। এই কদিন পাখিগুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে। দলবল মিলে ফ্ল্যাটের বারান্দা, গাছের মাথা, ছাদের কার্নিশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেন আজ এতদিন পর রক্তিম আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিতে বসল তার উত্তর ওর কাছে অজানা।
লকডাউনের গল্প – তিন
বিকেলে সূর্যের তেজ কমে আসতেই ছাদে উঠে তিলোত্তমা দেখল সবাই ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গাইছে। পাঁচতলার ছাদে বিকেলের ফুরফুরে হাওয়া মনেই করতে দিচ্ছে না যে এই পৃথিবীতে মিশে থাকতে পারে ভাইরাসের বিষ। কে জানে আগামীদিনে কি হবে এই পৃথিবীটার। প্রতিদিনের ২৪ ঘন্টা ঘেরাটোপের কর্মক্ষেত্র আর সময় মেপে ছুটোছুটিতে এখন লকডাউন। কতদিন এই ফ্ল্যাটের ছাদে আসেনি ও। মনে পড়ল ২০১০ সালে যখন সুকল্পর সঙ্গে এসে ফ্ল্যাটটা কেনে তখনই প্রোমোটারের লোক ঘুরে দেখিয়েছিল ছাদটা। আকাশের কাছাকাছি পামির মালভূমির মত বিশাল বিস্তৃত এই ছাদ দারুন ভালো লেগেছিল তিলোত্তমার। সুকল্পকে তখনই বলেছিল মাঝেমধ্যে ছাদে চলে আসব, কেমন! কিন্তু সে ফুরসত আর হয় নি। সুকল্প ঘরে বসে কম্পিউটারে অফিসের কাজ করে চলেছে এখনও। এই কমপ্লেক্সের পাঁচটা ব্লকই পাশাপাশি। উঁচু-নিচু সবকটা ফ্ল্যাটই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। তিলোত্তমা দেখল এই বিকেলে এছাদ, ওছাদ, সেছাদ মিলিয়ে কত মানুষ। ছোট, বড়, বয়স্ক। লকডাউনে এখন সকলের মুক্তি একখণ্ড ছাদেই। সবাই একই কমপ্লেক্স,একই ঠিকানার বাসিন্দা, অথচ কেউ কাউকে সে ভাবে চেনে না। কিন্তু সবাই দূরে দূরে থেকে হাততালি দিয়ে গাইছে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’।
গ্রামের মানুষদের নিয়ে এনজিওর কাজ করতে গিয়ে বহুবার বাংলা তর্জমায় এই গান গেয়েছেন তিলোত্তমা। এক সময় খ্রিষ্টান ধর্মের এক স্তুতিগান থেকেই এর উদ্ভব। তারপর এই গান হয়ে ওঠে নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের গান। ১৯৬৩ তে মার্টিন লুথার কিং-এর পদযাত্রায় গাওয়া হয় এই গান। এই গান গেয়েছেন জিলফিয়া হার্টন, ফ্রাঙ্ক হ্যামিল্টন,পিট সিগারের মত গায়কেরা। তিলোত্তমার এত কিছু জানা ছিল না। এই কদিনে ইন্টারনেট ঘেঁটেই মিলেছে এসব।
আজ তিলোত্তমার কেমন মনে হল ওদের এই কমপ্লেক্সটা একটা গোটা পৃথিবী। আর এক একটা ছাদ এক একটা মহাদেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দেশের মানুষগুলো। সবাই গাইছে গভীর অসুখ থেকে মুক্তির গান। প্রত্যেকেই আলাদা,কিন্তু একসঙ্গে।
হঠাৎ গান ধরল তিলোত্তমা। গেয়ে উঠল – আমরা করব জয় …
হঠাৎ পৃথিবীটা চুপ। তারপর সবাই একসঙ্গে গেয়ে উঠল- আমরা করব জয় …
Tags: অণুগল্প সংখ্যা, লকডাউনের গল্প, সমীর ঘোষ
email:galpersamay@gmail.com
subhrajit on May 5, 2020
দারুন লাগলো। তিনটে গল্পই পড়লাম।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।