সাগর মেলার কিশোর
সাগর মেলায় লক্ষ মানুষের ভীড়।বেশীর ভাগেরই উদ্দেশ্য পূণ্যস্নান, কপিল মুনির মন্দিরে পুজো দেওয়া।তার মধ্যে বহু মানুষ হাজির রোজগারের তাড়নায়।দোকানী, ফেরিওয়ালা, মালিশ ওয়ালা, জ্যোতিষী, টোটকা ওষুধ বিক্রেতা, আরও কত পেশার মানুষ হাজির মেলাপ্রাঙ্গনে কিছু রোজগারের আশায়।ভিখারীরাও সার দিয়ে বসে থাকে প্রাপ্তির আশায়।মানুষ পূণ্য সঞ্চয় করে সাগরে স্নান ক’রে, মন্দিরে পুজো দিয়ে, ভিখারীকে ভিক্ষে দিয়ে এমনকি সাগরের জলে দু-এক টাকার মুদ্রা ছুঁড়ে দিয়ে।
সেই ভীড়ে এক পূণ্যার্থীর নজর কাড়ে এক মলিন বসন কিশোর, বয়স বছর আট-দশ।হাতে একটা লোহার পাত, দুপ্রান্তে তার দড়ি বাঁধা। মানুষ যেখানে স্নান করছে সে লোহার পাতটি জলের মধ্যেদিয়ে টেনে টেনে চলেছে এদিক থেকে ওদিক।কিছুক্ষণ পর ডাঙায় উঠে প্লেটটি থেকে সংগ্রহ করছে খুচরো পয়সা।মহিলা কাছে গিয়ে দেখেন প্লেটটির গায়ে লাগান আছে গোল গোল চুম্বক, তাতেই আটকে আছে খুচরো পয়সা।মহিলার মনে পড়ে তার নিজের ছেলের মুখ, সে কত যত্নে বড় হচ্ছে। তারই সমবয়সী এই কিশোরটি মকর সংক্রান্তির ঠান্ডায় সারাদিন সমুদ্রের জলে নেমে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করছে পূণ্যের বদলে কিছু খুচরো পয়সা।উচ্চবিত্ত ঘরের নাগরিক মহিলা অবাক হয়ে ভাবেন এই পৃথিবীকে চেনা তার কত বাকি। কিন্তু তিনি জানতেন না তার চেনা আরও বাকি ছিল।
মাতৃসমা মহিলার সহৃদয়তা দেখে ছেলেটি সংগ্রহ করা মুদ্রাগুলি দেখিয়ে বলে, এই ছোট একটাকাগুলো এখানে চলেনা, এগুলোই বেশি উঠছে।
-কেন চলবে না এগুলো? মহিলা অবাক হন, অবশ্য মনে করতে পারেন না এক টাকার কয়েন, ছোট অথবা বড়, শেষ কবে ব্যবহার করেছেন।
-নেয় না, বলে চলবে না। তুমি এগুলো নেবে? তোমাদের শহরে চালিয়ে দেবে? আমাকে বদলে টাকা দাও।
– মহিলা ভেবে পাননা কোথায় এগুলো চালাবেন। বলেন- ওগুলো আমাকে দিতে হবে না, আমি তোকে টাকা দিচ্ছি।
-না,এমনি টাকা আমি নেব না।
-কেন?
-মা ভিক্ষে করতে না বলেছে।
বিষ্ময়ের ঘোর কাটিয়ে মহিলা বলেন – আচ্ছা দে, কতগুলো আছে?
-কুড়িটা।
মহিলা ব্যাগ থেকে কুড়ি টাকা বার করতে গিয়ে কী ভেবে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করেন।-এই নে।
-এতো পঞ্চাশ টাকা। আমি তো ফেরত দিতে পারব না।
-দিতে হবে না। মাকে বলিস এক মাসি দিয়েছে। মা কিছু বলবে না।
ছেলেটি বড় বড় চোখ মেলে মাসির মুখের দিকে তাকায়। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে বলে -ঠিক আছে, দাও।
মা
অবসর জীবন, দুজনের সংসার- মিলে মিশে কাজ করি।খাবার পর বেঁচে যাওয়া খাবার পরিস্কার পাত্রে গুছিয়ে রাখতে রাখতে আজকাল মনে একটা গ্লানি আসে।
কম বয়সে শীতের রাতে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরে দেখতাম মা বিছানায় হারিকেনের আলোয় একটা বই নিয়ে বসে ঢুলছে। স্টোভ জ্বেলে খাবার গরম করে খেতে দিতে দিতে মা বলত, ‘ এত দেরী করিস!’
খাওয়া হলে নিজের ঘরে চলে যেতাম। মা এঁটো বাসন গুছিয়ে, বেঁচে যাওয়া খাবার তুলে, রান্নাঘর ধুয়ে শুতে যেতো অনেক পরে।মা কি মনে মনে বলত, ‘শোন –মা সহ্য করছে- বৌ কিন্তু সহ্য করবে না’?
এখন মনে হয়, মা যদি কথাগুলো সোচ্চারে বলত হয়তো আমার চেতনা আসত ।আজ এই অনুতাপ করতে হতনা।
Tags: অণুগল্প সংখ্যা, ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাগর মেলার কিশোর ও অন্য গল্প
email:galpersamay@gmail.com
Swapan bandyopadhyay on April 28, 2020
পড়লাম। ভালো লাগলো।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।