[দীর্ঘ সময় ধরে লিখছেন কণা বসু মিশ্র। নিজের লেখনীতে মেয়েদের বঞ্চনার কথা ,অত্যাচারিত হওয়ার কথা তুলে ধরেছেন বারবার। মেয়েদের কথা মেয়েরাই সবচেয়ে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন তিনি। আজ থেকে প্রায় তিন যুগ আগে তাঁর বিয়ের পর যুগ্ম পদবি গ্রহণ যথেষ্ট আলোচনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিল। বড় পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশ থেকে রাত জেগে লেখালিখি, সম্মানলাভ থেকে বিদেশযাত্রা ‘গল্পের সময়’-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছেন সবকিছুই। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমীর ঘোষ।]
গল্পের সময়– আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। বহু পুরস্কার পেয়েছেন। প্রথম কবে লেখা শুরু করলেন ?
কণা বসু মিশ্র-আমার যখন পাঁচ–ছ বছর বয়স তখন থেকেই আমি রাজারানীর গল্প তৈরি করতাম। যখন স্কুলে যেতাম তখনও আড়ালে গিয়ে একটু গল্পের কথা ভাবতাম। এমনকি যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন আমি লেখক হয়েই গেছি, কিন্তু তবুও গল্পের ঘোরে থাকতাম।
গল্পের সময়– প্রথম লেখা প্রকাশ হল কোথায় ?
কণা বসু মিশ্র– তখন আমার পনের বছর বয়স হয় নি। আমার লেখা বের হল বসুমতী পত্রিকায়। আমাদের বাড়িতে ‘দেশ’ আসত। আমার বাবা ছিলেন খুব কড়া মেজাজের, ওকালতি করতেন। বাবার নির্দেশ ছিল–ছাত্রজীবনে পড়াশুনো ছাড়া আর কিছু যেন মাথায় না ঢোকে। তো সেই সময় বাড়িতে একটা ‘বসুমতী’ পত্রিকা পেয়ে তার ঠিকানায় আমার লেখা একটা গল্প পাঠিয়ে দিলাম। ‘দেশ’–এ পাঠালে এবং তা প্রকাশ হলে বাবা জানতে পারবে এবং মহা কেলেঙ্কারি হবে বলে আমি ‘বসুমতী’তেই পাঠালাম। আমার গল্প ছাপা হয়ে গেল ‘বসুমতী’ পত্রিকায়। তখন আমরা আসামের তেজপুরে থাকতাম। তা একদিন বাবা কোর্ট থেকে ফিরেছে এমন সময় পিওন এসে বাবার হাতে ‘বসুমতী’ ধরিয়ে দিয়ে গেল। বাবা বললেন এ-কাগজ তো আমাদের বাড়িতে নেওয়া হয় না। দেখা গেল পত্রিকাটা কণা বসুর নামে এসেছে। বাবা খুলে দেখলেন আমার গল্প প্রকাশিত হয়েছে। বাবা পত্রিকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন – বললেন সর্বনাশ হয়েছে, আর তোমার দ্বারা কিছু হবে না। তুমি লিখতে শুরু করে দিয়েছো ? তুমি পৃথিবীকে কতটুকু জানো ? জীবন সম্পর্কে কী অভিজ্ঞতা আছে তোমার ?
গল্পের সময় – গল্পটার কী নাম? মনে আছে ?
কণা বসু মিশ্র– না। গল্পটা সংগ্রহও করা হয় নি। তারপর আমি কলকাতায় কলেজে পড়তে চলে আসি। কলেজ ম্যাগাজিন, কলকাতার বিভিন্ন কাগজে লেখা পাঠাতে লাগলাম। ছাপাও হতে লাগল। একদিন বন্ধুরা বলল যেদিন ‘দেশ’ পত্রিকায় তোর লেখা প্রকাশিত হবে সেদিন তোকে আমরা লেখক বলে মানব। তখন আমার মাথায় ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখার ঝোঁক চাপল। একটা লেখা নিয়ে দক্ষিণ কলকাতা থেকে ‘দেশ’ পত্রিকা দপ্তরে গেলাম। কিছু তো চিনি না। টু-বি বাসে চড়ে পুলিশকে জিজ্ঞাসা করতে করতে গেলাম। আনন্দবাজারের তিন তলায় উঠে ‘দেশ’ পত্রিকার দপ্তরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম সাগরময় ঘোষ আছেন ? একজন বললেন (জ্যোতিষদা বলে এক ভদ্রলোক) কেন ? আমি বললাম একটা গল্প দিতে চাই। উনি বললেন সাগরবাবু তো গল্প দেখেন না, দেখেন বিমল কর। আমি বললাম, উনি কখন আসবেন ? তিনি বললেন বেলা একটার সময়। গেটের সামনে দাড়িয়ে রইলাম। তখন আমি বিমল করের কিছু লেখা পড়েছি। আমার মনে হত মোটাসোটা কালো মতন কেউ একজন হবেন। তাঁর আশায় দাঁড়িয়ে আছি। সকাল ন’টায় বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি এমন মিথ্যে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। তিনটে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে কল্পনার মানুষটিকে দেখতে না পেয়ে ফের দপ্তরে গেলাম। আমার কথা শুনে অন্যরা বললেন উনি তো যথা সময়ে এসেছেন, ওই তো বসে রয়েছেন। আমি দেখলাম ফর্সা–ছিপছিপে, কালো ফ্রেমের চশমা পরা একজন মানুষ। প্রুফ দেখছেন। বললাম, আমি একটা গল্প দিতে চাই। উনি মাথা না তুলেই একজনকে বললেন – সুজিত, গল্পটা লাল ফাইলে রেখে দাও।আমি বললাম কবে জানতে পারব গল্পটা মনোনীত হল কী না ? উনি বললেন তিন মাস পর।
গল্পের সময় – তারপর কী হল? ‘দেশ’ পত্রিকা ছাপল আপনার গল্প?
কণা বসু মিশ্র– সেইটাই বলছি। তিনমাস আমার ঘুম নেই। তখন আর একটা গল্প লিখে তিনমাস যেদিন কমপ্লিট হল সেদিন চলে গেলাম ‘দেশ’ দপ্তরে। আমার প্রশ্ন শুনে না তাকিয়েই বললেন কী নাম ? আমি নাম বলতেই উনি বললেন, সুজিত গল্পটা ফেরত দাও। আমি বললাম আমি আর একটা গল্প এনেছি। উনি মাথা না তুলে বললেন, সুজিত গল্পটা লাল ফাইলে রেখে দাও। আমি বললাম কবে জানতে পারব নির্বাচিত হয়েছে কী না ? উনি বললেন ১৪ দিন পর। ১৪ দিন পর ফের আমি গেলাম ‘দেশ’ পত্রিকার দপ্তরে। সেদিন আকাশভাঙা বৃষ্টি। আমি একেবারে ভিজে গেছি। ওনাকে ফের বললাম লেখার কথা। উনি না তাকিয়েই ফের বললেন, সুজিত গল্পটা ফেরত দাও। গল্পটা ফেরত নিয়ে আমি আর একটা গল্প দিলাম। বললাম, আর একটা লেখা এনেছি। তখন উনি বললেন, সুজিত গল্পটা রেখে দাও। এরপরই ‘সাগরদা’ বলে হাঁক পাড়লেন। সাগরময় ঘোষ আসতেই বললেন এই সেই বালিকা, যে লেখিকা না হয়ে যাবে না। আমার তখন খুবই কম বয়েস, দুদিকে বিনুনি ঝোলানো। সাগরময় ঘোষ বললেন, আমরাই পালাই পালাই করছি আর তুমি এই দুর্যোগের দিনে চলে এসেছো ? তারপর আমাকে চা দিতে বললেন। প্রথম ভাল ব্যবহার পেলাম ‘দেশ’ দপ্তরে । বাড়ি ফিরে এলাম। চিন্তা করছি কী হবে, কী হবে। পরে দেখলাম ওই গল্পটা আমার প্রকাশিত হয়েছে। এর পরে ত্রিকোণ পার্কে – বিমল দা, শীর্ষেন্দুদাদের আড্ডায় যেতাম। একদিন বিমল দা বললেন তোমার প্রথম গল্প দুটোই ভাল হয়েছিল। কিন্তু আমরা তোমার অধ্যাবসায়, ধৈর্য্য পরীক্ষা করছিলাম। তখন আমি বন্ধুদের মুখে শুনে শুনে নানারকম প্রেম – অপ্রেমের গল্প লিখতাম। ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প প্রকাশের পরই বাবা চিঠি লিখলেন, তোমার গল্প পড়িয়া স্তম্ভিত হইলাম। এই সব যুবক–যুবতী কাহারা চিনিতে পারিলাম না। কোথায় ইহাদের সহিত তোমার পরিচয় হইয়াছে বুঝিতে পারিলাম না। তোমাকে পড়ার জন্য কলেজে ভর্তি করানো হইয়াছে। গল্প লিখিবার জন্য নয়। তবে গল্প যদি একান্তই লিখিতে হয় তাহলে ভ্রমণ কিংবা শিকারের গল্প লিখিও। চিঠিটা দেশ পত্রিকার দেওয়ালে সাগরদা, বিমলদা সেলোটেপ দিয়ে এঁটে রেখেছিলেন সকলকে দেখানোর জন্য।
গল্পের সময় -তাহলে ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প লিখে ফেললেন।এরপর কোথায় লিখলেন ? কী লিখলেন ?
কণা বসু মিশ্র – ঠিকঠাক বললে ‘দেশ’ পত্রিকা দিয়েই আমার গল্প লেখার শুরু। সেসময় আমি নানা কাগজে লিখেছি, কিন্তু সেগুলোকে লেখা হিসেবে ধরছি না। সেই সময় এক বয়স্ক সুন্দরী, ডিভোর্সী মহিলাকে নিয়ে গল্প লিখে খুব বিপদে পড়েছিলাম। একদিন তিনি আমায় ডেকে বললেন তুমি যখন আমার মত বয়সী হবে তখন সেই বয়সীদের নিয়ে গল্প লিখো। প্রমথনাথ বিশী তখন ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকায় ছদ্মনামে লিখতেন। একবার আমার অধ্যাপককে নিয়ে লেখা ‘কুড়িয়ে পাওয়া ডায়েরি’র লেখার কড়া সমালোচনা করলেন। লেখার ফান্ডা ও পাওয়ারফুল কলমের কথা বললেও লেখিকাকে অকালপক্ক ও সেন্টিমেন্টাল বললেন। বন্ধুরা হইহই আমায় তা দেখালো। আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম কিন্তু এতে আমার জেদ আরও বেড়ে গেল। আমি কলেজে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসতাম গল্প লিখব বলে। বাড়িতে এসেও গল্প লিখতাম। আমি রাত জেগে গল্প লিখতাম। আমি যাতে তা করতে না পারি সে জন্য বাবার কড়া নির্দেশ মেনে আলো নিভিয়ে দেওয়া হতো। বাথরুমে চৌবাচ্চার মাথায় বসেও আমি গল্প লিখেছি। বাড়ির লোক বাথরুমেও ধাওয়া করত।
গল্পের সময়– তার মানে আপনি তখন পুরোপুরি গল্পের রাজ্যে ঢুকে পড়েছেন।
কণা বসু মিশ্র – একেবারে। একটা ঘটনা বলি। ৭০ এর দশক। ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার অনেক গল্প প্রকাশ হচ্ছে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পড়াতেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। আমরাই শেষ ব্যাচ। জনপ্রিয় শিক্ষক। প্রচন্ড ভীর হত ক্লাসে। অন্য ক্লাসের ছাত্র–ছাত্রীরাও এসে পড়া শুনতো। আর এই মওকাতেই আমি ক্লাস কাটতাম। কলুটোলায় আনন্দবাজারে লেখা জমা দিতে যেতাম। নারায়ণবাবু ছিলেন ছ’ফুটের ওপর লম্বা, ফর্সা, টিকালো নাক, মাথায় ব্যাকব্রাশ করা চুল, সৌম্যদর্শন পুরুষ। স্যার যখন ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে যেতেন তখন অনেকে শুনতে পাইনি বলে স্লিপ দিত। চল্লিশ মিনিট ক্লাস কেটে আমিও স্যারকে স্লিপ দিয়েছি। তখন তিনি বললেন, তুমি তো আজ ক্লাসে ছিলে না। বললাম বাবার শরীরটা ভাল নেই …তাই।
আবার মাসখানেক বাদে একই কারণে ক্লাস কেটে স্লিপ ধরাতে দিয়ে ধরা পড়ে গেলাম। বললাম, মায়ের শরীরটা ভাল নেই তো …তাই। আর একদিন ডুব মেরে স্লিপ ধরাতেই বললেন, কী ব্যাপার আজ কি তোমার ঠাকুরদার শরীর খারাপ ? আমি বললাম, ঠাকুরদা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। উনি বললেন – তিনি রেহাই পেয়েছেন।
গল্পের সময় – প্রথম বই কবে বের হল ? সেটা কী বই ছিল ?
কণা বসু মিশ্র – আমার প্রথম বই বের হয় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। সেসময় আমি ‘দেশ’ পত্রিকায় বেশ স্নেহধন্য ছিলাম। ওই পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলোকেই সংকলিত করে আনন্দ পাবলিশার্স তা প্রকাশ করে। এরপর ৭৭ সালে ‘শারদীয়া দেশ’ পত্রিকায় আমার প্রথম উপন্যাস বের হল। সেই উপন্যাসটিই প্রকাশ করল আনন্দ পাবলিশার্স।
গল্পের সময় – গল্পের সংকলনের কেমন সাড়া পেলেন ?
কণা বসু মিশ্র – খুব সাড়া পেয়েছিলাম। আমি মেয়েদের কথা খুব লিখতাম। আশাপূর্ণা মাসিমারা তো মেয়েদের কথা বলতেনই, কিন্তু আমি আজকের নারীদের কথা বলতে শুরু করলাম। আমি মনে করি একজন মহিলা লেখক যে ভাবে মেয়েদের কথা বলতে পারে পুরুষরা কখনোই তা পারে না। মেয়েরা বিয়ের আগে একরকম, বিয়ের পর আরেকরকম। এপ্রসঙ্গে একটা কথা বলি… যখন বিয়ের পর ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প দিতে গেলাম তখন বিমল দা বললেন তুমি কী পদবি লিখবে ? আমি বললাম বসু মিশ্র দুটোই লিখব। এর আগে কবিতা দি নিজের বাপের বাড়ির সিংহ পদবিই চালিয়ে গেছেন, আর নবনীতা দি দেবসেন হয়েছেন। টেলিগ্রাফে বিষয়টি নিয়ে লেখাও হল। যেহেতু আমি তখন খুব লিখছি তাই আমার দেখাদেখি যুগ্ম পদবি ধারণ বেশ জনপ্রিয় হল।
গল্পের সময় – আপনি তো অনেক লিখেছেন। এরমধ্যে কোন কোন গল্প লিখে আপনি সন্তুষ্ট। আপনার সেরা বাছাই কী কী ?
কণা বসু মিশ্র– ‘তুলির কিছু সময়’ খুব হইচই ফেলেছিল। তখন বিয়ের পর আমি দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে থাকি। আমার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী খুব বড় পদে চাকরি করতেন। মাঝে মধ্যেই পার্টিতে যেতেন। আমি যেতাম না, লেখার জন্য। তখনই ওই গল্প লিখি। ওই গল্পের জন্য বহু বড় বড় লেখকরা চিঠি লিখেছিলেন। ‘মলাটের শেষে’, ‘সম্বুদ্ধ’ নামে গল্প লিখেছিলাম। সবই ‘দেশ’ –এ প্রকাশিত হয়েছিল। বুধসন্ধ্যায় ‘সম্বুদ্ধ’ গল্প পড়া হলে সুনীলদা (গঙ্গোপাধ্যায়) খুব প্রশংসা করেছিলেন। গল্পটা প্রকাশিত হলে বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার। তখন তাঁকে চিনতাম না। তিনি তাঁর বাড়ির একটা অনুষ্ঠানে গল্পটা পড়তে বললেন। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুদিত হয়েছে গল্পটি। বাংলার সমস্ত প্রথম সারির কাগজে গল্প লিখেছি আমি। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেও গল্প লিখেছি।
গল্পের সময়– পত্রিকায় লেখা কিভাবে দিতেন ? আপনি নিজে পাঠাতেন না লোকে চেয়ে নিত ?
কণা বসু মিশ্র – যখন একটু নামডাক হয়েছে তখন বাড়িতে এসে লোকে বসে থাকত গল্প নেবে বলে। সাগরদাও পিওন পাঠাতেন। এমন হত, আমার ছেলে ছোট, সে স্কুলে যাবে, স্বামী কাজে যাবে তার মধ্যেই লোকটিকে বসিয়ে আমি গল্প শেষ করে দিয়েছি। সংসার সামলাতে গিয়ে অনেক ধাক্কা খেয়েছি। সাংসারিক জীবন, সামাজিক জীবন অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আমার একদম সময় ছিল না। একজন লেখক সবচেয়ে আগে স্বার্থপর তার নিজের কাছে। লেখার জন্য বিনোদনের জগৎ, মেলামেশার জগৎ তাকে বাদ দিতে হয়। বাড়ির সবাই জমিয়ে টিভিতে সিনেমা দেখছে, ওদিকে আমি মাথায় বোঝা নিয়ে লিখে চলেছি। ইচ্ছে হলেও উপায় নেই টিভি দেখার। ঘুম পাবে বলে রাতের খাবার খেতাম না। ফ্লাক্সে চা নিয়ে সারারাত লিখতে বসে যেতাম।
গল্পের সময়– আপনি বড়দের জন্য তো প্রচুর লিখেছেন, ছোটদের জন্য কতটা লিখেছেন ? ওদের জন্য লিখতে কেমন লেগেছে ?
কণা বসু মিশ্র– ছোটদের জন্য লেখা লিখেছি অনেক পরে। আনন্দমেলা, পক্ষীরাজ ছাড়াও অনেক ছোটদের কাগজে লিখেছি। খুব ছোটবেলায় ছোটদের লেখা লিখেছি। তখন দুটো খাম নিতাম। একটাতে গল্প পাঠাতাম আর একটা রিপ্লাই খাম দিতাম। অপছন্দ হলে ফেরত পাওয়ার জন্য। এরকম ভাবে অনেক গল্প ছাপাও হয়েছে আবার ফেরতও এসেছে। আনন্দমেলার তখন সম্পাদক মৌমাছি। সেখান থেকেও গল্প ফেরত এসেছে।
গল্পের সময় – গল্প লেখা, উপন্যাস লেখা তো রীতিমত পরিশ্রমের কাজ। কি করে লেখেন?
কণা বসু মিশ্র– পরিশ্রম তো বটেই। আসলে লেখাগুলো ভেতর থেকে ধাক্কা মারে। সবসময় গল্পের খোঁজে থাকতাম। ভীর বাসে চলেছি–একটা বাচ্চা ছেলের প্রশ্নের জবাবে এক বয়স্ক লোক বললেন – ‘আমার কেউ নেই সোনা’। হঠাৎ এটা মনে স্ট্রাইক করল। বাড়ি এসে লিখে ফেললাম গল্প। কতদিন হয়েছে বাসে বা অন্য কোথাও কোনও কিছু দেখেছি বা কথা শুনেছি, সঙ্গে সঙ্গে তা নোট করে নিয়েছি টিকিটের পেছনে বা কাগজের টুকরোয়, পরে গল্পে লিখব বলে। ঘোরতর নকশাল মুভমেন্টের সময় আমরা পড়াশুনো করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কলকাতায় গুলি চলছে, ঢাল নিয়ে পুলিশ দৌড়োচ্ছে, আশুতোষ ভাবনের মাথা থেকে পুলিশ মারবে বলে সাই-ই করে বেঞ্চি ফেলা হচ্ছে–ওই পরিস্থিতির ভেতরেও আমি ঝপ করে কোনও ঘরে ঢুকে গিয়ে গল্প লেখার নোট করে নিয়েছি। নেশার মত ছিল।
গল্পের সময় – আপনি কখনও লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন ?
কণা বসু মিশ্র – লিট্ল ম্যাগাজিনে আগে আমি একেবারেই লিখতাম না। আজকাল দু একটা লিখি। অনেকে জোর করেন। তবে মূলত কবিতাই লিখি।
গল্পের সময় – আপনার কবিতা নিয়ে কিছু বলুন না…
কণা বসু মিশ্র – গল্পের পাশাপাশিই কবিতা লিখতাম। প্রথম বয়সে আমার থেকে একটা লিট্ল ম্যাগাজিন কবিতা চাইল। আমি আনন্দে উল্লাসে আমার কবিতার খাতাটাই ধরে দিয়ে দিলাম। তারপর কবিতার খাতাটাই ওদের কাছ থেকে হারিয়ে গেল। তার পর দেখলাম আমার কবিতা গুলোই নানা জায়গায় নানা নামে বের হচ্ছে। ক্ষোভে – দুঃখে কবিতা লেখা বন্ধ রাখলাম। এখন কবিতা লিখি। সহজাত, স্বাভাবিকভাবে যা আসে তাই লিখি।
গল্পের সময় – আপনি অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন, বিদেশেও গেছেন। সম্মান পেয়ে কেমন লাগে ?
কণা বসু মিশ্র– বহু পুরস্কার পেলেও ২০১৩ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন আমায় ভূবনমোহিনী গোল্ড মেডেল দিল আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। যেদিন প্রথম ফোন এল আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখোপাধ্যায় পেলেন স্যার আশুতোষ গোল্ড মেডেল আর আমি পেলাম ভূবনমোহিনী গোল্ড মেডেল। সে এক আশ্চর্য অনুভব। ভাবলাম বাবা যদি বেঁচে থাকতেন। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘মাতৃত্ব’ বলে আমার একটি গল্প প্রকাশ হয়েছিল। বাবা চিঠি লিখেছিলেন – অন্তত এই গল্পটির জন্য ক্ষণকাল হইলেও তুমি বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাইতে পার। আমাদের বাড়িতে আসা এক বুড়ি ভিখারিকে নিয়ে আমি ‘বোঁচকা বুড়ি’ নামের গল্প লিখেছিলাম। সেটা নব্যেন্দু চ্যাটার্জি ছবি করবেন বলেছিলেন… কিন্তু পরে তা আর হয় নি।
আশির দশকে একবার একটা কাগজে সমালোচনা করে লেখা হল কণা বসু মিশ্র তথাকথিত উচ্চ সমাজের কথাই বলেন। আমার মনে হল সত্যিই তো গ্রামে – গঞ্জের কথা আমি জানি না। তখন আমার স্বামী কাজে চলে গেলে আমার কাজের লোকের সঙ্গে লক্ষীকান্তপুর – ক্যানিং চলে যেতাম। সেখানকার মহিলাদের, মানুষের দুঃখ, কষ্টের অনুভবের সামিল হলাম। তখন ‘তথ্যকেন্দ্র’ পত্রিকায় ওই সব মানুষকে নিয়ে লিখতে লাগলাম। সুন্দরবন অঞ্চল থেকে প্রশংসা করে চিঠি আসতে লাগল। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়েও গেল। এরকম পাঠকের পাশাপাশি বহু বড় লেখকের ভালবাসা পেয়েছি। বিমল কর, সাগরময় ঘোষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আশাপূর্ণা মাসিমা আমায় খুব ভালবাসতেন। ছেলে বিদেশে থাকে। সেই সূত্রে এবং বঙ্গ সম্মেলনে আমেরিকায় যেতে হয়েছে আনেকবার।সেখানে লেখালিখির জন্যে সম্মান পেয়েছি, সমাদর পেয়েছি।
গল্পের সময় – কখন লেখেন ? ভোরে লেখেন না রাতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ? এখন কী ধরনের লেখা লিখতে ইচ্ছে হয় ?
কণা বসু মিশ্র – আমি সবসময় লিখতে পারি। বিভিন্ন চরিত্র আমার সামনে ঘুরে ফিরে বেড়ায়। আগে তো গড়িয়াহাটে ফার্ন রোডের বাড়িতে থাকতাম। এখন থাকি হাইল্যান্ড পার্কে। দু-জায়গার প্রতিবেশী, মানুষজনকে লক্ষ্য করি। একসময় রাতে ঘুমোতাম না। কোনও গল্প মাথায় এলে রাতে উঠেই ডায়েরিতে লিখে রাখতাম। এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিখি। এখন গবেষণাধর্মী লেখা লিখতে ইচ্ছে হয়।
গল্পের সময়– এতদিন ধরে লিখলেন, এখনও লেখা হয় নি, বা লিখতে পারলে ভাল লাগবে এমন বিষয় কিছু কী আছে ?
কণা বসু মিশ্র– কত কিছু আছে যা এখনও লেখা হয়নি। এর জন্য মাঝে মাঝে আক্ষেপ হয়। তবে আধ্যাত্মিক জগত নিয়ে আমি কাজ করেছি। স্বামী লোকেশ্বরানন্দজীর কথায় ‘শতরূপে সারদা’ তে লিখেছি। সেটা ১৯৮৫ সালের কথা। তখন পুজোসংখ্যার চাপে প্রথমে লিখতে চাইনি। কিন্তু এ লেখার জন্য প্রচুর খাতির পেয়েছি। সে বইয়ের বোধহয় ১২৫ তম সংস্করণ বেরিয়ে গেছে। এর সূত্রে ক্যালিফোর্নিয়ায় বেদান্ত সোসাইটিতে গিয়ে বক্তব্য রেখেছি। কানাডায় সারদা মায়ের জন্ম তিথিতে বক্তব্য রেখেছি। সারদা মঠ থেকে প্রকাশিত ‘জন্ম জন্মান্তরে মা’ সংকলনেও লিখেছি। ২০০২ সাল থেকে যুক্ত হয়েছি আর্ট অফ লিভিং এর সঙ্গে। শ্রী শ্রী রবিশঙ্করের মত – ভাবনা আমার ভাল লেগেছে। এই সূত্রেও দেশে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। গুরুজীর মত ও পথ নিয়ে আমি একটা বইও লিখেছি।
গল্পের সময়– এতটা সময় দেওয়ার জন্য গল্পের সময়ের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
কণা বসু মিশ্র– গল্পের সময়কেও ধন্যবাদ।
Tags: কণা বসু মিশ্র
email:galpersamay@gmail.com
তৃপ্তি চৌধুরী, উত্তর লালপুর, চাকদহ, নদীয়া on February 15, 2017
কণা বসুমিশ্র র লেখা পড়া শুরু করেছি সেই স্কুলে পড়ার সময থেকেই. ভাল লাগত তো নিশ্চযই, এখনও পড়তে ভালই লাগে. সম্ভবত, লেখক সময়ের সঙ্গে নিজের লেখার বিষয়কেও যে পরিবর্তন এনেছেন, সেটাই আমাকে টানে. আপনাদের এই ম্যগাজিনে প্রকাশিত গল্পটিও সকলকে পড়াতে ইচ্ছে করছে. এখন তাঁর লেখক হয়ে ওঠার কথাও যে গল্পের মতই রোমান্চকর তা জানতে পারলুম. এজন্য গল্পের সময়কে ধন্যবাদ. তাঁর মনের কথাই তো শুধু নয, এসবের মধ্যেই রয়ে গেছে মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মেয়ের জীবনকথাও. আরও অনেকদিন তাঁর কলম সচল থাকুক, তাই চাই.তৃপ্তি চৌধুরী, চাকদহ
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।