রাজনীতির আলোতে দেখার জন্য বিমল করের চারটি গল্প মুখ্যত গ্রহণ করা হয়েছে। অতি পরিচিত গল্পগুলি এই তালিকায় অনুপস্থিত।তাঁর পঞ্চাশটি স্বনির্বাচিত গল্পে অবশ্য এই চারটি গল্পই আছে।ঐ সংকলনের ভূমিকায় লেখক মন্তব্য করেছেন , “ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, এই পঞ্চাশটি গল্পই লেখকের পক্ষ থেকে যথেষ্ট।এর বেশি নাই বা থাকল।লেখক তাঁর চয়নে রাখায় এই গল্পগুলি লেখক-মানসে স্বতন্ত্রভাবে বেঁচেছিল বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
‘উদ্বেগ’ গল্পের প্রকাশকাল ১৯৬৩, ‘সে’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭১,’ওরা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৩ এবং ‘নিগ্রহ’১৯৮১ তে প্রকাশিত হয়।দীর্ঘ দুই দশক মতো সময় টানা পাওয়া যায় এদের প্রকাশের স্থানাঙ্ক মেলালে। চারটি গল্পেই প্রশাসনিক বেনিয়মকে লক্ষ করা হয়েছে।ক্ষমতাসীনের রাজনীতির নানা রন্ধ্র দেখানো গেছে।
সাধারণ মানুষের জীবন বঞ্চনা, দারিদ্র্যের সঙ্গে মিলিয়ে চলার বাধ্যবাধকতা।সমকালীন পৃথিবীতে স্বার্থসর্বস্ব উচ্চবিত্তের রাজ।বুর্জোয়া সুবিধাবাদ রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত।কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে কিন্তু প্রশাসক বিচারক নেতাবর্গ স্বরূপত ধরা পড়েন। নীতিহীন রাজনীতি ও সমাজনীতির বিপক্ষে সাধারণ মানুষের ঘৃণা গোপন থাকে নি।রাজনীতিতে জনসমষ্টির একাংশকে বিচ্ছিন্ন বা পাপেট করে রাখার ষড়যন্ত্রকে আঘাত করতে পেরেছে নেহাত পরিচয়হীন লোকজন- ছেলে-ছোকরারা। যে ব্যবস্থার মর্মে হিংস্রতার স্বীকৃতি তাকে চিনেছে লোকসাধারণ –তাকে অতর্কিত কশাঘাতে চকিত করে টলিয়ে দিতে সক্ষমও হয়েছে।যুবকরাই বঞ্চিত সমাজের অপরিচিত প্রতিনিধি।এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ছোটগল্পের শিল্পসিদ্ধির বিন্দুতে মিলিত হতে পেরেছে।
শ্রেণীস্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে বুর্জোয়াজি আমলাতন্ত্র ভণ্ডামির আশ্রয় নিয়েছে। সাধারণ মানুষের আনুগত্য যে ভাবে হোক আদায় করতে হবে এই তাঁদের উদ্দেশ্য। কিন্তু বাধাও এসেছে। এ যেন একরকম প্রতিবর্ত ক্রিয়া বা রিফ্লেক্স অ্যাকশন। বাধা দেওয়ার সংস্কার-সম্ভাবনা অনেকদিনের বঞ্চনার মধ্যেই জমেছিল। ‘সে’, ‘নিগ্রহ’ ইত্যাদি গল্পে আদিত্য সুবোধরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ‘উদ্বেগ’ গল্পের শিশিরও তাই। উল্টোমেরুতে আছেন পালিত সাহেব, ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর অফিসার – কিংবা হাকিম, চেয়ারম্যান, মুখার্জিসাহেবরা। বাঁচতে গেলে আক্রান্ত অবস্থায়ও ঘুরে দাঁড়ানো দরকার।স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের নিরাশার ছবি অনুসরণ করেছেন লেখক। ইতিহাসে থাকা দ্বন্দ্বচেতনায় বিশ্বাস ছাড়া ‘নিগ্রহ’ গল্পে মুখ্য চরিত্রটির মুখ দিয়ে বলানো যেত না- ‘আমাদের দোষ আছে। কুকুরের দোষ।আর আপনাদের শুধু গুণ…।“পরক্ষণেই সংঘাত তীব্রতর “সুবোধ আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আচমকা ডান পা তুলে লাথি মারল।মুখে।“ ‘নিগ্রহ’-গল্পের সমস্ত রাষ্ট্রীয় নীতি এবং তার প্রস্তরীভূত প্রাতিষ্ঠানিক মিথ্যাচারকে যেন সব নিগৃহীত মানুষের পক্ষে সুতীব্র প্রত্যাঘাত হানা গেছে, যা অনিবার্য ছিল বলে লেখক উপলব্ধি করেন।
ক্ষমতার মণ্ডলী যেন একটি জীবতন্ত্রের দেহ-উপদেহে গড়া, আর তার অবধি নেই- সুবিধাবাদ, স্বজনপোষণ, মূল্যবোধের অবনমনকে দারিদ্র্য, বৈষম্য, বেকারির কারণ বলে লেখক মনে করেছেন; যদিও আশা জাগে অসহায় আত্মসমর্পণের মোহ কাটছে।আবার রাজতন্ত্রের মতোই শক্তিশালী রাষ্ট্রতন্ত্র দেখে দনি দিদেরোর ঘোষণা মনে পড়ে-“ Men will never be free till the last king is strangled with the entrails of the last priest”। বিমল কর মনে করেছেন তৎকালের প্রতিক্রিয়াশীলবৃত্তি যত কৌশলী ততটাই রণকৌশল অপাঙক্তেয় শ্রেণীও অলক্ষ্যে আয়ত্ত করেছে নির্ভুলভাবে। চারটি গল্পেই আছে -১।জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা, ২। মৃত্যু কিংবা মড়ক কিংবা নৈরাজ্যের ফলে সন্ত্রাস,৩।গরিবদের ব্যবহার করার অভ্যাসের জন্য আচরণগত প্যাটার্ন, ৪।অকুস্থল গলির অন্ধকার, বস্তি, আঁস্তাকুড়, নর্দমা অথবা বোমাবাজির ও সমাজবিরোধীর আনাগোনা, নয়তো
কাঁটাতারে ঘেরা জেলহাজত,থার্ড ডিগ্রির আয়োজন; ৫।চেনা শহরের হঠাৎ অচেনা ছবি, ৬।কায়েমী স্বার্থের চেহারা চরিত্র অনুভব,৭। শেষে বাজিমাত না হলেও প্রত্যাঘাতে অপ্রত্যাশিত চমকদেওয়া, ৮।যদিও যে শঙ্কাকুল পরিস্থিতির অবতারণা করা হয়েছিল তা গল্পের শেষেও ব্যাপ্ত রয়েছে।
শহরে মড়ক লেগেছে, এহেন অবস্থায় পৌর কর্তৃপক্ষকে আমল না দিয়ে শিশির নামে এক ব্যক্তি নিরাপত্তার জন্য একক চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে তাঁকে দ্রুত অসম্মানজনকভাবে নিরস্ত করা হয়।একজন নাগরিকের নিজের জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারে উদ্বেগকেও নিয়মতন্ত্র অধিকার করে রাখতে চায়। তাঁকে কড়াভাবে জিজ্ঞাসা করা হয়-“যে লোক ডাক্তার নয়, যে কোনো রকম সোস্যাল ওয়েলফেয়ারের রেকর্ড দেখাতে পারবে না, এমন কি মিউনিসিপ্যালিটির মেম্বারও নয়, তার পক্ষে এসব ধৃষ্টতা কেন?” মুখার্জি সাহেবের মতো উচ্চপদাধিকারিরা হয়তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দামী গাড়িতে সুরক্ষিত থেকে ভ্রমণ করবেন কিন্তু গল্পকার দেখিয়েছেন-“…সোমে মারা গেল দশজন,মঙ্গলবার গোশালার দিকে ইতর জনের মহল্লাটা ভয়ংকর হয়ে উঠল, ওদিকে পা বাড়াতে কারও সাহস হচ্ছিল না…”
‘সে’ গল্পেও সন্ত্রাসের রাজত্ব।পালিত সাহেবের অফিসে পারচেজ অফিসার দত্তগুপ্ত বিবরণ দিলে পরিস্থিতি যথেষ্ট ভীতিকর মনে হয় –“একজন শুনছি বেশ বুড়ো, ষাটটাট হবে; রাবার ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। এক কোপেই সাবাড় করে দিয়েছে,কসাইয়ের দোকান থেকে চপার এনে মেরেছে শুনলাম।হরিব্ল।“ আর এক সহকর্মী বলেছেন যে দমদম এলাকা নাকি ভিয়েতনাম হয়ে গেছে।তিনি যোশী সাহেবের ভীতির কারণ সবিস্তারে বলছেনঃ “ মার্ডার। ক্লীন মার্ডার।একেবারে ওর বাড়ির কাছেই।ক’টা ছেলে মিলে আর-একটা ছেলেকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল।“স্পষ্ট সত্তরের নকশাল রাজনীতির চিত্র।“ বোমা আর পাইপগান নিয়ে দুদলের কলেজ-দখলের লড়াই চলে সে তথ্যও তাঁর কাছে পাওয়া যায়। ‘বস্তিফস্তি প্রায় নেই বলে আমরা হাঙ্গামাহুজ্জুত থেকে বেঁচে গিয়েছি অনেকটা” এই তাঁর নিরীক্ষা।
‘ওরা’ গল্পে আবারও দমবন্ধ অবস্থা, সুবিধাবাদী রাজনীতিই হেতু । “…পান্নার এই ভয়ংকর মৃত্যুর সংবাদ সকালের দিকে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আমাদের গোটা অঞ্চলটা –মানে রেল লাইনের একপার থেকে কোথাকার সেই ব্যাটারী ফ্যাক্টরি দেশলাই কল পর্যন্ত, আবার ওদিকে গঙ্গার ঘাট থেকে এদিকে থানা পর্যন্ত একেবারে থমকে গেল।বাজার হাট দেখতে দেখতে উঠে গেল,…….থানার কালো কালো গাড়িগুলো ঘুরতে লাগল।“
সংশ্লিষ্ট চতুর্থ গল্প একইরকম আবর্তকে মন্থন করে উঠে এসেছে। ।সুবোধ নামক একটি তরুণকে জেল কাস্টডি থেকে নিয়ে আসা হয়েছে জেরা করবার জন্য সব রকমে প্রস্তুত একটা পর্দা ঢাকা চেম্বারে।শারীরিক অত্যাচার করে কথা কবুল করাবার আয়োজনে ঘাটতি নেই।এক এক করে লেখক শ্বাসরোধী পরিবেশের ঘনত্ব বাড়িয়ে তুলেছেন।ভদ্র চেহারার তদন্তকারী অফিসারের মুখ থেকে অনর্গল অমানবিক অন্যায্য এমনকি আইনসম্মতও নয় যা, সেসব উৎপীড়নের বিশ্লেষণ নির্গত হচ্ছে।যেমন-“এটা ইলেকট্রোনিক্যালি অপারেটেড একরকম টর্চ।ইনফ্রারেড রে বেরুবে জ্বাললে।তোমার চোখের পাতায় আলোটা দিয়ে রাখলে ভীষণ যন্ত্রণা হবে।গরম লাগবে খুব। মনে হবে চোখের পাতা, মণি পুড়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ রাখলে অন্ধও হয়ে যেতে পার।“আজকের স্বীকৃতি অস্বীকৃতির ঊর্ধ্বে অভ্যস্ত অনায়াস ফ্যাসিজম।সুবোধ সাময়িক হলেও প্রতিহত করে নির্যাতনের গতিকে।বিমল করের আর একটি গল্পে বটানির প্রোফেসর পূর্ণেন্দুবিকাশ মানুষের বা অন্য প্রাণীর সঙ্গে উদ্ভিদের তুলনা করতে চেয়েছেন- ‘…..হু ইজ মোর সুটেবল টু দিস আর্থ, অ্যানিমালস অর প্ল্যান্টস? অর্থাৎ কোন জীবন উপযুক্ত বেশি; সেই জীবন,যা রেসপন্ড করতে পারে ,রি-অ্যাক্ট করতে জানে, প্রয়োজনে হিংস্র, করুয়েল- অথবা অসহায়, অনড় ,মূক জীবন-যা সম্পূর্ণভাবেই দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে আয়ু আর ক্ষুধা নিয়ে পড়ে আছে।…মনে রাখতে হবে আমরা অ্যানিমালস –হায়ার অ্যানিমালস …’
আক্রান্ত হতে হয়েছে যে সব সুবোধদের তারাও জেনে নিয়েছে প্রতিপক্ষের দুর্বলতা কোথায়? ‘ওরা’ গল্পে তাবড় তাবড় নেতাদের প্রায় দুর্গে বন্দী করে ফেলেছে না-লায়েক ছোকরার দল। তাও গল্পগুলিতে ক্রম-অগ্রগতিও কালানুগ। ‘উদ্বেগ’-এ শিশিরকে অনধিকার এবং অযোগ্যতার কথা বলে মারির থেকেও বেশি গ্লানিকর পরিবেশে নিক্ষেপ করা হয়েছে।–“শিশির বাইরে এল।বাইরে এসে তার চৌদ্দ বছরের সাইকেলটা ঠেলে মহামারীর দিকে এগিয়ে চলল।যেতে যেতে শিশির ভাবছিল,এই শহরের মহামারীতে সে এবং মীরা কোনওদিন মৃতের তালিকায় স্থান পেতে পারে।কেন না,আপাতত এই শহর কেবল মাত্র যোগ্য এবং অধিকারী ব্যক্তিদের উপদেশ মতন পরিচালিত হবে।“ ‘সে’ –এর কাহিনী মানসিক সংকটেরও।পালিত সাহেব নিজের নীতিশূন্য অবস্থানে আরও বেশি সন্ত্রস্ত।নকশাল সময়ের যুবকদের সুবিধাভোগীরা ভয় পেয়েছে। অবশ্য এই ছেলেটি সেই ক্ষমতাশালী বিশেষ ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ আক্রমণ সম্ভবত করেই নি।শুধু তার বা তাদের মতো বঞ্চিতদের অবস্থান জানাতে এসেছিল।তবু আদিত্য নামের সেই পালিত সাহেবের ভাগ্নের বান্ধব শ্রেণীর ছেলেটি উপেক্ষিত মানুষের হয়ে নিম্নোদ্ধৃত স্বীকারোক্তি আদায় করেছে :”ইউ হ্যাভ কলড মী এ বাস্টার্ড, সান অফ এ বীচ। ইট ইজ অল রাইট; আই অ্যাম এভরিথিং।“”ভগবান জানেন, এইরকম এক বিপজ্জনক মুহূর্তেও আমার কেন যেন মনে হল, আদিত্যর চোখ ওর হাতের ছোরার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর ধারালো।ওর ঘৃণায় কোনো দ্বিধা নেই ,দুর্বলতা নেই, যেন আজন্মকাল নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতন ওটা ওর রয়েছে এবং দিন দিন বেড়ে উঠেছে।“ছেলেটি তাঁর মেয়ের প্রত্যাখ্যাত প্রণয়ী বা এমন কোনো এজেন্ট বা উমেদার হয়ত যাকে ইনি ঘুষ নিয়ে বঞ্চিত করেছেন।অমূলক নয় এই অন্তর্গত ভীতি। ‘ওরা’ গল্পের অগ্রগতি বেশিদূর পর্যন্ত- এরা নেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।মস্তান গুন্ডা তৈরি করে রাজনৈতিক ক্ষমতালাভ করার সোজা উপায় দলমতনির্বিশেষে সব দলনেতাই নেন।লুম্পেন বলে তারপর তাদের যথেচ্ছ ব্যবহার করা চলে।সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ বন্ধ হয়, বেশিরভাগ কেত্রে অকালে ভয়ংকর মৃত্যু হয়।পান্নার তাই হয়েছে।সমাজজীবনে এদের সাহায্যে ত্রাস সৃষ্টি করেন নেতারা। বিমল করের এই আলোচনাধীন গল্পটিতে ত্রাসের মুখ ঘুরে গেছে।থমথম করছে রাত। ত্রস্ত হ’য়ে ফুলেশ্বর, গোপীমোহন, কেষ্ট গুপ্ত ও প্রমথ শুনেছে ফোনের বালকোচিত অথচ ভীষণ অভিযোগের গলা।যে লোকনায়কেরা জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করে তারা শুনেছে রণবাদ্য, তখন লেখক লিখেছেন, “আমরা চারটি সন্ত্রস্ত, শঙ্কিত,ভীত, মৃতপ্রায়, লুব্ধ প্রবীণ এই ভয়ংকর ফাঁদে আটকা পড়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছি “চলে,’বলুন, হোয়াট নেক্সট?”ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বানিয়েছে তারাও। নতুন দল নতুন রক্ত না হলে নীরক্ত রাজনীতি বাঁচবে না। এই গল্পটি সংঘাতের মধ্যেও আশাব্যঞ্জক।
‘ নিগ্রহ’-এর প্রধান প্রতারিত ব্যক্তি পাষাণের মতো প্রতিষ্ঠানকে নেপথ্যে নয়, সব জুজুর ভয় জয় করে মুখোমুখি প্রত্যাঘাত করেছে।সুবিধাবাদের প্রসাদে যারা আরক্ষিত তাদের মধ্যে কারও রক্ষাকবচ কেড়ে নেওয়ার কথা এ কাহিনীতে আছে। এক লহমায় ৮০-র দশকের কিছু সংকটকে দেখে নেওয়া গল্পগুলির গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করে।‘১৯৮১ থেকে যে দশকের শুরু হল তার মতো সংকটময় দশ বছর স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আগে কখনও আসেনি। অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, কালো টাকার প্রসার, আন্তর্জাতিক লেনদেনে প্রচণ্ড ঘাটতি, টাকার বহির্মূল্যে অস্থিরতা,বিদেশ থেকে প্রচুর ঋণের ব্যবস্থা ইত্যাদি সমস্যা প্রত্যেকটি অন্যগুলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।…”(দিন বদলায়, দেশ নিশ্চলঃভবতোষ দত্ত-সাত দশক সমকাল ও আনন্দবাজার)
অবক্ষয় হতাশা তখন দিকচক্রব্যাপী।আঙুরলতা-র সেই নিরবচ্ছিন্ন নিরালোক।আঙুর নন্দর সৎকারের জন্য জননেতার সহকারির কাছে সাহায্য চেয়েছিল-“আপনি বাবু একদিন এসে আমার ভোট কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দাড়িবাবুর জন্যে।বলেছিলেন, আপদবিপদ সুখসুবিধে দেখবেন।“বেশ্যাপট্টির ভোট পাওয়ার জন্য মানিক মুন্সী আরও গুরুতর অন্যায়ও করেছিলেন-‘পান মিষ্টি খেতে জনে জনে টাকা’ দিয়েছিলেন। অবশেষে আঙুরকে নিঃস্ব হওয়ার পরেও প্রভুলালের কাছে দেহ বিক্রি করে তবে নন্দর সৎকার করতে হয়।মনে পড়ে যায়যে ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা ছবিতে হরপ্রসাদ নামক চরিত্রটির ভীতিকরভাবে আবৃত্তি-‘ রাত কত হলো? উত্তর মেলে না”।
ইতিহাস এদিকে বিবিধ সংশ্লেষ ও তথ্য দিয়েছে।তার কয়েকটি উদ্ধৃত হল। এগুলি সমকালের প্রামাণ্য বিষয়-
১। ভারতের আমলাতন্ত্র অনমনীয়। মূলত রক্ষণশীল, স্থিতাবস্থা-পন্থী এবং সামাজিক পরিবর্তন-নিরোধী, বিশেষ করে গরিবদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারে অথবা পুনর্বণ্টন সংক্রান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে।(সরকারি প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র)
২।“ভারতীয় পুলিশের একটি জঘন্য বৈশিষ্ট্য হল সাধারণ মানুষের প্রতি এর নেতিবাচক মনোভাব।…বিচারাধীন বন্দিদের ওপর পাশবিক অত্যাচারের জন্যও ভারতীয় পুলিশ কুখ্যাত।”(পুলিশ)
৩।“এদিকে ভারতের অধিকাংশ ছোটবড় শহরের পৌর-প্রশাসন- সংস্থাগুলি কিন্তু আগের মতোই অপটু আর দুর্নীতিগ্রস্ত রয়ে গেছে,তাদের কার্যকর প্রশাসনিক ক্ষমতারওওভাব আছে।”(কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক)
৪।“পরিব্যাপ্ত বড় মাপের দুর্নীতি,অপরাধের বাড়বাড়ন্ত, রাজনীতি আর পুলিশের দুর্বৃত্তায়ন,এইগুলি ভারতের উন্নয়ন, গণতন্ত্র এবং নৈতিক স্বাস্থ্যের পক্ষে প্রধান বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে।”(দুর্নীতি)
[ ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পরে ১৯৪৭-২০০০ঃবিপন চন্দ্র,মৃদুলা মুখার্জি,আদিত্য মুখার্জি]
বিমল করের প্রধান প্রধান ছোটগল্পের সৃষ্টির মূলে নীতিশূন্য অবস্থায় মানব-অস্তিত্বের পর্যালোচনা রয়ে গিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীর মতো তিনি তৎকালের নীতিহীনতার পরিমাপ করেছেন। রাজনৈতিক দূষণের পরিবৃত্তে বসবাস করতে করতে মানবসত্তা কোন গহনে নিক্ষিপ্ত হয়েছে আর তা থেকে কীরূপ অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা আছে এই গল্পচয়ে নিরীকৃত। আজও অনুসন্ধানের বিশিষ্টতার জন্য, বাস্তবানুগত্যের জন্য এগুলিকে বিস্মৃত হওয়া উচিত হবে না।
Tags: তন্বী মুখোপাধ্যায়, প্রবন্ধ, রাজনীতির অনুষঙ্গে বিমল করের গল্প
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।