[বর্তমান প্রবন্ধটি দেবাশিস মুখোপাধ্যায় (দে মু) তৈরি করেছিলেন সুধীর চক্রবর্তীর একটি বক্তৃতাকে ভিত্তি করে। সমগ্র বক্তৃতাটি ইন্দুমতী সভাগৃহে বসে রেকর্ড করেছিলেন দেবাশিস বাবু। পরবর্তীতে এটি নন্দন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বছর পনেরো আগে। সুধীর চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের অনুমতি ক্রমে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেই বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশ করা হল।]
রবীন্দ্রনাথ ও লালন ফকির – নাম দুটি উচ্চারণ করার মধ্যে একটা বৈপরীত্য আছে। কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের টানে, এখন, আমরা এমনভাবে এগিয়ে একটা জায়গায় এসেছি যে, রবীন্দ্রনাথ ও লালন ফকির নাম দুটি এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতে পারছি। এটা পঞ্চাশ বছর আগেও কল্পাতীত ছিল এবং যে সময় লালন ফকির জীবিত ছিলেন (মৃত্যু ১৮৯০) তার পরবর্তী কয়েক দশক লালন ফকির যাদের প্রতিনিধি ছিলেন সেই বাউল বৈরাগীদের উচ্চসমাজে,এলিটটিস্টদের কাছে প্রায় কোনো মূল্যই ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাঁদের ব্রাত্য এবং লোকায়ত বলা যেতে পারে। মনের মানুষের গভীর নির্জন পথে যাঁরা এগিয়ে যাবার ব্রত নিয়েছিলেন যাঁদের সমাজের যাঁরা উচ্চবর্গের মানুষ তাঁরা খুব যে শ্রদ্ধার চোখে দেখত তা মনে হয় না। সত্যি কথা বলতে কি W.W. Word এবং H.H. Wilson – এই দুজন সাহেব আমাদের দেশে মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টস বা গৌণ ধর্মী মানুষদের সন্ধান শুরু করেন। অর্থাৎ সব কিছু যেমন আমাদের সাহেবদের হাত ধরে হাতে খড়ি – গৌণ ধর্মের চর্চাটাও প্রায় তাই। ওঁরাই প্রথম এই গৌণ ধর্মের মধ্যেও যে একটা প্রাণবীজ আছে এটা তাঁরা দুজন উপলব্ধি করে এক ধরণের ডক্যুমেটেশন করেছিলেন। তাতে অনেক ভুলভাল ছিল, কিন্তু তাঁরাই পথিকৃৎ। বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা এ ধরনের অনুসন্ধান করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন অক্ষয় কুমার দত্ত। তাঁর সেই লেখা ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। কিন্তু অক্ষয় কুমার দত্ত নিজে সরেজমিন ঘুরে ঘুরে সব তথ্য সংগ্রহ করেননি। তিনি অসুস্থ ব্যক্তি ছিলেন, ফলে বিবিধ সংগ্রাহকদের কাছ থেকে খবর নিয়ে যেটুকু পেয়েছেন সেটা তাঁর বইয়ে লিখেছেন। পরবর্তীকালে তা আমাদের কাছে দিশারীর কাজ করেছে। কিন্তু সত্যিকারের নিম্নবর্গীয়দের সম্পর্কে যে চেতনা, আমাদের ঔপনিবেশী চিন্তা-ভাবনার উলটোপিঠে যে দেখা – রবীন্দ্রনাথের সৌভাগ্যক্রমে তেমন করে ইংরেজি স্কুলে তাঁর ইতিহাসের পাঠ নেওয়া ছিল না বলে তিনিই প্রথম দেশীয়তাকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ – এটা কোনো অঙ্গীকার নয়, এটা তাঁর জীবনের একটা সত্য। সেজন্য তিনি নিজে যা করেছিলেন এবং যে সমস্ত উদাহরণীয় কাজ করে গেছেন, তার মধ্যে একটা কাজ হচ্ছে লালন ফকিরকে সভ্য সমাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
লালন ফকিরের জীবন সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তাতে দুটি তথ্য খুব জরুরি। একটা হচ্ছে, কুষ্টিয়ার কাছে ছেঁউরিয়া বলে একটা গ্রামে সেইখানে নিম্নবর্গের কারিগর সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে বাস করতেন, – জোলা, তাঁতি, তাদের কারিগর বলে। সেই কারিগরদের পাড়ায় লালন ফকির থাকতেন ছেঁউরিয়াতে। যেখানে তাঁর সমাধি আজও আছে। ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন, সেইখানেতে চরণ তোমার রাজে।’ রবীন্দ্রনাথের এই বাণী লালনের জীবনে সত্য হয়ে গেছে। সবার অধম দীনের হতে দীন – তাদের মধ্যেই তিনি বাস করে গেছেন। তাঁর জীবন-তথ্য তেমন কিছু জানা যায় না। তাঁকে নিয়ে প্রচুর অনুমান ও হটোক্তি আমরা পাই। তাঁকে নিয়ে অন্তত ছ’টা উপন্যাস বেরিয়েছে। তাঁকে নিয়ে দুটো কাহিনী-চিত্র বেরিয়েছে। অন্তত গোটা আষ্টেক পি.এইচ.ডি গবেষণা হয়েছে। তাঁর জীবনী গ্রন্থ বেরিয়েছে কমপক্ষে দশটা। তার মধ্যে কিছু কিছু নকল কলমী অর্থাৎ হাতে লেখা জাল পুঁথি বেরিয়েছে। কিন্তু সমস্ত কিছুকেই যদি খুব নিরপেক্ষভাবে দেখা যায়, যাঁরা সত্য দ্রষ্টা যাঁরা ইতিহাসের দিকে চোখ রেখে এগোতে চান তাঁদের মনে হবে এই জালটালগুলো সরিয়ে লালন ফকিরকে উদ্ধার করতে গেলে দুটো সার কথা বেরিয়ে আসে। একটা হচ্ছে, তাঁর জন্ম সাল আমরা কেউ জানি না, দুই হচ্ছে তাঁর জন্ম স্থান কোথায়? তাও জানি না। কোন্ গ্রামে কোন্ অঞ্চলে? সমাজবিজ্ঞানে যে-গবেষণার ধারা আমরা তার সূত্রে দেখেছি, লালনের পিতৃপুরুষের কোনো ভিটেমাটি নেই। লালনের পৈতৃক কোনো দলিল দস্তাবেজ নেই। লালনের কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই। অর্থাৎ লালনের কোনো পূর্ব সূত্র নেই। যা আছে তা বানানো। কিন্তু একটা ভিত্তি খুব সত্য, সেটা হচ্ছে যে ছেঁউরিয়াতে তিনি আশ্রম করেছিলেন। ১৮৯০ সালে তাঁর মৃত্যু হয় এবং সেই মৃত্যুর ঠিক পনেরো দিন পরে কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ বলে একটা পত্রিকাতে তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়। তার নির্দিষ্ট সময় তারিখ মৃত্যুর ক্ষণ দিয়ে বলা হয়েছে –
পয়লা কার্তিক ভোর বেলা তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ১১৭। কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই তথ্যই আমার কাছে সবচেয়ে জোরালো তথ্য বলে মনে হয়। তাই তাঁর মৃত্যুর তারিখটা সুনির্দিষ্ট হয়েছে। স্থানটিও নির্দিষ্ট হয়েছে। কিন্তু মানুষটি কোথা থেকে এলেন ওখানে কীভাবে এলেন, সেসব বোঝা যায় না। আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনি। আমার গবেষণার প্রথম কাজই হচ্ছে ঘুরে বেড়ানো। আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে পশ্চিমবাংলা এবং পূর্ব বাংলার অনেকাংশে ঘুরেছি পায়ে হেঁটে এবং সমাজ বিজ্ঞানের আর সামাজিক নৃতত্ত্বের যত সূত্র আছে সবই প্রয়োগ করে আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে লালন ফকিরের পূর্ব-জীবন সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। দ্বিতীয় যেটা জানা যায়, সেটা হচ্ছে ১৮৮৯ সালে তাঁর একটা পোট্রেট স্কেচ পাওয়া গেছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা অভ্যাস ছিল, উল্লেখযোগ্য কোনো মানুষের সম্মুখীন হলেই তিনি তাঁর একটা স্কেচ করে রাখতেন। তাঁর স্কেচবুকের সেই খাতায় একটা ছবি পাওয়া গেছে লালন ফকিরের। তাতে লেখা আছে ‘শিলাইদহ, বোট, লালন ফকির ১৮৮৯’। এর থেকে বোঝা যায় মৃত্যুর এক বছর আগে লালন ফকিরের একটা পেনসিলে আঁকা লাইন – পোট্রেট হয়েছিল। অর্থাৎ লালনের সত্যিকারের পাথুরে প্রমাণ আছে দুটো। এক, লালনের চেহারা কেমন ছিল সেটা জানা যায়। ছবিটা ছাপা হয়েছে-দু একটা বইয়ে এখন পাওয়া যায়। মূল ছবি রবীন্দ্রভারতীতে সংরক্ষিত আছে। ছবিটা আমি দেখেছি। দ্বিতীয় যেটা – ‘হিতকরী’র ফাইলটা পাওয়া গেছে, তাতে তাঁর মৃত্যুকালীন খবর ছাপা আছে। সেই খবরের মধ্যে যেটা জরুরি সেটা হচ্ছে – ‘হিতকরী’ লিখছে, তিনি কোনো বিশেষ ধর্মমতে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর পূর্বজীবন বা জীবন সম্বন্ধে ‘তিনি কিছু বলিতেন না’। শিষ্যদের নিষেধ করা ছিল, ‘তাহারা কিছু বলিতে পারে না’। এবং মৃত্যুর পর একজন মানুষ হিন্দু না মুসলমান জানার যা সহজ পদ্ধতি অর্থাৎ তাঁর অগ্নিসংস্কার হয় তবে বুঝতে হবে যে সে হিন্দু, যদি তাকে জানাজা নামাজ পড়ে কবরে দেওয়া হয় ইসলামি মতে, তবে বুঝতে হবে যে লালনের নির্দেশ ছিল দুটোই না করা। ফলে তিনি যেখানে থাকতেন সেই ছেঁউড়িয়ার যে-মাটি, সেই আশ্রম, সেই পর্ণকুটির, ঠিক তার তলাতেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এখনও সেখানে গেলে সবাই সেটা দেখতে পাবেন। তাঁর ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী, তাঁর কাঁথা কম্বল, একতারা-দু একটা জিনিস আছে, এখনও গেলে সেগুলো দেখতে পাওয়া যায়। আসলে মানুষটির সমস্ত পরচিয়টা উদ্ভাসিত হয়ে আছে তাঁর গানে। সেই গানও মনে হয় বাচনিক। উনি নিজে লিখতেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
এই প্রসঙ্গে সন্ত কবীরের কথা মনে পড়ে যায়। কবীর চারশ বছর আগে জন্মেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি কখনও কাগজ হাতে করিনি, কলম হাতে করিনি, আমি কখনও সাদা কাগজের ওপর কোনো আখর টানিনি। কবীরপন্থের সমস্ত গানই বাচনিক পরস্পরায়। শিষ্যরা সেই গানগুলোকে ৪০০ বছর ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। আমাদরে দেশে ওরাল-ট্রাডিশন খুব পুরোনো জিনিস, হয়ত পৃথিবীর সব দেশেই আছে। যেভাবে কবীরের গান বেঁচে গেছে, সেভাবেই লালনের গান বেঁচে আছে। যেভাবে কবীরের গানে বিকৃতি এসেছে, সেভাবে লালনের গানেও বিকৃতি এসেছে। কারণ, আমাদের শিক্ষিত পণ্ডিতদের স্থূলহস্তাবলেপে তার মধ্যে কিছু কিছু শব্দ পালটে গেছে। লালনের অনেক গানের মধ্যে আমরা আমাদের উদারতা বা প্রগতিশীলতার চিহ্ন রাখবার জন্যে, অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেও, লালনের গানের মধ্যে এমন সব শব্দ ঢুকিয়ে দিয়েছি যা লালনের কল্পনাতীত ছিল। আমরা লালনের যে গান পেয়েছি সেই গানের text এখন নতুন করে দেখার চেষ্টা চলছে। সেই সব text এখনকার সাহিত্য বিচারের যে পদ্ধতি, textকে দেখার চেষ্টা আলাদা করে এবং লেখককে ছেড়ে দিয়ে, দেশকালকে ছেড়ে দিয়ে, হয়তো রোলা বার্তের থিয়োরি অনুযায়ী আমরা শুধু text টাকেই পড়ে দেখছি কী ব্যাপার। লালন ফকিরের জীবনে অনেকগুলো দুর্ভাগ্য ছিল বোঝা যায়। তবে সৌভাগ্যও ছিল।ঘটনাচক্রে তিনি কুষ্টিয়াতেই ছিলেন শেষের দিকে। তাঁর জীবনে দুটো মহৎ সৌভাগ্যের কথা যে, কুষ্টিয়াতে ছিলেন বলেই তাঁর গান রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল। তাঁর বার্তা গিয়ে পৌঁছেছিল। তিনি যদি কুষ্টিয়াতে না থেকে, ধরা যাক চট্টগ্রামে বা বরিশালে বা শ্রীহট্টে থাকতেন, তাহলে কিন্তু লালনের পরিণতিটা এমন হত না। কেন না রবীন্দ্রনাথ তাঁকে জানতে পারেন ভৌগলিক ভাবে, যেহেতু তাঁর জমিদারি ছিল শিলাইদহে, পতিসরে, শাহজাদপুর, কালিগঙ্গায়। এই চার জায়গায় ঘুরতেন। কুষ্টিয়ায় গেলে দেখা যায় কুষ্টিয়ায় ছেঁউড়িয়া আশ্রম থেকে দুই কিলোমিটার এগিয়ে ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব একটা আদিমঘর আছে এখনও। লালনের আখড়া ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারি আওতাভুক্ত। সেই আখড়া তাঁর মৃত্যুর পরে ভগ্নদশায় পড়ে। তাঁর শিষ্য প্রশিষ্যরা সেটাকে যদি বাঁচানো যায়, সেজন্যে ঠাকুর সাহেবের কাছে টাকা চেয়েছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছু টাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন, ঘটনাচক্রে তা হয়নি। লালন ফকির আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটা ভৌগলিক এবং জমিদার-প্রজা সংক্রান্ত সম্পর্ক না থাকলে এটুকুও হত না। রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ বক্তৃতার মধ্যে বলেছিলেন – বিভিন্ন গ্রামে কোনো একজন ব্যক্তি হয়তো বিশেষ একটাধর্ম সম্প্রদায় সৃষ্টি করছেনে, সেগুলিকে লক্ষ্য করতে হবে। অর্থাৎ গৌণ ধর্মকে উপেক্ষা নয়, বড়ো বড়ো যে ধর্ম, অভিজাত ধর্ম তার বাইরে যে-গৌণ ধর্মের ব্যাপার, তার যে প্রতিবাদ, তার যে সমন্বয়কামিতা, সেগুলোকে উপেক্ষা করা যাবে না। ছাত্রদের বলছেন, গ্রামে যাও তাদের লক্ষ্য করো। রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় যে কাজটা করলেন, সেটা হচ্ছে তিনি ছেঁউড়িয়া আশ্রম থেকে দুখানা লালনের খাতা কপি করে আনলেন। এক্সারসাইজ বুকের দুটিখাতায় ‘লালন গীতি’ পাওয়া গেছে। সেটা শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনে এখনও সংরক্ষিত আছে। তাতে লেখা আছে ‘সঙস অফ লালন ফকির, কালেকটেড বাই রবীন্দ্রনাথ টেগোর’। অ্যাকসেসন নম্বর দেওয়া আছে। খাতাটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে খাতাটি ডান দিক থেকে বাঁ দিকে এগোতে হবে। অর্থাৎ ইসলামি পদ্ধতিতে খাতাটা কপি করা হয়েছে। দুটি খাতা। হাতে লেখা বেশ অস্পষ্ট। হাতের লেখার ছাঁদটাই খারাপ। যিনি কপি করেছেন, তিনি খুব বেশি শিক্ষিত মনে হয় না। তিনি মূল খাতা থেকে গানগুলো কপি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যে সেই খাতা পড়েছেন তার প্রমাণ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন, এই গান পড়া খুব কঠিন, যেখানে যেখানে উনি পড়তে পারেননি, যে শব্দটা বুঝতে পারছেন না কী হতে পারে, অনুমান করে সেটা লিখেছেন তার থেকে বোঝা যায় যে প্রত্যেকটা পদ উনি মন দিয়ে পড়েছেন। তার থেকে ২০টা পদ কলকাতার ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘হারামণি’ বলে একটা বিশেষ ক্রোড়পত্রে তিনি প্রথম সভ্য সমাজে ছেপে বার করেছেন। কাজেই আমাদের এলিটিস্টদের কাছে লালনের লিখিত রূপ যদি কেউ এনে থাকেন তিনি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ভাইঝি ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে দিয়ে দুটি লালনের গান স্বরলিপি করিয়ে ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকায় তিনি মুদ্রণ করেন ১৮৯৮ সালে, লালনের মৃত্যুর ৮ বছর পরে। তাহলে তিনি একজন সাধকের জীবনকে লক্ষ করতে বলেছেন, তাঁর গানগুলি সংগ্রহ করে এনে নিজের কাছে রাখছেন। তার থেকে ২০টি গান নিয়ে কলকাতার পত্রিকায় ছেপে বোঝাতে চাইছেন যে এই গানের কত বৃহৎ তাৎপর্য আছে। সেই গানের স্বরলিপি করে প্রমাণ করেছেন এমন কী স্বীকার করছেন – লালনের গানের একটা অন্য মূল্যও আছে, সেটা সাংগীতিক – এখানেই শেষ নয়। ইন্ডিয়ান ফিলোজফিক্যাল কংগ্রেসে ‘রিলিজিয়ন অফ ম্যান’ বক্তৃতার মধ্যে তিনি হাসন রাজার গান, লালনের গান, গগন হরকরার গান ইংরেজিতে অনুবাদ করে বুঝিয়েছেন – আন্তর্জাতিক কবিতার বিচারেও এসব গান অত্যন্ত মূল্যবান, তার ধরণ আর মরমিয়াবাদ অনেক বেশি। শেলির কবিতার সঙ্গে লালনের গানের একটা তুলনা করেছেন এক জায়গায়। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক লাগতে পারে, কিন্তু এটা আছে, ছাপার অক্ষরেই আছে। আমরা যারা পরবর্তীকালে লালন অনুরাগী, লালনের মৃত্যু ১৮৯০ সালে হয়ে থাকলে আমরা যার অনেক পরে জন্মেছি, লালনকে আমরা যেভাবে পেয়েছি বিভিন্ন তথ্য বিভিন্ন খবরের কাগজের খবর, সমসাময়িক সাক্ষ্য-এসব থেকে বিচার করে পরামর্শ করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে দেখা যাচ্ছে এতসব তথ্যের মধ্য অনেক ফাঁক আছে। যেমন ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবাসী’তে যে গানগুলি ছেপেছেন দুটি তুলনা করলে দেখা যায় খাতায় ৮ খানি গান ‘প্রবাসী’তে আছে। বাকি ১২ খানি গান কোত্থেকে এল? এ থেকে সন্দেহ হয়, তাহলে আর একটা খাতা আছে। যিনি শিলাইদহে গেছেন, তিনি অন্নদাশঙ্কর রায়ই হন বা জজসাহেব মতিলাল দাসই হন, কী শচীন্দ্রনাথ অধিকারী – রবীন্দ্রনাথের চেনা মানুষদের মধ্যে যিনি গেছেন ছেঁউড়িয়াতে লালনের আখড়ায় – প্রত্যেককে ভোলাই শাহ বলে লালনের এক শিষ্য বলেছেন যে রবিবাবু আমাদের গানের খাতা নিয়ে গেছেন, সেই খাতা আমাদের কাছে আর ফেরত আসেনি। আপনারা দয়া করে সেটা ফেরত দেবার চেষ্টা করবেন। লালন গবেষকরা বহুদিন পর্যন্ত ভেবেছিলেন ওই খাতা দুটো বোধহয় সেই খাতা। পরে প্রতীতি হয়েছে যে ওটা কপি। তাহলে মূল খাতাটা কোথায় গেল? এরপর যেটা সমস্যা – যেটা চিরকাল মজার জিনিস – কুষ্টিয়া ছেঁউড়িয়া গ্রামের বহুলোকের ধারণা যে রবীন্দ্রনাথ যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন তা লালনের গানের খাতা টুকে। এই অনুমান ও সন্দেহগুলো ছাপার অক্ষরে আছে। বহু শিক্ষিত ব্যক্তিও তা মনে করতেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সত্যি একটা দ্বিতীয় খাতা পাওয়া গেছে। আজ থেকে ১০/১২ বছর আগে, রবীন্দ্রনাথের যিনি জামাতা, কৃষ্ণ কৃপালনি, তাঁর বাড়ির পুরোনো বইপত্র বিক্রি করার সময় লালনের একটা খাতা পাওয়া গেছে। সেই খাতার অন্তর্গত ২০টা গান ‘প্রবাসী’র সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। অতএব অনুমান করা যায় লালনের গানের খাতার অনেকটা ভাবনার বিষয় আছে। সেই নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। ঘটনাচক্রে লালনের সমাধিটা পড়েছে পূর্ববঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে নয়। কুষ্টিয়াটা ভাগ হয়ে গেছে নদিয়া জেলার মাঝখান থেকে। তাতে মোহরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া তিনটে পড়ে গেছে বাংলাদেশে, তখনকার পাকিস্তানে। সেই পূর্ব পাকিস্তানে লালনের সমাধিটা ছিল। প্রথমে ছিল একটা পর্ণকুটির তারপরে তাঁর শিষ্যরা ইঁটের গাঁথনি করে একটা ঘরদোর বানিয়ে ছিলেন। একবার প্রবল ঝড়ে সেটা ভেঙে পড়ে। কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলের জৈনিক লালন অনুরাগী তার সংস্কার করে মোটামুটি এক কাঠামো করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। তারপর লালনের কথা কেউ আর জানে না। দেশ ভাগ হয়ে গেছে। আমরাও, পশ্চিমবঙ্গের লোকজন উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে খুবই ব্যস্ত, বিপন্ন। ওঁরাও ওদের জীবন নিয়ে বিপন্ন। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমিরা ওখানে গিয়ে একটা মিশ্র সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। নতুন প্রশাসন সেসব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এর মধ্যে লালন আবার কে? আর রবীন্দ্রনাথ যে লালন সম্বন্ধে এতসব কাণ্ড করে গিয়েছিলেন তা কেউ জানত না। আমাদের পাঠক্রমে এসব ছিল না। আমাদের স্কুল-কলেজে মাস্টার মশাইরা সেকালে লালন বলে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি। সুকুমার সেনের মতো সাহিত্যের ইতিহাসবিদেরা এসব নিয়ে লেখেননি। দীনেশচন্দ্র সেন এর উল্লেখ করেননি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে লালনের কথা কেউ জানত না। ইতিমধ্যে হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানে একটা ইসলামি চেতনা জেগে উঠল। ওঁরা ঠিক করলেন, লালন ফকির বলে একটা লোককে পাওয়া গেছে। তার একটা ইসলামীকরণ করা দরকার। কাজেই ওঁরা ওখানে একটা একাদেমি মতন খুলে ফেললেন। মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের চেষ্টায় তখনকার পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ অনেক টাকা নিয়ে এলেন ঢাকা থেকে। দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ায় যে আছে, তার নকলে সাদা রঙের ইসলামি সৌধ লালন ফকিরের সমাধির ওপর তৈরি হয়েছে। এখন সেখানে গেলে দূর থেকে সেই বিশাল সৌধটি দেখতে পাওয়া যাবে। সাম্প্রতিককালে আমার কাছে যে সংবাদ এসেছে, লিখিত খবর যে, ফকিরদের মৌলবাদীরা তাড়িয়ে দিয়েছে এবং লালনের ওই সৌধের মধ্যে বসে প্রতিদিন কোরানের তেলওয়াত করা হয়। লালন যা চাননি, সেটা করা হয়েছে। পাকাপাকি ভাবে লালনকে ইসলামি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তার সমর্থনে জীবনী তৈরি করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে উনি মুসলমানই ছিলেন। কোনো মতেই হিন্দু ছিলেন না। তার আগে যে কটা জীবনী বেরিয়েছিল, তাতে লেখা ছিল তাঁর কায়স্থ বংশে জন্ম, তাঁর পদবি হচ্ছে কর। পরে তিনি মুসলমান হয়েছেন। তার কারণ তিনি গিয়েছিলেন এক তীর্থে। তীর্থের আবার তিনটি রূপ আছে। কেউ বলেছেন নবদ্বীপ, কেউ বলেছেন কাশী, কেউ বলেছেন জগন্নাথ দর্শন। এই তীর্থে যাওয়ার কারণ, হিন্দু তো তীর্থ করতে যেতেই পারেন। যাওয়ার সময় তাঁর গুটি বসন্ত হয় এবং সেই বয়াবহ রোগের ভয়ে পিতামাতা মতান্তরে বন্ধুরা তাঁকে ফেলে চলে যায়। অদ্ভূত সেই পিতা-মাতা, অদ্ভূত সেই বন্ধুরা। এবং নদীর জলে ভেসে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে এসে তাঁর প্রথম জ্ঞান হল। তিনি ‘পানি পানি’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আমি নির্দিষ্ট একটি জীবনী থেকে এসব কথা লিখছি। ‘পানি পানি’ বলে চেঁচিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যটা বুঝতেই পারা যাচ্ছে যাঁরা বইটা লিখছেন, তাঁরা বোঝাতে চাইছেন উনি মুসলমান ছিলেন। তখন দূরে লালনের গান শোনা যাচ্ছিল। তিনি বললেন, আমার গান এখানে কে গাইছে? অর্থাৎ সেই সময়ে লালনের গান যে সারা দেশে প্রচারিত তাও জানা যাচ্ছে। এইভাবে অলীক কিংবদন্তির মধ্যে দিয়ে অনেক জীবনী লেখা হয়েছে। কিন্তু ভৌগলিক ভাবে দেখা যায়, দূরের কোনো নদীর স্রোত দিয়ে ছেঁউড়িয়াতে পৌঁছনো যায় না। তিনি পরিত্যক্ত হয়েছেন হয় গঙ্গায়, না হলে তারও দূরে কোথাও। যদি আদৌ হয়ে থাকেন? অবশ্য তাঁর মুখে কিছু বসন্তের চিহ্ন ছিল।
এইবার একটা সার কথা বলা দরকার রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বলেই লালন বিখ্যাত হয়েছেন। লালনের আশ্রম পূর্ব পাকিস্তানে পড়েছিল বলেই তার আজকের এত রমরমা। তাঁকে নিয়েএত গবেষণা। তাঁকে ইসলামীকরণ করার জন্যে এত চেষ্টা। মাঝখান থেকে লালন নামক একজন লোক যদি থাকেন তিনি নিশ্চয় ভেতরে ভেতরে কবীরের মতোই হাসছেন। তিনি যা চাননি তাইতো করা হয়েছে। তাঁর একটা বিখ্যাত গান আছে ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে / লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে’। জীবিত কালেই তিনি এই গানটা লিখেছিলেন, তার মানে জীবিতকালেই তিনি বিতর্কিত লোক ছিলেন। সব লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করত – আপনার কী জাত মশাই? কেননা জাত না জানা পর্যন্ত মানুষ খুব নিশ্চিত হয় না। এটাও ঠিক যে, তিনি জীবিতকালে একটা আড়াল টানতে চেয়েছিলেন। চেষ্টাকৃত আড়াল। সেটা গড়পড়তা মানুষের একদম উলটো পিঠ দিয়ে যাচ্ছে। কেন না আমাদের কাজই হচ্ছে আত্মপ্রকাশ। নিজেকে আড়াল করা বা আবৃত করা আমাদের উচ্চ সমাজে নেই। আমরা যারা ঔপনিবেশী শিক্ষায় শিক্ষিত, আমরা যারা নাম পরিচয়ের সঙ্গে ডিগ্রিকে ব্যবহার করি বাড়ির নামফলকের মধ্যেও সেখানে লালন ফকির বলছেন, আমরা কোনো ব্যক্তি পরিচয় তোমরা দিয়ো না। আমি ছিলাম, আমি চলে গেছি। এত সহজে স্পষ্ট একটা মানুষ ১৮৯০ সালে মারা গেছেন, পিছিয়ে গেলে ১১৭ বছর ধরলে ধরলে সেটা হয় রামমোহনের সময়। রেনেশাঁস, নবজাগরণ – যা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, যা প্রধানত কলকাতা কেন্দ্রিক বা নগরস্পর্শী যার প্রতীক রামমোহন বা বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষা ও ইংরেজি ভাষা। যেখানে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, যেখানে জাতীয়তাবাদ ও স্বদেশচেতনা, যেখানে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, যেখানে ক্ষুদিরামের ফাঁসি। সেই বিশাল ঔপনিবেশিক বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের জাগৃতির সমান্তরালে অন্য একটি মানুষও বেঁচেছিলেন – লালন ফকির। তাঁর ধ্যান ধারণা, বিশ্বাস, বস্তু জ্ঞান নিয়ে তাঁর মতো করে জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাঁর ছিল আত্মবিলোপের সাধনা। ‘হিতকারী’ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, তিনি ঘোড়া. চড়তে অভ্যস্থ ছিলেন এবং ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন আর তার মতগুলি প্রচার করতেন। তাঁর অন্তত ২০/২২ হাজার শিষ্য ছিল। এর থেকে বোঝা যায়, তিনি খুব আত্মভোলা উদাসীন সাধক ছিলেন না, একজন প্রচারকও ছিলেন। তৎকালীন বিদ্যমান ধর্মের সঙ্গে তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। যেমন ব্রাহ্মধর্ম, হিন্দু ধর্ম, আর একটা ইসলামিক ধর্ম – তার মৌলবাদ। এর মধ্যে থেকে তিনি তাঁর নিজস্ব ধর্ম প্রচার করে গেছেন। কুষ্টিয়া থেকে যত বই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে লালন ফকিরের খবর পাওয়া গেছে। তাঁকে কেউ কোথাও বাউল বলেননি। তিনি তাঁর গানের মধ্যে নিজেকে কখনও বাউল বলেননি। সব জায়গায় ফকির বলেছেন। লালনের গানই আছে – আগে ফিকিরি ছাড়, তবে হবে ফকির। ফিকিরি যার নেই সেই হচ্ছে ফকির। ফকিরি কোনও ধর্ম নয়। ফকিরি কোনও আচরণ বাদ নয়, ফকিরি হচ্ছে একটা বিশ্বাস। তাঁর স্কেচ এঁকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘লালন ফকির’ লিখেছেন। লালন বাউল ছিলেন না, লালন উদাসীন ছিলেন না। বৈরাগী ছিলেন না, জীবনবাদী ছিলেন। তাঁর সাধন সঙ্গিনী ছিল। তাঁর সম্পত্তি ছিল। হিতকারী’তে লেখা আছে তিনি কিছু জমি রেখে গেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষটি বেশ বৈষয়িক ছিলেন। ভালো সংগঠক ছিলেন। ১৮৯০ সালে প্রয়াত মানুষটির ভাগ্য এটাই – রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি পড়ল তাঁর ওপর। যদিও দুজনের মধ্যে নিশ্চিত দেখা হয়নি। তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শান্তিদেব ঘোষের বাবা কালীমোহন ঘোষকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, যে লালন ফকিরের শিষ্যদের সঙ্গে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেন। শিষ্যদের কথা বলেছেন, লালনের কথা বলেননি। লালনের সঙ্গে ওঁর দেখা হয়নি। ১৮৯০ সালের পর সত্যি রবীন্দ্রনাথ জমিদারির কাজে ওখানে গিয়েছিলেন – এটা হচ্ছে তথ্য। তার আগে দু একবার গেছেন। প্রধানত ওই জমিদারিটি তখন দেখতেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে যেতেন। জ্ঞানদানন্দিনী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী একবার লালনকে দেখতে চেয়েছিলেন বলে ঠাকুরদের বজরাতে উনি এসেছিলেন বলে বিবরণও পাওয়া গেছে। কলকাতার ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকাতে লালন ফকিরের কথা সরলাদেবী ছেপেছেন। এখানে একটা কথা বলা দরকার। কুষ্টিয়ার পাশেই ছিল কুমারখালি, সেখানে বেশ কজন শিক্ষিত লোক বাস করতেন। তাঁদের নাম অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তিনি বেশ বড়ো ঐতিহাসিক ছিলেন। ছিলেন বিখ্যাত জলধর সেন! ছিলেন কাঙাল হরিনাথ এবং মীর মশারফ হোসেন ছিলেন তাঁরই পত্রিকা ‘হিতকারী’। এই সব শিক্ষিত লোকদের সঙ্গে লালনের বেশ ঘষ্ঠিতা ছিল। যেমন লিখিত বর্ণনায় জানা গেছে একবার নাকি সারাদিন ধরে কাঙাল হরিনাথের বাড়িতে লালন গান শুনিয়েছিলেন। লালনপন্থা আসলে একটা গৌণধর্ম। এক সময়ে বৃহৎবঙ্গে প্রচুর গৌণধর্ম ছিল। তার অনেকগুলির আজ আর অস্তিত্ব নেই। ‘বৈষ্ণব ব্রতদিন নির্ণয়’ বইতে ১৩০টা গৌণধর্মের নাম পাওয়া গেছে। এতগুলো দল ছিল। বৈষ্ণবদের মধ্যেই ১১টা উপধর্ম আছে। এখানে এসে রবীন্দ্রনাথের কথাটাই বলতে হয়, হায় গগন নহিলে তোমায় ধরিবে কে বা ওগো তপন তোমার স্বপন দেখি গো করিতে পারি না সেবা। ‘শিশির বলছে দুঃখ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে – হে সূর্য তোমার মতো ওই প্রতাপ কাঁদিয়া, ‘তোমারে যে রাখি বাঁধিয়া হে রবি আমার নাহিক তেমন বল, তোমা বিনা তাই ক্ষুদ্র জীবন কেবলই অশ্রু জল।’ শিশির বলছে সূর্য তোমায় আমি ধরবো এ ক্ষমতা আমার কোথায়, তখন সূর্য বলছে, ‘আমি বিপুল কিরণে ভুবন ভরি যে আলো, তবু শিশিরটুকু যে ধরা দিতে পারি বাসিতে পারি যে ভাল। রবীন্দ্রনাথ যতই বিশ্বকবি হোন, তবু লালনকে চিনতে পেরেছিলেন। শিশিরটুকুর মধ্যেই দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া একথা তাঁর সম্বন্ধে বলা যাবে না। তিনিই প্রথম চোখ খুলে দেখিয়ে দিয়েছেন, ওখানেই আমাদের নিজস্ব সাধনা। ওইখানেই আমাদের সত্য ইতিহাস। আমাদের সমাজের সত্যিকারের কোনো সমন্বয়বাদ যদি থাকে, প্রতিবাদ যদি থাকে, কোনো মানবতার আহ্বান থাকে, দেবতা, মূর্তি, পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে যদি কোনো সচেতন আন্দোলন কোনোদিন হয়ে থাকে, ওইখানেই আছে। এটা রবীন্দ্রনাথ বলতে পারলেন। সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ আর লালন খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে। লালনকে তিনি আমাদের চিনিয়েছেন, লালনের পথটা আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন এবং যদিও তাঁর সমকালীন কোনও লোকই প্রায় লালনকে নিয়ে চর্চা করেননি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাউল জিজ্ঞাসায় সঙ্গী পেয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন সেনকে। তাই কেবলই কেঁদুলির মেলায় ক্ষিতিমোহনকে পাঠাতেন। ক্ষিতিমোহন, নন্দলাল আর প্রভাত মুখোপাধ্যায়কে কেবলই বলতেন কেঁদুলির মেলা দেখে এসো। উনি নিজে যাননি কখনও। (সংক্ষেপিত)
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।