26 Jan

ঐক্য-বাক্য-নাট্য

লিখেছেন:পার্থ রায়


প্ল্যাটফরম যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে কিছুটা এগোলেই লেভেল ক্রশিং। লেভেল ক্রশিং পেরিয়ে একটা ধূলো ভরা ঢালু রাস্তা এঁকে বেঁকে এগিয়ে বাজার চত্বর পেরিয়ে কিছুটা উঠে যেখানে বড়ো রাস্তায় পৌঁছোল ঠিক সেখানেই একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের এই চায়ের দোকান। মণিদার চায়ের দোকান নামে এর পরিচয়। মণিদা নেই। তাঁর ছবি আছে দোকানে। দোকান চালায় মণিদার জ্যেষ্ঠপুত্র বিশু। বিশ্বনাথ। বিশ্বনাথ ঠিক ওর বাপের স্বভাব পেয়েছে। পরিশ্রমী। স্বল্পবাক।

বিশ্বনাথ নিজে স্বল্পবাক কিন্তু অন্যদের বাকরোধ করে না কখনও। ফলতঃ সেউ সুদূর মণিদার কাল থেকে আজ অবধি এখানে বাক্যস্রোত অব্যাহত। কোনো কোনো সন্ধ্যায় এখানকার সাহিত্য পত্রিকার (অনিয়মিত) প্রধান উদ্যোগীদের সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে জটিল বাক্যের ধূম্রজাল এতদূর উর্ধগামী হয়ে যে ফ্রেমের ভেতরে ছবির মণিদাও নড়ে চড়ে ওঠেন। তাই এই দোকানটির আরো দুটি নাম আছে। পত্রিকাওয়ালারা নাম দিয়েছে “কাফে দি জেনি’’। সৈয়দ মুজতবা আলি থেকে নেওয়া। আর যারা এদেরকে বাঁকা চোখে দ্যাখে তারা নাম রেখেছে ‘আঁতেল টি স্টল’। এই হল মণিদার চায়ের দোকানের প্রাথমিক পরিচয়। মানে লোকমুখে যে পরিচয় চরে বেড়ায়। এর আরও পরিচয় ক্রম প্রকাশ্য।

(২)

সদ্য সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। বিশু পিছন ফিরে ধূপ দেখাচ্ছে দেয়ালে সাঁটা দেবতাদের। এবার সামনে ফিরে অন্ধকারে অপদেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রণিপাতের মুহূর্তে যে ব্যক্তির আবির্ভাব হল আমরা তাকে এখন থেকে আগন্তুক বলব।

আগন্তুক: চা হবে।

বিশু: হবে। বসুন।

দোকানের ভেতরে এসে আগন্তুক দেখল বেশ অনেকটা জায়গা যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। বেশ বড়ো টেবিল। তিনটে বেঞ্চ আর কয়েকটা টুল। ওপরে টালির চালের নিচে বাঁশের কাঠামো থেকে ঝুলছে একটা তেলচিটে বাল্ব। তিন জন লোক। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। একজন খবরের কাগজে ঝুঁকে আছেন। আরেকজন নিজে অন্ধকার। এখানকার আলগা অন্ধকারকে সঙ্গে নিয়ে আরো ঘন হয়েছেন। আরেকজন টেবিলে কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তাঁর মুখ এখানকার আলো অন্ধকারে ভাগাভাগি হয়ে আছে।

আমাদের আগন্তুক প্রায় সকলের উদ্দেশ্যেই – ‘ফিরতি ট্রেন ক’টায় আছে?’ জিজ্ঞেস করতেই ঘনান্ধকার সাদা দাঁত বার করে তার বাকী অন্ধকারকে বিদ্রুপ করে হেসে উঠল খলখলিয়ে – ‘এসেই যখন পড়েছেন ফেরার কথা না হয় পরেই ভাবা যাবে।’

আরেকজন। যিনি আলো অন্ধকারে নিজেকে ভাগ করে রেখেছেন – ‘বাঃ বেশ গুছিয়ে বলেছ মাইরি।’ আরেকজন – ভাঁজ করা খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলে – ‘ওনার সবটা এখনও এসে পৌঁছায়নি।’ এবার হাসি-কাশি আর শ্লেষ্মায় মাখামাখি হয়ে একটা বিদঘুটে হল্লা টেবিলের ওপর দু-চার পাক নেচে গেল।

আমাদের আগন্তুক ভাবছে কী করবে! এমন সময়ে সেই ঘনান্ধকার কথা কইল – ‘ওনার কথায় ঘাবড়ে যাবেন না। উনি এখানকার দার্শনিক। জ্যোতিষীও বলা যায়।’

দার্শনিক : কি ভাবছেন তো, এ কাদের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা!

ঘনান্ধকার : দেখেছেন, আপনি কি ভাবছেন? কী ভাবতে পারেন আর কখন আপনি ভাবনা ছেড়ে দেবেন, সব এনার নখদর্পণে।

আগন্তুক : উনি কী করে বোঝেন এটা? উনি কি অন্যের ভাবনা দেখতে পান?

ঘনান্ধকার : এইটাই হল কথা। ভাবনা দেখতে পাওয়া। যা বলেছেন না আপনি। (আবার তার সাদা দাঁত করাতের মতো ঝিকিয়ে উঠল।)

আগন্তুক : তাহলে আপনি বলছেন যে উনি অন্যের ভাবনা দেখতে পান। তাই তো?

দার্শনিক : এটা কিন্তু আদালত নয়। সাক্ষী – প্রমাণ – ধারা – বিধি …

আগন্তুক : আমি কিন্তু এসব বলিনি।

দার্শনিক : কিন্তু এবার যে আপনি এসব বলবেন সেটা তো আমি জানি।

আগন্তুক : বাঃ সব জেনে গেছেন দেখছি!

দার্শনিক : নাঃ সব জানা যায় না। সব আমরা জানতে চাইও না।

আগন্তুক : ঠিক আছে। কিন্তু উনি বললেন আপনি নাকি ভাবনা দেখতে পান? সেটা কী করে সম্ভব?

ঘনান্ধকার : হ্যাঁ। আমি বলেছি যে উনি ভাবনা দেখতে পান। এই দেখতে পাওয়া কি ওই মাঠে গরু চলে বেড়াচ্ছে, সেই রকম কি কিছু?

আগন্তুক : আরে বাবা! দেখতে পাওয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়?

দার্শনিক : ঠিক কিছুই বোঝায় না। বুঝেছেন? (একটু থেমে বিশুকে এক রাউন্ড চায়ের অর্ডার দিয়ে) হ্যাঁ। যা বলছিলাম। আমাদের কপালে যে দুটো চোখ আছে তাই দিয়ে আমরা সব দেখি বটে এবং এটা যে একটা খুবই দরকারী জিনিস সে বিষয়ে কারুর দ্বিমত নেই। কিন্তু তাই বলে এই চোখ দিয়ে কারুর ভাবনা দেখা যায় না।

আগন্তুক : এ ছাড়াও আরো চোখ আছে না কি?

দার্শনিক: (কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে) হ্যাঁ। আছে। তবে সকলের থাকে না। কারুর কারুর মনের ভেতরে চোখ ফোটে। সেই চোখই অন্যের ভাবনা দেখতে পায়। গভীরভাবে ছুঁতে পারে। শঙ্খ ঘোষ যেভাবে বলেছিলেন – ‘অন্ধের স্পর্শর মতো।’

আগন্তুক : অন্ধের স্পর্শের মতো! আশ্চর্য। অন্ধের স্পর্শ কেমন তা কি আমরা জানি!

দার্শনিক : না জানি না। কেন না এখানে আমরা কেউই অন্ধ নই। এবং অ্যাতোটাই চক্ষুমান যে কাছের লোকটিকেও দেখতে পাই না তেমন করে আর।

(একথার পরে কিছুক্ষণ সবাই নিঃশব্দ থাকল)

স্তব্ধতা ভেঙে ঘনান্ধকার কথা কইল – ‘এই চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।’

চা খেতে খেতে দার্শনিক আমাদের আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করলেন – ধূমপান চলে?

আগন্তুক : সব সময় নয়। তবে কখনও কখনও চলে।

দার্শনিক : বেশ। (পকেট থেকে প্যাকেট বের করে আমাদের আগন্তুককে দিলেন এবং নিজে নিলেন। বাকী দুজনও ধরালেন। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ফিরে এল পুরোনো মেজাজ।

আগন্তুক : কিন্তু আপনি তখন বললেন – ‘সব জানা যায় না। সব আমরা জানতে চাইও না। দেখুন সব জানা যায় না; ঠিক আছে। এটা বুঝলাম।

দার্শনিক : বুঝেছেন। বাঃ! (অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে) একটু বুঝিয়ে বলুন তো, কী বুঝলেন?

আগন্তুক : আপনি কি আমাকে Judge করতে চাইছেন?

দার্শনিক : না রে বাবা! আমি শুধু এইটুকু বুঝতে চাইছি আপনার জানা আমার জানার ভেতরে কোন আলো নিয়ে এল।

আগন্তুক : বুঝতে পারলাম না।

দার্শনিক : ছেড়ে দিন। আপনি শুধু এইটুকু বলুন যে জানা অর্থে আপনি এই বিশ্বসৃষ্টির রহস্য অনুসন্ধানের কথাই কী বোঝাতে চাইছেন?

আগন্তুক : হ্যাঁ। (ভেতরে ভেতরে ভাবতে ভাবতে) অনেকটা তাই।

দার্শনিক : দেখুন, এ রহস্য ক্রম উন্মোচনের পথে। আমি কিন্তু এ রহস্য অনুসন্ধানের কথা বলছি না। আমি বলছি মানুষের মন আর তার আশ্চর্য সৃষ্টি রহস্যের কথা। এর সবটা ,সবটা কেউ জানতে পারে না। বোঝাতে পারলাম!

আগন্তুক : বুঝলাম। কিন্তু সব আমরা জানতে চাইও না। এটা কিরকম কথা?

দার্শনিক : যে জানা আমাদের অস্তিত্বের মূল ধরে টান দেয়, তাকে কি আমরা জানতে চাই?

আগন্তুক : ঠিক বুঝতে পারছি না। কেমন যেন স্ববিরোধী বলে মনে হচ্ছে।

দার্শনিক : কী করে যে বোঝাই! আচ্ছা আপনি কি সোফোক্লেসের রাজা অয়দিপৌস নাটকটা পড়েছেন?

আগন্তুক : হ্যাঁ পড়েছি সে অনেকদিন আগে। আবছা আবছা মনে আছে।

দার্শনিক : দাঁড়ান মনে আনার চেষ্টা করি…। (দার্শনিক মাথা নীচু করে ভাবনার ভেতরে চলে গেলেন)। এই নৈঃশব্দের ভেতর অন্ধকার হলে শেষ মুহূর্তে কিছু দর্শক যেমন চোরের মতো নিঃশব্দে হলে ঢোকে আর অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিয়ে সিট খুঁজে বসে পড়ে ঠিক তেমনি জনাতিনেক নিঃশব্দে ঢুকলেন আর নানা খাঁজে সেট হয়ে গেলেন।

এইবার ঘনান্ধকার একটা সিগারেট ধরিয়ে গুরুকে নিবেদন করার ভঙ্গীতে দার্শনিককে স্পর্শ করে বললেন – “দাদা, ধোঁয়া না দিলে ধরা দেবে না।’

দার্শনিক হাসলেন। সে হাসি ছড়িয়ে পড়ল উপস্থিত সকলের মুখে মুখে।

দার্শনিক কয়েকটা দীর্ঘ টানের পর অবশিষ্ট জ্বলন্ত সিগারেট ঘনান্ধকারকে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন – ‘দেখুন, একটু আগে থেকে ধরার চেষ্টা করছি, কেমন। অয়দিপৌস নিজের কাছে এবং থিবেসের সমস্ত মানুষের কাছে লাইয়াসের হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়ার জন্য কৃতসংকল্প। বদ্ধ পরিকর।

আগন্তুক : হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ছে … সেই মারাত্মক ঘোষণা। সর্বসমক্ষে। ‘সে যদি আমার নিকটতম আত্মীয়ও হয় তাহলে যে শাস্তি …

দার্শনিক : সেই শাস্তি যেন আমার নিজের মাথায় বর্ষিত হয়।

আগন্তুক : ঠিক। ঠিক।

দার্শনিক : মনে করুন। অয়দিপৌস আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সেই অন্ধ ভবিষ্যৎ বক্তা তেইরেসিইয়সকে। মনে পড়ছে তেইরেসিইয়সের  সেই অসামান্য প্রজ্ঞার গভীর উচ্চারণ – ‘কি ভয়ঙ্কর সেই জ্ঞান, যে জ্ঞানে মানুষ কেবল দেখতে পায়, কিন্তু প্রতিরোধ করতে পরে না।’

(আগন্তুক কি একটা বলতে গিয়েও থেমে  গেলেন। দার্শনিক বলে চললেন) তারপর ক্রুদ্ধ অপমানিত তেইরেসিয়াস তাঁর শেষ ভবিষ্যতবাণী যখন উচ্চারণ করছেন তখন সমগ্র থিবেস যেন থর থর করে কেঁপে উঠল – ওফঃ গায়ে কাঁটা দেয় জানেন।

আগন্তুক : মনে আছে ?

দার্শনিক : হ্যাঁ আছে।

আগন্তুক : একবার বলবেন।

দর্শনিক : কিন্তু এইখানে? ওটা সাধারণভাবে বললে ফুটবে না।

ঘনান্ধকার : তুমি কেন সাধারণভাবে বলবে। যেভাবে বললে ঠিকভাবে বলা হবে তুমি তো সেভাবেই বলবে। (ঘনান্ধকার চোখ চালিয়ে একবার সকলকে জরিপ করে নিল। আর ইশারায় বুঝিয়ে দিল সবাই প্রস্তুত হয়ে থাকো)

দার্শনিক : তাহলে শুরু করছি। দেখি পারি কিনা। (সামান্য পিছিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। মুখটা একটু ওপরে তুলে উঁচু পর্দায় ধরলেন)।

“লাইয়সের হত্যাকারী বলে যে লোকের তুমি এত সন্ধান করছ সে লোক এখানেই আছে। তাকে দেখলে মনে হয় যেন সে বিদেশীর মতো কিন্তু প্রকাশ পাবে যে সে এই থিবেসেরই সন্তান এবং সেই সৌভাগ্যে সে সুখী হবে না। যদিও এখনো তার দৃষ্টিশক্তি আছে তবু তাকে অন্ধের মতো – যদিও এখনো তার প্রচুর ঐশ্বর্য আছে তবু তাঁকে ভিক্ষুকের মতো – লাঠি দিয়ে মাটি ঠুকে ঠুকে কোনো এক দূর অপরিচিত দেশে আশ্রয় নিতে হবে? এই – এই আমার ভবিষ্যৎবাণী। এবং এর মধ্যে যদি কোনো কথা ভুল প্রমাণ হয় তাহলে এখন বলো যে ভবিষ্যৎ দৃষ্টি আমার অনুমাত্র নেই। আমি সম্পূর্ণ অন্ধ।

ঘনান্ধকার খচাং করে দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে স্তব্ধতা ভাঙলেন। তারপর গুরুকে নিবেদন করার ভঙ্গীতে জ্বলন্ত সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন। দার্শনিক সিগারেট হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। শ্বাস পতনের পর স্বাভাবিকতায় ফিরলেন।

আগন্তুক : অসামান্য। এক্সসেলেন্ট।

ঘনান্ধকার : মানছেন।

আগন্তুক : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

ঘনান্ধকার : তাহলে আর এক রাউন্ড চা হয়ে যাক। (সাদা দাঁত ফের করাতের মতো ঝিকিয়ে উঠল)।

আগন্তুক : এটা কিন্তু আমি বলব।

ঘনান্ধকার : (আগন্তুককে উদ্দেশ্য করে) বেশ বলুন। (দার্শনিককে উদ্দেশ্য করে) কিন্তু দাদা নাটকটার যে জায়গাটার কথা তুমি বলতে চাইছিলে …

দার্শনিক : হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। আসলে এই নাটকটা এমন যে তোমার সমগ্র সত্ত্বাকে সাম্প্রতিক থেকে ছিন্ন করে জীবন ও মৃত্যুর সীমানায় দাঁড় করিয়ে দেবে। জীবন কী? কোথায়. কোন পথে চলেছি আমরা … এই সব আর কি।(দার্শনিক হাসলেন। এক অদ্ভূত বিষণ্ণ সেই হাসি)।

ঘনান্ধকার : (যেন হঠাৎ একটা সূত্র আবিষ্কার করে) এই মাত্র তুমি যে কথাগুলো বললে, ঠিক এর পরে যে কোরাস আছে তার ভেতরের ভাবনাটাই তোমার কথাগুলোর ভেতর থেকে উঠে এল।

আগন্তুক : আচ্ছা আপনি কি সেই পালাও পালাও তুমি … তারপর কি যেন …

দার্শনিক : (ঘনান্ধকারকে) কি মনে করিয়ে দাও।

ঘনান্ধকার : কে? কে সে?

দেলফয় পাহাড় থেকে এ দৈব ঘোষণা

কার দিকে অঙ্গুলি দেখায়? (তারপর ?)

দার্শনিক : কার হস্ত এই নীচ পাপ কর্মে কলুষে পঙ্কিল

ঘনান্ধকার ও দার্শনিক একসাথে – পালাও, পালাও তুমি রাজহন্তারক, পালাও, পালাও তুমি যত দূরে পার।

কি জানি কি কথা আছে

অন্ধকার ভবিষ্যের দুর্নিরীক্ষ অন্তরের মাঝে।

বর্তমান প্রহেলিকাময়, ভবিষ্যত্ যেন আরো

গাঢ় কোনো অন্ধকারে সম্পূর্ণ আবৃত

ভয় হয় – ভয় হয়।

উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকার দিয়ে নীরবতা ভাঙলেন সেই আশ্চর্য রসিক। যিনি আলো-অন্ধকারে ভাগাভাগি হয়ে থাকেন। জোরে জোরে হাততালি দিয়ে বললেন – নাটক জমে গেছে। এরপর পেছনের কাটা অন্ধকারে বসে থাকা তিনজন তারাও উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকল।

দার্শনিক : দাঁড়ান! দাঁড়ান! আমরা ওনার একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে …

আগন্তুক : আরে আমারও মাথা থেকে সরে গেছে।

ঘনান্ধকার : কিন্তু, বিশু, চায়ের কি হল ভাই? অর্ডার তো অনেকক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

বিশু : আরে চা টা দেব কি করে? আপনাদের প্লে চলছে না!

ঘনান্ধকার : ভাইসব এখন চা পানের বিরতি। বিশু চা দিয়ে দাও।

দার্শনিক : হ্যাঁ কি যেন কথার সূত্রে এই নাটকটার মধ্যে এলাম আমরা?

আগন্তুক : সেই যে আপনি বললেন না … আমরা জানতে চাইও না…।

ঘনান্ধকার : আমাদের অস্তিত্বের মূল ধরে টান দেয় …

দার্শনিক : হ্যাঁ। তেইরেসিয়াস চলে যাবার পর অয়দিপৌস-এর মন নানাভাবে বিপর্যস্ত। সে সন্দেহ করছে ক্রেয়নকে? তেইরিসিয়াসের এখানে আসা এবং তার মারাত্মক ভবিষ্যৎবাণী এটা যে একটা গভীর ষড়যন্ত্রের অঙ্গ এবং সেই চক্রান্তের প্রধান চক্রী নাকি ক্রেয়ন এই ভাবনাই এখন অয়দিপৌসকে পেয়ে বসেছে। অয়দিপৌসের আচরণ প্রায় উন্মাদের মতো। কোরাসের নায়ক অয়দিপৌসকে বোঝাতে ব্যর্থ। তখন রাণী ইয়োকাস্তের হস্তক্ষেপে অয়দিপৌস সাময়িক ভাবে বিরত হলেন। এরপর আস্তে আস্তে সেই ভয়ঙ্কর সত্যের উদঘাটনের পথে নাটক এগোতে থাকল। যে ভৃত্য এসে লাইয়সের মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছিল এখন তার খোঁজ চলছে। সে এখন শহর থেকে অনেক দূরে পশুপালনের কাজে নিযুক্ত। আর অয়দিপৌস বলে চলেছেন যে এই থিবেসের দিকে আসার পথে কী কী ঘটনা ঘটেছিল। এক অদ্ভুত অবস্থা। যেন এক অতল খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে থিবেস। যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। আর ঠিক এরকম সময়ে করিন্থস থেকে এক দূত এসেছে শুভ সংবাদ নিয়ে। করিন্থসের প্রজা সাধারণ অয়দিপৌসকে তাদের রাজ্যে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করতে চায়। করিন্থসের রাজা অয়দিপৌসের বৃদ্ধ পিতা পল্যুবস মারা গেছেন। তাঁর  দেহ এখন মাটির নীচে সমাধিস্থ। ইয়োকাস্তে বার বার দূতকে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন যে বৃদ্ধ পল্যুবসের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়েছে কিনা। যখন দূতের মুখ থেকে খুব স্পষ্ট ভাবে জেনে নিলেন যে বৃদ্ধ পল্যুবসের মৃত্যু যে বার্ধক্যজনিক কারণে হয়েছে এই সংবাদে ইয়োকাস্তের বুক থেকে যেন একটা ভারী পাথর নেমে গেল। অয়দিপৌসকে খবর দেওয়া হল। অয়দিপৌস যখন শুনলেন যে তিনি তাঁর বৃদ্ধ পিতার মৃত্যুর কারণ নয় তখন তাঁরও যেন শাপমুক্তি ঘটল। এ এক আশ্চর্য মুহূর্ত। স্বপ্নের মতো। বাতাসে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদ। আর সেই ভয়ঙ্কর মর্মন্তুদ ঘটনা সকলের অলক্ষেও বুকে হেঁটে এগিয়ে আসছে। কেউ জানে না কী ঘটবে। এই সময়ে ইয়োকাস্তের একটা সংলাপ মনে পড়ছেঃ

“ভয়? কিসের ভয়? মানুষ কত ভয় করবে অয়দিপৌস? কত? আমাজের জীবন তো কতকগুলো আকস্মিকের খেলা। কত বিভিন্ন রকমের আকস্মিক ঘটনারই যেন আমরা হাতের পুতুল। এবং আমাদের ভবিষ্যৎ? কেউ জানে না কী আমাদের ভবিষৎ। তাই কী করবে মানুষ? যতটুকু সে পারে ততটুকু সে নিজের যেমন ইচ্ছে হয় তেমনি করেই বাঁচবে । কোনো কিছুকে গ্রাহ্য না করেই বাঁচবে।’’

এরপরই ঘটবে সমস্ত কিছুকে ছিন্ন করে সেই মর্মান্তিক সত্যের উন্মোচন। যখন দূত জানাবে যে বৃদ্ধ পল্যুবস তাঁর জনক নন। পালক পিতা। আর এই দূতই সেই মেষপালকের হাত থেকে অয়দিপৌসকে বাঁচিয়ে নিঃসন্তান পল্যুবসের হাতে দেন। এটা জানার পর অয়দিপৌস অদ্ভূত স্বরে রাণীকে জিজ্ঞেস করেন – রাণী যাকে আমরা ডেকে পাঠিয়েছি – এ দূত কি তারই কথা বলছে? তুমি কি জানো?

ইয়োকাস্তে : কী হবে জেনে? এ কার কথা বলছে সে কথা জেনে কী লাভ? তুমি চলে এস অয়দিপৌস, চলে এসো,এর কথা কিছু শুনো না। কী এসে যায়? কিছুতেই আর কিছু এসে যায় না।

অয়দিপৌস : অসম্ভব। এমন একটা সূত্র পেয়েও আমি আমার সৃষ্টির কাহিনীকে অন্ধকার থেকে ছিনিয়ে আনব না?

ইয়োকাস্তে : ভগবানের দোহাই, যদি তুমি বাঁচতে চাও তাহলে থামো। এ জ্ঞানের অন্বেষণ তুমি করো না। আমার যা কষ্ট তাই যথেষ্ট হোক।

অয়দিপৌস : তোমার তো কোনো কষ্ট নেই। যদি প্রমাণও হয় যে আমি ক্রীতদাসীর সন্তান, তিন পুরুষানুক্রমে আমি ক্রীতদাসীর সন্তান; তাহলেও তোমার বংশমর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে।

ইয়োকাস্তে : তবু তুমি কোরো না, আমি তোমায় বলছি অয়দিপৌস এ সন্ধান তুমি কোরো না। সব কিছু তুমি জানতে চেয়ো না।

অয়দিপৌস : আমি শুনব না। সত্য কথা আমি জানবই। আলো, আলো চাই আমার।

দার্শনিক থামলেন। অল্পক্ষণ মুখ নীচু করে রইলেন, তারপর মুখ তুলে আমাদের আগন্তুককে জিজ্ঞেস করলেন – আপনার প্রশ্নের উত্তর পেলেন?

আগন্তুক একটা অদ্ভূত অবস্থার মধ্যে ছিলেন। উত্তর দিতে দেরি হল। বললেন – কিছুটা। দেখুন আরো একটা ব্যাপার …

ঘনান্ধকার : আচ্ছা। এই মুহূর্তে আমাকে একটা জরুরি কথা বলতেই হচ্ছে। এখন ঘড়িতে দশটা বাজতে দশ। উনি জানতে চেয়েছিলেন ফিরতি ট্রেন ক’টায় আছে? দশটা সাতে ডাউন ট্রেন। এখনই উঠে পড়তে পারলে অনায়াসে পাওয়া যাবে।

আগন্তুক : আচ্ছা তাহলে …

দার্শনিক : তাহলে আপনি আবার একদিন আসবেন।

আগন্তুক : (হেসে ফেললেন) হ্যাঁ।

ঘনান্ধকার : আপনি হাসলেন কেন বলব?

আগন্তুক : বলুন তো …

ঘনান্ধকার : ভবিষ্যৎ বক্তা। তবে সম্পূর্ণ অন্ধ নয়। চশমা আছে।

দার্শনিক : এদিকটা দিয়ে আসুন। এটা শর্টকাট।

অনেক দূর থেকে ট্রেনের হর্ন শোনা গেল …।

Tags: , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • P BAGCHI on January 29, 2021

    এই লেখাটি খুব ভাল লাগল। বেশ একটা নতুন আঙ্গিকে কিছু গভীর কথার আস্বাদ পাওয়া গেল।

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ