প্রথম পর্ব
ওয়েস্ট এন্ড পার্কের যে ৫০ বছরের বাড়িটা থেকে আমরা মাস তিনেক আগে উঠে আসি, সেটা ১৯৬৭ সালের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে আমার দাদু শ্রী সুবোধ চন্দ্র চক্রবর্তী তৈরি করেছিলেন। আসাম থেকে একপ্রকার পালিয়ে এসে। বংগাল খেদা ‘আন্দোলন’-এর শিকার হয়ে। আমি তারও ১৭ বছর পর ওখানে জন্মাই। সে অর্থে ওয়েস্ট এন্ড পার্ক আমার মাদার পাড়া। ‘বাম’ জমানায় মধ্যবিত্ত পাড়া যেমন হত আরকি! বছরে তিনটে সাংস্কৃতিক জলসা সমেত রক্তদান ইত্যাদি। আমার বয়েসের প্রায় ১০/১২ জন ছেলে সেখানে ছিল। জ্ঞান হবার পর খেয়াল করেছি। বুকুদের বাড়ির সামনে একফালি মাঠ ছিল তাকে কেন্দ্র করেই এরা সবাই আমার জিগরি দোস্ত। দুর্গাপূজার অষ্টমী/নবমী ছাড়া আমরা মেয়েদের বন্ধু বলে স্বীকৃতি দিতাম না। নাহলে ওই একই বয়েসি ১০/১২ জন মেয়েও ও পাড়ায় থাকত। একমাত্র ব্যতিক্রম তুলি। একটা বড় বয়েস অবধি তুলি চুটিয়ে আমাদের সাথে ক্রিকেট ফুটবল খেলেছে।
আমাদের পাড়া সেন্টিমেন্ট এত প্রবল ছিল যে পাশের পাড়ার অরিজিত হাজরার সাথে দোস্তি গড়েই ওঠেনি কেবল মাত্র ক্রিকেট-প্রতিদ্বন্দ্বী বলে। অরিজিতের সাথে আরো পরে ক্লাস টুয়েলভে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এমনকি এখনকার বিখ্যাত গায়ক সমন্ত্যক সিনহা একই পাড়ায় থাকলেও মূল ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় আমরা তাকেও খুব পাত্তা দিতাম না।
প্রাইমারিতে একটা স্কুলে পড়তাম, পরাণচন্দ্র বিদ্যালয়। ভারি কড়া ইস্কুল। মাইনেও নিত চড়া হারে, পরিবারের চরম আর্থিক দূর্দশাতেও আমাদের ওই স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। সম্ভবত বামফ্রন্টের ইংরাজি তুলে দেবার বিরোধিতা করে এই স্কুলটি কেজি ওয়ান থেকে ইংরাজি পড়াত। এখানেই আমার পলাশের সাথে পরিচয়। আড়াই বছরে, আমার আর দিদির মারপিটে তিতিবিরক্ত মা স্কুলে দিয়ে দেন, পলাশেরও তাই। ৮৭ সাল থেকে আমরা একসাথে আছি। আমাদের বাড়ি থেকে আড়াই মিনিটের দূরত্বে পলাশ থাকলেও ওই প্রবল পাড়া সেন্টিমেন্টে তা ওয়েস্ট এন্ড পার্ক-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু কীকরে যেন পলাশ এই পাড়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। তার আঠাশ বছর পরেও, এই মূহুর্তে পলাশ আর ওয়েস্ট এন্ড পার্ক প্রায় সমার্থক শব্দ।
৯২ সালে বিয়ে করে ছোটপিসি পিসেমশাই-এর সাথে পুরানো শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে এক ভাড়া বাড়িতে উঠে যান। চক্রবর্তী মেয়ের দাস পদবিধারি কাউকে জামাই হিসাবে মেনে নেওয়ায় ঠিক কী কী সমস্যা হয়েছিল মনে নেই, তবে এটা মনে আছে পিসেমশাই চলে গেলে এঁটো গ্লাস তো বটেই জলের জগেও গঙ্গাজল ছেটান হত। পিসি এসবের ধার ধারেননি। প্রবল শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও খুব লড়াকু মহিলা ছিলেন। আমার অবশ্য বিয়ের আগে থেকেই পিসেমশাই-এর সাথে ভয়ঙ্কর দোস্তি। কীসব চমৎকার গল্প বলতেন, আফ্রিকা থেকে উত্তরমেরু একলহমায় ঘুরে আসতে পারতেন। ছোট পিসি চলে যাওয়ায় এত মন খারাপ হয়েছিল যে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি দিদি আর মা ওদের ভাড়াবাড়িতে কিছুদিন থাকতে যাই। ক্লাস টু তখন। বাবা দুর্গাপুরে আলমারি কারখানার শ্রমিক। মাসে একবার বাড়ি আসেন।
ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে এমন একদিন রাতে পিসেমশাই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বললেন কিছুদিন কোথাও বের হওয়া যাবে না। দেশজুড়ে ১৪৪ ধারা অযোধ্যায় দাঙ্গা লেগেছে। কিছু বুঝিনি বিরক্তই হলাম, ৮/৯ দিন বুকুদের মাঠে যাওয়া নেই আবার কিছুদিন থাকতে হবে। ছোটপিসিদের বাড়ির মালিক মৈত্র দাদু পিসেমশাইকে কমরেড বলে ডাকতেন। দিদি ছোটবেলেয় হেভি পাকা ছিল। খুব বিজ্ঞমুখে জানাল সিপিয়েম করলে কমরেড বলে ডাকতে হয়। আমি তো অবাক! একীরে নামটাম বদলে যায়। সিপিয়েম তো মজার জিনিস, করতেই হবে। এমনি আমার নাম নিয়ে আমার খুব সমস্যা ছিল, উত্তম কুমারের সামাজিক অভিঘাত সেকালে এমনিই, নাম বললেই লোকে হেসে বলত উত্তম কুমার? মাইরি বলছি গা জ্বলে যেত। সিপিয়েম করলে নাম চেঞ্জ হবে ভেবেই আমিও পিসেকে জানালাম সিপিয়েম করব। পিসেমশাই হাসলেন। উনি সিপিয়েম ছিলেন না।
খুব লুকিয়ে পিসে দু একদিন বাদে আমাদের বাড়ি পৌছে দিলেন, মৈত্র দাদু বলে দিয়েছিলেন হাত তুলে বাড়ি যাবি। ১৪৪ ধারার ওইটাই দস্তুর। আরো কতকগুলো শব্দ শিখলাম রামমন্দির, কল্যান সিং, রাজাবাজার….
বাড়ি ফিরে দেখি এক ফর্সা ভদ্র মহিলা, খবরের কাগজে কীসব লিখে আমাদের বাড়ির দেওয়ালে লটকাচ্ছে। পাশে আরো কিছু লোক। কাকা খুব খেঁকিয়ে বলছে এইসব লাগাবেন না। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। উনি এবং তার সঙ্গীরা নম্রভাবে উত্তর দিচ্ছেন, ঠাকুমা এই বাক বিতণ্ডায় বিরক্ত হয়ে কাকাকে উপরে চলে আসতে বলছেন। পরে জেনেছি ওনার নাম শর্মিলা ঘোষ। আমাদের বাড়ির পিছনের বাড়িতে থাকতেন। ওটা এপিডিআর অফিসও ছিল। বিষ্ণুদা শর্মিলাদির বর, থাকতেন ও পাড়াতেই কিন্তু তাকে আমি ২০১১-এর মিছিলে প্রথম চিনি। কিন্তু শর্মিলাদিকে পাড়ায় সবাই চিনত। আমাদের দেখলেই রোলে-কোলা লজেন্স দিতেন। তার ছেলে আকাশের কোনও পদবী নেই, শাঁখা সিঁদুর পরেন না এমন মহিলাকে চট করে মেনে নেওয়া মুস্কিল হলেও তিনি আমাদের পাড়ায় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
আমি তখন খবরের কাগজের ঠোঙা থেকে দেবুদার কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন সব পড়ি। তাই ওই লটকানো লেখাগুলো পড়লাম। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা নিয়ে কথা। বুঝলাম না। বাড়ি ফিরতে পারায় কাকা খুব খুশি। বাবার খবর নেই। চারিদিকে ফিসফাস। অন্য রকম আবহাওয়া। বুকুদের মাঠে পরপর কয়েকদিন কেউ খেলতে এলনা। খেলা শুরু হবার দিন সৌরভ মাঠে আসায় সবাই মুখ তাকাতাকি! সৌরভ একদম আমার বয়েসি। পুরো নাম সৈয়দ সৌরভ।(চলবে…)
Tags: অগ্নীশ্বর চক্রবর্তী, অংশহর
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।