অর্পির আজ মনটা ভীষণ খারাপ। ভেবেছিল আজ ওর একত্রিশতম জন্মদিনে শুভম অন্যন্য বারের মত ওকে বিছানায় থাকতেই ভোরবেলা ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ বলে উইশ করবে। কিন্তু বিছানায় তো দুরের কথা, অফিস যাবার আগে বাড়িতে বা অফিস গিয়েও যে কমপক্ষে ফোনে উইশ করবে, সারাদিনে তার কোন লক্ষনই নেই। অর্পি, মানে অর্পিতাকে, যাকে শুভমই বিয়ের পর থেকেই আদর করে অর্পি বলে ডাকে, এখন আর সেভাবে সময় পর্যন্ত দেয় না। শুভম সেন আজ প্রায় এক বছর যাবত ঠিক এইরকম ভাবেই নিজেকে অনেক দুরে নিয়ে গেছে বেচারি অর্পির কাছ থেকে। এখন তো প্রায় সাত আটমাস যাবত ওদের মধ্যে কোন শারীরিক সম্পর্কও নেই। অথচ ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র চার বছর হল।
আসলে শুভম যে অর্পির কোন সন্তান হয়নি বলে বিক্ষিপ্ত মনে আছে ব্যপারটা তাও নয়। ওদের প্লানই ছিল বিয়ের অন্তত পাঁচ বছর বাদে ওরা বাচ্চা কাচ্চা নেবে। অর্পির বিয়ের সময় বয়স ছিল মাত্র সাতাশ আর শুভমের তখন তিরিশ। সুতরাং দুজনেই জীবনটাকে আরেকটু উপভোগ করে তারপর সংসার বাড়াবার কথা ভাববে। কিন্তু শুভমের মধ্যে প্রায় একবছর যাবত হটাত একটা পরিবর্তন দেখতে পায় অর্পি। পরে বুঝতে পারে যে অর্পি ছাড়াও শুভমের জীবনে অন্য কারও প্রবেশ ঘটেছে। প্রায়ই ওকে ফোনে কারও সাথে ফিস ফিস করে কথা বলতে বা অনেকক্ষন যাবত চ্যাট করতে দেখা যায়। অর্পি বেশ বুঝতে পারে শুভমের মধ্যে এই পরিবর্তনের কারনটা কী।
অর্পিতা বিয়ের আগে থেকেই মধ্য কলকাতার একটা সরকারী হাসপাতালে নার্সের চাকরী করে। ওর চেহারাটা বেশ সুন্দর। শুভম সেনের সাথে সম্বন্ধ করেই বিয়ে ঠিক করেছিলেন ওর বাবা। শুভমের দুর্গাপুরের বাড়িতে ওর বাবা মা এক বোন ও এক ছোট ভাই সবেই আছে। শুভম কলকাতা থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সেক্টর ফাইভে একটা বিদেশী আই টি কোম্পানিতে এরিয়া সেলস ম্যানেজারের চাকরী করে। ভাল মায়না পায়। বেলেঘাটার এই টু বেডরুমের ফ্ল্যাটখানা ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে কিনেছে বছর দুয়েক আগে। দুজনের চাকরীতে ই এম আই দিয়ে ওদের পুষিয়ে যায়।
শুভম লম্বা ফর্সা, মুখে দাঁড়ি গোঁফ কিছুই রাখেনা বলে ওকে বেশ স্মার্ট লাগে। অবশ্য সেলসের লোকেদের স্মার্ট হতেই হয়, নাহলে চলবে কী করে ? শুভমের চরিত্রের বিশেষত্ব হল কোন কিছুই ওর খুব বেশিদিন ভালো লাগেনা। ব্যাচেলর অবস্থায় বেশ কয়েকবার মেস বদল করেছে। এমনকি বিয়ের পরেও দুখানা বাড়ি পাল্টে শেষে একেবারে বেলেঘাটায় এসে আস্তানা গেড়েছে। দু দুবার মোটর সাইকেল ও একবার গাড়ি পাল্টেছে শুভম। বিয়ের তিন বছর বাদেই তাই পরকিয়া প্রেমে পড়তে কোন দ্বিধা করেনি। ওর যুক্তি হল অর্পিতার প্রতি ওর সব কর্তব্যই তো ও করছে ,তবে ?
অর্পিতা আজকাল শুভমের সাথে আর কোন ঝগড়া ঝাটি করে না। আগে প্রায়ই ওদের মধ্যে এই ফুসুর ফুসুর কথা বার্তা বা চ্যাটিং নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হত। শুভম সবসময়েই বলত ও নাকি কখনো ওর বন্ধুর সাথে কথা বলে বা আবার কখনো কোন পার্টির সাথে সেলসের কাজে চ্যাটিং করে। কিন্তু অর্পিতা সবই বুঝতে পাড়ত যে শুভম আন্য কোন মেয়ের চক্করে পড়েছে। দুঃখে অভিমানে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে আনছিল অর্পিতা। আগে লুকিয়ে কান্না কাটি করত, এখন আর সেটাও করে না।
অর্পিতার হাসপাতালে বিভিন্ন রকমের পেসেন্ট আসে, ভর্তি হয়, ট্রিটমেন্ট করার পর ভালো হয়ে আবার ছাড়া পেয়ে চলেও যায়। গত একমাস যাবত ওর সেকশনে মনীষ গাঙ্গুলি নামের এমনই একজন ভদ্রলোক ভর্তি হয়ে আছেন যার অবস্থাও অর্পিতার মতন। লোকটার বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ হবে। সল্ট লেকে বাড়ি,খুব বড় ব্যবসায়ী মানুষ, অনেক টাকা পয়সার মালিক। কিন্তু মনে শান্তি নেই।
মনিষের স্ত্রী প্রিয়া অসম্ভব স্বাধীনচেতা মহিলা। ইদানিং বছর খানেক যাবত কারও সাথে প্রেমও করছে। ভদ্রলোক অশান্তি সহ্য করতে না পেরে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে এখন প্রায় একমাস যাবত এই হাসপাতালে পড়ে আছেন। প্রিয়া মাঝে দু’একবার এসে স্বামীকে দেখেও গেছেন। দেখতে বেশ সুন্দরী বলা চলে। বয়স প্রায় তিরশ হবে। কিন্তু স্বামীর প্রতি ওর যে কোন টান নেই সেটা ওর কথায় বা আচার আচরন দেখেই বোঝা যায়। অর্পিতার সাথে কথা বলবার সময়েও মহিলাটি যথেষ্ট খারাপ ভাবে ঔদ্ধত্ব দেখিয়ে কথা বলেন। অর্পিতার মনীষবাবুর জন্য খারাপ লাগে। এতো ভদ্র ও সভ্য লোকের কপালে এরকম একজন বাজে মহিলা জুটেছে ভেবেই ওর অবাক লাগে।
মনিষ বাবু কিন্তু অর্পিতার কথা কিছুই জানেন না। কিন্তু এই সিস্টারের সাথে কথা বলে বেশ শান্তি পান আর তাই অর্পিতার আসবার পথ চেয়ে থাকেন। অর্পিতা ওর স্নেহ মমতা দিয়ে ধীরে ধীরে মনীষ গাঙ্গুলিকে অনেকটা সুস্থ করে তুলেছে। প্রিয়া হয়ত এখনো সেই লোকটার সাথে প্রেম করছে, কিন্তু মনীষ বাবুকে অর্পিতা শিখিয়েছে যে জীবনে অনেক আপ্স এন্ড ডাউন আছে, মানুষের সম্পর্কে অনেক টানা পোড়েন থাকে। কিন্তু হেরে গেলে চলবে না। জীবন একটা চ্যালেঞ্জের নাম, এটাকে একসেপ্ট করে লড়াই করতে হবে। যারা এই লড়াইটা বুদ্ধি দিয়ে,সততা দিয়ে ও অনুভূতি সহ লড়তে জানে তারাই এটা জিততে পারে।
অর্পিতার ভালো ব্যাবহারে এবং ওর কথায় উদ্দিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত মনীষ গাঙ্গুলি একদিন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। হাসপাতাল ছাড়বার দিন অর্পিতাকে ওর সেবা শুস্রসার জন্য অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে অর্পিতার সেল নম্বর নিয়ে নিলেন। বলে গেলেন যে একদিন অর্পিতাকে মনীষ বাবু একটা ট্রিট দিতে চান এবং সেদিন অর্পিতা এলে উনি খুব খুশিই হবেন।
ঘটনাচক্রে আজ অর্পিতার জন্মদিনে সেই মনীষ বাবু অর্পিতাকে লাঞ্চে ইনভাইট করেছেন। অর্পিতা আজ ছুটি নিয়ে বাড়িতেই ছিল আর সকাল থেকেই মনমরা হয়ে ছিল। মনীষ বাবুকে আর না করতে পারেনি। বেলা একটার সময় একটা ক্যাব ধরে সোজা চলে গেল মনীষ বাবুর নির্দেশ মত সল্ট লেকের জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ রং দে বাসন্তী ধাবাতে। ঘড়িতে তখন বেলা দেড়টা বাজে প্রায়। মনীষ বাবু রেস্তোরাঁর উল্টো দিকের রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন। অর্পিকে ক্যাব থেকে নামতে দেখেই এগিয়ে গিয়ে,’ গুড আফটারনুন’ বলে স্বাগত জানান। অর্পিতাও মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে যায় এবং দুজনে রেস্তোরাঁয় ঢুকে যায়।
এই রেস্তোরাঁয় অর্পিতা আগেও এসেছে । মনীষ বাবু এখানেই ওকে ট্রিট দেবেন বলাতে অর্পিতা মনে মনে খুশিই হয়েছিল। মনীষ বাবু ছিলেন অর্পিতার ঠিক সামনেই। হটাত ভিতরে ঢুকেই উনি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় অর্পিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,’কী হল, চলুন। থামলেন কেন ?’ কথাটা বলেই অর্পিতা লক্ষ করে দেখল মনীষ বাবু কোনের একটা টেবিলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। কোনের সেই টেবিলে মনীষ বাবুর স্ত্রী প্রিয়া টেবিলের উল্টো দিকে বসা আরেকজন ভদ্রলোকের সাথে ফিস ফিস করে কথা বলেছেনা আর সেই লোকটি ঘাড় নেড়ে নেড়ে সায় দিয়ে যাচ্ছেন। অর্পিতা বুঝতে পারল মনীষ বাবুর দ্বিধার কারন। পাশ থেকে বলল,’আসুন এই দিকটাতে, ঐ টেবিলটাতে গিয়ে বসি।‘ বলে অর্পিতা ঘরের অন্য কোনের দিকে ইশারা করে।
মনীষ বাবু বসেছেন এমনভাবে যাতে ওঁর স্ত্রীর সাথে চোখাচোখি না হয়। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে উনি ভীষণ ভাবে অস্বস্তি বোধ করছেন কারন উনি জানেন যে অর্পিতা প্রিয়াকে ভাল ভাবেই চেনে এবং আজ ওঁর স্ত্রীর এই পরকিয়া প্রেমের সাক্ষী হয়ে গেলেন। এদিকে অর্পিতা যেখানে বসল সেখান থেকে মনিষ বাবুর স্ত্রীর সামনে বসা মানুষটার একটা সাইড দেখা যাচ্ছিল। সেই লোকটিকে ভাল করে দেখেই অর্পিতা বুঝে গেল যে সে আর কেউ না, ওরই স্বামী শুভম। মনীষ বাবুর স্ত্রী নেহার প্রেমিক যে ওরই স্বামী সেটা ভেবেই অর্পিতা লজ্জায় চোখ নামিয়ে একটু বেঁকিয়ে বসল যাতে শুভমের সাথে ওর চোখা চখি না হয়ে যায়। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতে লাগল যাতে ওদের দুজন মুখোমুখি না হয় আজ এখানে। তাহলে মনীষ বাবুর কাছে লজ্জার আর সীমা থাকবে না।
মনীষ বাবু ও অর্পিতা দুজনেরই মনের অবস্থা সেই মুহূর্তে অপারেশন রুমের ডাক্তার ও নার্সের মত। কেউই চাইছিল না কোন অঘটন ঘটুক। মনীষ বাবু ওর স্ত্রীর প্রেমিককে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবার জন্য মনীষ বাবু একটু বাদে হেসে বললেন, ’আমার বৌয়ের পছন্দ আছে বলতে হবে। যার সাথে প্রেম করছে, দেখেছেন কী হ্যান্ডসাম চেহেরা লোকটার ! মনে হয় নিশ্চয়ই বড় কোন কোম্পানিতে চাকরী করে নয়ত বড় কোন ব্যবসায়ী হবেন। তার মানে এরা বোধ হয় এখানেই এসে মিট করে আর তারপর কোথাও বেড়াতে চলে যায় বা সীনেমা দেখতে যায় হবে। বাঃ বাঃ, বেশ ভালো।‘
মনীষ বাবুর শেষ কথাটায় ঝরে পড়ল ওর মনের ঘৃণা ও দুঃখের অনুভূতি । লজ্জায় অর্পিতার মাথা নিচু হয়ে গেল। কী ভাবে ও বলবে যে ঐ লোকটাই ওর স্বামী এবং সেও মনীষ বাবুর স্ত্রীর মতই অর্পিতাকে একটুও ভালবাসেনা আজকাল। এরা দুজনেই এখন দুজনের প্রেমে মশগুল হয়ে আছে। এই পৃথিবীতে ওদের জন্য আরও একজন যে অপেক্ষা করে আছে একটু ভালোবাসা একটু আদর পাবার জন্য সেটা এরা ভুলেই গেছে। এদের মনের ও শরীরের চাহিদার কোন শেষ নেই। অল্পেতে এরা কোনদিনই খুশি নয়। আর এদেরই একজন অর্পিতার সাত পাঁকে বাঁধা পড়া স্বামী শুভম।
মনীষ বাবু সামনে এসে দাঁড়ানো বেয়ারাকে প্রথমে কিছু স্টার্টারের অর্ডার দিয়ে দিলেন। এরপর অর্পিতাকে বললেন,’আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি বুঝতে পারছি আপনি হয়ত আমার স্ত্রীর সামনা সামনি হয়ে যেতে পাড়েন সেই লজ্জায় এই দিকটাতে এসে বসলেন, কিন্তু প্লিস কোনরকম টেনশন নেবেন না। আমি সব সামলে নেব। আপনি একদম রিলাক্স করে বসুন আর আমার এই ট্রিটটা এঞ্জয় করুন।‘
অর্পিতা আড় চোখে একবার ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,’না না। আমি একদম নার্ভাস হইনি। কী আছে ? এটাতো বেশ ভাল রেস্টুরেন্ট। আমরা আগেও দুবার এসেছি এখানে। আমার মনে হয়না কোন সমস্যা হবে। আমার আপনার জন্য খুব খারাপ লাগছে। মন খারাপ করবেন না প্লিস।‘ কথাটা বলে অর্পিতা মনে মনে হাসে।কে কাকে মন খারাপের কথা বলছে। আজ ওর জন্ম দিন, অথচ আজ ওকে একবারও উইশ না করে ওরই স্বামী দেবতা অর্পিতার পেসেন্টের স্ত্রীর সাথে এখানে বসে লাঞ্চ করছে আর ফিস ফিস করে ওরা মনের ভাব দেয়া নেয়া করছে। আর ওরা দুজন ভিকটিম সেটা বসে বসে দেখছে !
স্টার্টার খেতে খেতে হটাত অর্পিতা লক্ষ করল শুভম বিল পেমেন্ট করছে আর মনীষবাবুর স্ত্রী প্রিয়া উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলে থেকে বেড় হতে গিয়েই শুভমের সাথে অর্পিতার চোখা চখি হয়ে গেল। শুভম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অর্পিতার দিকে। অর্পিতাও স্মার্ট মেয়ের মত হাত তুলে বলল,’হাই। তোমাদের খাওয়া হয়ে গেল ?’ অর্পিতার দৃষ্টি লক্ষ করে চমকে ঘুরে তাকালেন মনীষ বাবু। দেখলেন ওঁর স্ত্রীর সাথে আসা লোকটা এদিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে আর তার পিছনে ওঁর স্ত্রী প্রিয়া, সেও অবাক হয়ে মনীষ বাবুকেই দেখছে। মনীষ বাবুর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল যেন।
শুভম অর্পিতাকে এখানে দেখবে ভাবতেই পারে নি। সামনে এসে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,’কী ব্যাপার, তুমি এখানে ? আর ইনি কে, চিনলাম নাতো !’
অর্পিতা একই রকম স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিল,’আলাপ করিয়ে দেই, ইনি হলেন আমার স্বামী আর ইনি আমার বিশিষ্ট বন্ধু মিস্টার মনীষ বর্ধন। একসময় ইনি আমার একজন পেসেন্ট ছিলেন, আর এখন আমরা বন্ধু। আজ আমার জন্মদিন বলে উনি আমাকে ট্রিট দিচ্ছেন। তোমার সাথে ইনি …?’
মনীষ বাবু চুপ করে মাথা নিচু করেছিলেন। ওঁর পরিচয় দিতেই দুই হাত এক করার ভঙ্গি করে বললেন, ’নমস্কার। আমারাও এখানে লাঞ্চ করতে এসেছি। তা কেমন হল তোমাদের লাঞ্চ ?’ কথাটা বলে ওঁর স্ত্রী প্রিয়ার মুখের দিকে তাকালেন মনীষ বাবু। প্রিয়া অপ্রস্তুতের মত বলল,’হ্যাঁ, ভাল ছিল খাবার গুলি …। ‘ বলেই প্রিয়া শুভমের দিকে তাকিয়ে জজ্ঞাসা করল,’আচ্ছা, ইনি তোমার স্ত্রী ? আমি তো চিনি ওঁকে। হাসপাতালে দেখেছি। হ্যাপি বার্থ ডে মিসেস সেন। ভালো থাকবেন…। এই চল, দেড়ি হয়ে যাচ্ছে তো।‘ শেষ কথাটা বলেই শুভমের হাত ধরে টান মারল প্রিয়া। শুভম অবাক হয়ে পিছন ফিরে এগিয়ে চলল গেটের দিকে এবং ঠিক বেড় হবার আগে একবার ঘুরে তাকাল অর্পিতার দিকে।
মনীষ বাবু নেহার ঔদ্ধত্ব দেখে রেগে লাল হয়ে গেছিলেন। ওরা চলে যেতেই তাকালেন অর্পিতার দিকে আর গলা নিচু করে বললেন,’আজ আপনার জন্মদিন আগে বলেন নি তো ! কি সৌভাগ্য আমার। সত্যি বলছি আমি ভীষণ খুশি হয়েছি আপনি আপনার স্বামীর সামনে যেভাবে আমাকে পরিচয় দিলেন সেটা দেখে। আপনার বার বার ওদের দিকে তাকানো দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তারপর আপনার স্বামী এগিয়ে এসে আপনাকে যেভাবে প্রশ্ন করলেন তাতেই বুঝলাম। যাই হোক, জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা নেবেন।‘ কথাটা বলে মনীষ বাবু বাঁ হাত অর্পিতার ডান হাতের কব্জির উপর রেখে বললেন,’আজ থেকে সত্যি সত্যি আমাকে আপনি একজন সত্যিকারের বন্ধু ভাববেন মিসেস সেন।‘
অর্পিতার চোখের কোনে জল জমে এসেছিল। বাঁ হাতে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে হাসি মুখে সেই হাতটা রাখল মনীষ বর্ধনের ডান হাতের কব্জির উপরদিকে। ফিসফিস করে বলল,’এটা আমার জন্মদিনের সেরা উপহার মনীষ। আমি সত্যিই তোমাকে আমার একজন প্রকৃত বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবি। এখন থেকে তুমি যখনই ডাকবে বা চাইবে, দেখবে আমি তোমার পাশে আছি। বরাবরের মত আমি তোমার বন্ধু হয়ে থাকব মনীষ। তুমি এখন ইচ্ছা করলে আমার কাছে তোমার সুখ দুঃখের সব কথা শেয়ার করতে পার।‘
মনীষ অর্পিতা ওকে তুমি বলায় এমনিতেই চমৎকৃত হয়েছিলেন। তারপর অর্পিতা ওকে সত্যিকারের বন্ধু বলায় আরও খুশি হয়ে নিচু গলায় শুধু বললেন,’আমি আছি তোমার পাশে অর্পিতা। তুমি একা নও। এখন থেকে তোমার সুখ দুঃখেও আমাকে সবসময় কাছে পাবে তুমি। মন খারাপ করো না প্লিস। আজ তোমার জন্ম দিন। লেট আস এঞ্জয় ইট। লেট আস এঞ্জয় দ্য রেস্ট পার্ট অফ আওয়ার লাইফ।‘
একটু বাদেই দেখা গেল মনিষ বাবুর হণ্ডা সিটি গাড়ির পিছনের সিটে ওঁর কাঁধে মাথা রেখে অর্পিতা সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ড্রাইভারকে আগেই নিকো পার্কের দিকে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন মনিষ বাবু। বাঁ হাতটা অর্পিতার কাঁধের উপর দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সামনের ওয়ান ওয়ে ট্র্যাফিক দিয়ে ওদের গাড়ি ছুটে চলল ঠিক উল্টো দিকে, যেদিকে একটু আগেই শুভম ও প্রিয়ার গাড়ি ছুটে বেড়িয়ে গেছে অজানা কোন এক পথের দিকে। এই ভাবে চলতে থাকার নামই তো জীবন, যার কোন নিশ্চিত লক্ষ্য নেই।
Tags: উত্তম চক্রবর্তী, মনের মানুষটা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।