১
পার্কে ঢোকবার ঘোরানো গেটটার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে তাকিয়ে অপরাজিতার চোখে প্রায় ব্যথা হওয়ার জোগাড় ।
এদিকে ওর ভীষণ দেরী হয়ে যাচ্ছে, সূর্য্য ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে পশ্চিমে ।
একে তো বিকেলবেলায় এই পার্কটায় এসে মানসদার সঙ্গে দেখা করায় বেশ রিস্ক আছে ।
একটু দূরে মোড়ের মাথায় বাড়িটার তিনতলার একটা ফ্ল্যাটে মেজোমাসী থাকে ।
কাজে অকাজে এই বিকেলে মেজোমাসী বেরিয়ে এসে যদি বড়ো রাস্তার দিকে যায় তাহলে তো পার্কের এই গেটের পাশ দিয়েই যাবে ।
আর তারপর এই বেলা পাঁচটার সময় যদি স্কুলড্রেস-পরা বোনঝিকে এখানে এই পার্কের গেটের ভেতর ঘুরঘুর করতে দেখে ফেলে…
-‘কিরে অপু, তুই এখানে…কি করছিস ? স্কুল ছুটির পর বাড়ী যাসনি ? আমাদের বাড়ী আজ বিকেলে আসবি দিদি তো বললো না…সকালেই তো ফোনে কথা হলো…তা বাড়ীতে যাবি তো এখানে পার্কের গেটে কি করছিস’…
মেজোমাসীর প্রশ্নের রাজধানী এক্সপ্রেস চলতে থাকবে…বাপ রে বাপ !’
অপরাজিতা এইসব কাল্পনিক সংলাপ ভাবছে আর নিজের ওপর রাগ হচ্ছে…কেন যে গতকাল ঠিক করে নেয়নি পার্কের ভেতরে দেখা করার জায়গাটা…তাহলে সেখানেই চলে যেতে পারতো…এই টেনশন নিয়ে দুদিকে বারবার দেখতে হতো না ।
#
আসলে এতো বড়ো এই পার্কটা…ভেতরে ঢুকলে যে কেউ আধঘন্টার জন্যে হারিয়ে যেতেই পারে ।
আর মানসদার সঙ্গে দেখা করতে এসে অপরাজিতা আধঘন্টা সময় নষ্ট করার কথা ভাবতেইপারে না ।
কি যে হয় ওর মনের মধ্যে মানসদাকে একদিন না দেখলে ।
বাকি দিনটা খারাপ যায়, রাতে ঘুম হয় না ভালো করে, বার বার উঠে পড়ে,ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে ।
স্কুলের বন্ধু পর্ণা তো বলেছে, ‘অপু, তুই তোর মানসদার প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছিস রে !’
অপু তো এখনো জানেনা, বুঝতেই পারে না, এটা কি সত্যি প্রেম, না কি অন্য কিছু ।
ওর কেবল মনে হয় মানসদার ওপর কি করে যেন অনেক দিন থেকে ওর দাবী সব থেকে বেশী ।
সেই যে দুবছর আগে পাড়ার সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যের ফাংশনে মানস আর অপরাজিতা আবৃত্তি করেছিল, সেই থেকে দুজনের পরিচয় ।
অপরাজিতার কবিতা বলা শেষ হয়ে গেলে উইংসের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানস বলেছিলো, ‘খুব ভালো বলেছিস তুই…ভালো করে শিখলে আরও ভালো বলতে পারবি ।’
সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা একটা অপরিচিত ছেলে হঠাৎ ওকে তুই বলে সম্বোধন করাতে ক্লাস নাইনের অপরাজিতা একটু কঠিন ভাব নিয়ে ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকাতে গেলো ।
আর সেই যে গন্ডগোল হয়ে গেলো তাকানোর পরে, ব্যাপারটা কি হলো অপরাজিতা আজও বুঝে উঠতে পারলো না ।
পর্ণা বলেছে ওটা হচ্ছে লাভ এট ফার্স্ট সাইট !
কি শান্ত ভাব মানসের, মাজা মাজা রঙের মায়াময় মুখের মধ্যে বড়ো বড়ো চোখ !
অপুর বন্ধুরা মাঝে মাঝেই তাকে ক্ষেপানোর জন্য বলে, ‘তোর মানসদার মধ্যে একটু কৃষ্ণ কৃষ্ণ ভাব আছে রে, তুই নিজের নামটা বদলে নিয়ে রাধিকা রেখে দে !’
মানসের সেই প্রথম কথার উত্তরে তাও একটু কঠিন স্বরেই অপু বলেছিলো,
-‘কেন, তোর কাছে আবৃত্তি শেখার কথা বলছিস ?’
ইচ্ছে করে ‘তোর’ কথাটার ওপর জোর দিয়ে বলেছিলো ও ।
মানস একটু থতমত খেয়ে বলেছিলো,’আমি সেকথা বলেছি নাকি ।’
তারপর টুক করে স্টেজের পেছনের সিঁড়িটা দিয়ে নেমে গিয়েছিল ।
২
এসব দুবছর আগের কথা ।
কিন্তু অপরাজিতার আজও মনে আছে যতক্ষণ মানস চলে যাচ্ছিলো ও একভাবে ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়েছিল…তাকাবে, ঠিক একবার পেছন ফিরে তাকাবে…ষোলোবছরের সুন্দরী অপরাজিতা মনে মনে নিজের সঙ্গে বাজি ফেলছিলো সেইসময় ।
কিন্তু না…মানস সেদিন ফিরে তাকায়নি !
আর সেইদিনই অপরাজিতা রায়চৌধুরী, স্টিভেডর অনিমেষ রায়চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে, নিজের কাছে গোপন বাজি হেরে ঠিক করে ফেলেছিলো, এই অহংকারী ছেলেটাকে বাগে আনতে হবে, এমনভাবে বাগে আনতে হবে যে অন্য কোনোদিকে তার নজর দেবার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই হবে না !
কিন্তু মানস ফিরে তাকাবে কি করে ।
সে তো অহংকারী নয়, বয়সের তুলনায় বেশ বুদ্ধিমান ছেলে সে ।
পাশের পাড়ার ধনী স্টিভেডর অনিমেষ রায়চৌধুরীর বাগানঘেরা দুপুরুষের বাড়ীটি সে ভালোভাবেই চেনে ।
ওই রায়চৌধুরী বাড়ীর রাজকন্যা অপরাজিতার দিকে আলিপুর সাব পোস্ট আপিসের পোস্টমাস্টারের ছেলে মানসের ফিরে তাকাবার কোনো কারণ নেই, সেটা সে ভালো করে জানে ।
তবে সেদিন যেটা সে জানতে পারেনি সেটা হচ্ছে অপরাজিতার নিজের কাছে নিজের ওপরে ধরা সেই বাজি !
#
এর পরে তো দুটো বছর কেটে গেলো ।
সেই দুবছরের ঘটনাগুলোর সারসংক্ষেপ করে গল্পটা বলতে গেলে এটাই বলতে হবে যে সেদিনের পর পুরো ব্যাপারটা অপরাজিতা রায়চৌধুরীর কাছে ঘেঁটে গেছে ।
কোথায় অহংকারী, সৌন্দর্য্য-বিরূপ কিশোরের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া, আর কোথায় কি !
যত দিন এগিয়েছে, মাস শেষ হয়েছে, অপরাজিতার মনের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জেগে উঠেছে যে, এই মানস মিত্রই এই পৃথিবীতে তার সব থেকে কাছের মানুষ ।
এই মানুষটার জন্যে উপযুক্ত সময় এলে ( এখন তো উচ্চমাধ্যমিক দেবে, এখন নয় ) সে বাবা, মা, সব আপনার জন, বাড়ী, ঘর, সব কিছু ত্যাগ করতে পারবে ।
তাই মানসের ভালোমন্দ সবকিছু দেখাশোনার, মায় জামাকাপড়জুতো জোগানোর ভার, জবরদস্তি সে নিজের আঠারো বছরের কাঁধে তুলে নিয়েছে !
জবরদস্তি এই কারণে যে, সাধাসিধে মানস তার এই অর্বাচীনা কিশোরী প্রেমিকার দাক্ষিণ্যের মুহুর্মুহু অত্যাচারে সদা ব্যতিব্যস্ত বোধ করে ।
তার নিজের অত্যল্প পকেটমানি ছোট্ট কোনো প্রতিদানের জন্যও যথেষ্ট হয় না, তাই সে সর্বদাই কুন্ঠিত ও বিপর্যস্ত হয়ে থাকে।
প্রথম প্রথম মানস মৃদু প্রতিবাদ করেছে, কারণে অকারণে ‘গিফট’ নিতে অস্বীকার করেছে ।
কিন্তু কমলি ছোড়তি নেহী…স্টিভেডর-কন্যার ব্যক্তিত্ব ও হাতখরচের পার্স, দুইয়েরই গভীরতা বিশাল !
তাই মানসের প্রতিবাদ বা যুক্তি কোনোটাই শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায়না ।
#
এই তো আজ বিকেলে অপু ব্যাগের মধ্যে একটা উলমার্ক-এর গাঢ় মেরুন রঙের ওপর সাদা চেকচেক হাতকাটা সোয়েটার নিয়ে কখন থেকে অপেক্ষা করছে মানসদার জন্যে !
গত পরশুই গিয়েছিলো গ্রেট ইস্টার্ন মল-এ, পৰ্ণার সঙ্গে ।
শোকেসের ডিসপ্লে এরিয়াতে সোয়েটারটা দেখেই ওর মনে হলো মানসদাকে ওটা বেশ মানাবে।
পর্ণাকে জিজ্ঞেস করে তো কোনো লাভ নেই, ভাবলো অপু, ওর নিজের কোনো মতামত নেই, অপুর সব কথাতেই হ্যাঁ হ্যাঁ করে !
শীত আসছে, তাই আর সাত-পাঁচ বেশী না ভেবে বারোশো টাকা দিয়ে মানসদার জন্য সোয়েটারটা কিনে ফেললো অপু ।
বাড়িতে এতো বড়ো জিনিসটা লুকিয়ে লুকিয়ে রাখাটা সে আর এক ঝঞ্ঝাট ।
নেহাত ওর স্কুল ব্যাগে কেউ হাত দেয়না ।
‘এখন দেখো প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেলো, কই বাবুর তো দেখাই নেই !’
৩
মিনিবাসটা থেকে নেমে তাড়াতাড়ি পার্কের দিকে পা চালালো মানস ।বেশ দেরী হয়ে গেছে, অপু যে রেগে ফায়ার হয়ে পায়চারি করছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে ও ।
যানজটের যুক্তি অপুর কাছে আগে কোনোবার চলেনি, আজও যে চলবে না সেটা ভালোই জানে মানস ।
মানসকে দেখতে পেয়েই হনহন করে পার্কের ভেতরের দিকে চলতে শুরু করলো অপু ।
ওকে ধরবার জন্য মানসকে প্রায় দৌড়োতে হলো ।
গেট থেকে বেশ দূরে এসে একটা বড়ো বটগাছের নীচের বাঁধানো ধাপির কাছে এসে অপু থামলো ।
পেছনে পেছনে হাঁফাতে হাঁফাতে মানস এসে দাঁড়ালো ।
তারপর দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হলো এইরকম…
-‘আমার কথাটা শোনো অপু । কলেজ থেকে বেরিয়েছিলাম ঠিক সময়ই। কিন্তু আমার মিনিবাসটা এমন লোক তুলতে তুলতে…’ ( তুই-তোকারি-টা দুজনের সেই প্রথম আলাপের মাসখানেকের মধ্যেই কি করে যেন বাতিল হয়ে গিয়েছিলো )
– ( ঝাঁঝালো গলায় ) ‘শোনো মানসদা, রোজ রোজ তোমার ওই এক মিথ্যেটা বোলো না, ভালো লাগে না একেবারে।’
– ( বেশ মিইয়ে গেছে ) ‘না, না, আমি সত্যি বলছি অপু, বিশ্বাস করো ।’
– ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে , তোমাকে আর মিথ্যে বলতে হবে না । এখন এটা পরো তো ।’
– ‘ কি এটা ?’
– ‘এটাকে সোয়েটার বলে ! নাও পরতো তাড়াতাড়ি…সাইজটা আবার ঠিক হলো কিনা কে জানে । পরো ।’
– ‘পরবো ? এখন…এইখানে ? কেন ?’
– ‘ হ্যাঁ পরবে । আমি বলছি বলে পরবে…ব্যাস।’
এরপর লেখবার মতো আর বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটলো না !
সাইজটা কনফার্মড হয়ে মানসের কাঁধের ঝোলায় উলমার্কের সোয়েটারটা ঢুকে গেলো, আর মানসের দিকে একটা ভর্ৎসনা ও প্রশ্রয় মেশানো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে হুড়মুড় করে বাড়ির দিকে রওনা দিলো অপরাজিতা ।
#
মিত্তির বাড়ীতে মানস আর অপুর এই অসম মেলামেশার ব্যাপারটা এখন পর্যন্ত জানেন কেবল মানসের মা ।
সেটা সম্ভব হয়েছে কারণ মানস মা-র কাছে প্রায় কিছুই লুকোয় না।
আর তাছাড়া তার নিজের ঘরে ঘন ঘন নতুন নতুন জামাকাপড় আর সৌখীন পুরুষালী জিনিসের আমদানি তো আর মা-র চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনা ।
তাই মায়ের মনে ছেলের কাজকর্ম বা চালচলনের ব্যাপারে কোনো দুশ্চিন্তা জন্ম নেবার আগে প্রথম সুযোগেই মা-কে এই অপ্রতিম বন্ধুত্বের কথা জানিয়ে দিয়েছিলো মানস ।
যা জানাতে পারেনি তা হলো অপরাজিতার অপরিণত মনের অপর্যাপ্ত অধিকারবোধ, যা প্রাচুর্য্য-প্রসূত দাক্ষিণ্যের রূপ নিয়ে তাকে প্রায়শই বিব্রত করে তোলে ।
সময় যত এগিয়েছে, একজন ঘরোয়া মায়ের মতোই মানসের মা-ও এই সম্পর্কের কথা বিশদে জানবার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ।
কিন্তু মানস মায়ের সেই আগ্রহকে কখনোই বিশেষ আমল দেয়নি ।
৪
সময়ের প্রেক্ষিতে গল্পটা আরও কয়েক বছর এগিয়েছে ।
অপরাজিতা কলেজের শেষ বছরে আর মানস বিশ্ববিদ্যালয়ের এম কম ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সবেমাত্র এমপ্লয়মেন্ট নিউজের গ্রাহক হবার কথা ভাবছে ।
দুজনের সম্পর্কটা যে উদাহরণমূলক এক গাঢ় প্রেম ও তার একটা সর্বজনগ্রাহ্য সামাজিক পরিণতি হওয়াই উচিত, সে বিষয়ে মানস, অপু, পর্ণা বা দুজনের অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের সব সংশয় দূর হয়েছে ।
মানসের মা-ও গত বছরখানেকের মধ্যে বার কয়েক বাংলা সিনেমা সিরিয়ালের মায়েদের মতোন ‘আমাদের বাড়িতে ওকে একবার নিয়ে আয় না রে’ বলেছেন !
ইতিমধ্যে, এক শনিবারের সন্ধ্যায়, নাটক দেখে একাডেমী থেকে ফেরার পথে অপরাজিতা ফরমান জারি করার সুরে ঘোষণা করলো, ‘শোনো, তোমাকে আর এমপ্লয়মেন্ট নিউজ দেখতে হবে না । কাল রবিবার…সকালে দশটার সময় তুমি আমাদের বাড়ি আসবে ।বাপি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে । ওই আকাশী রঙের শার্টটা, যেটা গত ক্রিসমাসে গিফট করেছিলাম, সেটা পরে যাবে । মনে থাকে যেন। আর বাপি যদি কিছু প্রস্তাব দেয় তুমি না করবে না ।’
-‘উনি যদি বলেন আমার মেয়ের সঙ্গে আর মিশবে না…ওকে ভুলে যাও…তাহলে ?’ মানস একটু ঠাট্টা করতে গেলো ।
-‘আঃ, বাজে বকবে না একদম । বাপির অফিসে তোমার চাকরি হবে। আমি বাপিকে বলেছি…বাপি ও-কে বলে দিয়েছে ।’ অপু বললো ।
-‘শেষে ভাবী শ্বশুরের কোম্পানিতে চাকরি করতে হবে ? তাতে আমার মান…না-আ, মানে, তোমার মান…তাতে কি থাকবে ?’
মানস আর একটু হলেই ফেঁসে যাচ্ছিলো আর কি !
-‘সে আমি বুঝবো । তোমাকে যেতে বলছি…তুমি যাবে, ব্যাস । ট্যাক্সি…এই ট্যাক্সি…রোকো রোকো ।’
#
অপুর সঙ্গে চার-পাঁচ বছরের মেলামেশা হলেও অনিমেষ রায়চৌধুরীর বিশাল বাড়িতে মানসের সেই প্রথম প্রবেশ ।
একটু সংকোচ যে হচ্ছিলো না তা নয় ।
তবে মানস জানতো ধনবান মানুষটি খোলামেলা মনের, মিশুকে স্বভাবের…আদরের একমাত্র কন্যার সাথে তিনি বন্ধুর মতো ব্যবহার করেন ।
সেই তিনি এখন নিজে লাডলি কন্যার বিশেষ বন্ধু মানসের সঙ্গে দেখা করতে, কথা বলতে চেয়েছেন, যেতে তো হবেই ।
আদরের কন্যার কোনো কথাই তার বাপি অগ্রাহ্য করে না ।
কিন্তু তাই বলে বাবা একমাত্র মেয়ের সারাজীবনের পছন্দটা মেনে নেবার আগে যাচাই করবে না তা তো হয় না ।
এ তো প্রকৃতপক্ষে অনিমেষ রায়চৌধুরীর ব্যবসার ভবিষ্যৎ কর্ণধার বেছে নেবার ইন্টারভিউ !
প্রায় সেইরকম-ই হলো কথাবার্তা ।
মানসের পড়াশোনা, তার ইন্টারেস্ট এরিয়া, হবি, ভবিষ্যতের প্ল্যান, সবকিছুই একটু একটু করে জানাতে হলো মানসকে ।
স্টিভেডরিং ব্যাপারটা সম্বন্ধে ভাসাভাসা ধারণা ছিল মানসের…এর ফিনান্স আর একাউন্টিং-এর খুঁটিনাটি জানতে পারলো সেদিন ।
খাবারদাবার-এর মধ্যে কেক, কুকিজ আর কফি এলো ।
সকালের জলখাবার খেয়ে এসেছে জানালেও উপরোধে মানসকে সব কিছুই খেতে হলো ।
বাপির পাশে সোফায় সর্বক্ষন বসে থেকে সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করলো অপরাজিতা ।
মাঝেসাঝে দু একজন পরিচারিকা উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেলো লিভিংরুমের দরজায় ।
মানস বুঝতে পারলো মনিব বাড়ির মেজাজী কন্যার পছন্দের মানুষটাকে দেখবার কৌতূহল তারা দমন করতে পারছিলো না ।
এটাও বৃহত্তর ইন্টারর্ভিউয়ের একটা অংশ ভাবলো ও ।
মোটের ওপর ভাবী শ্বশুরকে পছন্দ হয়ে গেলো মানসের ।
দুই পরিবারের আর্থিক অবস্থার বিশাল তারতম্যের মানসিক অস্বস্তিটা কাটিয়ে উঠলো সে ।
৫
অনিমেষ রায়চৌধুরীর বেঙ্গল স্টিভেডরস কোম্পানিতে এসিসট্যান্ট ফাইন্যান্স ম্যানেজার হয়ে যেদিন জয়েন করলো মানস, সেদিন সন্ধ্যেয় ফ্লোটেল-এ ছোট একটা চারজনের পার্টির ব্যবস্থা করলো অপু ।
ওরা দুজনে আর দুজনের একজন করে প্রিয়তম বন্ধু আসতে পারে…এইরকমই বিধান দিয়েছিল পার্টির হোস্টেস ।
পার্টির প্রস্তাবে মানস মৃদু আপত্তি তুলেছিল, কিন্তু তার কথা কবেই বা শুনেছে অপু !
তাই ওদিক থেকে এলো পর্ণা, আর উপায়ান্তর না দেখে মানস পাড়ার ছোটবেলার বন্ধু বিবেককে নিয়ে পৌঁছলো সেখানে ।
হাসি ঠাট্টা চলার মাঝখানে মানস লক্ষ্য করলো, চাকরিটা যে অপুর বাবার কোম্পানিতে সেকথাটা একবারের জন্যও কেউ তুলছে না ।
স্বস্তি বোধ করলো ও ।
অবশ্য আজ সারাদিন অফিসের মধ্যে তার একবারও মনে হয়নি অফিস কলিগদের কেউ তার স্পেশাল ষ্টেটাস সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ।
বরং এইচ আর ম্যানেজার যখন অনিমেষ বাবুর চেম্বারে তাকে রুটিন পরিচয়ের জন্যে নিয়ে গেলো, তখন তিনি মানসের সঙ্গে অপরিচিতের ভঙ্গিতে ফর্মাল ব্যবহার করলেন ।
মন দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজকর্ম বুঝে নিতে বললেন, দায়িত্বের সঙ্গে কোম্পানির উন্নতির জন্য চেষ্টা করতে বললেন ।
তাঁর কথাবার্তায় বাড়ির সেই মিশুকে ভাব অনুপস্থিত ছিল ।
ব্যাপারটা মানস বুঝেছিলো ও সে জন্য মনে মনে অনিমেষবাবুর ওপর কৃতজ্ঞ না হয়ে পারেনি ।
#
-‘কি রে, পাশ করার পর তোর প্ল্যানটা কি ?’ ফর্কের আগায় ন্যুডল্স জড়াতে জড়াতে অপু জিজ্ঞেস করলো পর্ণাকে ।
-‘ল কলেজে ভর্তি হবো। কোম্পানি ল পাশ করে প্র্যাকটিস করবো । বাবার চেম্বার থেকেই শুরু করবো ।’
পর্ণার বাবা এডভোকেট, হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন ।
-‘আমি পাশ করে বিয়ে করবো ! অপরাজিতা রায়চৌধুরী থেকে অপরাজিতা মিত্র হয়ে যাবো । তাই তো…মানসদা ?’
অপু মানসের আর সকলের দিকে তাকিয়ে বললো, বলে খিলখিল হাসতে লাগলো ।
-‘আজকাল তো কেউ পদবি বদল করে না ।’ মানসের মৃদু উত্তর ।
বিবেক বললো, ‘কংগ্র্যাচুলেশন্স, তোমাদের দুজনকে । তা মহাভোজটা কবে হচ্ছে অপু ? জানোই তো, মিষ্টান্নম ইতরে জনাঃ !’
-‘হবে হবে, ধৈর্য্যং, ধৈর্য্যং ! অনিমেষ রায়চৌধুরীর একমাত্র মেয়ের বিয়ে, ধুমধাম করে হবে, সময় তো লাগবেই ।’
হাসি থামিয়ে অপু উত্তর দিলো ।
মানস তাকালো অপুর দিকে, কোনো কথা বললো না ।
#
কয়েক মাস পরে পাড়ার বড়ো খবর হলো পোস্টমাস্টার গোপাল মিত্তিরের ছেলে মানসের বিয়ে হয়ে গেলো পাশের পাড়ার ধনী ব্যবসায়ী অনিমেষবাবুর একমাত্র মেয়ে অপুর সঙ্গে ।
ঠিকঠাক বলতে গেলে অপরাজিতা বিয়ে করলো মানসকে !
কিন্তু সেই গভীর সত্যটা জানে কেবল মানস ।
প্রচুর শাড়ি, গয়নাগাঁটি আর ফ্যান্সি আসবাব নিয়ে, বাগানঘেরা তিনতলা বাড়ি ছেড়ে অপরাজিতা স্বামীর ঘর করতে এলো তিন কামরার সাদামাটা ফ্ল্যাটে ।
মিত্র বাড়ির আত্মীয় পরিজন বৌ-এর রূপ দেখে বললো, বাঃ, ভারী সুন্দর বৌ হয়েছে মানসের ।
বাড়ির বাইরে গিয়ে তারা বললো, ‘জানিনে বাবা, মানসের কি গুণ দেখে যে মেয়ের বড়োলোক বাপ বিয়েটা দিলো ! ওই তো ছিরির চাকরি ! রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব পেয়ে গেলো !’
পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো, ‘পুরো রাজত্ব বলো ! শুনলে না একমাত্র মেয়ে ।’
আর অফিসে মানস বাড়তি সম্ভ্রম পেতে শুরু করলো…’কে জানে এই লোকটাই হয়তো ভবিষ্যতে কোম্পানির মালিক হবে !’
৬
এর পরের কয়েকমাস বিশেষ ঘটনাবহুল হলো না ।
বিয়ের পরপরই হনিমুনে নবদম্পতি সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গেলো ।
সে ট্রিপ স্পনসর করলেন অনিমেষ রায়চৌধুরী ।
অষ্টমঙ্গলার দিনে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মানস বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাবটা জানতে পেরে একটু হালকা প্রতিবাদ করেছিল, নিষ্ফল হবে জেনেও…সাথে সাথে ছিল দক্ষিন ভারতে বেড়াতে যাওয়ার অনুবন্ধ ।
কিন্তু শ্বশুর অনিমেষ রায়চৌধুরী বেশ মোলায়েম করে মানসকে বুঝিয়ে দিলেন ওঁর ঐকান্তিক ইচ্ছার কথা…’মেয়ে-জামাই দুজনে বিয়ের পরে বিদেশে বেড়াতে যাবে !’
পরের দিন মানসের পাসপোর্ট ছবি নিয়ে আসতে বললেন অফিসে, তৎকাল পাসপোর্ট ও ভিসার ব্যবস্থা করতে হবে ।
আলোচনার পুরো সময়টা বাবার পেছনে সোফার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল অপরাজিতা, মানস তাই আর দ্বিরুক্তি করেনি !
#
ওদিকে মানসের মা বড়োলোক বাবার সুন্দরী এবং খেয়ালী মেয়েকে বাড়িতে বৌ করে এনে তার সঙ্গে প্রতিদিনের পারস্পরিক কাজেকর্মে অসামান্য বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দিতে লাগলেন, আর স্বামীকেও এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত পরামর্শ দিতে লাগলেন ।
সুতরাং এই গল্পের বিষয় হয়ে উঠতে পারে, মানসের বাড়িতে এমন কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটলো না !
আর বন্ধ দরজার পেছনে অপরাজিতা যে সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না তাদের, যারা দুজনকেই ভালো করে জানতো ।
সুতরাং মাঝে মাঝে একতরফা তর্জন ছাড়া সেদিকেও সবকিছু স্বাভাবিকই থাকলো ।
#
পরের তিন চার বছরের মধ্যে একটা সামান্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো যে মানস অপরাজিতার এযাবৎ কোনো সন্তান হয়নি।
এ সময়ের কালধৰ্মের নিরিখে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার ।
মানসের মা-র মনের মধ্যে এ ব্যাপারে হয়তো কিছু আক্ষেপ অঙ্কুরিত হয়েছে কিন্তু তিনি কখনোই বাইরে তা প্রকাশ করেননি ।
স্বামীর প্রতি প্রবল অধিকার বোধে সর্বদা-সচেতন পুত্রবধূর ব্যক্তিত্বে এমনিতেই তিনি বেশ সতর্ক থাকেন সারাক্ষণ, যাতে কখনো কোনো বেফাঁস কথা না বেরিয়ে পড়ে মুখ থেকে ।
মানসের বাবা তথৈবচ !
ইতিমধ্যে আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, অপরাজিতার যে তীব্র মনোযোগ মানসের ওপর সর্বক্ষণ আরোপিত হয়ে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো, তার কেন্দ্রবিন্দু সরে গেছে একটি সৌভাগ্যবান সারমেয় শাবকের ওপর !
মেয়ের আগ্রহাতিশয্যে অনিমেষ এই উচ্চকোটির পমেরিয়ানটি নিউ মার্কেটের একটি বিখ্যাত দোকান থেকে এনে দিয়েছেন।
এখন তাকে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে অপু ।
এতে অধিকাংশ সময়ে মানস কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করে ।
তবে মাঝে মাঝে এক অসম্বদ্ধ চিন্তায় সে আক্রান্ত হয় …’সন্তানধারণের প্রতি অপুর প্রবল অনীহার এক বহিঃপ্রকাশই কি তার এই মনুষ্যেতর প্রেম!’
মানসের মনের এইসব কথা বলে হালকা হওয়ার জন্য বিবেক আছে সে কলেজে পড়ায় ।
সুতরাং সন্ধ্যে থেকেই তাকে আড্ডার জন্য পাওয়া যায় ।
এখন প্রায় প্রতি সন্ধ্যেতে বিবেকের বাড়িতে মানসের আড্ডাধারীর ভূমিকা ।
নানারকম কথা হয় । কিন্তু মানস কিছুতেই বলে উঠতে পারে না তার এই সংশয়ের কথা ।
সেটা তার মনের গহনেই লুকিয়ে থাকে ।
৭
কিছুদিন যায় এভাবেই ।
এখন প্রায় রাতেই মানসের খাবার নিয়ে বসে থাকার জন্যে মা উদ্ব্যস্ত হয়ে থাকেন ।
খাবার টেবিলে মানসের অনুপস্থিতিতে অপরাজিতার বিশেষ হেলদোল থাকে না, সে খেয়েদেয়ে ঘরে চলে যায় ।
একটু বিসদৃশ লাগলেও মানসের মা ভাবেন এখন তো এরকমই সব ব্যাপার ।
তাও তো অপরাজিতা চাকরি করে না !
করলে হয়তো রাতের খাবার নিজের ঘরে বসেই খেতো !
আজকে মানস বাড়িতে ফিরতেই মার অনুযোগ,
-‘রোজ রোজ তুই দেরী করে ফিরিস। একসঙ্গে রাতের খাওয়াটা হয়না আমাদের আজকাল । অপু তো একলা খেয়ে চলে যায় । বাবু, তোর বিবেচনা বুদ্ধি দিনদিন কমে যাচ্ছে ।’
মানস একবার তার ঘরের পর্দাঢাকা দরজার দিকে তাকায়, তারপর বলে,
‘তুমি বসে থাকো কেন আমার জন্যে ? তুমিও খেয়ে নিলেই পারো ।’
বোধহয় দুজনের কথার আওয়াজে এবার অপু বেরিয়ে আসে, বলে, ‘তুমি কেন ওকে বকাবকি করছো মা ? ওকে যা বলার আমি বলবো।তোমার খাওয়ার সময় হলে তুমি খেয়ে নেবে । যেমন আমি করি ।’
বলে অপু গটগট করে আবার ভেতরে চলে যায়, মা আর ছেলে দুজনকেই হতবাক করে রেখে ।
মানস আর কিছু বলে না ।
মা আর ছেলে দুজনে নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে।
#
মানস ঘরের মধ্যে ঢুকতেই অপরাজিতা বললো,
-‘তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে ।’
মানস উত্তর দেয়,’আমিও তোমাকে একটা কথা বলতে চাই অপু । মা-র সঙ্গে অমন রূঢ়ভাবে কথা বলা তোমার উচিত হয়নি ।’
অপু মানসের অভিযোগ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কড়া গলায় বললো, —–‘তোমার মানসিক অত্যাচার আমার আর সহ্য হচ্ছে না । আমি এর একটা পার্মানেন্ট সলিউশন চাই । আর, হ্যাঁ, আমি একজন এডাল্ট মেয়ে, তুমি আমাকে উচিত অনুচিত বোঝাতে এসো না ।’ অপরাজিতার গলার স্বর বেশ উত্তেজিত ।
মানস অপুর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো,
-‘মানসিক অত্যাচার ! তুমি কি বলছো অপু ! আমি তোমার ওপর মানসিক অত্যাচার করছি ! তুমিই বরং…’
মানস থেমে গেলো, যে কথাটা মনের মধ্যে এলো সে কথাটা তো আর মুখে বলা যায় না ।
অপরাজিতা একই সুরে বললো,
-‘হ্যাঁ, মানসিক অত্যাচারই তো ।এরপরে হয়তো শারীরিক অত্যাচার শুরু হতে পারে । আমি তার আগেই একটা হেস্তনেস্ত চাই ।’
মানস এর আগেও বেশ কয়েকবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে ।
তাই আবহাওয়া সহজ করার জন্য একটু হেসে বললো,
-‘ঠিক আছে, ঠিক আছে । সন্ধ্যেবেলায় আর দেরী করে ফিরবো না। আর রাগ করতে হবে না ।’
এই বলে মানস প্রায় ভুলে যাওয়া অভ্যাসে অপুর কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলো ।
অপরাজিতা ছিটকে ঘরের অন্যদিকে চলে গেলো,
-‘না, তুমি একেবারে কাছে আসার চেষ্টা করবে না…ছোঁবেই না আমাকে । আমি কালই জিঞ্জারকে নিয়ে বাপির কাছে চলে যাবো ।’ ( পমেরিয়ানটিকে জিঞ্জার নামেই ব্যাপ্টাইজ করা হয়েছে )
মানস তবুও হালকা স্বরেই বললো,
-‘ঠিক আছে, যাবে যাবে । কাল আমি তোমাকে ওবাড়ি পৌঁছে দিয়ে অফিস চলে যাবো । তুমি কদিন মা-র কাছে থেকে এলে তো তোমার ভালোই লাগবে ।’
অপরাজিতা বললো, ‘না, তুমি আমার সঙ্গে যাবে না । কদিনের জন্য নয়, আমি আর ফিরবো না এ বাড়িতে । আর হ্যাঁ…অফিস ! আমি চলে যাবার পর তুমি বাপির অফিস থেকে রিজাইন করবে। তোমার লজ্জা করে না শ্বশুরের অফিসে চাকরি করতে ?’
অপরাজিতা জোরে শেষ কথা বললো, বোধহয় পাশের ঘরে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীকে শোনাবার জন্যেই ।
মানস এবার হতবুদ্ধি হয়ে গেলো । তারপর সামলে নিয়ে বললো,
-‘আর ফিরবে না মানে ? কি যা তা বলছো ! আর ইউ আউট অফ ইওর মাইন্ড ? আর তুমি ভালো করেই জানো যে তোমার বাপির অফিসের কাজটা আমি খুব দক্ষতার সঙ্গেই করি । গত বছর আমার একটা প্রমোশনও হয়েছে । হ্যাঁ, তুমি যখন কোম্পানির মালিক হবে তখন যদি তুমি আমার কাজ পছন্দ না করে নোটিস দাও সে আলাদা কথা ।’
শেষ বাক্যটা বলে মানস আবার একটু হাসতে চেষ্টা করলো ।
কিন্তু আজকে অপরাজিতার ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা ।
একটা ঝংকার দিয়ে বলে উঠলো,
-‘কাল সকালে আমি চলে যাবো। অনেক দিন ধরেই ভাবছি…তোমার সঙ্গে আর থাকা সম্ভব নয় । পর্ণা-র সঙ্গে কথা বলে ওর পরামর্শমতো মিউচুয়াল ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দেবো, তুমি সই করে দেবে…ব্যাস । হ্যাঁ, যদি তুমি ডিভোর্স পেপারে সই না করো তাহলে আমি ফোর নাইন্টি এইট ধারায় রিপোর্ট করবো, তুমি বেছে নিও কি চাও, জেল না ডিভোর্স ।’
একসঙ্গে এতখানি বলে অপু হাঁফাতে লাগলো।
মানস একেবারে হতবাক হয়ে গেলো, কি বলবে ভেবে পেলো না।
অপুর কথা বাইরে যাচ্ছে ভেবে ও তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করতে গেলো।
তার পেছনে ধমাস করে মেঝেতে বালিশ আর চাদর পড়ার আওয়াজ হলো ।
#
পরদিন সকালে অপরাজিতা একটা বড়ো ট্রলিব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে চেনবাঁধা গুটগুটে ছোট্ট জিঞ্জার ।
মানসের মা কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করে ভাসা ভাসা উত্তর পেলেন।
ঘরের মধ্যে মানস অফিস যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলো,মা হাতে টিফিনের বাক্সটা নিয়ে তাড়াতাড়ি সেখানে এসে বললেন,
‘হ্যাঁরে বাবু, সকাল সকাল অপু কোথায় বেরোলো, স্যুটকেস নিয়ে, তোকে কিছু বলেছে ? আমি জিজ্ঞেস করতে পরিষ্কার করে কিছু বললোও না !’
মানস টেবিল থেকে ব্যাগের মধ্যে কাগজপত্র নিচ্ছিলো ।
মার হাত থেকে টিফিনকৌটোটা নিয়ে ব্যাগের মধ্যে রাখতে রাখতে ও শান্তভাবে বললো,
‘ওবাড়ি যাচ্ছে । চিন্তা কোরো না । সপ্তাখানেক থেকে চলে আসবে ।’
৮
কিন্তু এক সপ্তাহের পর দুই তিন করে চার সপ্তাহ, একমাস কেটে গেলো, অপু ফিরলো না মিত্রবাড়িতে ।
নানারকম ভাবনাচিন্তা নিয়ে মানস এর মধ্যে বার দু তিন গিয়েছে শ্বশুরবাড়িতে ।
প্রত্যেকবার একসঙ্গে বসে চা খাওয়ার পর অনিমেষ ডেকে দিয়েছেন অপুকে ।
মানস বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য তাকে অনুনয় করেছে অনেক ।
প্রত্যেকবারই অপু বলেছে মানসের সঙ্গে থাকা যায় না…সে থাকবে না…তাই ওই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না ।
মানস ভেবে পায় না তার দোষটা ঠিক কোথায় হলো ।
তাদের দুজনের দাম্পত্য জীবনটা ভালোমন্দ মিশিয়ে, চলছিল ঠিকঠাক…অন্তত সাধারণ বাঙালী ঘরে যেমন চলে তার থেকে একটু বেশীই ভালো ছিল ।
মানস সন্ধ্যেবেলায় যায় বিবেকের বাড়িতে ।
সে পরামর্শ দেয় আরও ধৈর্য্য ধরতে, বলে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আর কিছুদিনের মধ্যেই পাড়ার মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়লো…গোপালবাবুর ছেলের বৌ এতদিন শ্বশুরঘর করে বাপের বাড়ি পার্মানেন্ট ফিরে গেছে… বিয়েটা ভাঙলো বলে !
যারা এতদিন মিত্রবাড়ির সৌভাগ্যে মানসিকভাবে যারপরনাই বিপর্যস্ত ছিল, তারা এতদিনে আলোচনার উপযুক্ত বিষয় খুঁজে পেয়ে বেদম খুশী হলো…মানসদের পাড়ার চায়ের দোকানটা সকাল বিকেল সে আলোচনায় অনুরণিত হতে থাকলো ।
৯
– ‘ওর সঙ্গে বেশীদিন থাকা যায় না জানিস । ওর আবাহন নেই, বিসর্জনও নেই…একটা নিষ্প্রাণ মানুষ !’
অপু বিকালে পর্ণার চেম্বারে এসেছে ।
– ‘কিন্তু তুই তো বরকে পুরোপুরি অধিকার করে রেখেছিলি। মানসদা তো তোর কথায় ওঠে বসে, তুই বলেছিলি । তবে ?’
অপু শ্বাস ফেলে বলে, ‘ওই তো !’
– ‘তাহলে ? কোথায় আটকাচ্ছে ? শারীরিক…’
অপু পর্ণার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘না, না, ওসব ব্যাপারে আমার কোনো কমপ্লেন নেই, উই আর কমপ্যাটিবল । আমি তোকে ঠিক বোঝাতে পারবো না রে । আমার আগ্রহ কোথায় যেন হারিয়ে ফেলছি । ‘
-‘তাই বলে ডিভোর্স চাইবি ! ভেবে দ্যাখ আরও । ওটা কোনো সলুউশনই নয়। শোন, কয়েক বছর তো প্ল্যানিং হোল, এবার একটা বাচ্চার কথা ভাব…আর, আদারওয়াইজ, সেরকম বুঝলে, একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যা…মানসদার সঙ্গে…দুজনেই যা । ‘
– ‘তোকে আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না রে পর্ণা । ভাগ্যিস জিঞ্জার এসে গেলো আমার জীবনে ! নইলে আমি যে কি করতাম, কি ভাবে বাঁচতাম।’ অপু একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেললো ।
পর্ণা এবার হতবাক, ‘সে কিরে…এর মধ্যেই তুই মানসদাকে ছেড়ে আর একজনের সঙ্গে…’
অপু এবার বিরক্ত, ‘আঃ পর্ণা ! তুই কি রে ! জিঞ্জার ফ্রেঞ্চ পমেরিয়ান, আহা…আমার কিউট বেবি ! বাপি আমার এই জন্মদিনে গিফট করেছে । ও যে কি লাভলি, তুই ওকে না দেখলে বুঝতে পারবি না ।’
পর্ণা একটা শ্বাস ফেললো,’ তাই বল ! আমি ভাবলাম…সে যাক, তুই বাড়ি যা। তোর এই ডিভোর্সের আইডিয়াটা একেবারেই এনডোর্স করছি না আমি । তুই ভাব, আরও ভালো করে ভাব…পজিটিভলি ভাব ।’
অপু উঠে পড়লো চেয়ার ছেড়ে, ‘ হ্যাঁ, আমিও উঠবো এবার, পাঁচটা বেজে গেলো । একাডেমীতে নান্দীকারের নাটক দেখতে যাবো, টিকিট কেটেছি…ছটায় শো । মানস এসে আবার দাঁড়িয়ে থাকবে ।’
পর্ণা ভীষণ অবাক হলো এবার, ‘মানে ? তুই মানসদার সঙ্গে নাটক দেখতে যাচ্ছিস !’
– ‘হ্যাঁ, যাবো না কেন ? প্রায়ই যাই তো, সিনেমা, নাটক, শপিং-এ । সপ্তায় অন্তত একবার আউটিং তো হয়ই। ‘
– ‘না…মানে…লিগ্যালি তুই তো যেতেই পারিস । আমি বলছিলাম কি, মানসদা আসে ? আপত্তি করে না ?’
– ‘আসতে আপত্তি করবে মানে ? আমি ডাকলে একশোবার আসবে, আসতে হবে । ডিভোর্সটা হয়ে গেলেও আসতে হবে, আমি গত মাসেই বলে দিয়েছি ।’
অপু আর একবার ঘড়িটা দেখে ছিটকে বেরিয়ে গেলো ।
পর্ণা অবাক হয়ে ওর চলে যাওয়াটা দেখতে লাগলো ।
#
-‘অপুর ব্যাপারটা বোধহয় আমি একটু একটু বুঝতে পারছি, বুঝলি বিবেক । ওর আসলে একটা কাউকে চাই, যাকে ও নিজের পছন্দমতো লালন পালন করবে, গড়বে, সাজাবে…চাই একটা অবজেক্ট ! সেটা মানুষ হতে পারে, আবার পমেরিয়ান কুকুরও হতে পারে ! মানে, আমার মনে হয়, এটা ঠিক ভালোবাসা নয় বোধহয়…হতে পারে একটা অবসেশন ।’ মানস ক্লিষ্ট স্বরে বিবেককে বললো ।
– ‘তুই শুধু শুধু হার্শ হচ্ছিস বাবু । আমার মনে হয় ব্যাপারটা ঐসব সিরিয়াস কিছু নয় । অভিমান হয়েছে অপুর, অভিমান…গাঢ় অভিমান । তুইও তো ওর জন্য কম সময় দিতে শুরু করেছিলি।সন্ধ্যেবেলায় রেগুলার আমার এখানে আড্ডা দিতে আসতিস…রাত করে বাড়ি ফিরতিস ! এ তারই রিঅ্যাকশন, হ্যাঁ, বলতে পারিস একটা সিভিয়ার রিয়্যাকশন ।’ বিবেক বোঝানোর ভাবে বললো ।
– ‘দ্যাখ, ওর সেই ক্লাস নাইন থেকে আমার সঙ্গে মেলামেশা, আমার ছিল ক্লাস টুয়েলভ । এই গত আট-ন বছরের সব ছোট বড়ো ঘটনাগুলো এখন যদি আমি এনালিসিস করি তোর কাছে, তবে দেখবি অপু প্রায় সবসময়েই তার মতামতটা জোর করে আমার ওপর চাপিয়েছে । আমি কখনোই সেভাবে কোনো প্রতিবাদ করিনি । কারণে অকারণে দামী দামী উপহার দিয়ে ও আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে…সেই স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই । প্রতিবারেই আমার মনে হয়েছে এসব ভালোবাসার অত্যাচার, সহ্য করে নেওয়াই যায় । কিন্তু এখন মনে হয় তখন আমি ছিলাম ওর অবসেশন, এখন হয়েছে জিঞ্জার ! সে কথা না, কিন্তু তাই বলে এমন কি হলো যে একবারে ডিভোর্সের কথা বলে দিলো মুখের ওপর…’বেছে নাও ফোর নাইন্টি এইট না ডিভোর্স’ ! আবার মজার ব্যাপার কি জানিস তুই ? এই তিন মাসে প্রতি সপ্তায় ডাক পড়ছে, তাকে নিয়ে নাটক সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতে হচ্ছে, শপিং মল-এ সঙ্গ দিতে হচ্ছে !’
স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে একসাথে এতগুলো কথা বলে মানস থেমে গেলো ।
বিবেক ছোটোবেলার বন্ধুকে বেশ ভালোই চেনে।
তাই হালকা হেসে বললো,
-‘কিন্তু, তুইও তো যাচ্ছিস ? কেন ?’
মানস একটা শ্বাস ফেললো,
-‘ওই ! কিছুটা ভালোবাসার টানে, আর কিছুটা শান্তি ফিরে আসার আশায় বলতে পারিস। ওর ভালোবাসার ব্যাপারে আমার মনে এখন হালকা সংশয় জাগছে ঠিক , কিন্তু এটাও তো সত্যি যে আমি অপুকে খুব, খুব ভালোবাসি । তেমন করে, ওর মতন করে ভালোবাসাটা প্রকাশ করি না হয়তো । কিন্তু ব্যাপারটা তো দারুণভাবে সত্যি । আবার কিছুদিন আগে কি বলেছে জানিস ? রাতে একাডেমী থেকে নাটক দেখে বেরিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে…আইসক্রিমটা অবশ্য আমাকেই কিনে দিতে হলো…আমাকে বললো, ডিভোর্স হয়ে যাবার পরও নাকি এই সব সান্ধ্য প্রমোদভ্রমণ চালিয়ে যেতে হবে…বোঝ !’
১০
সন্ধ্যেবেলায় চেম্বারে এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে পর্ণা কথা বলছে, এমন সময় একটা ঝড়ের মতো অপু ঘরে ঢুকলো ।
পর্ণা আর ক্লায়েন্ট ভদ্রলোক দুজনেই ঘুরে তাকালেন ওর দিকে…হাঁফাচ্ছে, চেহারা একটু বিধ্বস্ত ।
অপু বললো, ‘ পাঁচ মিনিটের বেশী তোর সময় নেবো না রে । একটু আর্জেন্ট…আপনি যদি একটু পাশের ঘরে…’
কথার শেষ অংশটা অপু ওই ক্লায়েন্ট লোকটির দিকে তাকিয়ে বললো ।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন,
-‘না না ঠিক আছে, আপনারা কথা বলে নিন । আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। ‘
পর্ণা বললো, ‘হ্যাঁ, প্লিজ, আমি আপনাকে ডেকে নেবো, থ্যাঙ্কস ।’
পর্ণার ক্লায়েন্ট বেরিয়ে গেলেন ।
অপু চেয়ারে বসে টেবিলের ওপরে সামনে রাখা গ্লাসের জলটা নিয়ে একচুমুকে খেয়ে নিলো ।
পর্ণা বললো, ‘হ্যাঁ, এবার বল। সেই আলিপুর থেকে এক্সাইড দৌড়ে এসেছিস মনে হচ্ছে !’
-‘আচ্ছা পর্ণা, একটা কথা আমাকে বল। আমার মিউচুয়াল ডিভোর্স চাওয়া পেপারটা মানস সাইন করলে ডিভোর্সটা হয়ে যাবে…আমরা ফ্রি হয়ে যাবো, তাই তো ?’
– হ্যাঁ, তবে একটু সময় লাগে । জজ সাধারণত ছমাস সময় দেন, দুজনকেই আরও ভাবার জন্যে । তাতেও যদি দুই পার্টি মত না বদলায়, তাহলে ডিভোর্স হয়ে যাবে…দুজনে লিগ্যাল বিবাহবন্ধনটা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে । তখন ইচ্ছে করলে যে যার আবার বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতে পারবে । কিন্তু কেন…একথা জানতে চাইছিস কেন ?’
অপু টেবিলের সামনে একটু ঝুঁকে এলো, গলায় উত্তেজনা,
-‘পর্ণা, এখন আমার ছাব্বিশ চলছে । বাপি এই ডিভোর্সটা মেনে নিলেও, মা, বাপি, আমাকে সারাজীবন তো কিছুতেই একা থাকতে দেবে না। তার ওপর বাপির এতো বড়ো ফার্ম, ঢালাও বিজনেস ! আমার এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই, বাপি জানে । তাই আবার বিয়ে করার জন্য আমাকে খুব জোর করবে…করবেই…বিজনেসের উত্তরাধিকারী চাই বাপির…আমি বেশ জানি ।’
– ‘তো ? বিয়ে করবি ! সারাজীবন একা থাকবি কেন ?’
অপু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, ‘ নাঃ । হবে না । ‘
-‘কি হবে না ?’
-‘এই ডিভোর্স । ঠিক করে ফেললাম, ডিভোর্সটা নেবোনা রে । আমার কথা ছাড়। ওকে আর কাউকে বিয়ে করার সুযোগ দেব নাকি ! তুই আমাকে কি ভেবেছিস ? কালই বাড়িতে চলে যাবো ।’
যেমন এসেছিল, আবার তেমনই ঝড়ের বেগে পর্ণার চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলো অপরাজিতা মিত্র ।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।