কোপাই পাড়ের নিরিবিলি শাল বন – গতকাল গোধূলিতে এই শালতরু গুলিকে ঘিরে অবিরাম বৃষ্টি পড়েছে , ফাল্গুনী রৌদ্রগন্ধ ধুয়ে মিশেছে মাটিতে – আজ সারাদিনই শালতরুর নতুন করে চৈতি রৌদ্রস্নান দেখে এখনও মেদুরতায় ভুগছে কোপাই পাড় – সন্ধ্যা সলজ্জিত নববধূর মতো এইমাত্র আলতো স্পর্শ করেছে কোপাইয়ের জল , দিগন্ত ছুঁয়ে একটা কালো পাখি উড়ছে – আকাশের মেঠো পথ ধরে শুক্লা-ত্রয়োদশীর পোয়াতি চাঁদ – পুরানো ক্ষেতের ধারে পলাশরা প্রশাখায় আগুনে ফাঁদ সাজিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সারাদিনই , এখন সেই ফাঁদে ধরা দিয়েছে বসন্তের বাতাস – কী অদ্ভূত কৌশলে বাতাস ও আগুনে পলাশের ভাব হয়ে গেছে – বাতাস যত দুলে দুলে হাসছে , ততই পেখমের মতো জ্বলে জ্বলে উঠছে কোমল আগুন – আমাদের চোখের সামনে এছাড়া আর কোন আবিলতা নেই , আমাদের পিছনে বনের কাছটায় অধীর অন্ধকার এসে ক্ষণিকের জন্য হলেও থেমেছে !
– ফুল নেবে ? মালা করে গলায় পরবে বসন্ত উৎসবে ? সুন্দর লাগবে !
আমরা দুজনে একসাথে চমকে পিছনে ফিরে দেখি , একটি কিশোরী মেয়ে অনেকগুলি প্লাস্টিকে আগুনে পলাশ ভরে কখন আমাদের পিছনে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে – মায়ের পুরনো শাড়ির নীচে কিশোরীদের সদ্যোদ্ভিন্ন , লোকলজ্জা কাতর বুকদুটির মতোই তার মুখ , আনত দুটি চোখ স্বপ্নালু । আমাদের বিস্মিত হতে দেখে, সে আরও একটু সংকোচের সাথে বলল , ফুল নেবে ? এই সবে মাত্র কুড়িয়েছি!
কিশোরীর গলার স্বর মধুর , যেন গোটা কয়েক কাঁচের চুড়ি একসাথে ভাঙছে !
অভিষিক্তা হেসে বলল , না লাগবে না ! আমাদের বাড়ি হলুদ পলাশ আছে !
এতক্ষণে অন্ধকার আলাপের লজ্জা কাটিয়ে শাল বনে খেলা করে বেড়াচ্ছে – কোপাইয়ের জলে বিষণ্ণতার ছাপ গাঢ় হচ্ছে , তার ভিতর ফুটফুট করছে দু একটা মিটিমিটি তারা ! অভিষিক্তার কথা শুনে কিশোরীটাও বুঝি বিষণ্ণ হল , আনত দুচোখে তার ছাপ – বললাম , আমি কিনবো – কত করে গো ?
কিশোরী ফুটফুটে চোখ করে বলল , দশ টাকা এক প্যাকেট !
দাও সব গুলোই ! পাঁচ প্যাকেট আছে মনে হচ্ছে – এতগুলো একসাথে কিনছি একটু কম হবে না ? চল্লিশ টাকা দিই !
-আচ্ছা তাই দিন !
আমি একশ টাকার নোট বের করে তার হাতে দিলে , সে খুব দুঃখিত হয়ে বলল – আমার কাছে তো কোনো টাকা নেই !
-নেই ? আচ্ছা তবে এখন পুরোটা রাখো – পরে দেখা হলে ফিরত দিও !
কিশোরী যেন আরও দুঃখিত হল , বলল – আপনাকে ফুলগুলো এমনি দিলাম । আমার টাকা লাগবে না !
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম , এটা তুমি কি বললে ? মেয়েরা কোন ছেলেকে এমনি এমনি পলাশ দিলে কী হয় জানো ?
যে গভীর বিস্ময়ে ভীতু স্বরে বলল , কী হয় !
ছেলেটা মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলে !
কিশোরী খলখলিয়ে হেসে ফেলল , এমন অদ্ভুত কথা যেন সে আগে কোনদিনই শোনেনি – কিশোরী বেশ অনেকক্ষণ ধরে আগ্রহ করে হেসে চলেছে , আমি এমন করে কখনও কাউকে হাসতে দেখিনি , হয়ত সে অনেক দিন পর হাসছে – তার মনের ভীতরটা আমার কাছে স্পষ্ট না হলেও , মনে হচ্ছিল – অনেকদিন পর তাকে ঘিরে যেন বৃষ্টি পড়ছে , আর সে এখন শুধু কিশোরী নয় – কিশোরী শালতরু !
কপট রাগ দেখিয়ে বললাম , অত হেসো না হেসো না – আমার পাশে কে দাঁড়িয়ে দেখছ তো ? একে আমি রাখাল বালক বলে ডাকি ! এখন তুমি যদি আমাকে পলাশ দিয়ে দাও , তবে আমার রাখাল বালকের কী হবে শুনি !
সে আবার নতুন করে হাসতে শুরু করল , পিছনের বনে যত অন্ধকার ছোটাছুটি করছে , ত্রয়োদশীর চাঁদের পোয়াতি আলোয় তার গায়ের চাঁপাফুলের মতো রঙটা যেন আরও উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে !
অভিষিক্তারও মেয়েটাকে বোধ হয় ভালো লেগে গেল , বলল – কী মিষ্টি মেয়ে ! নাম কী তোমার ? থাকো কোথায় ?
কিশোরী চড়ুই পাখির মতো ঠোঁটে বলল , কাবেরী ! এরপর আঙুল উঁচু করে অন্ধকারে প্রায় মিলিয়ে যাওয়া কম্পমান বিন্দু বাতির দিকে দেখিয়ে বলল , ওই বাড়িটা !
অভিষিক্তা বলল , শোনো কাবেরী , সন্ধ্যা হয়ে এলো ! তুমি বাড়ি যাও । আর ওই টাকাটা রাখো । কাল বাদে পরশু বসন্ত উৎসব তো , তাই মনে করো ফুলের দাম বেড়ে গেছে – এখন কুড়ি টাকা করে । ঠিক আছে ?
সে এখনও কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না , কখনও মাথা নীচু করে কী ভাবছে , কখনও বা আমাদের দুজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে – বোধ হয়, কিশোরীটির আত্মসম্মানবোধ প্রবল , তাই তার ভিতর অদ্ভুত একটা গ্লানি কাজ করছে – এই গ্লানি কিছুতেই কিশোরীটির সুন্দরতার দেওয়ালে লজ্জায় একেবারে লীন হয়ে ধুয়ে মুছে মিলিয়ে যাচ্ছে না !
অভিষিক্তা কিশোরীর কাছে সরে এসে বলল , তুমি ফুল বিক্রি করো ? আগে তো তোমাকে কখনো দেখিনি !
কাবেরী চমকে বলল, না না ফুল তো আমি বিক্রি করি না , আজই শুধুমাত্র করছি ! আমি এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবো ।
আমি অবাক হয়ে বললাম , আজ বিক্রি করছো মানে ?
কিশোরী দুচোখ টলমল করে উঠল, বিষাদ অবনত দু চোখ থেকে অতিকষ্ট করেও ক্ষীণ অশ্রু ধারাকে তার পক্ষে সামলানো সম্ভব হল না !
অভিষিক্তা তার দুহাত নিজের হাতে নিয়ে বলল , আমাদেরকে বলতে চাইলে বলো ।কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে একটা ! এই দেখো , ওই ছেলেটার কিন্তু একটা সমস্যা আছে – ওর সামনে যদি কেউ কাঁদে সেও ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে , বুড়ো ছেলে কাঁদলে রাস্তার লোক কী বলবে ভাবো !
কিশোরী অশ্রুধারা নিয়েই খলখলিয়ে হাসলো ! কী মধুর সে হাসি , সে হাসিতে কোথাও যেন ব্যথা বাজে !
এরপর কিশোরী আমাদের যেন বিশ্বাস করে ফেলল , বিহ্বল ঠোঁট দুটি থেকে তার যত্ন করে লুকিয়ে রাখা কষ্টগুলো আমাদের মনকে মুহূর্তে বড্ড বেশি আবেশিত করলো !
সে অনেক কষ্টে একপ্রকার ঘোরের ভিতর যা বলল, সেটা হল – কাবেরীর বাবা নেই, বেঁচে থাকলেও সে কোথায় আছে কাবেরী জানেনা ! তবে তার মাঝে মাঝে মনে হয় , খুব ছোট বেলায় সে তার বাবাকে দেখেছে – বাবা তাকে যেন লাল বেলুন কিনে দিয়েছিল। কাবেরীর দিদি আছে , ওর থেকে চার বছরের বড় – বিশ্বভারতীর ছাত্রী । কাবেরীর মা, তিনটে বাড়ির বাগান দেখাশোনা করে …. মালিকরা সবাই কোলকাতায় থাকে । মাস গেলে যা পায় , তাতে কাবেরীদের চলে না , তাই তিন জন মিলে রাত জেগে মাটির গহনা বানায় , কাপড় সেলাই করে। অভাব অনটন থাকলেও , সুখে এতদিন ভাঁটা পড়েনি মা-মেয়েদের ক্ষুদ্র সংসারে , দিন বেশ চলে যাচ্ছিল । মেয়ে দুটোই রূপবতী এবং মেধাবিনী সুতরাং মায়ের আর চিন্তা কিসের ?
এবারের জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝিতে হঠাৎ কাবেরীর দিদি অসুস্থ হয়ে পড়ল ,তার যে কী হয়েছে কেউ ধরতে পারে না , ডাক্তার , মনসা , শীতলা , পীর ফকির সবাইকে ফেল করিয়ে দিদি এখন বিছানায় , খালি চেয়ে থাকে ছাদের দিকে । গভীর সে দৃষ্টির আকাশে মাঝে মাঝে মেঘ করে বৃষ্টি হয় , বাঁধ ভাঙা বৃষ্টির জল চোখ থেকে গড়িয়ে বালিশ ভিজে যায় ।
দিদি গত বছরও বসন্ত উৎসবে কাঁচা হলুদ শাড়ি পরেছে , খোঁপাতে দিয়েছে রুদ্র পলাশ । তারপর বোনের হাত ধরে সবার সাথে আবির খেলেছে – নাচ করেছে , ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় …
কাবেরীর খুব ইচ্ছে ,এবারে সে তার দিদির সাথে ঘরেই রঙ খেলবে -বসন্ত উৎসবে নাই বা যাওয়া হলো ! কিন্তু , রঙ সে পাবে কোথায় ! রঙ যে হাতে তৈরি করবে তার উপকরণ কেনার পয়সাই বা কোথায়! এতদিন ভাবনা চিন্তা করেও সে যখন কোন উপায় পেল না , তখন আজই সে ফুল বিক্রি করার সিধান্ত নিয়েছে , কিন্তু সে একটা ফুলও গাছ থেকে পাড়েনি , তলা থেকেই কুড়িয়েছে ! কারণ , তার মা নাকি তাকে বলেছে – ফুল গাছদের সন্তান , সন্তান থেকে মাকে আলাদা করতে নেই ।
কাল সে দিদির জন্য রঙ কিনবে , লাল – সবুজ – হলুদ ! আর পরশু দিন দিদিকে পরাবে কাঁচা হলুদ শাড়ি , গলায় পরাবে মাটির মালা , খোঁপা করে গুঁজে দেবে রুদ্র পলাশ । তারপর সে অনেকগুলো গান গাইবে , সবই বসন্ত উৎসবের গান …. প্রকৃতির উৎসবে মিশে যাওয়ার গান। তার ধারণা, রবীন্দ্র-সঙ্গীত শোনার মুহূর্তটায় দিদি ভালো হয়ে যায়, আগের মতো করে একটা আনন্দের রেখা তার মুখে জেগে ওঠে ।
সন্ধ্যার আলিঙ্গনে আঁধার নেমেছে ,অভিষিক্তাকে নিয়ে টোটো করে ফিরছি , যদিও অন্যদিকে ফিরে তবুও বুঝতে পারছি ও অবিরাম কেঁদেই চলেছে , একটি হাত কেবল শক্ত করে আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে । আমাদের মধ্যিখানে রক্তরাঙা বসন্তের ফুল আর দুপাশের কতদিনের পুরানো গাছগুলোতে যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে একটা মৃদু অথচ বিহ্বল বিষণ্ণতা !
Tags: সাত্যকি দত্ত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।