যত দিন যাচ্ছে, আতঙ্ক ততই শরীরের ভেতর গেঁথে বসছে। করোনা ভাইরাসের অস্তিত্বের মতোই এ সত্য আজ আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু শুধুই কি করোনা পরিস্থিতি? করোনার ভয়াবহ আক্রমণ বাদ দিয়েও, সামগ্রিকভাবে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কেও কি এটা সমান সত্য নয়? কাজ হারানোর ভয়, বাড়িতে ডাকাত পড়ার ভয়, কলে জল চলে যাওয়ার ভয়, মাঝরাস্তায় বৃষ্টি নামার ভয়, এটিএমে জালিয়াতির ভয়, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়। করোনার আগেও কি আতঙ্ক মুক্ত ছিলাম আমরা? তবে একথা বলতেই হবে করোনা বাকি সব আতঙ্ককে পিছনে ফেলে দিয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই নিজেকে চার দেওয়ালের জমাট নিরাপত্তায় বন্দি রেখেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। কাজেই আতঙ্ক তাড়া করে ঢুকছে চার দেওয়ালের নিশ্চিত আশ্রয়েও। আশেপাশের মানুষ, আগের দিনও যাকে দেখা গেছে রাস্তায়, খবর মিলছে আক্রান্তের নয়া তালিকায় ঢুকে পড়েছেন তিনিও। অনেকেই আর ফিরে আসছেন না। আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলতে, অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালে যাওয়ার সময় চোখেমুখে যে মৃত্যুভয় দেখা যাচ্ছে, আমাদের কোন, কোন অভিজ্ঞতা দিয়ে কি তার কাছাকাছি পৌঁছনো যায়? মৃত্যুভয়ের ঐ অনুভূতিকে ছোয়া যায়? উত্তর খুব সম্ভবত নাই-ই হবে। আতঙ্কিত আক্রান্তেরা, হয়তো বা তার থেকেও বেশি আতঙ্কিত আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় দিন গুনতে থাকা সারি সারি অসহায় মানুষেরা। সাধারণভাবে যিনি যুক্তি মেনে চলতে চান, ঘটনার পেছনে কার্যকারণ খুঁজে দেখতে চান, তাদেরও যুক্তিবোধ কাজ করছে না, মেরুদণ্ডে হিমশীতল অনুভূতি যুক্তির জাল খুলতে দিচ্ছে না। আর যারা নিজের চোখে দেখা, নিজের কানে শোনার থেকেও বেশি পছন্দ করেন, ‘ঐ তো ও বললো’য়, তাদের কি অবস্থা, সে আমরা প্রায় সবাই কম বেশি নিজের চোখে দেখছি, নিজের কানে শুনছি। যুক্তি কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে, তা আরও বোঝা যায়, ১৫ মের বিকেল থেকেই। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্ন থেকে ঘোষণা করেন, ১৬ মে থেকে বাজার শুধুমাত্র সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। আবারও শুরু হয় আতঙ্ক। আতঙ্ক বাজারে কিছু না পাওয়ার, আতঙ্ক না খেয়ে থাকতে হওয়ার। অথচ এরকম নয় যে এইসব মধ্যবিত্ত মানুষের ঘরে আগামী কয়েক দিনের চাল, ডাল, সবজি মজুত ছিল না। এরকমও নয় যে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন বাজার প্রতিদিন খুলবে না, একদিনই শুধু খোলা থাকবে। তবু এইসব মানুষ থলে হাতে ছুটলেন বাজারে, কেউ কেউ সঙ্গে নিয়ে নিলেন ঘরের ছোট ছেলে মেয়েদেরও। ছুটলেন অনেকেই সঠিকভাবে মাস্ক না পড়ে, ভিড়ে ঠেলাঠেলি করলেন কোনরকম সামাজিক দূরত্ব না রেখেই। এরকম মুহূর্তের অপেক্ষাতেই তো থাকে করোনা? আমরা ভুলে গেলাম সে কথা। আবারও বিশ্বব্যাপী এই আতঙ্কের কাছে পরাজিত যুক্তিবোধ, এমনকি যুক্তি মানার মানসিকতাও।
আতঙ্ক, আতঙ্ক… ক্রমশ মিশে যাচ্ছে মেরুদণ্ডে। দূরে হটিয়ে দিচ্ছে স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসার মানবিক গুনগুলিকেও। কেউ আর খতিয়ে দেখছি না কার্য কারণ সম্পর্ক।
কবে বলা না গেলেও একথা বলাই যায় আজকের দানব করোনা ভাইরাস একদিন নেহাতই কাগজের বাঘে পরিণত হবে, বিদায় নেবে মানব শরীর থেকে। কিন্তু আতঙ্ক? নিজের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় ঘর থেকে মুখ তুলে বাইরের দিকে দেখতে পারব তো আমরা? সমস্ত রকম মানবিক গুন নিয়ে আমরা আবার মানুষ হয়ে উঠতে পারব তো? প্রশ্নটা নেহাতই ছেলেমানুষি। তবু, ঐ আতঙ্ক মগজের ভেতর চেপে বসে।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।