[ মাঝে মাঝে স্বপ্নে কিংবা জাগরণে এমন কিছু মানুষজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যায় যারা আমার বহুকালের চেনা অথচ কোথাও যেন অচেনাও বটে। সেইসব সাক্ষাৎকারের গল্প শুনে বন্ধুরা হাসে, বিশ্বাস করতে চায় না, ভাবে গুল মারছি। তাই আমার নিজের কথাগুলো নিজের কাছেই রেখে দিই আজকাল। তেমনই একটা অভিজ্ঞতার কথা লিখলাম এইখানে, সেইসব পাঠকের ভরসায় যারা এখনও মনে করেন মানুষের শরীরটাকে লকডাউন করে আটকে রাখা যায়। মনটাকে নয়।]
।। ১ ।।
গত সপ্তাহের কথা । গিয়েছিলাম সেন্ট জনস চার্চের কম্পাউন্ডের ভেতরে জোব চার্নকের সমাধি দেখতে । সেটা দেখে বাইরে বেরিয়ে হেঁটে আসছিলাম ধর্মতলার দিকে। লরেন্স এন্ড মেয়ো’র সামনে রাস্তা পেরিয়ে একটু এগিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে কিছুটা এগোতেই দেখলাম এক ভদ্রলোক রাস্তায় ঝোলানো রংচঙে জামাগুলো বেশ মন দিয়ে দেখছেন । ওঁর মাথায় একটা ব্রিটিশ ড্রাইভিং ক্যাপ মার্কা টুপি, লম্বা জুলপি গায়ে কতগুলো তাসের ছবি দেওয়া জামা । সব মিলিয়ে খুব চেনা চেনা লাগছিল ভদ্রলোককে। কিন্তু পিছন ফিরে থাকায় ওঁর মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না । কিন্তু পরক্ষনেই উনি টুপিটা খুলে নিজের টাকটা চুলকোতে শুরু করতেই চিনতে পারলাম ওঁকে । মন্দার বোস ! ইতিমধ্যে উনি হাঁটা লাগিয়েছেন সামনের দিকে, ফলে আমাকেও পিছু নিতে হল । এইবার উনি বাঁ দিকে ঘুরে ঢুকে পড়লেন ডেকার্স লেনের ভেতরে । অগত্যা আমিও ঢুকলাম। একটা দোকানের সামনে এসে আচমকাই ঘুরে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘যেন কিছুই হয়নি’ এমন ভাবকরে আমাকে বললেন-
‘চা চলবে তো ? সঙ্গে দুটো করে মাখন টোস্টও বলছি । দাঁড়িয়ে কেন বসতে আজ্ঞা হোক’। আমি দোকানের সামনে রাখা কাঠের বেঞ্চির এককোণে ধুপ করে বসে পড়লাম । উনি বললেন ‘এইবার আমার নামটা জিজ্ঞেস করতে পারেন। জামার দোকানে উত্তর দেওয়ার একটু আসুবিধে ছিল’।
কি আসুবিধে? আমি তখনো ভ্যাবলা মেরে যাওয়া ব্যাপারটা কাটিয়ে উঠতে পারি নি ।
‘আসলে যেখানে বসার যায়গা নেই সেখানে আমি নিজের নাম বলি না । নিজেকে নিজেই বলবো মন্দার বোস অথচ বসার জায়গা নেই তা তো হতে পারে না’। এই বলে তিনি বেশ আয়েশ করে বেঞ্চিতে বসে পড়লেন ।
‘তারপর বলুন কি মনে করে? কারোর ছেলে হারিয়েছে না কেউ কাউকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে?’
এমন কথা বলছেন কেন? আমি ঘাবড়ে যাই ।
‘না নন্দ ঘোষেদের যুগ তো আর নেই, এখন হয়েছে একচোখো ফেলুভক্ত বাঙালীদের যুগ । তাদের মার্কামারা স্লোগান হচ্ছে-
যত রকম অকাজ কুকাজ / সব করেছে মগনলাল মেঘরাজ, আর যত দোষ মন্দার বোস। কি ঠিক বলছি তো?’
আপনি জানলেন কি করে যে আমি ফেলুভক্ত?
‘জানবো না কেন, আপনি তো ফলো দ্য ফেলিওরস নামক নিষ্কর্মা ফেসবুক গ্রুপের সবজান্তা দেবরাজ বাবু’।
একটু ভুল হল, গ্রুপের নাম ফেলুদা ফলোয়ার্স …
‘ওই হল মশাই, আমি কি জানিনা না নাকি । জনাকতক আধদামড়া বয়েসের লোক, যাদের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, তারা সব শিং ভেঙ্গে বাছুরের দলে ভিড়েছে, আর বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মাথাগুলো চিবিয়ে খাচ্ছে । তাদের নিজেদেরও কোন অ্যাচিভমেন্ট নেই জীবনে আর ছোটদেরও ভুলভাল রাস্তা দেখাচ্ছে । ওই ফলো দ্য ফেলিওরসই আপনাদের গ্রুপের ঠিক নাম বুঝেছেন । যে দেশে এমনিতেই মানুষের জীবনে এতরকম সমস্যা সেখানে একটা গপ্পের চরিত্রকে নিয়ে এই বাড়াবাড়ির কোন মানেই হয় না । তাও যদি বুঝতুম আপনারা বইটই পড়ায় উৎসাহ দিচ্ছেন । এরপর দেখবেন যারা জীবনে কোনদিন একলাইন ফেলুদা পড়েনি তারাও নিজেদের বিরাট ফেলুভক্ত বলে ক্লেম করছে। তখন কতজনকে রোজ গ্রুপে অ্যাড করবেন?’
এই পর্যন্ত বলে মাখন টোস্টে একটা পেল্লায় কামড় বসালেন মন্দার বোস । ইতিমধ্যে আমাদের গ্রুপকে এবং বকলমে আমাকে গালাগাল দেওয়ায় আমার মেজাজ গরম হয়ে গেসলো । আমি খানিক তেরিয়া হয়েই বললাম –
তাও তো এলাহাবাদে আপনাদের মত সো কল্ড অলৌকিক প্রক্রিয়ায় সম্মোহনের সাহায্যে রোগ চিকিৎসার জঘন্য কারবার খুলে বসিনি মশাই। সেই বা কম কি?
‘না তা করেন নি, তার বদলে সো কল্ড বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ফেসবুকের সাহায্যে নস্টালজিয়ায় সুড়সুড়ি দিয়ে মানসিক রোগ চিকিৎসার এক জঘন্য কারবার খুলে বসেছেন। হ্যাঁ টাকা পয়সার ব্যাপারটা এতে নেই কিন্তু বাকিটা একই । কোন ফারাক নেই’।
কাঁচের প্লেটে চা ঢেলে তাতে সশব্দে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে, আমি গুম মেরে গেছি দেখে একটু নরম হয়ে ভদ্রলোক বললেন –
‘হাজরা কি বলেছে, আমরা এলাহাবাদে লোককে বোকা বানাতাম ? একদম বাজেকথা। লোককে বোকা বানাবার দরকার হয় না, লোকে এমনিই বোকা । ব্যাপারটা স্রেফ বুঝে নিতে হয় । এই যে সেদিনের ছোকরা রামরহিম, কি ভেবেছেন? ও এই লাখ লাখ লোককে বোকা বানিয়েছে । মোটেই না । একজন মানুষ এতজনকে বোকা বানাতে পারে না । এরা এমনিই বোকা । বোকা পাঁঠার চেয়েও বড় বোকা । এই মানুষরূপী গরু গাধা ছাগলদের তো আর আলাদা করে জনগণনা হয় না, তাই আমরা মাঝে মাঝে একটু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই এই মহান গণতান্ত্রিক দেশের একটা বিরাট অংশই আসলে এই দলের । আমরা আসলে সোশ্যাল ইন্ডিকেটারের কাজ করি । কিন্তু হিরো হয়ে যায় হাজরা আর ফেলু মিত্তির’।
তা আজকাল আপনি কি করছেন?
‘আপাতত গ্লোব ট্রটারদের আসল গুরুদেব যিনি তাঁর কাছে শিক্ষানবিশি করছি । এখান থেকে তাঁর কাছেই যাবো । তার আগে এক প্যাকেট দামী সিগারেট জোগাড় করতে হবে কোন দোকান থেকে । ‘গুরুদেব সিগারেট পছন্দ করেন ।’
ও আচ্ছা। তা ইনি আবার কিনি?
‘আপনাকে বললে কি চিনতে পারবেন।আপনার দৌড় তো একুশ নম্বর রজনীসেন রোডেই শেষ । ফেলুদা বলতেই আপনারা অজ্ঞান । আমার গুরুদেব থাকেন বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনে । নাম ঘনশ্যাম দাস । এককালে বাঙালীরা তাকে ঘনাদা নামে চিনতো, আর সারা দুনিয়ার লোক তাঁকে ডস বলে জানে । যাকগে অনেক দেরী হয়ে গেল, ওদিকে গুরুদেবের ক্লাস আরম্ভ হয়ে যাবে, আমি উঠি ।
চা আর টোস্টের দাম চুকিয়ে আমরা উঠে পড়লাম । মন্দার বোস আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন ‘যাওয়ার আগে আপনাকে একটা সাজেশান দিয়ে যাই, যে কোন যায়গায় মিত্র কথাটা থাকলেই তাকে সন্দেহ করবেন । চলি ভাই’।
চাঁদনিচকমুখী একটা চলন্ত বাসের পিছনের দরজায় একলাফে ঝুলে পড়ে বাস ট্রাম ট্যাক্সির ভিড়ে হাওয়া হয়ে গেলেন মন্দার বোস ।
ডেকার্স লেন থেকে বেরিয়ে একটা পান সিগারেটের দোকানের সামনে আমরা দু তিন মিনিট অপেক্ষা করেছিলাম । মন্দার বোস বাসে চেপে হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঠিক পরেই একটা চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে দেখি পানের দোকানদার রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে আর উত্তেজিত হয়ে কি যেন খোঁজাখুঁজি করছে । খবর নিয়ে জানা গেল ওর দোকানের সামনে সাজিয়ে রাখা দুটো বড় ডানহিল সিগারেটের প্যাকেট কে বা কাহারা গাপ করে দিয়েছে । আমার মনে পড়ে গেল মন্দার বাবু সিগারেট ‘জোগাড়’ করবার কথা বলছিলেন বটে । কিন্তু সেটা কি ভাবে করবেন তা বলেন নি । তবে কি উনি যখন আমার কাঁধে যখন চাপড় মারলেন তখনই … আর তাই সঙ্গে সঙ্গে বাসে উঠে পড়লেন ! আমি তো ওঁর সঙ্গেই ছিলাম, কিছু দেখতে পেলাম না কেন ? প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষ দেওয়া তো ঠিক নয় । তবে যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয় তাহলে টঙের ঘরে বসে ওই ডানহিলে এখন সুখটান দেবেন মহান গ্লোব ট্রটার ঘনাদা ।
মন্দার বোসের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের কথা এক বন্ধুকে বলেছিলাম । সে জানতে চাইল ‘উনি কি বেঁচে আছেন’? কারণ রামদেওরা থেকে জয়সলমের যাওয়ার পথেই উনি তো চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে অক্কা পেয়েছিলেন । এই কথাটা আমিও বেশ মোলায়েম ভাবেই জিজ্ঞেস করেছিলাম ওঁকে। উত্তরে উনি খেঁকিয়ে উঠে বলেছিলেন –
‘কেন মশাই, আপনাদের ফেলু মিত্তির হিরো বলে তার গুরু শার্লক হোমস রাইখেনবাখ জলপ্রপাত থেকে নীচে পড়ে গিয়েও প্রাণে বেঁচে যাবেন আর আমি ভিলেন বলেই এত ডেয়ার ডেভিল চরিত্র হয়েও সামান্য ট্রেন থেকে পড়েই আমাকে অক্কা পেতে হবে? ভাল মজা তো! এই জন্যই বলছিলুম আপনারা ফেলুভক্তরা ভয়ানক একচোখো’।
আমি আমতা আমতা করে বললাম –
না আপনি পড়ে যাওয়ার সময় বিকট চীৎকার করে উঠলেন কিনা, তাই আমরা ভেবেছিলাম …
‘কি? মন্দার বোস পটল তুললো ? আরে তখন ট্রেন চলছে মরুভূমির ভেতর দিয়ে, আমি পড়েছিলাম বালির ওপর, মরবো কি মশাই, হাত পাও ভাঙ্গে নি’।
তবে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন কেন ?
অ, ওটা একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছিল। আমি পড়ে গেসলাম একটা ফণী থুড়ি শনিমনসার ঝাড়ের ওপরে । ফলে আমার পশ্চাদ্দেশে অ্যাট এ টাইম গোটা পঞ্চাশেক কাঁটা ফুটে যায়, তাই আমি যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম । কাঁটা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে কিছুটা সময় লেগে গেল, নাহলে ঠিক সময়ে কেল্লায় পৌঁছে ফেলু মিত্তিরের জারিজুরি ভঙ্গ করে দিতুম। শালা মন্দার বোস কে চেন না ।
।। ২ ।।
পিছন থেকে দেখেই চিনেছিলুম মহাশয়কে, লম্বা জুলপি আর মাথায় টাক। আর তাই তক্কে তক্কে পিছু নিয়েছিলুম ।
বনমালীনস্কর লেনের এঁদো গলিতে যখন সুট করে গিয়ে সেঁধালেন তখন আর বুঝতে বাকি রইল না মন্দার বোসের গন্তব্যটি কোথায় ।
রাস্তায় একটু নিরাপদ দূরত্ব রেখে অনুসরণ করে বুঝলুম আমার অনুমান নির্ভুল ।
জঞ্জালের খাসমহল এই রাস্তায় বাহাত্তর নম্বর মেসবাড়ির দরজা হাট করে খোলাই থাকে। চাকরকে দিয়ে টঙ্গের ঘরে খবর পাঠিয়ে মন্দারবাবু বসলেন আড্ডা ঘরের চৌকিতে। আমিও সেই সুযোগে দরজার পিছনে গিয়ে সেঁধোলুম। যদিও এ মেসের গৌর, শিবু, শিশির সকলকেই চিনি, কিন্তু যা মনে হল ওরা এখন বাড়ি নেই। একটু পরেই টঙ্গের সিঁড়িতে চটির শব্দ পেয়ে বুঝলুম তিনি নামছেন। দরজার আড়াল থেকেই দেখতে পেলুম আদি অকৃত্রিম প্রাতঃস্মরণীয় ঘনাদা ওরফে ঘনশ্যাম দাস ওরফে ডস ঘরে ঢুকে তাঁর মার্কামারা আরামকেদারায় বসলেন। ঘনাদা ঘরে ঢোকা মাত্রই মন্দার বোস হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং প্রায় মিলিটারি কায়দায় ঘনাদাকে একটা স্যালুট ঠুকলেন। ঘনাদার ঠোঁটের কোণে একটা হাল্কা হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
‘তারপর মিস্টার গ্লোব ট্রটার, কি মনে করে’?
‘ও কথা বলে আর লজ্জা দেবেন না স্যার’ জিভ কাটলেন মন্দারবাবু। ‘নেহাত ঠেকায় পড়ে ওই গ্লোব ট্রটারের ভুমিকায় নামতে হয়েছিল, কোন হোমওয়ার্ক ছাড়াই, আচ্ছা আপনিই বলুন, ম্যাট্রিকে ভূগোলে ছাপ্পান্নই পাই কি ছিয়াশি, আফ্রিকায় যে নেকড়ে নেই এটা কি জানা সম্ভব’?
‘তাই নাকি’? ঘনাদা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন, আর সেই অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে দিলেন মন্দার বোসের দিকে। মন্দারবাবু প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে বের করলেন একটা নতুন সিল করা ডানহিল সিগারেটের প্যাকেট। সেটা খুলে একটা সিগারেটের মাথাটা খানিক বের করে এগিয়ে ধরলেন ঘনাদার দিকে। ঘনাদা অন্যমনস্ক ভাবেই আলগোছে সিগারেটটা টেনে নিয়ে ঠোঁটের এককোণে গুঁজে দিলেন। মন্দার বোসের অন্য পকেট থেকে ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে একটা টেক্কা মার্কা দেশলাই। কাঠিতে অগ্নিসংযোগ করে এগিয়ে দিতেই ঘনাদা সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে লম্বা একটা সুখটান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন –
‘তুমি ঠিক জানো আফ্রিকায় নেকড়ে নেই’?
‘আজ্ঞে ঠিক বুঝলাম না …’ মন্দার বোসকে দৃশ্যতই বিভ্রান্ত দেখায়। ‘মানে লালমোহনবাবু তো সেইরকমই বললেন, আর এত কনফিডেন্টলি বললেন যে প্রথমে তর্ক করেও পরে কনফিউজড হয়ে চুপ মেরে গেলুম’।
‘তোমাদের নিয়ে ওই তো মুশকিল। বইপত্রও পড় না, কোন খোঁজখবরও রাখো না। গুল মারার মত একটা খাঁটি আর্টফর্মকে মিথ্যাচারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেল, আর সেটা দিয়ে লোককে ঠকিয়ে নিজেকে বুদ্ধিমান বলে মনে কর। গুল দেওয়ার মত খাঁটি আর্টের কদর করতে গেলে শুধু চালাকি দিয়ে চলবে না হে, মগজে খানিকটা গ্রে ম্যাটারও থাকা দরকার। তোমার ইম্যাজিনেশান আছে ঠিকই কিন্তু বাকি জিনিসগুলো একেবারে কহতব্য নয়’। সিগারেটে পরপর গোটাকতক লম্বা টান দিয়ে প্রায় ফিল্টারে পৌঁছে সেটাকে ছাইদানে ফেলে দিলেন ঘনাদা।
‘তাহলে কি আফ্রিকায় নেকড়ে আছে’? বিস্মিত মুখে প্রশ্ন করলেন মন্দার বোস।
‘আগে হয়তো থেকেও ছিল না, কিন্তু এখন আছে’।
‘লে হালুয়া! ব্যাপারটা একেবারেই মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে স্যার, আফ্রিকায় নেকড়ে থেকেও ছিল না এ আবার কিরকম কথা? মন্দার বোস এখন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত।
ঘনাদা আবার যথারীতি ফিরে গেছেন তাঁর নিজস্ব চিন্তার জগতে। মন্দার বোসের প্রশ্ন তাঁর কানে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। তিনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে চললেন ‘কি দিনকাল যে পড়লো, এই সেদিনের ছোকরা লালমোহন, ওই গড়পাড়ে থাকে, উটের পাকস্থলীতে জল থাকে লিখেও দিব্যি করে খাচ্ছে সে কিনা নেকড়ে নিয়ে কনফিউজ করে দিচ্ছে অন্যদের। আর ড্যামেজ কন্ট্রোলের আর্টও এরা ভুলে মেরে দিয়েছে, নয়তো জানেই না। “কি কেমন দিলুম … ঐযে আফ্রিকায় নেকড়ে” ছিঃ, ফেলুর মত বুদ্ধিমান লোককে এই দিয়ে যে বোকা বানানোর কথা ভাবে সে নিজেই আস্ত গবেট’।
‘আপনি আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু দিলেন না ঘনাদা’ মন্দারকে এবার কিছুটা অধৈর্য মনে হল। ঘনাদা একবার ঘড়ীর দিকে দেখলেন, তারপর আবার হাত বাড়িয়ে দিলেন। মন্দারবাবু ডানহিল সিগারেটের প্যাকেট থেকে আর একটি সিগারেট সামান্য বের করে এগিয়ে দিতে উনি গোটা প্যাকেটটাই মন্দারের হাত থেকে নিয়ে তার একটি ঠোঁটে গুঁজে বাকিটা অন্যমনস্কভাবে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে আরামকেদারা ছেড়ে উঠে পড়লেন।
দু তিন কদম এগিয়ে থেমে গিয়ে মন্দারের দিকে ঘুরে ঘনাদা বললেন –
‘আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরভাগের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে একরকমের শিয়াল দেখতে পাওয়া যায়। এর নাম গোল্ডেন জ্যাকেল। বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকেই মনে করেন এই শিয়ালের একটি ধারা আসলে গ্রে উলফের বংশজাত। ইদানিং বছর পনেরো আগে এই প্রজাতির ডি এন এ পরীক্ষা করে জানা গেছে এরা আসলে শিয়াল নয় নেকড়েবাঘ। জীববিজ্ঞান গত শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী এরা নেকড়ে বাঘের একটি সাবস্পিসিস। তাই এখন এদের গোল্ডেন উলফ বলা হয়। কাজেই উত্তরআফ্রিকায় নেকড়ের চাষ হয় বললে সেটা যে খুব ভুল বলা হত এমন নয়’। কিন্তু তুমি তো আবার ভূগোলে ছাপান্ন থুড়ি গোল, ফলে উত্তর ছেড়ে ফেঁদে বসলে মধ্য আফ্রিকার গপ্প। টাঙ্গানিকার পরিবর্তে যদি বলতে তিউনিশিয়া, আলজিরিয়া কি লিবিয়া তাহলেও কিন্তু খুব একটা ভুল বলা হত না । যাকগে তোমাদের গুল মারার উদ্দেশ্য তো আমার মত ঠিক আর্ট ফর আর্ট সেক নয়, বরং মিথ্যাচার করে ক্রাইমের সুবিধে করে নেওয়া, ফলে নিস্কাম কর্মের মত নিস্কাম গুল মারার ব্যাপারটা কোনদিনই তোমাদের মাথায় ঢুকবে না’।
হতবাক মন্দার বোস কে রেখে তালতলার চটির শব্দ তুলে সিঁড়ি দিয়ে ঘনাদা আবার তাঁর টঙ্গের ঘরে উঠে গেলেন ।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।