26 May

কোনও শিল্পই নতুনত্ব ছাড়া বাঁচে নাঃ মালবিকা মিত্র

লিখেছেন:প্রতিভা দাস


 ডা.মালবিকা মিত্রের সঙ্গে আলাপে প্রতিভা দাস

[কোনও শিল্পই প্রয়োগ ছাড়া বাঁচে না,নতুনত্ব ছাড়া বাঁচে না – এমনটাই মনে করেন  কথক নৃত্যে সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ডা.মালবিকা মিত্র। তাঁর মতে ‘কথক’ হল নৃত্যের এমন একটা ফর্ম যার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছনো সম্ভব। আর কথক শিক্ষা? সেজন্য কোনও শর্টকার্ট পদ্ধতি নেই বলে মনে করেন তিনি।এজন্য চাই পরিশ্রম এবং রেওয়াজ, যার মাধ্যমে শিল্প ভাবনা তাঁর নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে রক্তে প্রবাহিত হবে,সে শিল্পী হিসাবে সে সম্পূর্ণ হবে। ‘গল্পের সময়’-এর হয়ে এই সব কথা শুনলেন তাঁরই  ছাত্রী প্রতিভা দাস।]

প্রতিভা দাসঃ শুনেছি তিন বছর বয়সেই আপনি নাচ শিখতে শুরু করেছিলেন। এত ছোটবেলায় কিভাবে নাচ শিখতে গেলেন? আপনার বাড়িতে কি নৃত্য বা সঙ্গীতের পরিবেশ ছিল?

ডা.মালবিকা মিত্র

ডা.মালবিকা মিত্রঃ হ্যাঁ, তিনবছর বয়সেই নাচ শিখতে শুরু করেছিলাম। নাচ সম্ভবত আমার মধ্যে ছিল,কারণ নাচ ছিল আমার মায়ের স্বপ্ন,তাঁর কল্পনা। মা অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়ার ফলে তাঁর প্রতিভার কোনোরকম প্রকাশের সুযোগ পায়নি। তাই মায়ের স্বপ্ন ছিল তাঁর সন্তান,কন্যা সন্তান হলে তাকে নাচ শেখাবেন। হয়ত তাঁরই এই একান্ত চাওয়া বা স্বপ্ন আমার মধ্যে জন্মের আগেই প্রভাব ফেলেছিল। যার ফলে জন্মের পরে আমি আমার মা-বাবার কাছে গল্প শুনেছি যে, কোনরকম সংগীতের রেডিও বা কিছুতে সংগীত বাজলেই আমি তার সঙ্গে নড়াচড়া করার চেষ্টা করতাম এবং সেটা আমি আমার মধ্যে অনুভব করতাম,এরকমটা ওঁরা মনে করতেন। আর একটা কারণ,আমার পরিবারে তাঁদের এই প্রতিভা সামনে আসার সুযোগ পায়নি। আমার মা গান গাইতেন, সেতার বাজাতেন, গিটার বাজাতেন এবং এসরাজ বাজাতেন। আমার বাবা গান গাইতেন। দুজনেই ক্ল্যাসিক্যাল গাইতেন এবং রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল গীতি ইত্যাদিও গাইতেন। তার সঙ্গে বাবা সরোদ ছাড়া সবরকমের স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে জানতেন। তো এই একটা অবস্থা আমি পরে হয়ত আমার পড়াশুনোর বুদ্ধি দিয়ে বুঝেছি যে, জেনেটিক্যালি ডিটারমাইন্ড এবং আমি তার পরবর্তীকালে খোঁজ করে জেনেছি যে আমার মা বাবা দুই পরিবারেই চার পুরুষ ধরে সংগীতের চর্চা ছিল। নৃত্য অবশ্যই ছিল না কারণ তখনকার দিনে নৃত্যের উপস্থিতি বা সেটার চর্চা করা পরিবারে ঠিক মত মেনে নেওয়া হত না। যার ফলে  কন্ঠ সংগীত ও যন্ত্র সঙ্গীত  সংগীত চর্চা  ছিল। এবার আমার এই সংগীত- নাচের প্রতি যে একটা স্বাভাবিক ঝোঁক সেটা দেখে নিজে থেকেই কিছু কিছু গান গাইতেন। মা,বাবা দুজনেই গান গাইতেন এবং তার সঙ্গে আমাকে নাচতে উৎসাহ দিতেন এবং তাঁদেরই উৎসাহে আমাকে তিনবছর বয়সে নাচের স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়।আকাশবাণীর প্রভাতী উদ্বোধনীর সুর থেকে শুরু করে সারাদিনের বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠান শিশুকাল থেকে আমায় প্রভাবিত করেছিল। বাবা ভোর পাঁচটায় রেডিওর সুইচ অন করে দিতেন এবং প্রথম ভোরের যে ধ্বনি দিয়ে রেডিও খুলত সেই ধ্বনি, অনুষ্ঠিত ক্লাসিক্যাল থেকে শুরু করে যতরকমের গান হত সবকিছুই আমি শিশু অবস্থাতেই শুনতে অভ্যস্থ ছিলাম। আর সেই থেকেই আমার সংগীত সত্তার মধ্যে প্রবেশ।

ছোটবেলায় মালবিকা মিত্র

প্রথম গুরু স্বর্গীয় অক্ষয় কুমার বিশ্বাস। যিনি উদয়শঙ্কর শৈলীর শিক্ষা দিতেন। যেখানে সব ধরণের শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রাথমিক অংশ ছাড়াও উদয়শঙ্কর  শৈলীর এবং লোকনৃত্যের সামান্য শিক্ষাও আমি লাভ করি। সেই সময়ের বিখ্যাত “মুরারী স্মৃতি সংগীত ও নৃত্য” প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ৫-৯ বছর বয়স অবধি নৃত্যে সমস্ত বিভাগে জয়ী হতাম প্রথম স্থানে। সেই সাফল্য নাচের প্রতি আমার উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। দশ বছর বয়স থেকে আমার কথক নৃত্যে (স্পেশালাইজেশন) পারদর্শী হওয়া শুরু হয় স্বর্গীয় পণ্ডিত রামগোপাল মিশ্রের সন্ন্যিধ্যে। আমার সৌভাগ্য যে আমার প্রথম গুরু আমাকে সহস্তে স্বর্গীয় রামগোপাল মিশ্রের (জয়পুর ঘরানা) কাছে সমর্পণ করেছিলেন। এখান থেকে আমার কথকের পথ চলা শুরু।

প্রতিভা দাসঃ আপনি একজন ডাক্তার,পাশাপাশি একজন নৃত্যশিল্পী। চিকিৎসাবিদ্যার পাশাপাশি কিভাবে নাচের অনুশীলন চালিয়ে গেছেন?

ডা.মালবিকা মিত্র (কমবয়সে)

ডা.মালবিকা মিত্রঃ ডাক্তারি আমি পাশ করেছি এবং ইনটার্নশিপ, হাউস জব সবকিছু সম্পূর্ণ করেছি। রেজিস্ট্রেশনও হয়েছিল। কিন্তু নাচ ছিল আমার প্রাথমিক ভালোবাসা। নাচ শুরু আমার পড়াশোনা, স্কুল কলেজের পড়াশোনা শুরু হওয়ার অনেক আগে। আমি চার বছর বয়সে মঞ্চে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাই এবং সাড়ে চার বছর বয়সে আমি ভর্তি হয়েছি ক্লাস ওয়ানে স্কুলে। হয়ত তার জন্য নাচ আমার কাছে একটা প্রাথমিক ভালবাসার জায়গা ছিল। সেটা আমার জীবনে এমন একটা অঙ্গ হয়ে ছিল যে আমাকে  আলাদা করে কিছু করতে হচ্ছে তা ভাবার দরকার হত না। ওটা ছাড়া আমি বাঁচতেই পারতাম না। কাজেই পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ তো চলেইছে, সেইসঙ্গে আমার স্কুল এবং বাড়ি দু-জায়গা থেকেই সম্পূর্ণ সমর্থন থেকেছে। স্কুলের ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি আমার হেডমাস্টার মশাই আমাকে লাস্ট ক্লাসে (সাধারণত শুক্রবার যেহেতু আমি আমার গুরুর কাছে কথকের ক্লাসের জন্য যেতাম সেজন্য) উনি আমাকে একটা ক্লাস আগে ছুটি দিয়ে দিতেন। এবং সাধারণত সেটা খেলার ক্লাস রাখা হত রুটিনে এবং আমি ক্লাস সিক্সের পর থেকে যখন যে ক্লাসে উঠতাম এই সাহায্যটা স্কুল থেকে পেয়েছি। তো এটা একটা অন্যরকম অনুভূতি। যেন ঈশ্বর চেয়েছেন আমাকে ওই দিকে এগিয়ে দিতে।সেজন্য আমার কাজগুলো, সাহায্যগুলো আমার পাশ থেকে হয়েই এসেছে। আর চিকিৎসা বিদ্যায় ভর্তি হওয়ার একটা বড় কারণ আমার বাবার অনুপ্রেরণা। কিন্তু আমাকে কেউ জোর করেন নি। আমার নিজের মনে হয়েছিল আমি ডাক্তারি করতে চাই কারণ তখনকার সামাজিক অবস্থা যেটা ছিল সেখানে নাচকে সম্মানজনক পেশা হিসাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে ধরা হত না। কিন্তু আমি যখন ডাক্তারি পড়তে শুরু করি তার মাঝে সামাজিক পরিস্থিতি বদলে যায়। সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং উৎসব শুরু হয় যেখানে নাচকে প্রাধান্য এবং সম্মান দুটোই দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে সামাজিক মানসিকতারও পরিবর্তন হয়। যতদিনে আমি ডাক্তারি পাশ করি ততদিনে আমার গুরু আমাকে মোটামুটি শিল্পী হিসাবে এগিয়ে দিয়েছিলেন।

যদিও পড়াশোনার সঙ্গে এটা চালানো নিশ্চয়ই একটু শক্ত ছিল। কিন্ত ইচ্ছে থাকলেই আমার মনে হয় কোনো না কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায়। আমি পরিশ্রম করতে কখনো পিছুপা হতাম না। সপ্তাহে সাতদিনই আমি ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম। ছদিন কলেজে যেতাম আর সপ্তমদিন রবিবারে আমার গুরুর কাছে যেতাম আমার শিক্ষার জন্য। তো এইভাবে ওটা চলতেই থাকল। তাছাড়াও আমার বাড়ির সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমার দ্বিতীয় প্রফেশনাল পারফরমেন্স ছিল আমার এমবিবিএস পরীক্ষার সাতদিন আগে এবং আমার মা-বাবা আমাকে বারন করেন নি। বলেছিলেন,তুমি যদি করতে চাও তুমি দুটোই কর, পরিশ্রম কতটা করবে সেটা তুমি বোঝ। আর একটা জিনিস ছিল আমার সময়টা। আমি যেমন আমার যাতায়াত বাড়ি থেকে করতাম। যেহেতু হোস্টেলে থাকলে নাচ প্র্যাকটিস করতে পারব না সেজন্যে সেখানে আমার সময় যেত ঠিক কথা কিন্তু আমি কখনো কোচিং ক্লাসে পড়িনি। আমি সবকিছু নিজে পড়তাম যাতে কোচিং ক্লাসের সময়টা এক্সট্রা আমার নষ্ট না হয়। এইভাবেই আমি সবকিছুই চালানোর চেষ্টা করেছি। এবং আবারও আমি বলব, ঈশ্বর সহায় না হলে হয়ত এসব হোত না। কাজেই আমি মনে করি আমার ঈশ্বর এই কাজ দিয়ে হয়ত পাঠিয়েছিলেন। সেজন্যই হয়ত আমার এই কাজটা করা  সম্ভব হয়েছে। খুব সহজে হয়েছে আমি বলব না, কিন্তু হয়ে গেছে।আর একটা কথা না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে হাউসস্টাফশিপ শেষ করার পর আমার মনে একটা এমনই অনুভূতি হয় যে, আমি নাচ ছাড়া বাঁচতে পারব না। আর আমি এমন ডাক্তার হতে চাইনি যাকে পেশেন্ট তার দরকারের সময় পাবে না। সেজন্য আমাকে একটা ডিসিশন নিতেই হত। তখন আমি ঠিক করি যে, আমি নাচটাই সম্পূর্ণ ভাবে করব,ডাক্তারি করব না। আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন ডাক্তার হতে চাইনি বলে ডাক্তারি করা ছেড়েছি।কেননা ওই সময় আমি বুঝতে পারি যে, নাচ সম্পূর্ণ মন প্রাণ দিয়ে করতে চাইলে ডাক্তারি সেইভাবে করা যাবে না। দুটোকে সমানভাবে সমান মনোযোগ দিয়ে চালানো সম্ভব নয়,আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন আমাকে ঠিক করতে হয় যে কোনো একটা করব এবং সম্পূর্ণ ডেডিকেশন দিয়ে করব, মনপ্রাণ দিয়ে করব। সেখানে আমার কাছে নাচটা আগে এসে দাঁড়ায়। আরও একটা বড় কারণ যে আমার কাছে কিছু প্রোগ্রামের আমন্ত্রণ জানানো শুরু হয়ে গিয়েছিল যেটা আমার কাছে ছিল অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। আর একজনের কথা এখানে উল্লেখ করার বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করছি সেটা হচ্ছে স্বর্গীয় ডক্টর সুনীল কোঠারী। উনি সেই সময় কলকাতায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্য বিভাগে ছিলেন। উনি সেই সময় একটা অনুষ্ঠানে দেখে আমাকে খুব জোর করেন যে “তোমার মধ্যে যে ক্ষমতা রয়েছে সেটা তুমি নষ্ট হতে দিও না তুমি নাচটাই কর।” তিনি আমার কাছে খুব বড় অনুপ্রেরণা। এবং আমার চলার পথে অনেক সহায়তা, অনেক উপদেশ এবং অনেক মার্গ দর্শন ওনার কাছ থেকে পেয়েছি যেটা আমাকে এই রাস্তায় এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক সাহায্য করেছে।

প্রতিভা দাসঃ এই মুহূর্তে ভারতে কথক নৃত্যে আপনি প্রথম সারির একটি নাম। অনেকে বলেন শুধু নামটাই যথেষ্ঠ। এই পথ চলা, এই সাফল্য, কথক নৃত্যে এমন দখল কিভাবে সম্ভব হল?

গুরু স্বর্গীয় রামগোপাল মিশ্র

ডা.মালবিকা মিত্রঃ কথক নৃত্যে বা যে কোনো বিষয়ে সাফল্য আসার পিছনে অনেক, অনেক,  অনেক কিছু থাকে – যার প্রাথমিক শর্ত হল পরিশ্রম। যদি সফলতার পিছনে এক এক করে কারণগুলো ভাবি তাহলে তার প্রথম কারণ আমার মা-বাবার অনুপ্রেরণা,তাঁদের সার্বিক সমর্থন। মা সব সময়ই আমার সাথে থাকতেন, আমার প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার গুরু স্বর্গীয় অক্ষয় কুমার বিশ্বাস। তিনি নিজে হাতে আমাকে নিয়ে গিয়ে কথকের গুরু স্বর্গীয় রামগোপাল মিশ্রের কাছে দিয়ে এসেছিলেন। এটা জীবনের কত বড় প্রাপ্তি তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। এর পরে আমার সেই গুরু স্বর্গীয় রাম গোপাল মিশ্রের কাছেও আমি সন্তান স্নেহে শিক্ষা পেয়েছি এবং সে শিক্ষার মূল্যায়ন করার মত ক্ষমতা আমার নেই। শুধু এইটুকু আমি বলতে পারি আমার মা-বাবা আমায় বলে দিয়েছিলেন যে, “গুরু যা বলবেন তা কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে।”

আমি এমনিতেই খুব শান্ত এবং বাধ্য ছিলাম।গুরুজীর কথা মেনে চলে আমি রেওয়াজ করতে শিখেছি।উনি বলেছিলেন, প্রত্যেক বোল অন্তত ১০বার, তৎকার অন্তত ২০মিনিট এবং লড়ীর প্রত্যেক পাল্লা ২০বার করে অনুশীলন করতে। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে আমি রেওয়াজ করতে শিখেছি।ডাক্তারি পড়ার সময় আমার সময়ের অভাব দেখে উনি ৪৫মিনিট রেওইয়াজের পদ্বতি তৈরি করে দিয়েছিলেন, যাতে আমি ১ থেকে দেড় ঘন্টা নাচার মতো অনুষ্ঠানে দম রাখতে পারি।ডাক্তারি পড়ার শুরুর দিকে ১৯৭৪ সাল থেকে উনি আমাকে বিভিন্ন পেশাদার মঞ্চে আনুষ্ঠানের সুযোগ দিতে শুরু করেন।

গুরুজি একবার বললেন যে, “একটা লড়ীর প্রত্যেকটা পাল্লা ছোটো গুলো ৫০ বার করে বড় গুলো ২৫ বার করে রেওয়াজ করতে হবে এবং গুনতে যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে আবার ১ থেকে গুনতে শুরু করতে হবে।” আমি সেই কথাটাও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতাম। আজকে বুঝতে পারি একটা ১২-১৩ বছরের মেয়ের কনসেনট্রেশন তৈরি করার জন্য উনি ওই কথাটা বলেছিলেন এবং আমি আজকে অনুভব করি যে যে সেটা মেনে চলেছে সে পেরেছে। আর যে সেটাকে মানতে পারেনি সে কিছু পায়নি। তো এই অবস্থা গুলোর মধ্যে দিয়ে গিয়ে আমি রেওয়াজ করতে শিখেছি। একজন একটি ছোট বাচ্চাকে রেওয়াজ করতে বললে অনেক সময় সে অতক্ষণ রেওয়াজ করার ধৈর্য্য রাখতে পারে না। কিন্তু  ওই ২০ বার ৫০ বার যদি সত্যি সত্যি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা যায় তাহলে রেওয়াজ আপনা থেকে হয়ে যায়। এরপরে যখন আমি ডাক্তারি পড়ছিলাম তখন উনি আমায় বললেন, “সময় নেই বেশী। ৪৫ মিনিট যদি তুমি সময় পাও সেই প্র্যাকটিসটা তুমি এমন ভাবে করবে যাতে দম না ফেলতে পারো।”

গুরু স্বর্গীয় ওমপ্রকাশ মহারাজ জী

সেটাও আমি মেনে চলতাম। কারণ উনি বলেছিলেন, “ওই ৪৫ মিনিট প্র্যাকটিস করে দেড় ঘন্টার পোগ্রামে নাচার মত দম রাখতে হবে।” তখন উনি আমাকে অলরেডি পোগ্রামে প্রেজেন্ট করতে আরম্ভ করেছেন। এরপরে ওনার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হলাম, কারণ ১৯৭৯ সালে উনি মারা যান। তারপরে আমি রেওয়াজ একাই করতাম। কিন্তু হাউসজব চলাকালীন হোস্টেলে থাকতেই হত। ৬ দিন পুরো ডিউটি করার পরে ৭ দিনের দিন বাড়িতে ফিরে আগে তিন ঘন্টা রেওয়াজ করে তবে ঘুমোতাম যাতে আবার বিকেল বেলা হসপিটালে চলে যেতে পারি।  তবে আমার বন্ধুদেরও সহযোগিতা ছিল এই যে, ওই ১২ ঘন্টা তারা আমাকে ছেড়ে দিত প্র্যাকটিস করার জন্য। সবক্ষেত্রে আমি এত সহযোগিতা পেয়েছি সবার কাছ থেকে সেটা আমাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তারপরে ১৯৮২ সালে আমার পরের গুরু স্বর্গীয় ওমপ্রকাশ মহারাজ জীর সংস্পর্শে আসি। তখন ওনার কাছ থেকে পুরোনো দিনের রেওয়াজের গল্প শুনতে থাকি। ১২ ঘন্টা ১০ ঘন্টা রেওয়াজ। আমার অত ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু যখন আমি ঠিক করলাম যে, আমি নাচটাই করব; তখন আমি ৫  থেকে ৭ ঘন্টা সপ্তাহে ৫ দিন রেওয়াজ করতাম। ২দিন কিছু কম করতাম অথবা বিশ্রাম নিতাম। ওই মনোযোগ,মনোসংযোগ এবং রেওয়াজ করতে করতে একটা অন্তরের পরিবর্তন ঘটে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।নৃত্যের  অভ্যেস ধীরে ধীরে সাধনায় পরিণত হয়।  প্রত্যেক অঙ্গ সঞ্চালনকে যখন আমার পূজার অঙ্গ হিসেবে আমি অনুভব করতে পারি, যখন সেই রেওয়াজ  ধ্যানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। এটা সম্পূর্ণ ঈশ্বরের দান, কাজেই সেটা পেতে গেলে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ না করলে পাওয়া যায় না বলে আমার ধারণা। তো সেই ক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা আমাকে পথ দেখিয়েছে এবং আমাকে সেই ছাড় দিয়েছে যাতে আমি অন্য সব  সাংসারিক দ্বায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকতে পারি। শুধু আমার নাচের মধ্যে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে থাকতে পারি।

প্রতিভা দাসঃ ভারতের মত দেশে শিল্পকলার সঙ্গে মিশে আছে আধ্যাত্মিকতা। কথকের মত শিল্পের সঙ্গে মিশে আছে ঘরানা।অর্থাৎ কৃষ্টি থেকে শিল্পের সৃষ্টি।গোটা ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

একটি নৃত্যানুষ্ঠানে ডা.মালবিকা মিত্র

ডা.মালবিকা মিত্রঃ ভারতে সংগীত শব্দটাকে বিশেষভাবে দেখা হয় কারণ সংগীত মানে শুধু গান নয়। “গীতম্‌, বাদ্যম্‌ তথা নৃত্যম চ ত্রয়ম সংগীতমুচ্চতে”– এই তিনের মিলনে যে সংগীত তা সব সময়ই ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত ছিল। সংগীত ছিল পূজার প্রধান মাধ্যম এবং এখনও পর্যন্ত যে মন্ত্রপাঠ করা হয় তাতে সুর থাকে। কোনো কোনো সময় ছন্দও থাকে আর পূজার উদ্দেশ্যে ভজন ইত্যাদি গানের তো চল আছেই। সেই প্রাচীন কালে সাম গান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত  ভারতীয় সংস্কৃতিকে  আধ্যাত্মিকতার একটা বিশেষ অঙ্গ হিসাবে সংগীতকে দেখা হয়। এই সংগীতের মধ্যে নৃত্যও  এক অভিন্ন অংশ।

নটরাজ রূপে ভগবান শংকর,নটবর কৃষ্ণ রূপে ভগবান কৃষ্ণ আমাদের আরাধ্য দেবতা। নৃত্যকে পূজার অঙ্গ হিসাবে মানা হয়। কারণ শরীর  মন ও আত্মা সম্পূর্ণ ভাবে সমর্পন করা হয়। যদিও আমার ধারনা গীত, বাদ্য ও নৃত্য সব ক্ষেত্রেই তা সমান ভাবে সত্যি। নৃত্য অর্থাৎ ছন্দবদ্ধ  গতি  সৃষ্টির উৎস। দ্রুত কথা আধুনিক বিজ্ঞানেও প্রমানিত।  ক্ষুদ্রতম ইলেকট্রন থেকে এ বিশ্বব্রম্বান্ডের  সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র ছন্দোবদ্ধ গতিতে চলমান। সেটা সৃষ্টির মূল এবং এখান থেকেই ভারতীয় শিল্পকলার  আধ্যাত্মিকতার শুরু। ‘নটরাজ’ রূপে ভগবান শঙ্কর    এবং  ‘নটবর’ রূপে ভগবান কৃষ্ণ আমাদের আরাধ্য দেবতা। ।  তা সেই নৃত্য পূজার এক  বিশেষ  কারণে যে নৃত্যে শরীর-মন- আত্মা একসঙ্গে সমর্পণ করা হয়।  যদিও আমি মনে  করি   করি  গীত নৃত্য বাদ্য সবেতেই করা হয়। কারণ সবেতেই সেই শরীরকে ব্যবহার করেই এই কাজগুলো করতে হয়।

প্রতিভা দাসঃ আধ্যাত্মিকতা, ঘরানা. কৃষ্টি এসব থেকে বেরিয়ে কথক নৃত্য শুধুমাত্র নৃত্য শিল্প হিসাবে প্রকাশিত হতে পারে না? ধরুন কেউ যদি মনে করেন অন্য পোশাকে, অন্য ফর্মে কথক নৃত্য পরিবেশন করবেন, তাহলে কি গেল গেল রব উঠবে?

কিষান মহারাজের সঙ্গে,মালবিকা মিত্র ও তাঁর মা

ডা.মালবিকা মিত্রঃ কথক বা যে কোনো শাস্ত্রীয় নাচ সেটা শেখার সময় একনিষ্ঠতা খুব প্রয়োজন – সেই ফর্মটাকে নিজে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্বে আনবার জন্য। কিন্তু যে কোনও শিল্পই প্রয়োগ ছাড়া বাঁচে না। নতুনত্ব ছাড়া বাঁচে না। এই নতুনত্বের মধ্যে যেগুলো তার কথকের বৈশিষ্ট্য  এবং ব্যাকরণ অনুসারী তা কথকের প্রয়োগ হিসেবে প্রহণযোগ্য। বাকি প্রয়োগকে আধুনিকে নৃত্যের অংশ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। কারন  কোনো শিল্পীর মনের ভাব প্রকাশের অধিকারকে কেড়ে নেওয়া যায় না। আমি রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, নজরুলগীতি  ইত্যাদি নিয়ে কথকের উপরেই কম্পোজ করেছি। আরও অনেক কথক শিল্পী তাঁদের আঞ্চলিক সাহিত্যের প্রয়োগ কথকনৃত্যের মাধ্যমে সার্থক ভাবে করেছেন।

প্রতিভা দাসঃ করোনাকালে অনেকেই অনলাইনে নৃত্যশিক্ষায় অংশ নিয়েছেন। কথকের মত নৃত্যশিক্ষার ক্ষেত্রে কী ভার্চুয়াল/অনলাইন ব্যবস্থায় কোনও লাভ হয়? আপনার অভিজ্ঞতা কী?

ডা.মালবিকা মিত্রঃ করোনাকাল আমাদের অনেক কিছু যেমন বঞ্চিত করেছে তেমন অনেক কিছু দিয়েছেও। কিন্তু সেই দেওয়াটা গ্রহণ করার ক্ষমতা সকলের আছে কি নেই সেটা আমি জানি না। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, অনলাইন শিক্ষার ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ একটু জটিল।অন লাইনে শব্দ ও ছবির ট্রান্সমিশনে যে ব্যবধান ঘটে তা অসুবিধা জনক।আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কিছু সিনিয়র ছাত্রছাত্রী ভিডিওর মাধ্যমে শেখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ছোটোদের কাছে তা যথেষ্ট অসুবিধা জনক হয়েছে। ভিডিও কল এবং ফোনের মাধ্যমে তাঁদের নির্দেশ দেওয়া ও সাহায্য করার চেষ্টা করেছি শুধু মাত্র অতিমারির পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায়। বর্তমানে স্বাভাবিক ভাবে শেখার সুযোগ পেয়ে তাঁরা সবাই যেন প্রান ফিরে পেয়েছে। অনলাইন শিক্ষায় লাভ হয় কি না হয় সেটা আমি বলতে পারব না, কারণ যেহেতু আমি পারি না তার মানে এই নয় যে অন্য কেউ পারবে না। যেমন সমস্যাও আসে আবার সে সমস্যার সমাধান কিন্তু তৈরি হয়ে যাবে। সেই সমাধান আমি করতে পারিনি বলে অন্য কেউ করতে পারেনি এটা আমার মনে হয় না।

প্রতিভা দাসঃ অনেক শিল্পীই নিজের নেশাকে পেশা করতে পারেন না। তাঁকে অন্য পেশার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আপনার কী মনে হয় পরিপূর্ণ শিল্পী হতে গেলে অন্য পেশা তাঁর কাছে দায় হয়ে দাঁড়ায়?

ডা.মালবিকা মিত্র

ডা.মালবিকা মিত্রঃ হ্যাঁ এই প্রশ্নটা আমার খুবই ভাল লাগল। কেননা আমি নিজেকে খুব ধন্য মনে করি এবং ভাগ্যবতী মনে করি যে, আমার নেশাকে আমি পেশা হিসাবে পেয়েছি। এবং আমার মনে হয় আমার ভাগ্য সব দিক থেকে সাহায্য করে আমাকে এ রাস্তায় টেনে এনেছে। সে জন্যে এটা আমার কাছে বিশাল পাওনা। কিন্তু যদি জীবনধারণের জন্য বাধ্যতামূলক অন্য পেশার মধ্যে যেতে হয় তাহলে সেটা  শিল্পচর্চায়  বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে আমি মনে করি। কিন্তু নির্ভর করে সেই মানুষটির কর্মক্ষমতার ওপর। এটা কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সত্যি নয়। বর্তমান যুগে ছেলেমেয়েরা ছোট থেকেই অনেকেই মাল্টিটাস্কার।এবং তারা একসঙ্গে অনেক কিছু করতে পারে এবং মনে রাখতে পারে, কন্ট্রোলও করতে পারে। যারা পারে তাদের ক্ষেত্রে হয়ত এটা সম্ভব।কথক নৃত্যকে  সম্পূর্ণ পেশা হিসাবে  গ্রহণ করে আমি কথক নৃত্যর শিক্ষা দান শুরু করি এবং এর প্রতি এক অদ্ভূত আকর্ষণ অনুভব করি। শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সার্থকতা ও তাদের শিল্পী হিসাবে উত্তরণ আমাকে সম্পূর্ণ করে তোলে। কিন্তু যখন আমি নৃত্যকে সম্পূর্ণ পেশা হিসেবে গ্রহণ করে কথক নৃত্য শিক্ষাদান  শুরু করলাম, তখন আমার ভিতর থেকে একটা অনুভূতি হতে শুরু হল যে, এটাই আমার কাজ। আমি নাচ শেখাতে খুব ভালবাসি। শুধু অনুষ্ঠান নয়, অনুষ্ঠানের আনন্দ তো আলাদা, কিন্তু শেখানোর মধ্যেও আমি আনন্দ পাই। যে কারণে আমার মনে হয়নি এটা আমার কাছে বোঝা বলে। যেহেতু আমি একই কাজ নিয়ে আমি থাকছি সেহেতু আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু অন্য  পেশাতে থাকলে এটা একটু কষ্টকর তো বটেই। তবে অসম্ভব তা অমি বলব না। আজকের দিনে যা মেধা এবং বুদ্ধি তাতে মাল্টিটাস্কার হলে তাদের মধ্যে সবই সম্ভব।

প্রতিভা দাসঃ  কথক নৃত্য তাল প্রধান অথচ অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্য সঙ্গীত প্রধান — আপনার কী মত এ বিষয়ে? এই পার্থক্য কী কথক নৃত্যের পপুলারিটি বা সকলের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়?

নৃত্যানুষ্ঠানে ডা.মালবিকা মিত্র

ডা.মালবিকা মিত্রঃ এই প্রশ্নটা আমার কাছে একটু অবাস্তব মনে হচ্ছে। কেননা তাল এবং সংগীত — এই দুটোই ছাড়া কোনো নৃত্য, কোনও শাস্ত্রীয় নৃত্যই সম্পূর্ণ হতে পারে না। বিশেষত কথকের ক্ষেত্রে এর প্রাথমিক শুরুই সংগীতের মাধ্যমে। প্রথমদিকে যদি আমরা মন্দির যুগের কথা ভাবি তাহলে আমরা এটাই দেখব যে সাধারণ মানুষকে সংগীতের মাধ্যমে আমাদের রামায়ণ- মহাভারত- পুরাণের কাহিনী কথা শুনিয়ে  শিক্ষা দেওয়া হত।অর্থাৎ  মনোরঞ্জনের মাধ্যমে মানুষকে লোকশিক্ষা দেওয়া হত। জীবনের শিক্ষা, অধ্যাত্মিক, নৈতিক আর সামাজিক শিক্ষা দেওয়া হত। কেননা আমাদের সমস্ত পুরাণ ও মহাকাব্যের গল্পগুলির মধ্যে জীবনের সত্য প্রকাশিত।

ডা.মালবিকা মিত্র

এই গল্পগুলি সঙ্গীত অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরা হত। কথক শিল্পীরা স্বয়ং গান করে নৃত্য প্রদর্শন করতেন এবং তার সঙ্গে তাল অঙ্গের পাখোয়াজ সঙ্গত থাকত। পরবর্তী যুগে যখন এই নৃত্য দরবারে (হিন্দু ও মুসলিম) স্থান পায়, তখন নৃত্যকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টায় তাল অঙ্গের বিভিন্ন জটিল  বন্দিশ, সুন্দর সঞ্চালন ও ভ্রমরীর প্রয়োগ দেখা যায়। বর্তমান যুগে কথকে তাল অঙ্গ ও ভাব অঙ্গের সমান প্রয়োগ দেখা যায়। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে  ধ্রুপদ, ধামা‌র, খেয়ালের বন্দিশ,‌ ভজন, ঠুমরি ,কাজরি, দাদরা, গজল, ইত্যাদি বিভিন্ন সঙ্গীতের কথক নৃত্যের ভাব অঙ্গের প্রয়োগ করা হয়।

পুরোনো মন্দির যুগের কথকতা এবং তার লোকশিক্ষার পদ্ধতি আমার কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় বোধ হয় এবং ভাগ্যক্রমে আমার গুরু স্বর্গীয় ওম প্রকাশ মহারাজের কাছে  আমি এ ধরনের কিছু বন্দিশ শেখার সুযোগ পাই।এই ধরনের কথকতার কাহিনী আমার নৃত্য প্রদর্শনের অঙ্গ হিসাবে গ্রহন করি।রাজনীতিবিদ শ্রীকৃষ্ণের কথা, উর্দু ভাষায় লেখা  রাম ও শবরীর উপাখ্যান, নারদের গর্ব মোচন ইত্যাদি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আমার নৃত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাল ও ভাব অঙ্গের সমান সমান প্রয়োগ করে যথেষ্ঠ জনপ্রিয়তা লাভ করেছি।

প্রতিভা দাসঃ  শিল্পের ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনও শেষ না। তবুও একজন পরিপূর্ণ কথক শিল্পী হতে কতটা সময় দেওয়া দরকার?

ডা.মালবিকা মিত্র

ডা.মালবিকা মিত্রঃ  হ্যাঁ, এটা ঠিক যে শিল্পের ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো শেষ থাকে না। এমনই  যে কোনো ক্ষেত্রে আমরা সারা জীবন শিখতেই থাকি কিছু না কিছু। কিন্তু পরিপূর্ণ কথক নৃত্য শিল্পী হতে গেলে কতটা সময় দেওয়া দরকার এটা নির্ভর করে সে তার রোজকার জীবনের কতটা তার মধ্যে দিতে পারছে। আজকে যদি সে ‘কথক কেন্দ্র’র মত কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ পায়, সেখানে সম্পূর্ণভাবে থেকে সারাদিন সে ওই চর্চার মধ্যে থাকতে পারে, তাতেও তাদের অন্তত ১২-১৩ বছর লাগবে সেই কোর্স শেষ করার জন্য। তার মানে অতটা সময় নিশ্চয়ই প্রয়োজন।একজন শিল্পী হিসাবে তার শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের মতো যারা বাড়িতে থেকে পড়াশোনা স্কুল কলেজের সব কিছুর সঙ্গে শেখার চেষ্টা করেছি, যেখানে প্রতিদিনের শিক্ষালাভ সম্ভব হত না সেক্ষেত্রে সময়টা হয়তো একটু বেশী লাগে। এটা ওইভাবে বিচার করা মুশকিল।তবে সহজ পথ কিছু নেই।শেখা পরিশ্রম ও রেওয়াজের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করলে তবেই কেউ শিল্পী হিসাবে সার্থকতা লাভ করতে পারে,এটা আমার একান্ত বিশ্বাস।

প্রতিভা দাসঃ ২০১০ সালে আপনি সঙ্গীত নাটক অকাডেমি পেয়েছেন।এছাড়াও রাজ্য ও অনান্য স্তরে অনেক সম্মান পেয়েছেন।অনুষ্ঠান করেছেন দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়।এমন কোনও প্রত্যাশা কী এখনও বয়ে নিয়ে চলেন যা পাওয়া হয় নি?

সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তি

ডা.মালবিকা মিত্রঃ জীবনে অনেক অনেক পুরস্কার,ভালোবাসা পেয়েছি – যার কোনও প্রত্যাশাই কোনোদিন আমার ছিল না। আমি কখনই ভাবিনি যে আমি এইসব পুরস্কার পেতে পারি। আর পুরস্কার পাওয়ার জন্য আমি এটা করিও নি। আমি এটা না করে থাকতে পারবো না, বাঁচতে পারবো না,তাই জন্য করেছি। প্রাণের তাগিদে করেছি। এটা আমার পুজোর অঙ্গ।আমার মা ছিলেন আমার  নাচের প্রধান অনুপ্রেরণা। তাঁর স্বপ্নই আমি পূরণ করেছি। সেটাই আমার জীবনের মূল মন্ত্র। তাই যখন কোনো পুরস্কার পাই তখন সবচেয়ে আগে মনে হয়, “আমি কি সত্যি তার যোগ্য হতে পেরেছি?” আর যখন পুরস্কার পেয়েছি  তখন আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। আমি যা শিখেছি,জেনেছি ও অনুভব করেছি  তা আমার শিষ্য শিষ্যাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই আমার লক্ষ্য। তবে আমি ধন্য  এই এতভাবে সম্মানিত হয়ে। এছাড়াও আমার জীবনে বড় বড় শিল্পীদের আশীর্বাদ পেয়েছি । স্বর্গীয় পণ্ডিত কিষাণ মহারাজজী, স্বর্গীয় শান্তাপ্রসাদজী যাঁদের সঙ্গে আমি  কাজও করেছি এবং তাদের কাছ থেকে অনেক আশীর্বাদও পেয়েছি।এছাড়াও স্বর্গীয় শ্রীমতি গিরিজাদেবী সহ বিভিন্ন শিল্পীরা, শ্রী অরুণ ভাদুড়ীজী — ওনাদের সবার কাছে বসে তাঁদের কথা শোনা। তাঁরা আমাকে যে আশীর্বাদ করেছেন, আমার নাচ দেখার পর যে আশীর্বাদ  করেছেন সেগুলো আমার কাছে একটা প্রাপ্তির জায়গা। আর এই যে সম্মান আমার রাজ্য থেকে পেয়েছি, কেন্দ্র সরকার থেকে পেয়েছি – সেগুলো ওই বললাম আমি তার যোগ্য কিনা আমি তা জানিনা। ২০১০ সালে ঘোষিত হল সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার,তা ২০১১ সালে পেয়েছি। ২০১৯ সালে উদয়শঙ্কর পুরস্কার পেয়েছি। এছাড়াও আমি জীবনে বহু বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্য শিল্পীদের সান্নিধ্য ও আশীর্বাদ পেয়েছি যা  আমার কাছে পরম প্রাপ্তি ।

প্রতিভা দাসঃ এত বর্ণময় নৃত্যজীবনে আর কার কার কাছে থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?

মালবিকা মিত্রকে রোহিনী ভাটের সেই চিঠি

ডা.মালবিকা মিত্রঃ আমার নৃত্য জীবনে আমি বহু নৃত্য শিল্পীর দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছি। স্বর্গীয় পন্ডিত বিরজু মহারাজের নৃত্য আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে । এছাড়া স্বর্গীয় দুর্গা লালজী, স্বর্গীয় রোহিণী ভাট, স্বর্গীয় সিতারা দেবী, স্বর্গীয় দময়ন্তী যোশী, কুমুদিনী লাকিয়ার নাম উল্ল্যেখযোগ্য। কলকাতায় থাকার ফলে স্বর্গীয় পন্ডিত বিরজু মহারাজ জী ছাড়া অন্যদের নৃত্য খুব বেশি  দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু দিল্লীতে আমি সঙ্গীত নাটক একাডেমিতে ওনাদের নৃত্যের ভিডিও দেখার চেষ্টা করেছি এবং তার থেকে শিক্ষা লাভ করার চেষ্টা করেছি।এরকমই একটি ভিডিও তে স্বর্গীয় রোহিনী ভাটের সারে দশ মাত্রার প্রয়োগ আমাকে বিশেষ অনুপ্রাণিত করে ।আমার প্রথাগত শিক্ষার মধ্যে ১/২ মাত্রা বা ১/৪ মাত্রার যুক্ত কোনও তালিম ছিল না। ওনার ভিডিও দেখার পর আমি  একটু অন্য ভাবে ভাবার চেষ্টা করি। পুনেতে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করে ওনাকে আমার এই নতুন তালের প্রয়োগ শোনাবার সুযোগ পাই। ওনার অনুপ্রেরণায় আমি প্রয়োগ করেছি শুনে খুব খুশী হন। আমার একান্ত অনুরোধ স্বীকার করে উনি আমাকে অনুমতি দেন এই তালের নামকরনে  ওনার নাম কে যুক্ত করার। তাঁর সম্মতি অনুসারে ওই তালের নামকরণ করি  নওয়ার্ধ রোহিনী।

প্রতিভা দাসঃ ২০২২-এর ১৭ জানুয়ারি কথকের জগতে ইন্দ্রপতন হল,চলে গেলেন পন্ডিত বিরজু মহারাজ।আপনার জীবনে তাঁর অনুসঙ্গের কথা যদি শোনান।

বিরজু মহারাজের সঙ্গে মালবিকা মিত্র

ডা.মালবিকা মিত্রঃ আমাদের সকলের কাছে তিনি কথকের ঈশ্বর স্বরূপ।এমন একজন মানুষ যাঁকে লিজেন্ড ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।তাঁর প্রতিভা,তাঁর স্ফুরণ,তাঁর প্রকাশ – তিনি কথকের সঙ্গেই সমার্থক।কথক শব্দটাই বিরজু মহারাজের সঙ্গে সমার্থক। তাই আমাদের মনে এক গভীর দুঃখের ছায়া নেমে এসেছে। তবে তাঁর কাছ থেকে  সাক্ষাতে, প্রত্যক্ষভাবে, অপ্রত্যক্ষভাবে সারাজীবন শিখেছি। আরও হয়ত শিখব। কেননা তিনি যে বীজমন্ত্র দিয়ে গেছেন তা অন্তরে গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছি।  তাঁর কাছে প্রত্যক্ষভাবে শেখার অভিজ্ঞতা তো আমার ১৯৮২ সালে যখন কোলকাতায় প্রথম কথকের কর্মশালা  (ওয়ার্কশপ) হয়।সেই সময় আমি সবে ডাক্তারির হাউসস্টাফশিপ শেষ করেছি। সেই সময় আমার সুযোগ হয়েছিল সেই ওয়ার্কশপে যোগ দেওয়ার। সেখানে ওনার দেখানো পথ আমাকে কথকের আত্মার সঙ্গে পরিচিত হতে শিখিয়েছে। যদিও আমার প্রত্যক্ষভাবে ওনার কাছে পরে আর শেখার সুযোগ হয়নি, কিন্তু পরোক্ষভাবে আমি সারাজীবন ওনার কাছে শিখেছি এবং ওনাকে অনুসরণ করেছি। আর বিশেষ করে নৃত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ওনার যে লালিত্য যে সৌন্দর্য বোধ তা আমাকে বিশেষ অনুপ্রাণিত করেছে।  তাঁর চলে যাওয়ার ক্ষতি অপূরণীয়। কিন্তু তবুও মানুষকে মেনে নিতে হয়। আমি সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করি অমৃতলোকে সেই সুর তাল ছন্দের মধ্যে মিলে থাকুন আমাদের সকলের প্রিয় স্বর্গীয় পণ্ডিত বিরজু মহারাজ জী।

Tags: , , , , , , , , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ