|| ১ ||
সাবওয়ে দিয়ে চিরকালের অভ্যাসের মতো দুটো করে সিঁড়ি টপকে টপকে প্লাটফর্মে উঠে একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে বসে হাঁফাতে লাগলো শুভ | রবিবার সকালে ঘুমটা যেন ভাঙতেই চায় না | অগত্যা এই তাড়াহুড়ো !
নাহ্ ! লেট হয় নি | সাড়ে দশটার গ্যালোপিং বর্ধমানটা পেয়ে যাবো | – ভাবতে ভাবতে চশমাটা খুলে নিয়ে রুমাল দিয়ে মুছতে লাগলো সে | আপ বর্ধমান গ্যালোপিং লোকালটাও তখনি অ্যানাউন্স করলো |
আচ্ছা এটা কি বৈদ্যবাটি দাঁড়াবে ? – পাশে বসে থাকা একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো শুভর | চশমাটা চোখে পরে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল –
বৈদ্যবাটি ? সিওর কিনা জানি না | আপনি একবার জিজ্ঞেস করে উঠবেন |
ওহ আচ্ছা | এরপর ব্যান্ডেল কটায় আছে ?
ব্যান্ডেল এটার মিনিট পাঁচেক পরেই |
ওহ, তাহলে ওটায় যাওয়াই ভালো | পাঁচ মিনিটের ব্যাপার যখন |
তাড়া থাকলে জিজ্ঞেস করে উঠে যেতেই পারেন |
না, অ্যাকচুয়ালি আমি একা খুব একটা ট্রাভেল করি না তো ! তাই আর কি |
একটু থেমে মেয়েটি বলে উঠল –
-তুমি কোথায় যাবে ?
এতক্ষন ঠিক মতো খেয়াল করে নি তবে এবার মেয়েটির গলায় যেন একটা অদ্ভুত অসহায়তার সুর খুঁজে পেলো শুভ | অনভ্যস্ত মানুষ একা যাতায়াত করলে যা হয় | অল্প নার্ভাস তো হওয়া স্বাভাবিক | শুভ উত্তরে বললো –
আমি, চুঁচুড়া |
ইতিমধ্যে ট্রেনটা প্লাটফর্মে ঢুকে পড়েছে | শুভ উঠে এগিয়ে গেলো | পিছন ফিরে দেখলো না তবু কি একটা চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো | যেন কোনো একটা দোটানা তাকে পিছু টানছিলো | ট্রেনটা গতি থামিয়ে দাঁড়াতেই জানালার ধারে বসে থাকা একজন লোককে শুভ জিজ্ঞেস করলো –
দাদা এটা বৈদ্যবাটি থামবে ?
হ্যা থামবে | – বললেন ভদ্রলোক |
শুভ একবার কি যেন ভাবলো | তারপর উঠে পড়লো |
উঠবার পর থেকেই মুহূর্তের মধ্যে শুভর মনটা আবার খচখচ করতে লাগলো | ট্রেনটা ছাড়তেই যাবে, নেমে পড়লো সে | আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ট্রেনটা | কিছুটা এগিয়ে এসে দেখলো মেয়েটি তখনো ওখানেই গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছে | শুভ বলে উঠল –
হাই !
হাই ! কি হলো তুমি গেলে না ?
কি বলবে ভেবে না পেয়ে শুভ বলল –
সোজা ব্যান্ডেল, নেক্সট স্টপ |
আচ্ছা |
শুভ বসলো আবার | বলল –
বৈদ্যবাটিতেই বাড়ি নাকি তোমার ?
না না! আসলে একটা এন্ট্রান্স এক্সাম এর সিট পড়েছে |
আচ্ছা |
বাবার সাথেই যেতাম | কিন্তু কাল রাত থেকে বাবার আবার হাই ফিভার | মাকে দেখভাল করতে হচ্ছে | তাই আমাকে একাই বেরোতে হলো আর কি | তাড়াহুড়োতে মোবাইলটাও ফেলে এসেছি !
ঠিক আছে, ডোন্ট ওরি |
তুমি চুঁচুড়ায় কোথায় যাচ্ছ ?
এভাবেই কথাবার্তা চলতে লাগল | মেয়েটি জানালো যে সে কলেজে ভর্তির পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে | শুভও জানালো যে গত বছরই এম. এ কমপ্লিট হয়েছে তার | চুঁচুড়া যাচ্ছে টিউশন পড়াতে | কয়েক মিনিটের মধ্যেই একেবারে অচেনা থেকে আচমকাই ভীষণ রকম পরিচিত হয়ে গেলো দুজন !
যথা সময়ে ব্যান্ডেল লোকালটা এলো | উঠে পড়লো ওরা | এটা – ওটা গল্প করতে করতে সময় যে কিভাবে কেটে গেলো বোঝাই গেলো না | এক সময় শুভ বলল –
ব্যাস এরপরেই বৈদ্যবাটি | এক নম্বর প্লাটফর্ম দিয়ে নেমে অটো – টোটো যা হোক কিছু একটা পেয়ে যাবে |
মেয়েটি হঠাৎ করে এমন একজন কাউকে পেয়ে যাবে যে তার এই একাকী যাত্রার ভয় ও দুশ্চিন্তা মুহূর্তের মধ্যে দূর করে দেবে ভাবতেই পারে নি | কৃতজ্ঞতার সুরে সে বলে উঠল –
থ্যাঙ্কস !
বাবা ! এতে আবার থ্যাঙ্কস কেন ? – অল্প হেসে শুভ বললো |
কিছুক্ষন শুভর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মেয়েটি বললো –
না কিছু না, এমনিই !
স্টেশন এলো | নেমে পড়লো মেয়েটি | হুড়মুড়িয়ে লোক উঠলো কামড়াটায় | মানুষের ভিড়ে মেয়েটি কখন যে চোখের আড়াল হয়ে গেলো বুঝতে পারলো না শুভ |
|| ২ ||
মাঝখানে একটা মাস কেটে গেছে | সেদিনটাও রবিবার ছিল | সময়টাও সাড়ে দশটা | আপ গ্যালোপিং বর্ধমান লোকাল থেকে নামলো শুভ |
আচ্ছা এটা কি বৈদ্যবাটি দাঁড়াবে ?
হ্যা দাঁড়াবে | – মোবাইলে কি একটা দেখতে দেখতে মুখের দিকে না তাকিয়েই বলে চলে যাচ্ছিল শুভ | চকিতেই কণ্ঠস্বরটি খুব চেনা চেনা ঠেকলো | পিছন ফিরে চাইতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল সে |
চিনতে পারছ না ?
হ্যা সরি, খেয়াল করি নি একদম | কেমন আছো ? হ্যা এটা বৈদ্যবাটি……
ব্যাস ! আর কোনো কথা মুখ দিয়ে বের করতে পারলো না শুভ | মেয়েটি ঠোঁট টিপে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে | ইতিমধ্যে ট্রেনটাও ছেড়ে দিলো | মেয়েটি তখনো হেসে চলেছে | লজ্জায় কোনো মতে মুখ খুলল শুভ –
তুমি উঠতে পারতে | এটা বৈদ্যবাটি…
দাঁড়াবে না | সোজা ব্যান্ডেল, নেক্সট স্টপ | – হাসি থামিয়ে কৌতূকের সুরে বলল মেয়েটি |
কোনো একদিন নিজেরই বলা কথাগুলো হুবহু একভাবে মেয়েটির থেকে শুনে শুভও না হেসে থাকতে পারলো না আর | তারপর বলল –
তা আজ আবার বৈদ্যবাটি ?
নাহ, বাবার ট্রান্সফার হয়েছে | সি অফ করতে এসেছিলাম |
আচ্ছা আচ্ছা |
তবু পরিস্থিতিটা যেন ক্রমেই অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিলো শুভর কাছে | আমতা আমতা করে বলল –
লিসেন, আই এম রিয়েলি সরি !
ইটস্ অল রাইট ! ইউ ওয়ের রিয়েলি ভেরি হেল্পফুল দ্যাট ডে ! বাই দ্য ওয়ে, হাতে সময় আছে এখন ?
হ্যা সে আছে, কেন ?
এখানে অটো স্ট্যান্ডের কাছে একটা কফি শপ খুলেছে নতুন | শুনেছি ভালোই |
কয়েক মুহূর্তের নিঃশব্দতা | তারপর কিছুক্ষন মেয়েটির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে শুভ বলল –
থ্যাঙ্কস !
বাবা এতে আবার থ্যাঙ্কস কেন ?
না কিছু না, এমনিই !
Tags: অণু গল্প, এমনিই, দেবাশিস সাহা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।