ট্রেনে নয় লাক্সারি বাসে চলেছি পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে। সাথী ত্রিরিশ জন। কপালগুণে বাসের পেছনে পড়েছিল আমার সিট। আমার দুটো সিট আগে বসেছিল বছর কুড়ির এক তরুণী তার বাবার সঙ্গে। চা-জলখাবারের জন্যে মাঝে একবার বিরতি দেওয়ায় অন্যান্ন সহযাত্রী সহ ওই মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হয়। মেয়েটি সবেমাত্র কম্পুউটার সায়েন্স নিয়ে পাশ করে টিসিএসে যুক্ত হয়েছে। কথাবার্তায় বেশ সপ্রতিভ। দেখতেও বেশ সুন্দর। পানপাতা মুখ। চোখ দুটো টানাটানা। ঠিক লক্ষীপ্রতিমার মতন। নাকটা বাঁশির মতন টিকালো। বুদ্ধিদৃপ্ত মুখ। নাম পারমিতা মিত্র । কথায় কথায় জানা গেল ভাল গান জানে। সেই সুযোগটা আমরা কেউই মিস করতে চাইলাম না। চলন্ত ভলভো গাড়িতে মাইক্রোফোনের ব্যবস্হা ছিল। আমাদের সকলের পীড়াপীড়িতে রাজি হয়ে গেল গাইতে। একের পর এক রবীন্দ্র, আধুনিক এমনকি কয়েকটা জনপ্রিয় হিন্দি ছবির গান গাইলো। সময়টা যে কোথায় দিয়ে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না কেউই। পুরুলিয়ার লাল মাটিতে রুক্ষ আবহাওয়ায় রাস্তার দুধারে টকটকে লাল পলাশ আর শিমুলের শোভা দেখতে দেখতে আর পারমিতার গান শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম আমাদের হোটেলে।
আগে থেকে ঘর বুক করা ছিল আমাদের। কেয়ার টেকারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে যে যার রুমে চলে গেল ফ্রেস হতে। টিম ম্যানেজার সময় বেঁধে দিয়েছিলেন আধঘন্টা। তড়িঘড়ি সকলে ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে এসে হাজির হলাম। দেরি হচ্ছে দেখে আমাদেরই এক সহযাত্রী হাফ প্যান্ট পরে খাবার দিতে শুরু করে দিতেই অন্য একটা দলের লোকজন হোটেলের ওয়েটার হিসেবে মনে করে তাঁকে খাবার পরিবেশন করার কথা বলতেই আমাদের দলের মধ্যে হাসির রোল বয়ে গেল। তাঁকে আসনে বসে খেয়ে নিতে বললাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা সদলবলে বেরিয়ে পড়লাম পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়, সীতাকুন্ডু, মার্বেল রকস, পাখী পাহাড়, আপার ড্যামস, চেড়িয়া গ্রামের ছৌ মুখোস ইত্যাদি দেখতে। সীতাকুন্ডুতে এসে একজন গাইডের কাছে জানতে পারলাম রামচন্দ্রের বনবাসের সময়ে সীতা দেবীর একবার ওইস্থানে খুব জল পিপাসা পাওয়ায় রুক্ষ জায়গায় স্বয়ং রামচন্দ্র ধনুকবান সহয়োগে মাটির তলা থেকে জল তুলে সীতার দেবীর পিপাসা মিটিয়েছিলেন বলে ওই কুন্ডুটার নাম রাখা হয় সীতাকুন্ডু। এখনোও ওই কুন্ডু থেকে গ্রামের লোকেরা জলপানের জন্যে জল তুলে নিয়ে যান। ছৌ- মুখোশ স্থানে গিয়ে দেখা গেল হরেক রকমের মুখোশ বিক্রি করছেন ঘরের মেয়ে বধুরা। তাঁদের কাকুতি-মিনতিতে কেউ কেউ মুখোশ কিনছেন।
এরপরে ঘুরতে ঘুরতে বামনী ফলসে এসে পৌঁছালাম। উপর থেকে নামতে নামতে আমরা অনেক নীচে চলে এসেছিলাম। প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারিনি। পাহাড়ের কোল বেয়ে ঝরে চলেছে স্রোতস্বিনী জলধারা। অনেকেই ফটো তোলতে ব্যস্ত। সেই সময় একটা সেলফি তুলতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে যাচ্ছিল পারমিতা। হ্যাঁচড়- ফ্যাঁচড় খেয়ে পাথরের খাঁজে পা আটকিয়ে কোনরকমে সামলে যায় খরস্রোতা বরফ গলা জলে অতলে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে। তাড়াতাড়ি হাত ধরে ওকে টেনে তুলি। বড় একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পেয়ে আমরা মনে মনে ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। পায়ে খুব ব্যথা হয়েছিল পারমিতার। আমার ব্যাগ থেকে বের করে ফাস্ট এইড দিতে কিছুটা স্বস্তি পেল পারমিতা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমার কাঁধে ভর দিয়ে ওকে নীচ থেকে তুলে আনলাম। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার ছাপ ফুটে উঠেছিল ওর চোখে মুখে। কটা দিন বেশ ঘোরের মধ্যেই কেটে গিয়েছিল। ফেরার দিনে মনটায় কেমন যেন একটা ফাঁকা ফাঁকা বোধ হচ্ছিল। ঐ মিষ্টি মেয়েটির সঙ্গ আর পাওয়া যাবে না ভেবে। ওকে সঙ্গে নিয়ে নানান জায়গার ছবি ক্যামেরা বন্দি করেছিলাম। শেষদিনে আবদার জানিয়েছিল ছবিগুলো যেন ওর কাছে পাঠিয়ে দিই বাড়ি ফিরে। ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওর মোবাইলে। প্রত্যুত্তরে মোবাইলে জানিয়েছিল ‘থ্যাঙ্কস’ এ্যান্ড ‘মাই প্লেজার’।
Tags: অণু গল্প, ডা. প্রদীপ কুমার দাস, বাসে আলাপ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।