18 Jun

যে হাসি অগাধ করে তোলে

লিখেছেন:ঋভু চৌধুরী


শুধু কবিতার জন্য এ জীবনে কত কিছু হল! কত আলো, কত অন্ধকার৷ কত সম্মান, কত বঞ্চনা। শুধু কটা শুদ্ধ অক্ষর, যদিও নিতান্ত সব নিজ সুখ দুঃখের গালগল্প। বৃহৎ বোধের থেকে কত দূর তারা৷ আমার আজকাল লজ্জাই লাগে। এতো তো পাবার কথা ছিল না কোন।

বেঁচে থাকতে থাকতে যখন ক্লান্ত হয়ে উঠি তখন আশীর্বাদের ঝাঁপি খুলে দেন ঈশ্বর। অহৈতুকী কৃপার মতন মানুষ দেখি। তাদের মনের গভীরে গিয়ে তাদের পাপড়ির আড়ালে লুকনো পরাগের ঘ্রাণ নিতে চাই। সেটুকুই আমার একমাত্র পুন্য।

সোমরাবাজারের কালী দেখার লোভ ধরিয়েছিল তৌষিক। যাওয়া হয়ে ওঠেনি৷ ছন্দকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গভীরই হল প্রায় নিস্তারিনীর হাত ধরে। সুমিতাদি কতবার বলাগড় কালনা ঘুরিয়ে দেখাতে চেয়েছে। আমারই যাওয়া হয়ে ওঠেনি কখনো। কদিন থেকে ভালো লাগছিল না কিছুই। গুমোট গরম। বুকের মধ্যেটায় জটিল অন্ধকার। সবদিকেই মনে হয় প্রাচীর। মনে হয় কেউ বুঝি আদরযত্ন করে আমার অভিমান ধুইয়ে দেবে না কখনো। ভাবি, সাথে সাথে এও মনে হয় এর যুক্তি নেই কোন। অসহায় লাগে। মনে মনে ঝগড়াই হয়ে যায় একচোট ঈশ্বরের সাথে। বলি, ‘ সব মিথ্যে। থাকো যদি একটি জানান দিতে লাগে।’ অন্তরালবর্তী মুচকি হাসেন। ঝোড়ো হাওয়া বয়। বৃষ্টি নামে। সোঁদা গন্ধের কাছে নিচু হয়ে আসে রক্তজবার ফুলে ভরা ডাল। মাটি তাকে রামপ্রসাদী গান শোনাতে থাকে। আর আমি বেড়িয়ে পড়ি কালীর সাথে দেখা করব বলে।

কালীও হাত বাড়ান বৈকি। সঙ্গী জুটে যায়। প্রখর জৈষ্ঠ্য আকাশ মেঘে মেঘে নরম হয়ে আসে। কোথাও কিছু নেই সুমিতাদি নিজে থেকে একে তাকে ফোন করে আমার আপ্যায়ন ব্যবস্থা করে দেয়। যত আমি  বারণ করি ততই দেখি আমার ইচ্ছের বাইরে অতিকায় এক ইচ্ছে কাজ করে। যা চাই তার বাইরেও অনেকখানি আদর বিছিয়ে থাকে।

সোমরাবাজার স্টেশনের কাছেই দেওয়ানজী বাড়ির জগদ্ধাত্রী মন্দির। গাছে ঘেরা৷ ইদারার জলের পাশে নিম গাছের ছায়া৷ সেদিকে শীতল দৃষ্টি মেলে বসে থাকেন ছোট্ট খাট্টো মিষ্টি মতন জগদ্ধাত্রী।  রাজকীয় ভঙ্গি।  পায়ের কাছে প্রণত সিংহের থেকে চোখ ফেরানো দায়৷ দেবীর একপাশে পঞ্চানন,  একপাশে শিব। তার পাকানো গোঁফ।  কোলে কাঁখে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ। পুজো হয়ে গেছে সবে৷ ধুপের গন্ধ, বাতির আলো তখনও মুছে যায়নি ঘর থেকে৷ যে মহিলা আদর যত্নে রাখেন দেবীর ঘরদুয়ার তিনিই আদর করে দেখিয়ে দিলেন তালা খুলে৷ পূর্বজন্মের মতন করে বললেন শান্তিপুরে নিজের বাপের বাড়ির বৈভবগল্প। স্বপ্নে তার আজও বাপের কীর্তন ভেসে আসে। এ তল্লাটে বহুদিন তার সংগ্রামের সংসার কেটেছে। এখন জগদ্ধাত্রীর দেখাশোনার দ্বায়িত্ব বছর দুই হল মহিলার মুখে এনে দিয়েছে হাসি। কে জানে সেই হাসির রেশই লেগেছিল কিনা ওই ছায়াপ্রদ জগদ্ধাত্রীর কাজলচোখে!

সেখান থেকে যে মেয়ে আমাদের কালী দেখানোর দ্বায়িত্ব নিল সে সেবাকেই ধর্ম বলে জানে। নার্সিং পড়ছে। রাস্তার কুকুরদের নিয়ে তার বিশাল কর্মকান্ড। সেই রাস্তা দেখিয়ে দিল আনন্দময়ীর। এ মন্দির এ তল্লাটের প্রসিদ্ধ।  রাণি রাসমণি নাকি জলপথে যেতে এ মন্দির দেখেই তার আদলে গড়েছিলেন ভবতারিণী আবাস। নবরত্নের মন্দির ঘেরা টেরাকোটার কাজ এখন টেরাকোটা রঙে অস্পষ্ট। দ্বাদশ শিবমন্দিরের সামনে ঘাসের বাগান আর বিস্তৃত আমবাগানই এখন এ মন্দিরের নরম সৌন্দর্য। সেই স্নিগ্ধতার দিকে চেয়ে চেয়ে আনন্দে গুনগুন করে গান করেন আনন্দময়ী। শিবের ওপর আসিনা, রমনরতা সে হাস্যময়ীর দিকে তাকিয়ে ডুবে যেতে হয়। চোখের হাসি, নোলকের ঝিলিক, বরাভয়মূদ্রা তার দিকে তাকিয়ে থাকলে ধ্যান আপনি আসে। কে জানে হয়তো সিদ্ধিলাভও হয়। কোলাহল শান্ত হয়ে আসে।

এ মন্দির, মন্দির লাগোয়া মিত্র মুস্তাফিদের বাড়ি সবই খুব চেনা মনে হল মৃণাল সেনের আকালের সন্ধানের দৌলতে৷ সেই সব ফ্রেম মনে পড়ে গেল৷ মনে পড়ে গেল সেই একদল শহুরে আর একদল আকাল দেখা গ্রামের মানুষের মানবিক দ্বন্দ্ব। মনে পড়ে গেল দশমহাবিদ্যার গল্প, ক্ষুধার বসে কালীও কেমন অসহায় হয়ে শিবকে গিলে ফ্যালে। মানুষ বোধহয় চিরকাল তার না পাওয়াগুলোকে কোন মহত্তর রূপ দিয়ে, বোধ দিয়ে ছুঁতে চেয়েছে। শিল্প হয়ে উঠেছে সেই সব খোঁজ ও ক্ষিদে।

অনেক চেষ্টা করেও দেখা হল না হরসুন্দরী আর নিস্তারিণীর সাথে। তারা অশোকবনে সীতার মতন জঙ্গলঘেরা মন্দিরের পরিখায় তালাবন্ধ। কোন প্রিয়জন এলেও তাদের দেখা করার উপায় নেই। অন্ধকারে তাতের কান্নার কালো কাজল তাদের হয়তো দিন দিন আরো কালো করে তুলেছে। দেখা হল না বলাগড়ের মিত্র মুস্তাফিদের চন্ডীমন্ডপও। তালাই তাদের ভবিতব্য।

কিন্ত দেখা পেলাম এল আশ্চর্য নারীর। ছোটমনি সুমিতাদির বোন। আশ্চর্য মেয়ে। তার সংসার ঘিরে অজস্র পাখপাখালি, হনুমানের দল, আশ্রিত কুকুরবেড়ালের দাপাদাপি। তাদের সাথে আমাদেরও ‘সেবা’র বন্ধবস্ত করে মাসি। সমান আদরে। কেউ ফেলনা নয় তার কাছে। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামের আশ্রমভরা শিশুদের নিয়ে তার আগামীর সঙ্কল্প শোনালেন আমাদের৷ শোনালেন কেমন করে সব ছেড়ে শুধু সেবায় ডুবে যেতে চান তিনি। শুধু যে বলার জন্য বলেন তা কিন্তু নয়। বলতে বলতে তার চোখে মুখে সেই জগদ্ধাত্রীর হাসি দেখে ফেলি। আর মনে হয় এতো পাবার কথা ছিল না। এতো পাবার কথা ছিল না কোন।

এক একটা এমন দিন আসে জীবনে যখন নিজেই নিজের মধ্যে উপচে উঠি। রবীন্দ্রনাথ গান ভরে দেন বুকে। ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে…. আনন্দধারা বহিছে ভুবনে…….’

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ