চারপাশে কুয়াশা। এখন সকাল ন’টা তবু সমস্ত দিল্লি ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত । রাস্তাঘাট, গাছপালা সব ভেজা। কিছুই ঠিকমতো চোখে পড়ে না । নানা ধরনের শব্দই এখন জীবনের স্পন্দনের প্রমাণ দিচ্ছে। বিল্ডিং এর চারপাশ থেকে প্রতিদিনের মতো আওয়াজ আসছে । বাসওয়ানির চাকরটা রোজকার মত স্টোভ ধরিয়েছে – দেওয়ালের ওপাশ থেকে তারই সাড়া শব্দ পাচ্ছি । পাশের ঘরটায় অতুল মবানি জুতো পালিশ করছে। ওপরে সরদারজি গোঁফে রং করছেন – ওঁর জানলার পর্দা টানা , তবু সর্বত্র জীবনের স্পন্দন শোনা যাচ্ছে । তিনতলায় বাসওয়ানি বাথরুমের দরজা বন্ধ করে জলের পাইপ খুলে দিয়েছে ।
কুয়াশা ভেদ করে বাস ছুটছে। ভারী টায়ারের শব্দ দূর থেকে একবার কাছে আসছে , ক্রমে সরেও যাচ্ছে । পাগলের মতো হু হু করে অটো ছুটছে । সবে মাত্র কেউ ট্যাক্সির মিটার ডাউন করেছে। পড়োশি ডাক্তারের ফ্ল্যাটে ফোনের রিং হচ্ছে আর পেছনের গলিটা দিয়ে কয়েকটি মেয়ে কাজে যাচ্ছে সকালের শিফটে।
কনকনে শীত। রাস্তা যেন গুটিশুটি মেরে রয়েছে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে গাড়ি ছুটছে হর্ন বাজিয়ে । কুয়াশায় ঢেকে থাকা রাস্তার লোকজনকে দেখাচ্ছে উদ্ভ্রান্ত প্রেতাত্মার মতো।
কুয়াশার অপার সমুদ্রে প্রেতাত্মারা নীরবে এগিয়ে চলেছে – বাসেও ঠাসাঠাসি ভিড়। লোকজন ঠান্ডা সিটে গুটিশুটি মেরে বসেছে। ভিড়ের চাপে কেউ কেউ মাঝখানে যীশুর মতো হাত ছড়িয়ে ক্রুশে ঝুলছে। তাদের হাতের তালুতে পেরেক নয় – বরফ-ঠান্ডা রড ।
এহেন পরিবেশে একটা শবযাত্রা আসছে দূরের রাস্তা ধরে। মৃত্যুর খবরটা আজকের কাগজে আছে । সদ্য পড়েছি। নিশ্চয়ই এই মৃত্যুরই খবর। কাগজে লিখেছে – রাতে এরভিন হাসপাতালে করোলবাগের বিশিষ্ট ‘ বিজনেস ম্যাগনেট ‘ দেওয়ান চন্দের মৃত্যু হয়েছে। শবদেহ বাসভবনে আনা হয়েছে । সকাল ন’টায় আর্য সমাজ রোড হয়ে পচকুইয়া শ্মশানে যাবে…।
শবযাত্রাটা সম্ভবত ওঁরই । কিছু লোক মাথায় টুপি, গলায় মাফলার জড়িয়ে নীরবে পিছু পিছু আসছে । তাদের পদক্ষেপ রীতিমতো মন্থর। সবটা চোখে পড়ছে না, তবু মনে হচ্ছে , কিছু লোক পেছনে হাঁটছে।
দরজায় কেউ টোকা দিল। খবরের কাগজ টা সরিয়ে রেখে দরজা খুলে দেখি, সামনে দাঁড়িয়ে অতুল মবানি।
‘ আচ্ছা মুশকিলে পড়েছি ,… ইস্ত্রি করার লোকটা আজ আসেনি। তোমার আয়রনটা একটু দেবে?’
অতুল কথায় আমি সান্ত্বনা পেলাম । ওকে দেখে প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল , শবযাত্রায় যেতে না বলে! বিদেশি আয়রনটা ওকে এনে দিলাম । যাক- নিশ্চিন্ত হলাম, অতুল প্যান্টে ইস্তিরি করে দূতাবাসে বেরিয়ে যাবে।
দেওয়ান চন্দের মৃত্যু সংবাদ পড়ার পর থেকেই আমার মনে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা , এমন ঠান্ডায় কেউ এসে শবযাত্রায় যেতে না বলে। বিল্ডিংয়ের সবার সঙ্গেই ওঁর পরিচয় ছিল।
সর্দারজির চাকরটা হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে বাইরে যাচ্ছে। নিজেকে আরও আশ্বস্ত করতে ওকে ডাকলাম, ‘শোনো ধর্মা! চললে কোথায় ?’
‘সর্দারজির জন্য মাখন আনতে…।’ সুযোোগ বুঝে আমিও সিগারেট আনতে ওর হাতেে পয়সা দিলাম। সর্দারজি ব্রেকফাস্ট এর জন্য মাখন অনাচ্ছেন। এর অর্থ , উনিও শবযাত্রায় যাবেন না। আর একটু স্বস্তি পেলাম। অতুলআর সর্দারজির যখন যাবার ইচ্ছে নেই – তাহলে আমার প্রশ্নই ওঠে না। এই দুজন আর বাসওয়ানি পরিবারেরই দেওয়ান চন্দের বাড়িতে বেশি যাতায়াত ছিল। আমার সঙ্গে তো চার- পাঁচবারের বেশি দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তাই ওরা না গেলে আমার প্রশ্নই ওঠে না।
সামনের ব্যালকনিতে মিসেস বাসওয়ানি। ওর সুন্দর মুখখানি অদ্ভুত ঝকঝকে, ঠোঁটে সন্ধ্যার লিপস্টিকের লালিমা এখনও অম্লান। গাউন পরে বেরিয়ে এসে চুলের খোঁপা বাঁধছে। ওর গলা কানে আসছে – ‘ ডারলিং, প্লিজ আমাকে একটু পেস্ট দাও।’
আর একটু স্বস্তি। তাহলে বাসওয়ানিও যাচ্ছে না।
দূরে আর্যসমাজ রোডে শবযাত্রা মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে।
আতুল মবানি আয়রনটা ফিরিয়ে দিতে এল। নিয়ে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি, অমনি ও ভেতরে এসে বলে, ‘ শুনেছ দেওয়ান চন্দ মারা গেছেন !’
‘পেপারে পড়েছি।’ সোজাসাপ্টা জবাব দিলাম , যাতে কথাটা সেখানেই চাপা পড়ে । অতুল মবানির মুখটা মসৃণ, সদ্য শেভ করেছে। সে আরো বলে, ‘ দেওয়ান চন্দ সত্যি ভালো মানুষ ছিলেন।
মনে হল, প্রসঙ্গটা বাড়তে দিলে শবযাত্রার শরিক হবার দায়িত্ত্ব ঘাড়ে চাপবে। সেইজন্যই চটপট বললাম, ‘ তোমার সেই কাজটার কি খবর?’
‘মেশিন এলেই কমিশন হাতে পাব… কমিশনের ব্যবসার বড্ড ঝামেলা। কী আর করা যাবে! ভাবছি আট- দশখানা মেশিন বেচে দিতে পারলেই নিজের বিজনেস শুরু করে দেব।’ অতুল আরও জানায়, ‘এখানে যখন নতুন এসেছিলাম, দেওয়ান চন্দ খুব সাহায্য করেছিলেন। ওঁর জন্য কিছু কাজকর্ম জুটেছিল। লোকে ওঁকে খুব সম্মান করত।’
নামটা ফের কানে আসতেই সতর্ক হলাম। অমনি জানলা দিয়ে মুখ বের করে সর্দারজি জিজ্ঞেস করলেন – ‘মিস্টার মবানি, ক’টায় বেরোতে হবে ?’
বলেছে তো ন’টায় । যা ঠান্ডা আর কুয়াশা, নির্ঘাত দেরি হবে।’
মনে হচ্ছে, কথাটা শবযাত্রা প্রসঙ্গেই বলা।সর্দারজির চাকর ধর্মা আমাকে সিগারেট দিয়ে ওপরে গিয়ে টেবিলে চা সাজাচ্ছে। ঠিক তখনই মিসেস বাসওয়ানির গলা কানে এল – ‘প্রমীলা নিশ্চয়ই যাবে, কী বল ডারলি্ং?’
‘যাওয়া তো উচিত – তুমি একটু তাড়াতাড়ি তৈরি হও।’ বলতে বলতে মিস্টার বাসওয়ানি ব্যালকনি থেকে চলে গেলেন।
অতুল এবার আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ সন্ধ্যায় কফি- হাউসের দিকে যাবে নাকি?’
যেতে পারি’, বলতে বলতে কম্বল জড়িয়ে নিলাম, ও ফিরে গেল। আধ মিনিট পরেই ফের ওর গলা, ‘ ইলেকট্রিক লাইন আছে?’
জানলাম, ‘ আছে।’
ইলেকট্রিক রডে জল গরম করবে, তাই জিজ্ঞেস করছে।
‘ পালিশ !’ জুতো পালিশওলা ছেলেটা প্রতিদিনের মতো নিজস্ব ভঙ্গিতে হাঁক দেয়।
সর্দারজি ওপর থেকে তাকে ডাকেন। ছেলেটা বাইরে বসে পালিশ শুরু করে। উনি এবার চাকরকে আদেশ দেন, ‘ ঠিক একটায় খাবার নিয়ে আসবে। পাঁপড় ভাজা, স্যালাডও সঙ্গে আনবে।’
আমি জানি, সর্দারজির চাকরটা রীতিমতো পাজি। সময় মতো খাবার পৌঁছে দেয় না, ওঁর মনের মতো রান্নাও করে না।
রাস্তায় এখনও গভীর কুয়াশার। সূর্যের দেখা নেই। ছোলাওয়ালা বৈষ্ণব ইতিমধ্যে নিজের পসরা সাজিয়েছে । প্রতিদিনকার মত প্লেট সাজানোর শব্দ কানে আসছে।
সাত নম্বরের বাস ছাড়ছে। ক্রুশ বিদ্ধ যীশুরা যাচ্ছে ওতে। কন্ডাক্টর টিকিট বিলি করছে। পয়সার ঝমঝমানি এখানে আসছে। কুয়াশা জড়িয়ে থাকা প্রেতাত্মাদের মাঝখানে কালো পোশাকের কন্ডাক্টরকে দেখাচ্ছে ঠিক শয়তানের মতো।
আরো খানিকটা এগিয়েছে শবযাত্রা।
‘ নীল শাড়িটা পরব?’ মিসেস বাসওয়ানি কর্তা জিজ্ঞেস করে।
উত্তরে বাসওয়ানির চাপা গলা শুনে মনে হচ্ছে, সে টাই এর নট ঠিক করছে।
চাকরটা সর্দারজির স্যুট ব্রাশ করে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এদিকে সর্দারজি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাগড়ি বাঁধছেন।
অতুল মবানী ফের পাশ দিয়ে গেল। হাতে পোর্ট-ফোলিও, পরনে গত মাসে বানানো সুট। ওর মুখটা বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, পায়ে চকচকে জুতো। এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করে , ‘তুমি যাবে না ?’ ওকে যে পাল্টা প্রশ্ন করব , কোথায় যাবার কথা বলছে, তার আগেই সর্দারজির উদ্দেশে সে হাঁক ছাড়ে – ‘ নেমে আসুন সর্দারজি, দেরি হচ্ছে। দশটা বেজে গেছে।’
মিনিট দুয়েক পর সর্দারজি তৈরি হয়ে নেমে এলে বাসওয়ানি নতুন সুট দেখে ওপর থেকে মবানিকে জিজ্ঞেস করে , সুটখানা কোথায় বানালে ?’
‘খান মার্কেটে।’
‘ চমৎকার ফিটিং! টেলারর ঠিকানাটা একটু দিতো দিয়ো তো।’ এবার মিসেসকে ডাকে, ‘চলে এসো ডিয়ার। বেশ – আমি নামছি , তুমি এসো ।’ বলতে বলতে সে- ও মবানি আর সর্দারজির কাছে চলে আসে । সুটে হাত বুলিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, ‘ লাইনিং ইন্ডিয়ান নাকি ?’
‘ না , বিলেতি ।’
‘ দারুন ফিটিং।’ বলে টেলারের ঠিকানাটা ডায়েরিতে নোট করে নিল । মিসেস বাসওয়ানি ইতিমধ্যে লনে এসেছে – ভিজে ভিজে এই ঠান্ডার সকল ওকে আরও আকর্ষনীয়া দেখাচ্ছে। সর্দারজি অতুলকে চোখের ইশারা করে আস্তে শিস দিলেন।
শবদেহ এখন আমার ফ্ল্যাটের ঠিক সামনের রাস্তায়। সঙ্গে কিছু লোক আর দু-খানা কার, দু-একটা স্কুটার । লোকগুলো গল্পে মশগুল।
মিসেস বাসওয়ানি খোঁপায় ফুল লাগাতে লাগাতে নিচে নামছে । সর্দারজি পকেটের রুমাল ঠিক করছেন। সকলে বেরিয়ে যাবার ঠিক আগে বাসওয়ানি আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি যাবেন না ?’
‘আপনারা এগোন, আমি আসছি ।’ পরক্ষনেই মনে হয়, ও আমাকে কোথায় যেতে বলছে ! দেখতে দেখতে ওরা বেরিয়ে গেল।
শবযাত্রা আর একটু এগিয়েছে । একটা কার পেছন থেকে কাছাকাছি এসে গতি কমাল। চালক ভদ্রলোক শবযাত্রীদের একজনকে কিছু জিজ্ঞেস করার পর দ্রুত এগিয়ে গেল । পেছনের কারগুলো তাকে অনুসরণ করছে । ওরা চারজন ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে দেখছি মিসেস বাসওয়ানির গায়ে ফার কলার। সর্দারজি ওকে নিজের চামড়ার দস্তানা দেখাচ্ছেন । ড্রাইভার ট্যাক্সির দরজা খুলে দিলে চারজনই ভেতরে গিয়ে বসে। ট্যাক্সিটা এগিয়ে আসছে , ভেতরে হাসির হুল্লোড়। বাসওয়ানি শবযাত্রার দিকে ইঙ্গিত করে ড্রাইভারকে কিছু বলেছে। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে , দেওয়ান চন্দের শেষযাত্রায় আমারও শরিক হওয়া উচিত। ওঁর ছেলের সঙ্গে আমার ভালো চেনাশোনা আছে। এরকম শোকেরর সময়ে শত্রুকেও সঙ্গ দিতে হয়। ঠান্ডার জন্য ঠিক সাহসে কুলাচ্ছে না । তবু শবযাত্রায় শরিক হবার কথা মনে রীতিমতো খোঁচা দিচ্ছে।
ওদের ট্যাক্সি শবদেহের কাছে এসে গতি কমাল। মবানী ঘাড় বের করে কিছু বলায় ট্যাক্সিটা ডাইনের রাস্তায় ঢুকে গেল।
মনে ধাক্কা লাগায় ওভারকোট চাপিয়ে , চপ্পল পায়ে নিচে নেমে এলাম। পা- দুটো আপনা আপনি আমাকে যথাস্থানে পৌঁছে দিল। পেছন পেছন হাঁটছি । চারজন কাঁধ দিয়েছে আর সাতজন সঙ্গে সঙ্গে চলেছে । সপ্তম ব্যক্তিটি আমি। ভাবছি, কেউ মারা যেতে পরিস্থিতি কত দ্রুত বদলে যায়। গত বছর দেওয়ান চন্দের মেয়ের বিয়েতে হাজার হাজার লোক এসেছিল। সারি সারি কার…
দেখতে দেখতে আমিও লিঙ্ক রোডে পৌঁছে গেছি । মোড়ে বাঁক ঘুরলেই পচকুইয়া শ্মশান।
বাঁক ঘুরতেই দেখি, মানুষের ভিড় আর সারি সারি কার । খানকয়েক স্কুটারও রয়েছে। মহিলাদের জটলা থেকে শোরগোল কানে আসছে । ওদের দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও ঠিক যেমন কনটপ্লেসে দেখা যায়। সবার চুলের স্টাইল ভিন্ন ভিন্ন । পুরুষদের জটলা থেকে সিগারেটের ধোঁয়া উঠেছে। মহিলাদের লাল লাল ঠোঁটের ফাঁকে সাদা দাঁত ঝকঝক করছে। চোখে গর্বের ঝিলিক…
শবদেহটা বাইরের চাতালে রাখা। চারপাশ এখন নিস্তব্ধ। সমস্ত লোকজন শবের কাছাকাছি জড়ো হয়েছে । কারেরে শোফাররা ফুলের তোড়া হাতে নিজ নিজ কর্ত্রীর ইঙ্গিতের অপেক্ষা করছে।
আমার চোখ গেল বাসওয়ানির দিকে। মিসেস কে সে চোখের ইশারায় শবদেহের কাছে যেতে বলছে । মিসেস অবশ্য অন্য এক মহিলার সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত। সর্দারজি, অতুল মবানিও পাশে দাঁড়িয়ে। শবের মুখ থেকে আচ্ছাদনটা সরানোর পর মহিলারা একে একে চারপাশে ফুলের তোড়া রেখে যাচ্ছে। দায়মুক্ত শোফারেরা কারের পাশে দাঁড়িয়ে এখন সিগারেট টানছে।
এক ভদ্রমহিলা মালা রেখেই কোটের পকেট থেকে রুমাল বের করল । রুমালটা চোখে রেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পেছনে সরে গেল।
দেখাদেখি অন্য মহিলারাও রুমাল বের করেছে, তাদের নাকি – কান্নার ফোঁসফোঁস শব্দ কানে আসছে । শবের শিয়রের কাছে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু লোক। নাকি – কান্নার বহর দেখে মনে হয়, মহিলারাই মনে বেশি আঘাত পেয়েছে।
অতুল মবানি হাতের পোর্টফোলিও থেকে এবার একটা কাগজ বের করে বাসওয়ানিকে দেখাচ্ছে। আমার ধারণা , ওটা পাসপোর্ট এর ফর্ম।
শবদেহ শ্মশানের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছে সকলে।
শোফাররা এতক্ষণে সিগারেট শেষ করে, নইলে নিবিয়ে দিয়ে নিজের নিজের কারের পাশে সটান দাঁড়িয়ে।
শবটা ভেতরে চলে গেছে।
শোকজ্ঞাপন করে সকলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
কারের দরজা খোলা- বন্ধ করার আওয়াজ কানে আসছে। স্কুটার স্টার্ট হচ্ছে, রিডিং রোড বাসস্টপের দিকেও এগোচ্ছে কেউ কেউ।
এখনও কুয়াশা কাটেনি । রাস্তায় বাস ছুটছে। মিসেস বাসওয়ানি বলছে , ‘প্রমিলা সন্ধ্যায় ডেকেছে, যাবে না ? ওদের কার নিতে আসবে।’ বাসওয়ানি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
মহিলারা স্মিত হেসে পরস্পরের কাছে বিদায় নিচ্ছে , ‘ বাই-বাই…।’ কারগুলো একে একে ছেড়ে যাচ্ছে ।
অতুল মবানি আর সর্দারজি রিডিং রোড বাসস্টপের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ভাবছি, তৈরি হয়ে এলে আমিও সোজা কাজে চলে যেতাম। কিন্তু এখন ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা ।
চিতায় আগুন দেওয়া হয়েছে । গাছতলার বেঞ্চে চার-পাঁচজন বসে। আমার মতো ওরাও তৈরি না হয়েই এসেছে। নিশ্চয় ছুটি নিয়েছে , নইলে তৈরি হয়ে আসত।
বুঝতে পারছি না , ফ্ল্যাটে গিয়ে তৈরি হয়ে অফিস যাব , নাকি একটা মৃত্যেুর অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নেব। মৃত্যু তো সত্যি হয়েছে , আমিও শবযাত্রার শরিক হয়েছি।
…………………………………
কমলেশ্বর- জন্ম ৬ জানুয়ারি , ১৯৩২ মৈনপুরি ,উত্তরপ্রদেশ। হিন্দিতে এম. এ। গল্প-উপন্যাস ছাড়া ৭০ টির বেশি সিনেমার চিত্রনাট্য – সংলাপ লিখেছেন। গুলজার পরিচালিত সিনেমা আঁধি (১৯৭৫) , মৌসম (১৯৭৫) তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত । সম্পাদনা করেছেন ‘নয়ী কাহানিয়া’ , সরিকা , কথাযাত্রা’র মতো বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা। দৈনিক জাগরণ , দৈনিক ভাস্কর সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন । পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার (১৯৭৯), সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (২০০৩) আর পদ্মভূষণ (২০০৫) । জীবনাবসান ২৭ জানুয়ারি ২০০৭, ফরিদাবাদ।
Tags: অনিন্দ্য সৌরভ, অনুবাদ গল্প, কমলেশ্বর, দিল্লিতে একটি মৃত্যু
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।