01 Feb

বিংশতিঃ পাঠ প্রতিক্রিয়া

লিখেছেন:উষারঞ্জন ভট্টাচার্য


‘বিংশতি’ নাড়াচাড়া করতে গিয়ে তিন মাপের গল্প পেলাম । অণু, ছোট আর বড়ো । ছোট গল্প ‘one single vivid effect’ । কতো যে তার সংজ্ঞা দেশে বিদেশে । বাংলা ছোট গল্পের ভগীরথ রবীন্দ্রনাথ – সকলেই সে কথা বলেন । ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথার সরল ও সবল আলেখ্য দিয়ে তিনি বাজিমাত করেছেন । জমিদারি দেখতে গিয়ে এমন সব গল্প লিখলেন, যথাকালে অনূদিত হলে সেখান থেকেই উঠে আসতো নোবেল পুরস্কার বলে আমার বিশ্বাস!

গল্পের শিল্প বিচার কঠিন কাজ । আসুন, আমরা বরং হেলতে-দুলতে চলি, সাজানো বাগানের শোভা দেখি আর কিছু মনের কথা বলি ।

যাকে আমরা অণুগল্প, গল্পাণু বা গল্পস্বল্প বলি, এদের চমক দেখেছি ‘বিংশতি’তে । এই যে মাদার’স ডে ( পৃ ৮৮ ), হুকিং ( ১০৮ ), গুরুগ্রামের গ্রেগর সামসা ( 125 ), যুগলবন্দী ( ১২৬ ), পারাপার ( ১২৯ ) – এরা মুহূর্তে পাঠককে আকর্ষণ করে তার মন ভরিয়ে তোলে । মাদার’স ডে গল্পে সুকান্ত পরিকল্পনা করছে মাকে নিয়ে ফেসবুকে একটা ‘জবরদস্ত স্ট্যাটাস’ দেবে, ‘সুন্দর গিফট’ দেবে মা-কে । প্রচণ্ড কাজের চাপে হাওয়ায় উড়ে গেলো তার সংকল্প । ক্লান্ত সুকান্ত বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে । এক সময়ে তার ঘুম ভেঙে যায় মায়ের কোমল হাতের স্পর্শে । আনুষ্ঠানিকতার গায়ে কে যেন চড় মারলো – আরে, এমন সম্পর্ক যে শ্বাশ্বত ! গুগল গল্পে ইঞ্জিনীয়ার লেখকের কলমে ফুটে ওঠে মগজের অপরিচিত বিচারবোধের ফাঁকটি – এখানেও মশকরা, যেন নিজেকে নিয়েও !

এই ধারার সব থেকে আকর্ষণীয় গল্প হুকিং । ঋভুর গ্রাউনডফ্লোরের নতুন ফ্ল্যাটে আপাতত ঋভু একা । তার বউ ছেলেকে নিয়ে ক’দিনের জন্য গেছে অন্যত্র । ঋভুর ছোড়দিদা, রিটায়ার্ড হেডমিস্ট্রেস – রন্ধনপটীয়সী – ক’দিনের জন্য এসেছেন ঋভুর কাছে । খুঁতখুঁতে মেজাজ, তস্কর-সতর্ক তিনি, ঋভুর ফ্ল্যাটের জানলার নিরাপত্তার সীমাবদ্ধতা দেখে ক্ষুব্ধ । শীতের দুপুরে হঠাৎ চোখে পড়ে – একটি বারো-তেরো বছরের ছেলে, উস্কো-খুস্কো চুল, পাঁজর বের-করা খালি গা, আঁকশির মতো একটা কিছু দিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির বাচ্চা ছেলে বুবলুর জ্যাকেট । পারলেন না চিৎকার করতে । বহু বছর আগে কিশোর বয়সের পুত্রহারা হেডমিস্ট্রেসের বুকে নিজের অজান্তেই হঠাৎ করে বইতে থাকে করুণাধারা । এমন রূপান্তর পাঠককে আন্দোলিত না করে পারে ?

গুরুগ্রামের নির্জন পথে বাঁদরের নখরাঘাতে বিক্ষত স্বামীর হাতে টেডভ্যাক ইনজেকশন লাগিয়ে দেন ডাক্তার গিন্নী । সদা খিচখিচে স্বামীর শরীরে, আচরণে কিছু যদি বৈকল্য ঘটেই যায় তাহলে কি করে বোঝা যাবে ? তাই জরুরী ইনজেকশনের নিদান ! পরদিন ব্রেকফাস্টে প্রবল উৎসাহে দু-দুটো কলা খেয়ে ফেললেন সেই স্বামী । তারপরেই মনের শঙ্কা -এ  কি হলো তাহলে ? ভর করে নি তো ? মনের বাঘ যে বনের বাঘের চেয়েও মারাত্মক ।

যুগলবন্দী গল্পে কোলকাতার মুখারজি দম্পতির দিল্লী সফর । হিন্দি অভিযানে বিপর্যস্ত দুজনেই । দুটো হিন্দি শব্দ ‘পোতি’ ( নাতনি ) আর ‘সর্দি’ ( ঠাণ্ডা ) কি যন্ত্রণাই না দিলো তাঁদের ! বিজ্ঞানবুদ্ধি আর দৈবনির্ভরতার সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে ডাক্তার চ্যাটারজির পা-দুটো – বুঝতে গেলে পড়তে হবে পারাপার গল্পটি ।

গল্পকার, উচ্চশিক্ষিত, রসিক, বহু অভিজ্ঞতায় পোক্ত, পড়তে পড়তে অবাক হয়েছি – বিপুল অভিজ্ঞতাই শুধু নয়, কী যে ভাণ্ডারের রস-রূপান্তর !

‘সাতটা বেড়াল, দুটো কুকুর আর দুটো সাদা ইঁদুর’-এর জন্য নববিবাহিতা সীমন্তিনী সুবিক্রমে ঘর ছাড়লো – স্বামীটির অ্যালারজি জন্তু-জানোয়ারে । পশুপ্রেমীর দ্বিতীয় বিবাহ বছরখানেক বাদে – এ স্বামী নিজেও ডিভোর্সি । স্ত্রীর মর্মব্যথা বোঝেন,  সকলরকম চাহিদা সহায়ক, এমনকি সীমন্তিনীর জন্য ঘরে সাজানো আছে পুতুল-পশু -সেই পুতুলরাই এখন ঘরের শোভা ।গল্পনামটিও অর্থবহ – সীমন্তিনীর বিয়ে (পৃ ১৩ )।গল্প থেকে শিক্ষা আছে – নারী পুরুষ দুইয়েরই জন্য।

কিটি পার্টির সদস্যদের আলোচনার অভিনব বিষয়বস্তু থেকে মাতৃত্বের মাহাত্ম্য জেগে ওঠা নন্দিতার মন ( অস্তু পৃ ৫ ) ; অভিনয়কলায় দক্ষ অতীনকে অসুস্থ মরণাপন্ন মায়ের সামনে মৃত পুত্রের ভূমিকায় স্বামী অভিনয় করায়, স্ত্রীর শেষকটি দিন আনন্দে ভরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা ক’রে ( অনৃত পৃ ২৫ ) ; নরসুন্দর কানাইদাকে নিয়ে কৌতুকমাখা স্মৃতিচিত্রণ ( মিষ্টি কুমড়ো ও এক ভালমানুষের গল্প পৃ ৫৯ ), লেখার মুনশিয়ানায় প্রায় লেখকের আত্মস্মৃতির চেহারা নিয়ে নেয় ; বড়ো দুর্ঘটনা এড়ানোর সূত্রে মাতৃমহিমা ( আম্মা পৃ ৭৬ ), অপ্রাকৃতিক পরিবেশ রচনা ও অপ্রাকৃতিক চরিত্রের বাৎসল্য ( আত্মজা পৃ ৯৪ ); বাল্যস্মৃতির শৈলীতে লেখা ইস্কুলের রাস্তার ধারের ঘুগনি-দোকানি ক্ষুদিরাম ( ইস্কুলের ক্ষুদিরাম বা ক্ষুদিরামের ইস্কুল পৃ ১০০) বা সেই স্বভাবকবি মাস্টারমশাই, যিনি মুখে মুখে ছড়া বানিয়ে বালখিল্য ছাত্রদের দাবি মেটান, তাঁর ‘অশ্রুবিন্দু’ ( ছড়াদাদু মাস্টারমশাই পৃ ১৩১ ), ‘অর্বাচীন’ ক্ষুদ্রাপরাধীদের সংশোধনের চেষ্টা ( অর্বাচীন পৃ ১৮৮ ), নারীমনের জটিল গহীনে প্রেমের অভিনব উন্মেষ ও প্রকাশ ( একটি প্রেমের গল্প পৃ ১৭২ ), এ সবই আমাদের গল্পের বিচিত্র ভুবনে আনন্দভ্রমনে নিয়ে যায় ।

অপেক্ষাকৃত বড়ো দৈর্ঘ্যের গল্পও আছে, যথা পরম ধর্ম ; বিপত্তারিণী ; জগন্নাথ । জগন্নাথ সব থেকে দীর্ঘ, তেত্রিশ পৃষ্ঠা । পরম ধর্ম গল্পে প্রমোটারের হাতে প্রাচীন মিত্তির বাড়ি ভাঙ্গা হচ্ছে ; যুগের চাহিদায় নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি হবে । পটকা আর বিলটু গল্পের দুই মুখ্য চরিত্র – এরা দুজনে দুজনের কাছের যদিও, মনের দিক থেকে দুই মেরুবাসী । একের জ্বলন, অন্যের শুভ সংস্কার, গল্পকারের শুভচেতনাকে প্রকট করে । ভারি সুন্দর ।

অবিভক্ত বিহারের আধা-শহর ঝুমরি তিলাইয়াতে বারোয়ারি দুর্গাপুজোর বলতে গেলে কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্গদেশের ফরিদপুরের গরীব উদ্বাস্তু ব্রাহ্মণ ‘বিশু চক্কোত্তি’ । সে ‘হলুদের  গুঁড়ো’, কিন্তু সব বড়ো মানুষদের মাঝখানে থেকেও সে বউ, দুই শিশুপুত্রের বা নিজের জন্য পুজো উপলক্ষে নববস্ত্রের জোগাড় করে উঠতে পারে না – তার কি উপায় সে বার করে ? সে কি দেবী নির্দেশিত না কি অভাবে স্বভাব নষ্ট ? কি নিষ্ঠুর সত্য !

জগন্নাথ  দীর্ঘতম গল্প – মানুষের সুকোমল চারুবৃত্তি আর কদর্য বিত্তস্ফিতির চিরাচরিত লড়াইয়ের গল্প । এ লড়াই কবে কোথায় শেষ হবে পাঠক পড়তে পড়তে অবশ্যই ভাবতে থাকবেন ।

বিংশতি যেন খেলার মাঠ ; তার হরেক রঙ, হরেক শব্দ, হরেক মুখ, হরেক মুখোশ, হরেক অভিজ্ঞতার চিত্রমালা !  শত গল্পের উপকরণ । পড়ে সুখ, পড়িয়ে গর্ব ।

( লেখাটি আমাদের হাতে এসেছিল একটি চিঠির বয়ানে। প্রকাশ কালে সেই বয়ানের কিছুটা বদল করা হয়েছে )  

………………

ডঃ উষারঞ্জন ভট্টাচার্য

 আসামের হাইলাকান্দি শহরের আদিনিবাসী, অধুনা গৌহাটী শহরের স্থায়ী প্রবাসী ডঃ ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য  প্রতিষ্ঠিত প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও কৃতবিদ্য রবীন্দ্র-গবেষক । গৌহাটী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ও ডীন অফ ফ্যাকাল্টি অফ আর্টস, ডঃ ভট্টাচার্য প্রখ্যাত অসমীয়া সাহিত্যিক বীরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্যের ‘মৃত্যুঞ্জয়’ উপন্যাস অনুবাদ করে ২০০২ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন । রবীন্দ্র-সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর প্রচুর গবেষণামূলক প্রবন্ধ গত কয়েক দশক দেশের অনেক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে গুণীজনের সমাদর লাভ করেছে । আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘উত্তর-পূর্ব ভারতে রবীন্দ্রচর্চা’ প্রবন্ধের বইটি দেশের রবীন্দ্র গবেষকদের দ্বারা উচ্চ-প্রশংসিত ।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ