একসঙ্গে দু দুটি গ্রন্থ হাতে এল। গল্প, শ্রীরামপুর এবং কবিতা, শ্রীরামপুর। অনুমান করতে পারি আমার মতো অনেক পাঠকেরও মনে হয়তো এই মুহূর্তে প্রশ্নের উদয় হচ্ছে বা হয়েছে বইদুটির নামকরণ নিয়ে। গল্প এবং কবিতার পর কমা, তারপর লেখা শ্রীরামপুর। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া যায় নামকরণে বলতে চাওয়া হয়েছে শ্রীরামপুরের গল্প এবং শ্রীরামপুরের কবিতা। নামকরণেই এরকম এক সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক স্থান বেধে দেওয়া! মনে হতে পারে এও কি এক রকম সংরক্ষণবাদ? শুধু ঐতিহ্যবাহিত শহর শ্রীরামপুরের ভৌগোলিক সীমানায় যারা রয়েছেন, সেটাই মাপকাঠি হয়ে উঠেছে গল্প বা কবিতা নির্বাচনে? মনে এরকম প্রশ্ন সত্ত্বেও বইদুটি পড়া শুরু করলাম যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে। তার একটা কারণ নিশ্চয়ই বাংলা সাহিত্যে ইতিমধ্যেই যাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি, এরকম অনেক কবি ও গল্পকারের লেখা। লেখক তালিকায় নাম রয়েছে এমন কয়েকজনের, যাঁদের লেখা আগেও চোখে পড়েছে এবং নজর টেনেছে। দ্বিতীয় একটি কারণ বইয়ের সম্পাদকীয় নিবেদন। বলা হচ্ছে শ্রীরামপুর পৌরসীমার ছদ্মসীমান্তের মধ্যে থেকে…। অর্থাৎ সেই সীমান্তটাই চূড়ান্ত নয়। তার আড়ালে রয়ে গেছে আরও কিছু। এমন কারণ, যেখানে সীমান্তই ছদ্ম হয়ে যায়। কী সেটা? সে উত্তরও রয়ে গেছে বইয়ের দু মলাটের ভেতর। ‘ভ্রমর ঘাটের শেষ সিঁড়িতে একা আমি/ নদী যেখানে খুব কাছাকাছি/ ছলাৎ ছলাৎ নূপুরের শব্দ শোনায়/ ঢেউয়ের পরতে পরে শেকল ভাঙার গান………..’ যে বইযের কবিতায় শেকল ভাঙার গান উচ্চারিত হয় ভৌগোলিক সীমারেখায় আর তা আবদ্ধ থাকে না। বরং হয়ে পড়ে সব দেশের সব পাঠকের নিজস্ব অনুভব। সেই সৃষ্টির রূপকার যাঁরা, ঘটনা চক্রে তাঁদের সঙ্গে যোগ রয়েছে উইলিয়াম কেরি, রামমোহন রায়, রামরাম বসু,পঞ্চানন কর্মকারের স্মৃতি বয়ে নিয়ে যাওয়া এই শ্রীরামপুর শহরের।
৩১ জন গল্পকারের গল্প রয়েছে গল্প শ্রীরামপুরে। রয়েছে বইযের চার সম্পাদকের গল্পও। রামকিশোর ভট্টাচার্যর গল্প ‘পথ’ আক্ষরিক অর্থেই পথেরই গল্প। পথের গল্প আগেও লেখা হয়েছে, বা বৃহত্তর অর্থে সব গল্পই পথের গল্প, কিন্তু রামকিশোরের গল্পে পথই কথক হযে উঠেছে। পথেরই দৃষ্টিকোণে চলে আসে অসংখ্য মানুষ, গাছপালা এবং প্রেমিকা এক নদী। যে নদীর চরিত্রের সঙ্গে আশ্চর্য এক মিল পাওয়া যায় অনেক স্ত্রী, অনেক ঘরণীরএবং অনেক সংসারেরও। শেষে কোন পথই যেখানে থাকে না। মনে হয় পথের বলা এ গল্প তো আসলে আমাদের জীবনেরই গল্প। সুশোভন অধিকারীর গল্প টিন বাজারের কালো ঘোড়া পড়তে পড়তে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক গল্পের আমেজ পাওয়া যায়। সুশোভন যথেষ্ট মুন্সীয়ানার সঙ্গে এক রহস্য তৈরি করতে পেরেছেন গল্পের ভেতর দিয়ে। লকডাউন আমাদের জীবনের নেপথ্যে থাকা অনেক ঘটনা, অনেক অন্ধকার, অনেক আলো টেনে বার করেছে চার দেওয়ালের অভ্যন্তরে। আকাশের নীচে ছাদে ছাদে জুড়ে যাওয়া গল্প কীভাবে যেন জুড়ে দেয় পিতাকে তাঁর সন্তানের সঙ্গে। তবুও এ গল্প পড়ে মনে হয় এতবড় এক ঘটনা এতদিন সন্তানের আড়ালে থেকে গেলেও তাঁর কিছু ঘাত প্রতিঘাত বোধহয় আছড়ে পড়ার কথা দুই সংসারেই। ধ্রুব বাগচীর গল্পে তা হয়নি। করোনা আমলে চেনা মানুষেরও অচেনা হওয়ার গল্প শুনিয়েছেন গৌতম হালদার। তবে সে কাহিনী বাস্তব সত্য ছাড়িয়ে গল্প হয়ে উঠেছে কম। যা হয়নি ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে। করোনা আবহেই দিব্যি প্রেমের গল্প হয়ে ওঠে। বইয়ের শেষ গল্পে এ যেন ‘ফাউ’ পাওয়া। মৃদুল দাশগুপ্ত গল্প লেখেন হাতে গুনে। হয়তো সে কারণেই মৃদুল দাশগুপ্তের প্রতিটা গল্পের পটভূমি, গল্প বলার ধরণ নতুন করে ভাবায়। মৃদুলের এই গল্প ‘স্পর্শ’ আসর জমিয়ে দেয় কাহিনির জন্যে ততটা নয়, যতটা গল্পের বুননের বা আঙ্গিকের জন্যে। গল্পের শেষ পর্যন্ত না পড়লে ধরাই যায় না মৃত নাকি জীবিত ব্যক্তিরই জবানবন্দি শুনছেন পাঠক। এই সঙ্কলনেই রয়েছে দেবাশিস মজুমদার ও সমীর ঘোষের গল্প। দুজনেই বড় হয়ে উঠেছেন শ্রীরামপুরের এই সাংস্কৃতিক আবহে। দেবাশিসের গল্প সীমারেখা বিশ্বাস অবিশ্বাসের সীমায় দাঁড় করিয়ে রাখে পাঠককে। এরকমও হয় নাকি-গল্প শেষ করার পরেও মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে এই প্রশ্ন। সমীর ঘোষের গল্প ‘একটু শীতের জন্যে’ আবারও হ্যাভস আর হ্যাভস নট-এর প্রসঙ্গই তুলে আনে। তবে সমীর যে জায়গায় ধাক্কা দিতে চেয়েছেন, তা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের । হ্যাভস বলতে সত্যিই যাদের কথা বলা হয়, তাঁদের মূল্যবোধে কোথাও বুড়োবুড়ির মৃত্যু সংবাদ প্রবেশ করতে পারে না। এই সংকলনেই রয়েছে ৯৭ বছরের গল্পকার শচীন দত্তের গল্প। এই বয়সে পৌঁছেও যে গল্প উনি লিখেছেন,তার প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক জিজ্ঞাসা থাকলেও বলতেই হবে, শতবর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া এই গল্পকারের চোখ এখনও দেওয়ালে আঁকা রঙিন ছবি দেখতে পায়।
গল্প শ্রীরামপুরের এটি দ্বিতীয় সংকলন। প্রথম সংকলনে ছিল ২৮ কবির কবিতা সংকলন, দ্বিতীয় সংকলনে রয়েছে ৪৪ কবির কবিতা। প্রথম সংকলনের ২৫ বছর পর এই দ্বিতীয় সংকলন। দুই সংকলনের এত বছরের তফাত হয়তো মন খারাপ করে দেয়, উচ্চারণ করতে হয়, ‘সকালগুলিও ইদানীং খুব ম্রিয়মান/ কিছু কিছু দুপুর চুপচাপ বৃষ্টিতে ভেজে….’। তার সঙ্গে সঙ্গে সামনে উদ্ভাসিত হয় আর এক সত্য। ২৫ বছর পরেও দ্বিতীয় সংকলন প্রকাশের প্রয়াস জারি রাখেন এ শহরের কিছু কবি। সে কারণেই চমক লাগে না, যখন এক কবি বলে ওঠেন, ‘দলছুট কালো মেঘ চরাচর ভাসাবার আগে/ মোচ্ছব শুরু হোক সারারাত মহুয়ার বনে….’ অনেক প্রতিবন্ধকতা, অনেক নেইয়ের মধ্যেও মোচ্ছব জমাবার স্বপ্ন দেখেন এক কবি। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ কবিতা, শ্রীরামপুরেরই এক কবি তো বলবেন, ‘মাঝে মাঝে মূর্ছার অন্দরে উর্বরতা দেখে শূন্যরাও দেবী হয়ে ওঠে…..’ ৪৪ জন কবির সব কবিতাই কি ভাবনার উপকরণ দিয়ে গেল? মনের ভেতর এ প্রশ্ন উঠলেও উত্তর দেওযার সময় এখনও আসে নি। কারণ ‘গুপ্তপুঁথি আমি দিয়ে যাব পাণ্ডুলিপিখানি/ বিরাট কাঠের ঐ পেটিকায় রেখে দিও গৃহে এক কোণে’
চিন্ময় ভট্টাচার্যঃ লেখক প্রাবন্ধিক ও বাংলা সংবাদমাধ্যমে ‘কপি’ সম্পাদনা জগতে সুপরিচিত নাম।বহু টেলি ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যকার।নিজে নাট্যকর্মী।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।