15 Apr

বাংলা,বাঙালি, নতুন বছর- আজকের প্রজন্মের সম্ভাব্য চিন্তা

লিখেছেন:তন্বী মুখোপাধ্যায়


বাঙলা নববর্ষ, সেটা মাথায় রেখেই ভাবনার খাত কাটা এখন। দেখা যাচ্ছে বাঙলা বছরের শেষপাতাটাই শুধু ক্যালেণ্ডারে টিঁকে আছে। এবার নতুন ক্যালেণ্ডার আসবে। নস্যাৎ হয়ে গেলো একটু একটু করে গোটা একটা বরষকাল। ইংরেজি মাপেই হোক বা বাঙলা মাপে, বিশেষ একটি সম্বৎসর,-যার বারোটি মাস ‘নেই’ হয়ে গেল যে। পড়ে গেল ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। হালখাতা হবে, মিষ্টি খাওয়া, আগেকার আমরা বড়দের প্রণাম করে থাকি, এবারো আশীর্বাদ নেবো, শুভেচ্ছা বিনিময় আধুনিক কালে খুব চলছে, কোনো কোনো বাড়িতে নতুন পোশাক পরার চল আছে-তাও মানা হবে, নতুন ক্যালেন্ডার,পাঁজি,বিশেষ অনুষ্ঠান হবে গণমাধ্যমে।আস্তে আস্তে বছর জেঁকে বসবে,আবার একদিন তার পাতা শেষ হবে।আমরাও কতজন আর একটা কোনো নববর্ষে থাকবো না।

জীবনের সঙ্গে আমরা কখনো দেখি ‘যুদ্ধ’কে,কখনো দেখি ‘দর্শন’কে তার সঙ্গে একাত্মভাবে, তেমনি জীবন আমাদের কাছে’যাত্রা’। একটা সন,শন হয়ে যাত্রাপথের মাঝে মাঝে বুঝিবা মাথা উঁচিয়ে ওঠে। বয়সের মাঝেও স্টেশনগুলো অর্জিত উপলব্ধির ঠিকানা নিতে বলে। নিছকই অনন্ত মহাকালের পরিহাস বলে মানব মন বিভাজনকে মানে না,তা হয় নি। ঠিকই সুবিধামতো ‘বারোমাস্যা’ দাখিল করেছে,কখনও তা সুখের,কখনও দুঃখের, কী জীবনের কষায়-মধুর স্বাদের সংবাদ!

তারপর মানুষের জীবনের সঙ্গে সময় সংশ্লিষ্ট না হলে তা ইতিহাসে পরিণত হ’তে পারে না যে। মানুষই আজকের দিনে সময়ের উদাসীন চলাকে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-সাধনে একান্ত যত্নবান বলেও আবিষ্কার করেছে,তথা সেই স্বাক্ষরিত স্বরূপই  কালের মোহকারি চরিত্রবৈশিষ্ট্য হয়ে গিয়েছে। অকারণ অর্থহীন হলে তা অবহেলিত হতো,তাতো হয় নি। বারবার তাই যে বছর শেষ হলো সেও উজ্জ্বল হয়ে থাকলো আমাদের ইতিহাসে। ইতিহাস না বলে ব্যক্তি মানুষের কাছে তাকে স্মৃতি বলেছি। যে মানুষ গড়ে উঠেছে সে চির-কালের সন্ততি। মানুষের কাজের খতিয়ানের অস্তিতাই তার অস্তিত্ব। আবর্জনা বাদ দিয়ে যতটা তার সময় থেকে সারবত্তা পাওয়া গেলো তাই সঞ্চয় করে রাখা থাক। এজন্য বছরের শেষ সংক্রান্তির চড়কে কিছুটা গ্লানিমুক্ত হতে পারি।

বাংলা বছর শুরু হয় বৈশাখ মাস দিয়ে। বাংলা কবিতার রাজাধিরাজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন ২৫ শে বৈশাখ। বাংলাদেশে বৎসরের এ প্রথম মাস অথচ গরম দেশের ভীষণ গ্রীষ্ম। অদ্ভুত কিন্তু শীতের দেশের জনসাধারণও ঠিক তেমনি তাঁদের নববর্ষ-বরণ করেন শীতল জানুয়ারিতে। প্রসন্ন না হলেও প্রশস্ত হয়ে ওঠে বৈশাখ,কালবৈশাখীর মেঘগর্জনে,জরা-দূর করা ঝড়ের প্রাণাবেগে, ও শুকনো গাছের ধারাস্নান- ঔৎসুক্যে। নৈসর্গিক বদলের বৈপ্লবিক সূচনাকে স্বতই বাঙালি বর্ষবরণের ক্রান্তিতে নন্দিত করে আনন্দিত হয়।

স্বতন্ত্র সার্থকতার দৌত্য। বর্ষবরণের প্রয়োজনের তালিকা করা যাবে। সবথেকে চল কথা ‘বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণে’র সপক্ষে ওকালতিও থাকবে। ধর্মনিরপেক্ষ এতো সহজ সুন্দর উৎসবের অবকাশ আর হয় না নতুন বছর পড়ার মতো। আসলে যা সমূহের মনের উন্নতির একটু হলেও আনুকূল্য করে তাকে বুদ্ধিবিচারে প্রশ্নজর্জর করে ক্লান্ত করে ফেলা গেলেও তাকে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব। ‘প্রথম’ সব কিছুকে মানুষ বুদ্ধিবিবিক্ত ভাবেও ভালোবাসে,সেখানেও এই নব বর্ষের অদরকারি একটা মহিমা; জন্মদিন যেমন- “ভোরবেলাকার পাখির ডাকে প্রথম খেয়া এসে ঠেকল যখন সব-প্রথমের চেনাশোনার দেশে” নাম ভোলা ফুল ফুটলেও সেই ক্ষণকে কবি মনে না করিয়ে পারেন নি। ‘চৈতালি’ কাব্যগ্রন্থের বর্ষশেষ কবিতায় কিন্তু সময়-সচেতনায় নয়, ভৌম উচ্ছ্বাসে হয়েছে অনন্ত ও ক্ষণিকের গহন মিলন- “পাখিরা জানে না কেহ আজি বর্ষশেষ,/বকবৃদ্ধ-কাছে নাহি শুনে উপদেশ।/ যতদিন এ আকাশে এ জীবন আছে/ বরষের শেষ নাহি তাহাদের কাছে।”

ক্ষণে ক্ষণে, আবার বিশেষ অক্ষণেও সুর বাঁধার কাজ চলে, তা নির্ভর করে যন্ত্রীর কান পাতার সময়ের ওপর। কখন যে কোন তানে বর্ষণ নামবে,তা জানা নেই বলেই বছরের প্রথম দিন থেকে ঢ্যাঁড়া দিয়ে রাখি,যা বিগত কালে সেই প্রার্থিত উচ্চতায় গিয়ে উঠতে পারে নি, তাকে আবার সাহস যোগানোর দিন – দেখা যাক আরো এক বছরের বিরহকালে যদি সে রচনা করে ‘নব মেঘদূত’। যাহোক তাহোক, আমরা নিশ্চিত জানি,মানুষের একটি ছোটো পদক্ষেপ কোনোদিন ‘giant leap for mankind’ বলে নির্ণিত হয়েছে। বিরাট লম্বা যাত্রার জন্য পা-ফেলে দাও, একদিন পথযাত্রী গন্তব্যেও পৌঁছে যাবে। বছরের প্রথম দিন তাকে আশ্বস্তই করে। শুরু আমাদের নৈরাশ্য দেয় না। সেই সব চিত্তবৃত্তির আগ্রহে নতুন বছরকে আকাঙ্ক্ষা করে থাকি। বিরাট কালকে এই মানব-লীলার খাতিরে ভাঙা নেহাতই নিষ্প্রয়োজন বলার পক্ষে নই।

নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পুরোনো প্রজন্মের তর্ককে স্বাগত। হয়তো পুরোনো মানুষদের চেয়ে তরুণরা হবেন বেশি বুদ্ধিবিশ্বাসী। আরে বাবা সময় যাই হোক, ক্রেতা বিক্রেতাকে হিসেব নিকেশ, ধার-বাকি, আদায়-উশুল প্রভৃতিকে গুরুত্ব দিতেই হবে। হালখাতা বা পুণ্যাহে ধার শোধ করা হতো, তারপর বসতো নতুন খাতায় হালের বা সাম্প্রতিক অঙ্ক,বদলে বছরের প্রথম দিনে উত্তমর্ণ দেন এক প্যাকেট মিষ্টি ধরিয়ে। আগের কর্জ-প্রথা আমূল পালটে গেছে সত্যি, কিন্তু কিছু পাওনা যদি কারও মিটিয়ে দিতে পারা যায়,তার স্বস্তি যথেষ্ট।অনেক রকম সুবিধে দিয়ে আজকালও ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা হয়।এসবই দরকারি।পাওনাদারদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ জুলুমের এতে সমাপ্তি অবশ্য হওয়া মুশকিল, নিরুপায় কতোভাবেই না ঋণ পরিশোধ করেছে, সে হিসেবে নববর্ষের মাথাতেও আছে ইতিহাসের কলঙ্কটীকা।

বুদ্ধি বিচার সতর্কতা চাই, যেহেতু “ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।” নতুন প্রজন্মের কাছে তা স্বীকার করা গেলে তাদেরকে একান্তে বলার থাকে প্রথা নয়, বিবেচনা করে বিতর্ক করে ভাবী বর্ষের আগমন সংক্রান্ত হিসেব করতে হবে। প্রকৃতিকে লুঠ করা যদি কমানো যায়, মানুষকে রক্ত-ঘামের বিনিময়েও যেন শিল্প, অবসর, অনেকের জন্য কাজ করার পরিসর দেওয়া যায়, তার সুদীর্ঘকালীন পরিকল্পনা যদি নাও বা করতে পারি, যা বৎসরান্তিক সে পরিকল্পনাকে রূপ দেওয়ার যদি প্রতিশ্রুতি দিই এ বছরের প্রথম দিনে অর্থাৎ ১লা বৈশাখে, তাহলে? পৃথক ব্যবসাদারের  এরকম একটা হালখাতা খোলা চাই। পরিবেশের কতোটা বকেয়া আমরা পরিশোধ করবো?- কেননা “আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার।”

Tags: , , , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ