নব বিবাহিত দম্পতিকে নিয়ে সাজানো গাড়িটা রোড থেকে ষ্ট্রিটে ঢুকতেই সীমন্তিনীর চোখে পড়ল – “Men At Work” এর বোর্ডটা।
সামনে তাকাতেই দেখা গেল কালো ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে আর তার সঙ্গে বিরক্তিকর ঘড়র ঘড়র আওয়াজ – রাস্তায় পিচ হচ্ছে। বোশেখের এই আগুনঝরা দুপুরে কতগুলি ভগবানের দূত দুইপায়ে এবং মাথায় মোটা চট বেঁধে কর্তব্যে রত। নিবেদিত প্রাণে নিপুণ কর্মসামঞ্জস্যে যৌথভাবে সমন্বয় সাধন করে একটা সম্পূর্ণ কাজ সম্পাদন করছে।
এই দৃশ্যকে কোনোক্রমে পাশ কাটিয়ে এগোতে গিয়েই যেন অবরুদ্ধ হল গাড়িটা- একদল উৎসুক আনন্দিত মানুষের ‘এসে গেছে – এসে গেছে’ – আওয়াজে, হুলু ও শঙ্খধ্বনিতে। রাস্তার এই-জায়গাটুকুতে পিচ করা হয়ে গেছে। তা এখনও শুকোয় নি। গাড়ির চাকায় চটচট আওয়াজ হচ্ছে। গাড়ির কাঁচ খুলতেই দমকা হাওয়া যেন ঝলসে দিল। তার মধ্যেই শুরু হয়ে গেল বধূবরণ।
সবকিছুই যেন গোলমাল লাগছে সীমন্তিনীর। গরম পিচের রাস্তায় পা দিতেই চটি আটকে গেল। অতি কষ্টে তাকে টেনে টেনে তুলে তিনটি পদক্ষেপ – তারপরই ঘরের শানবাঁধানো চৌকাঠ।
জীবনের অভিজ্ঞতায় সীমন্তিনী জেনেছিল – দুধে-আলতায় পা ডুবিয়ে মখমলের কার্পেটের উপর দিয়ে সাজানো ঘরে আবাহন করে বধুলক্ষ্মী কে অধিষ্ঠান করানো হয়। তাই গরম পিচের উপর দিয়ে শ্বশুরালয়ের প্রথম পদক্ষেপকে সীমু সুগন্ধি ও পুষ্পবৃষ্টির সঙ্গে কল্পনায় মিশিয়ে নেয়। ইতিবাচক ভাবনা। এতগুলো খুশি-মুখের সামনে –এছাড়া আর উপায় কি? কাউকে ব্যথা দিতে বা ব্যথা পেতে দেখতেই যে সবচেয়ে খারাপ লাগে ওর- তাই খুশি থাকো মন।- তোমার খুশিই আজ সকলের চাহিদা। তোমার হাসিমুখটুকুর জন্য তোমাকে কিছুই খরচ করতে হবে না- কিন্তু না পারলে সারাজীবন পস্তাতে হবে।
ব্যস্ত অনুষ্ঠান বাড়িতে টুকরো টাকরা কথা এদিক ওদিক থেকে কানে আসছে –
“বেশ সুন্দর বউ হয়েছে তো।”
“এত দূর থেকে যে এলো, খুব একটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে না তো?”
গা ঘেঁষে বসে মিষ্টি মেয়েটি আস্তে আস্তে বলে গেলো- “ তুমি কিন্তু আমার মামি হও।”
এই সুন্দর আবহে-অতর্কিতে- “ এই যে গো নতুন বৌ- নাও ঠাণ্ডা শরবৎ খাও। তোমার কালো রং রোদে পুড়ে তো একেবারে ঝামা দেখাচ্ছে।” সীমু মুখ তুলে চাইতেই দশাসই সুন্দরী মহিলা শরবৎ-ওয়ালাকে গ্লাসটা এগিয়ে দিতে ইঙ্গিত করলেন। সীমুর চোখে ও ঠোঁটে স্মিত হাসি। মনরে, সবকিছুকেই ভালোভাবে নাও। প্রশংসা করো। এই যে মহিলা আজ দশজনের সামনে দাঁড়িয়ে কালোকে কালো বা সাদাকে সাদা বলার হিম্মৎ রাখেন তাকে সেলাম করো।
পরিচয়,আশীর্বাদ,উপহারের পালা শেষ হতে হতে বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেলো।
খাবার পরে সীমন্তিনী শ্বশুরবাড়িতে একান্তই নিজের ঘরে কল্পনার সোনার পালঙ্কে শুয়ে আশার রঙিন সুতোয় মিহি জাল বুনতে বুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে গেলো।
“বৌ-দি চা খাবে না?” হাসি খুশি গলার আন্তরিক ডাকের সঙ্গে ননদিনির দল বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল।
আচমকা ঘুম ভেঙে অপ্রস্তুত সীমন্তিনী উঠে বসে।বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। মনে ভাবল এও এক পরীক্ষা। তাই হয়ত এই পরীক্ষায় পাশ করার জন্য মেধাবী সীমন্তিনী তার অবিন্যস্ত দীর্ঘ এলো চুল হাতের কৌশলে নিজের বশে আনতে আনতে উপস্থাপনা করল সহাস্য বদন। ভাবটা এমন যেন তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম বা এটাই চাইছিলাম।
ব্যস হাতে চলে এলো গরম চা- ঘড়িতে ৫.৩৮। বোশেখের বিকেলে এটাই তো চায়ের সঠিক সময়।
টুকটাক গল্প-গুজব চলছে। এত-বড় বিছানায় আরও একজন দুজন করে এসে জড়ো হলো-
কেউ কেউ মেঝের ফরাস,তাকিয়া হেলান দিয়ে সবিশেষ আলস্য উপভোগের সঙ্গে আসরে নিজের উপস্থিতি বজায় রাখল।
খাওয়া দাওয়া,পোশাক আসাক, হাসি গল্পের ভিড়ে সময় এগোতে লাগলো। সীমন্তিনী বলে-এতো সুন্দর পরিবেশে একটু নাচ-গান হলে বেশ হত।
সকলে হৈ হৈ করে সায় দিল-আবেদন মঞ্জুর হলো জেনে সীমন্তিনী যার পর নাই আহ্লাদিত।
লাগু-সন্ধ্যায় সীমন্তিনীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে সকলে গাইল ‘আনন্দলোকে-মঙ্গলালোকে-বিরাজ-সত্য-সুন্দর।’ শাশুড়ি মা বললেন “রবি ঠাকুর -এর গান”, জামাইবাবু বললেন “আমাদের স্কুলের প্রার্থনায় হতো”। সীমন্তিনী সব বাদ দিয়ে মনে মনে ভাবল-‘সত্য-সুন্দর’- অর্থাৎ যা সত্য তাই সুন্দর। নাকি সুন্দরই চিরসত্য…।
এই নাচ-গান আবৃত্তির স্বতঃস্ফূর্ত ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সকলের অংশগ্রহণ উৎসবের মাত্রাকে যেন পরিপূর্ণ করল। সকলেই খুশী-
বাড়ীতে নতুন বৌ এসেছে-সঙ্গে অতিথি অভ্যাগত।
আগামীকাল উৎসবের সমারোহ।
আজ রাতে ভাল খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে।
তাই সীমন্তিনীও এই খুশিতে সামিল করল নিজেকে।
বুকের ভিতর একটা চিম্চিম্ ব্যথা। ফেলে আসা পরিমণ্ডল ব্যথা দিচ্ছে ওকে –কিন্তু আধো মুখে থাকার উপায় নেই- অজস্র চোখ এদিক-ওদিক থেকে ওকে লক্ষ্য করছে যে –
তাই গড়িয়ে আসা চোখের জল বা গলার ভিতর দলা পাকিয়ে আসা কান্না সীমন্তিনী তার মানসিক পরিপক্বতায় সহজেই সর্বজনের দৃষ্টির অন্তরালে রাখল।
সকলেই একে একে নিজের কাজে চলে গেল।– সীমন্তিনী জানালার পাশে বসে একা আনমনে ভেবে চলে- এই যে শুরু হল ভিন্ন পথে চলা- সর্বক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ ফেলতে পারব তো? নাকি বেশি ভাবছি, পথই বলে দেবে কোনদিকে পা ফেলব।
মুহূর্তে সচকিত অনুভূতি শিহরণ জাগালো, দ্বিধাগ্রস্ত লাজুক শব্দবন্ধে-“এখানে কেমন লাগছে ? কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?”- ছিপছিপে ঋজু চেহারার দেবার্ঘ্য যেন পরকীয়া করতে এসেছে-এমনই উচাটন ও আধোস্বর।
ললিত ভঙ্গিতে সীমন্তিনী এক ঝলক দেখে নিলো এই পরিধিতে তার একমাত্র আপনার জন – মাত্র ঘণ্টা কয়েক আগে যার সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা পড়েছে সীমন্তিনীর অনেক অঙ্গীকার।
সীমন্তিনীর চোখের খুশী, আবেদন ও ভালোলাগা যেন নিমেষে ছড়িয়ে পড়ল দেবার্ঘ্যকে এই বার্তা দিতে যে- ভালো আছি। ভালো আছি।
দক্ষিণের বারান্দা থেকে রাশভারী আওয়াজ ভেসে এলো —‘ দেবা…আ… আজ কালরাত্রি না……’ সঙ্গে উৎসুক কোলাহল।
Tags: শর্মিষ্ঠা সেনগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
ইন্দ্রনীল on March 19, 2017
খুব ভালো লাগলো
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।