‘গেহ্রায়ি কিতনা হোগা …’
‘করিব, হাজার ফিট তো হোগা …’
‘আগার গিরতা তো …’
‘কিমা বন যাতা …’
হেডলাইটের হলুদ সমান্তরাল দুটো রেখা সামনের সরলবর্গীয় জঙ্গল ভেদ করবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে এখনও। অরণ্যরাজির দেওয়ালে পৌঁছানোর আগেই জড়িয়ে গেছে কুয়াশার মরণ-জালে। আমাদের সামনে খাদের গা বেয়ে উঠে আসা সুউচ্চ দেবদারু, ওক, বার্চ, ম্যাপ্লের জঙ্গলের ভগ্নাংশ। পিছনে চুনাপাথরের গিরি-প্রাকার। টুকরো আলোর প্রাণান্ত বিদ্রোহে আর যা চোখে পড়ছে তা হল চাঁই থেকে নুড়ি নানা আকারের ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা প্রস্তরখন্ড। বাকিটাতে উপনিবেশ গেড়েছে দুর্ভেদ্য অন্ধকার আর ধুলোর মত উড়তে থাকা চুনাপাথরের গুঁড়ো।
একটা ঝিঁঝির শব্দও নেই কোনও দিকে। রাত সাড়ে ন’টা। উত্তাপ মাইনাস ছয় ডিগ্রি। সময়টা জানালো চলভাষ আর উত্তাপ জানিয়েছিল ঘন্টাখানেক আগে জলৌরি পাসের প্রবেশদ্বারে প্রহরীর মতো বসে থাকা মা কালীর মন্দিরের পাশের চায়ের দোকানের ছেলেটা।
তবে দু’টো শব্দ খুব বেশি করে কানে আসছে। আমাদের গাড়ির পাঞ্জাবী চালক সুরিন্দর সিং, ওরফে সিং-জির ঘন নিশ্বাসের শব্দ আর আমাদের নিজের হৃদপিন্ডের ঢাক পেটানো। সেটা আরও বাড়ল যখন আমরা গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম নিচের তেলের নল ফেটে জায়গাটা ভেসে যাচ্ছে। সামনের চাকা দু’টো মাটি থেকে বেরিয়ে শূন্যে অর্ধেক ঝুলছে।
মোবাইলটা এখন ঘড়ি আর টর্চের কাজ করছে। এখানে কোনও নেটওয়ার্ক নেই। মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে খাদটা যতটা দেখা যায় দেখার চেষ্টা করলাম। ভাবার চেষ্টা করলাম, এখান থেকে কোথায় গিয়ে পড়তাম আর তারপর আমাদের কি অবস্থা হত। এর পরের চিন্তাটা আরও মারাত্মক। এবার আমরা এখান থেকে বেরোবো কি করে। এখনও অর্ধেক পথও আসিনি।
সকালে যখন কল্পা থেকে রওনা হয়েছিলাম তখনও বুঝিনি — মৃত্যুই সব থেকে বড় শিক্ষক। খুব অল্প সময়ে জীবনের এত বড় পাঠ যদি কেউ দিতে পারে সে একমাত্র মৃত্যু। এ জন্যই বোধহয় দেহবিমুক্ত আত্মা সর্বজ্ঞানী হয়ে থাকে !
শিমলা আসার দিন-চারেকের মধ্যে আর্থিক লেন-দেন সংক্রান্ত একটা সমস্যায় পড়তে হল। গাড়ি আর হোটেলের অগ্রিম বুকিং ছিল বলে খুব বেশি সমস্যা হল না। তবে খাওয়া-দাওয়া বা এই ধরনের ছোট খরচের ক্ষেত্রে অসুবিধা হতে লাগল। অবশেষে কিন্নর পৌঁছে অসুবিধাটা বেশ একটা রেল্লার পর্যায়ে দাঁড়াল। টাকার ব্যবস্থা না করলেই নয়। সকালে কল্পা এসে রেকং শাখার একটি ব্যাঙ্কে লাইন দিতে হল।
স্থানীয় মানুষের সুদীর্ঘ সারি। কপালের পক্ষপাতিত্বে পর্যটক হিসাবে বিশেষ ছাড় পাওয়া গেল। কিন্তু বেলা ততক্ষণে বেশ বড় রকমের ফাঁকি দিয়ে ফেলেছে। ছোট কাঁটা এগারোকে ধরা-ধরি খেলায় পরাজিত করেছে।
বাইরে এসে সিং-জির গম্ভীর মুখ দেখতে হল। ব্যাঙ্কের বাইরে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন — ‘বহুত দের কর দিয়া। অভি জলৌরি কো পৌঁছ্তে রাত হো যায়েগা। রাত কো উহা সে চলনে কা খতরা আপ লোগোকো মালুম নহি। রাস্তা হি নহি হেয় ! পাহাড় চড়কে যানা পড়তা। জঙ্গল ভি সেফ নহি।’
রাতে জলৌরি পার হওয়ার ‘খতরা’ সত্যিই আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু করারও কিছু নেই। কিন্নরে হোটেলের মেয়াদ আজই শেষ। আমরা চার বন্ধু সকালে ঘর ছেড়ে দিয়ে মালপত্র সমেত পথে নেমে পড়েছি।
কল্পা থাকে জলৌরি হয়ে ‘সোজা’ নামে একটি জায়গায় পৌঁছানোর কথা আজ। রাতে ওখানকার বন-বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা। ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ অতিক্রম করতে হবে। তার আবার বেশিরভাগটাই পাহাড়ের গা বেয়ে। জলৌরি ঢোকার পর তো নাকি আর রাস্তাই নেই। পাহাড় কেটে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কিছুটা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে গাড়ি চলাচলের জন্য। দিনে যদিও বা এপথে কোনও রকমে চলা যায়, রাতে অতি দক্ষ চালকরাও ঝুঁকি নেন না। জঙ্গলটিও নিরাপদ নয়। প্রচুর হিংস্র প্রাণীর বাস। রাত হলে তাদেরই স্বর্গরাজ্য।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সিং-জিকে আজ উদ্বিগ্ন লাগল। সারা রাস্তায় কথা বললেন খুব কম। দুপুরের পর গাড়িতে যখন আমাদের মধ্যে আসন-বদল হল তখন সামনে সিং-জির পাশে বসে একটু মনযোগ দিতে বুঝলাম তিনি ইষ্টদেবতার নাম যপছেন !
সূর্যালোকের উজ্জ্বলতা ও রাস্তার দু’পাশের জনঘনত্ব সমানুপাতিক। আর শীত ব্যস্তানুপাতিক। যত অগ্রসর হচ্ছি ততই প্রথম দু’টি কমছে। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে তৃতীয়টা। জলৌরি পৌঁছোলাম রাত আটটা নাগাদ। ঘন্টাখানেক আগে থেকেই এখানকার স্থানীয় প্রজাতির এক ধরনের গরু (এখানকার মানুষ বলে ‘চরু’) আর আপাদমস্তক লোমে ঢাকা কিছু কুকুর ছাড়া কোনও প্রাণিই চোখে পড়ছে না।
জলৌরি পৌঁছে মনুষ্যসমাজের প্রথম প্রতিনিধিটিকে চাক্ষুষ করলাম। খন্ড খন্ড পাথর পরস্পর সাজিয়ে তার উপর পলিথিন ও নরম কাঠ দিয়ে ছাউনি বানিয়ে একটা ঝুপড়ির আকৃতি দেওয়া হয়েছে। দেখলাম সোজা হয়ে দাঁড়ালে ছাতের সর্বোচ্চ স্থানটি আমার কাঁধের সমান। তারই সামনে কাঠকুটো জড় করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরের আবদ্ধ অন্ধকার আর হাড়-কাঁপানো ঠান্ডার সাথে একাই বীরবিক্রমে লড়ে চলেছে মাঝারি মাপের একটি জ্বলন্ত উনুন। তার সামনে চামড়ার জ্যাকেট ও জিনস্ পরা একটি তরুণ রেডিওতে হিমাচলী গান শুনছিল। আমরা ঢুকতেই সে চা বানাতে তৎপর হয়ে উঠল। তারপর উনুন ঘিরে বসে চা খেতে খেতে গল্পগুজব চলতে লাগল।
— ‘নাম ক্যা হেয় তুমহারা ?’
— ‘জি ইন্দারজিৎ …’
— ‘আসপাশ কোই ভি নহি হেয় ক্যা … ?’
— ‘নাহি জি, অভি তো সব শিমলা চলা গিয়া …’
— ‘তুম নহি যায়োগে ?’
— ‘হাঁ জি, ই নাভেম্বার হেয়, ডিসেম্বার কো বহুত যাদা বর্ফ গিরেগা, তব চলে যায়েঙ্গে।’
— ‘ফির কব লওটগে ?’
— ‘আপ্রিল কো যব বর্ফ গলনে লাগেগা, তব সভি লওট আয়েঙ্গে।’
তরুণটি সিং-জির পুর্বপরিচিত। তার গোলাপী মুখে চিন্তা ও বিস্ময়ের মিলিত ছাপ পড়ল — ‘আপ ইতনে রাত কো জলৌরি সে যায়োগে ! দিমাক তো ঠিক হেয় !’
সিং-জি চলতি ভাষায় তাকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন আমাদের সামগ্রিক পরিস্থিতিটা।
গরম লিকার চা খেয়ে শরীরটা একটু ঝরঝরে লাগছে। বাইরের আগুনটা তখনও সমান উদ্দীপনায় জ্বলছে। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ উষ্ণতা অনুভব হচ্ছে। জানি এই অগ্নি বলয়ের বাইরে গেলেই শরীরের কঙ্কালটা পর্যন্ত জমে বরফ হয়ে যাবে। হিমেল হাওয়ায় হেলে-দুলে জ্বলতে থাকা আগুনের আলোয় মাঝে মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠেই আবার আবছা হয়ে আসা কালীমাতার মন্দির, মনটাকে যেন কোন এক সুপ্রাচীন গ্রাম্য পাহাড়ি শ্মশানের ধংসস্তুপে নিয়ে গিয়ে ফেলল। নিঝুম হয়ে কত কাল দাঁড়িয়ে থাকা পূজাগৃহ, কত লোকাচার, কত অলৌকিক বিশ্বাসের সাক্ষী। কত প্রাণির বলির রক্তে ভেসেছে এ প্রাঙ্গন ! চারদিকে সমুদ্রের উন্মত্ত ঢেউয়ের মত দিক্-দিগন্ত প্রসারিত পার্বত্য অভিসার আর মাথার উপর কালো চাঁদোয়ায় সারা রাত ঝিকমিক করা চুমকির মত তারাদের ঝাঁক। চায়ের দোকানের এই একটিমাত্র তরুণ ছাড়া কোনও জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই বহুদূর পর্যন্ত।
‘ইয়েহি জলৌরি কা আসলি ভেলি হেয় …’ — কথাটা শুনেই চমক ভাঙল। সিং-জি কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ! আবছা আঁধারে দিগন্তবিস্তৃত তরঙ্গায়িত পার্বত্য শাখা-প্রশাখার আভাস চোখে পড়ছে। এটাই জলৌরির আসল উপত্যকা।
ইন্দ্রজিতের সাথে হাত মিলিয়ে যখন প্রচন্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে গিয়ে বসলাম তখন গাড়ির কাঁচের উপর শিশির পড়ে তা জমে বরফ হয়ে গেছে। ফলে সিং-জিকে সামনের কাঁচ ভালো করে মুছে পরিষ্কার করে ওয়াইপার চালিয়ে দিতে হল।
চলতে শুরু করে দুই থেকে তিন কিলোমিটার যাওয়ার পরেই গাড়ি এমন একটা বাঁক নিলো যে আমরা সকলেই বাম দিকে পুরোপুরি হেলে পড়লাম। কিছু পরে একটু সোজা হতে পেরে গাড়ির আলোয় রাস্তার দিকে মনোনিবেশ করতেই বুকের ভিতরে একদলা রক্ত হৃদ্পিন্ড থেকে চলকে উঠল। কোথা দিয়ে চলেছি আমরা ! রাস্তা কোথায় ! এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি জমিন ছাড়া ভালো শব্দ আর খুঁজে পেলাম না। কোথাও কোথাও আবার পাহাড় থেকে ঝিরঝিরিয়ে নেমে আসা ঝর্না বরফ হয়ে পথের উপর অধিকার বিস্তার করেছে। তার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি পিছলে কিছুটা করে সরে যাচ্ছে। অতি সাবধানতাও এখানে মাঝসমুদ্রে সাঁতার কাটার মতই অর্থহীন।
চারপাশের শোভার আর কি বর্ণনা দেব। বিভূতিবাবুও এই পরিস্থিতির পারিপার্শ্বিকতায় রসলাভ করতেন কিনা সন্দেহ। পাহাড়-জঙ্গল-কুয়াশা-বরফ-অন্ধকার-নিস্তব্ধতা সব মিলেমিশে একাকার। ভয়ঙ্কর সুন্দর বোধহয় একেই বলে ! শুনেছি অনন্ত স্বর্গের পথও নাকি খুব দুর্গম। মনে হল এটাই সেই পথ। একাধারে নৈস্বর্গিক, আবার আততায়ীও।
গাড়ি সমুদ্রের উন্মাদ ঢেউয়ে পড়া মেছো নৌকার মতো টলমল করতে করতে, পাথরে আছাড় খেতে খেতে খুব ধীর গতিতে চলল। সিং-জি দাঁতে দাঁত চেপে পঞ্চ-ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে গাড়ি চালাচ্ছেন। আমাদের চোখ বন্ধ।
এক বন্ধুর গলায় পৈতে ছিল। একটু চোখ খুলে দেখলাম সে সেটা ডান হাতের দুই আঙ্গুলে জড়িয়ে বিড় বিড় করে কি যেন উচ্চারণ করছে। আর সকলেই নির্বাক … নিথর !
ঘন্টাখানেক জীবন হাতে করে চলার পর মনে হল গাড়িটা একটু সোজা হল। মাটির উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে চলেছে বটে, তবে আগের থেকে পথ যেন কিছুটা দয়ালু। গাড়ির গতিও এবার একটু বাড়ল। আমরা সবে ভাবতে শুরু করেছি, এবারকার মতো বোধহয় বেঁচে গেলাম, ফাঁড়াটা বোধহয় কেটে গেল, ঠিক এই সময় অতর্কিতে লাগল ধাক্কাটা।
হেডলাইটের আলোয় বেশি দূর দেখা যায় না। আলোর জাল যেটুকু ছড়িয়েছে তাতে দৃশ্যের বদলে ধরা পড়েছে শুধু চুনাপাথরের ধুলো আর কুয়াশায় মাখামাখি এক পান্ডুর ধুসরতা। ওয়াইপার দুটি ছন্দ মেনেই এপাশ-ওপাশ করে চলেছে। কিন্তু তাতে উপকারের বদলে ধুলো আর জল মিশে কাঁচটাই হয়ে উঠেছে দুর্বোধ্য।
এই অবস্থায় সম্পূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে সঙ্কীর্ণ পাহাড়ি পথ চলতে গেলে যা হওয়ার তাই-ই হল। বাঁক ঘুরতেই গাড়ির নিচের অংশে একটা জোর ধাক্কা অনুভব করলাম। বীভৎস ‘ঘটাং’ শব্দে গাড়িটা কেঁপে উঠে একরাশ ধুলো উড়িয়ে প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। তার ব্রেক কষার ‘ক্যাঁ-অ্যা-চ’ শব্দে মনে হল কানের পর্দা পর্যন্ত ফেটে যাবে। মুহুর্তের মধ্যে কি যে হল কিছুই বুঝতে পারলাম না। তীব্র আন্দোলনে সামনের সিটে ধাক্কা খেয়ে যখন আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলাম তখন দেখলাম, সামনে সিং-জির পাশের আসনে আমার বন্ধু অতনু দু’হাতে চোখ ঢেকে জড়সড় হয়ে বসে আছে। সিং-জি পাথরের মূর্তি। আমারও ঘাড় ঘোরানোর ক্ষমতা হল না। তাই পাশের দুই বন্ধুর অবস্থাটা আর দেখতে পেলাম না।
কতক্ষণ এভাবে বসে আছি জানি না। সিং-জির কথা কানে এলো — ‘আপ লোক ঠিক তো হেয় না … !’ তার গলা কাঁপছে। কন্ঠস্বর শুকনো খটখটে।
প্রথম খানিক্ষণ আমাদের কারও গলা দিয়ে কোনও শব্দই বেরোল না। তারপর অতি কষ্টে ঘড়ঘড়ে গলায় বললাম — ‘হাঁ, ঠিক হেয় …’, যদিও আমরা প্রত্যেকেই কম-বেশি চোট পেয়েছি।
আমাদের গাড়িতে বসতে বলে সিং-জি খুব সাবধানে নিচে নামলেন। সামগ্রিক পরিস্থিতি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার পর আমাদের নামতে বললেন। মাটিতে প্রথম যেখানে পা পড়ল সেখানে একটা তরল কিছু পায়ে লাগতে নিচু হয়ে দেখলাম জায়গাটা তেল পড়ে ভেসে যাচ্ছে। এবার গাড়ির সামনের দিকটা দেখব বলে এগিয়ে যেতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। কি বীভৎস দৃশ্য ! সামনেই প্রায় হাজার ফুট গভীর খাদ। পাহাড়ের গা বেয়ে যত দূর নজর যায় সরলবর্গীয় অরণ্য ধাপে ধাপে নিচে নেমে গেছে। আর এই খাদের ঠিক কিনারায় গাড়ির সামনের দুই চাকা অর্ধেক ঝুলন্ত অবস্থায় কোন রকমে আটকে আছে। তেলের নলটা পাথরের চাঁইতে ধাক্কা খেয়ে বাধা না পেলে আমরা এতক্ষণ গাড়িসমেত কত ফুট নিচের কোন পাথরটাতে গিয়ে কত জোরে আছাড় খেতাম তার ঠিক নেই।
এ পথে দিনের বেলা গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত অতি দক্ষ চালকের পক্ষেও রাতে রাস্তার বাঁক ঠিক রাখা খুব কঠিন। সিং-জি বাঁকটা ঘুরেই আলো-আঁধারিতে বুঝতে পারেননি রাস্তাটা দক্ষিণে আরও অন্তত চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। তিনি সোজা কিছুটা যেতেই যখন বুঝতে পারলেন খাদের কাছে এসে পড়েছেন তখন গাড়ি তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। খুব জোর ব্রেক কষলেও পাথরের গুড়োতে চাকা পিছলে একেবারে কিনারায় এসে পড়ে। তারপর ভাগ্য …
আমি শুষ্ক গলায় প্রশ্ন করলাম — ‘আব ক্যা হোগা সিং-জি … ইহাসে নিকলেঙ্গে কেয়সে ?’
সিং-জিও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে লোকটার মাথা খুব ঠান্ডা। স্নায়ুও শক্ত। এ অবস্থাতেও ঠান্ডা মাথায় খানিক্ষণ ভাবলেন। তারপর একটা উপায় স্থির হল। যদিও খুবই অনিশ্চিত, তবু চেষ্টা করতে দোষ কি ? জঙ্গলের মধ্যে কোথাও কোথাও নাকি বনকর্মীরা অস্থায়ী তাঁবু করে সারা রাত পাহারা দেয়। একটু ঝুঁকি নিয়ে কিছু দূর হাঁটতে পারলে তাদের দেখা পাওয়া কিছু অসম্ভব নয়।
এখানে চুপ করে বসে থাকলে প্রচন্ড ঠান্ডায় আর হিংস্র পশুর হাতে এমনিতেও প্রাণ যাবে। অতএব হাঁটা শুরু …
তাঁবুর দেখা মিলল টানা প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার হাঁটার পর। দু’জন অরণ্যরক্ষী একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দু’খানা রাইফেল নিয়ে বসে বসে গল্প-গুজব করছিল। তাদের সমস্ত বিষয়টা সিং-জি সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললেন।
— ‘আজ রাত কো হাম লোগ আপকা কোই মদত নহি কর সকতা। কাল সুবহা ফারেস্ট কা মিকানিক গাড়ি লেকরকে আয়েগা তো আপকা গাড়ি ঠিক কর দেগা। আজ রাত থোড়া এডজাস্ট করকে আপ পাঁচ লোগ তাম্বুমে সো যাইয়ে। হম দোনো কো রাত মে জাগনা পড়েগা।’
দীর্ঘ পথযাত্রার ক্লান্তি – দুর্ঘটনাজনিত মানসিক ধাক্কা – এতটা পথ এই ঠান্ডায় মৃত্যুভয় নিয়ে হেঁটে আসার ধকল, সব মিলে আমাদের আবস্থা তখন এতটাই বেহাল যে এক মুহুর্তও আর দাঁড়াতে ইচ্ছা করছিল না।
তাঁবুতে কোনও রকমে ঠেসাঠেসি করে বসতে পারলাম। শোয়া অসম্ভব। কত পথ হাঁটতে হবে তার ঠিক নেই। তাই মালপত্র আর সঙ্গে নিইনি। এই জঙ্গলে চুরি যাবে না।
সারা রাত না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, ঠান্ডায় জমে বসে রইলাম পরের দিনের অপেক্ষায়।
পরদিন আমাদের গাড়ি যখন খাদের ধার থেকে পথে উঠে এসে ঘড় ঘড় শব্দ করে চলতে শুরু করল তখন বেলা প্রায় একটা। যেখানে পৌঁছানোর কথা ছিল রাত এগারোটা নাগাদ, সেখানে পৌঁছলাম পরদিন বিকাল চারটে।
দুর্ঘটনাটার পর থেকে দেখলাম সবার মধ্যেই যেন কেমন একটা পরিবর্তন এসেছে। সকলেই অত্যন্ত চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের মত অকারণে হাসি-মজা আর নেই। বুঝলাম সকলেই ছোট্ট একটা মুহুর্তে অমূল্য জীবনের গভীর মর্মটা উপলব্ধি করতে পেরেছে।
তবে আমি ভাবছিলাম সিং-জির কথা। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনের বিনিময়ে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব এমনকি স্ত্রী-সন্তান সব ছেড়ে দিনের পর দিন অজানা-অচেনা, ভিনরাজ্যের, ভিনদেশের পর্যটকদের নিয়ে কত বন্ধুর, কত বিপজ্জনক পথে পাড়ি দিতে হয় লোকটাকে। কতবার কত রকম জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপদ ঘটে যাত্রীদের অনভিজ্ঞতা ও অবাধ্যতার কারণে । তবু লোকটার কোন অভিযোগ নেই। একবারের জন্যও কোনও দোষারোপ শুনিনি তাঁর মুখে।
শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল যখন শুনেছিলাম প্রায় অশিক্ষিত এই লোকটির এক ছেলে ও এক মেয়ে — ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর মেয়ে পড়ছে এম.বি.এ.।
Tags: শিবাজী সেন
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।