11 Aug

মুক্তি

লিখেছেন:শৈলেশ মটিয়ানি


গল্পের সময় শৈলেশ মটিয়ানি হিন্দি থেকে ভাষান্তর: অনিন্দ্য সৌরভ

[প্রখ্যাত লেখক শৈলেশ মটিয়ানির জন্ম  ১৪ই অক্টোবর, ১৯৩১, আলমোড়া জেলার বাড়েছিনা গ্রামে। উত্তরাখণ্ডের গ্রামীণ-পাহাড়ি জনজীবনের বিশিষ্ট কথাশিল্পী। কিছু সরকারি পুরস্কার ছাড়াও কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সাম্মানিক ডি. লিট. (১৯৯৪ সাল)। মৃত্যু: ২৪শে এপ্রিল, ২০০১, দিল্লি। উত্তরাখণ্ড সরকার তাঁর স্মৃতিতে প্রতি বছর শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের ‘শৈলেশ মটিয়ানি পুরস্কার’ দেয়।]

 

কেবল পান্ডে সবে নদীটা অর্ধেক পেরিয়েছেন। চতুর্মাসের শেষ পর্বে ঘাটের পাড়ে হাঁটুখানেক জল, যদিও বেশ স্রোত আছে। সহসা তাঁর ইচ্ছে হয়, সন্ধ্যাকালে সূর্যদেবকে প্রণাম করার। জলাঞ্জলি দেবার জন্য পূবমুখী হতেই, সূর্য আর তাঁর মধ্যবর্তী স্থানে ধূমকেতুর মতো কিছু একটা দৃষ্টিগোচর হয়। লক্ষ করে দেখেন, উত্তরে শূদ্রদের শ্মশান বোড়সি থেকে ধোঁয়া উঠছে। বায়ুপ্রবাহের দিকে তা ফালির মতো ঝুঁকে, মেঘের পুঞ্জ সৃষ্টি করে সূর্যের সমান্তরালে ধূমকেতুর মতো ঝুলছে।

ওম্‌ বিষ্ণু, বিষ্ণু, বিষ্ণু …

কেবল পান্ডের হাঁটুজোড়া জলের ভেতরই আপসে ধাক্কা খায়, অঞ্জলিপূর্ণ জল আঙুলের ফাঁক গলে নদীতে এসে মেশে। অর্ধচেতন মনে গভীর আশঙ্কা জাগে, বেচারি কিসনরাম মারা যায়নি তো?

কিসনরামের কথা মনে পড়তেই জলপ্রবাহে হাঁটু জোড়া ফের কেঁপে ওঠে। পুরোহিত কেবলানন্দ পান্ডের মনে হয়, তাঁর আর সূর্যের মধ্যিখানে ধূমকেতু নয়, কিসনরামের প্রেতাত্মা ঝুলছে। পান্ডে খানিকক্ষণ সুঁয়ালের জলের চেয়েও বেশি নিজের ভেতরে ডুবে থাকেন। কিসনরামের মৃত্যু-ভাবনা কী করে যেন তাঁর সম্পূর্ণ চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছে। গলায় উপবীত, কপালে চন্দনের তিলক আর রক্তে মিশে থাকা জাতি-সংস্কার। বারবার অনুভব হতে থাকে – ওপরের শ্মশান থেকে অচ্ছুতের শবের অস্থিমজ্জা ছুঁয়ে আসা সুঁয়ালের জল পায়ে লাগছে। অর্ধদগ্ধ শবদেহ ওরা হয়তো নিচে ভাসিয়ে দিয়েছে, সেটাই পায়ে এসে ঠেকছে। নদীর তীব্র প্রবাহে কাঠের স্লিপারের মতো পাক খাওয়া ভাসমান শব তিনি বেশ ক’বার দেখেছেন। বিশেষ করে বেনারসে অধ্যয়ন করার সময়।

এদিক দিয়ে সুঁয়াল অতিক্রম করলেই, গাঁ ঘেঁষে অরণ্য আরম্ভ হয়। সূর্যাস্তের কাছাকাছি এ সময় উঁচু উঁচু পাইনের ছায়া পড়েছে পূবদিকে। দূর ঢালুতে এক দঙ্গল গরু-ছাগল চরছে। কিছুক্ষণ নীরবে দূর দূর  তাকিয়ে দেখেন। শেষে নদী পেরিয়ে গ্রামের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, পান্ডে দ্রুত এপারে ফিরে আসেন। তাঁর মনে হয়, জল ভেঙে এগোনোর সামর্থ্য হাঁটুতে আর নেই। ধোঁয়া দেখার আগেই, নদী পেরোনোর মাঝামাঝি কেন যে হঠাৎ কিসনরামের কথা মনে পড়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে, নদীর জলকে তিনি পায়ে পায়ে তেমন করেই চিরে চলেছেন, কিসনরামের লাঙলের ফলায় যেমন খেত চিরে যেত। অকারণেই কেন যে তাঁর কল্পনার আকাশে আশঙ্কার ধূমকেতু ফুঁড়ে উঠেছে। নিশ্চয় কিসনরাম মারা গেছে – ওরই শবদেহ পোড়ানো হচ্ছে। আবার এও হতে পারে, নদীর ধারে মাছমারারা আগুন ধরিয়েছে।

কেবল পান্ডের ইচ্ছে করে, পারের জল তুলে দেখতে। অমনি মনে পড়ে, লাঙল দিতে দিতে কিসনরাম যখন তাঁর কাছে এসে পুঁটলি খুলে খৈনি মুখে দিত, ওর বেজায় ময়লা তেলচিটে কাপড় থেকে ঝাঁঝালো গন্ধ ছাড়ত। জল থেকেও যদি তেমন গন্ধ ছাড়ে। নিজের অদ্ভুত সব কল্পনায় কেবল পান্ডের  হাসি পায়, তবু হাসেন না। কিসনরাম সম্পর্কে দুর্বলতাই কিছুদিন ধরে তাঁকে দ্বিধাবিভক্ত করে তুলেছে। ওর মৃত্যু আশঙ্কার সঙ্গে এ সমস্ত উদ্ভট ভাবনা যুক্ত হবার ফলে, মন স্বাভাবিকতা হারিয়ে বসেছে। এখন তাই নদী পেরোবার পরিবর্তে বিনসর পাহাড় অর্থাৎ উত্তর দিকে, পাড় ধরে হাঁটতে থাকেন। ফার্লংখানেক দূরেই শ্মশান।

ঝুরঝুরে মাটির ওপর গড়িয়ে চলা গর্ভবতী সাপিনির মতো সুঁয়াল এখন উল্টো দিকে ফিরে যাচ্ছে বলে ভ্রম হয়। চাঁদের আলোয় ঝিলমিলে জলের উপরিতল, বাতাসের কাঁপনে মনে হয় নদী বুঝি গতিপথ বদলেছে। কিছুটা তফাত রেখে হাঁটলে, চাঁদের মতো নদীকেও সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে দেখা যায়। এমত অবস্থায়, কিসনরামের আধপোড়া শব ওরা হয়তো জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। সেটাও কি উত্তরের দিকেই ফিরে যাচ্ছে?

কিছুদূর এগোতেই একটা গভীর জলাশয় দেখে মনে হল, এমন যদি হয় ভেসে আসা শবটাকে মাছেরা ঠুকরোচ্ছে। জলাশয়ের গভীরে একবার উঁকি দিয়েই কেবল পান্ডে হনহন করে এগিয়ে চলেন। আশঙ্কা মিটে গেলে মনের বিভ্রান্তি দূর হবে। এবার তাই ধুতির কোঁচা কাঁধে ফেলেন, যাতে ঝুঁকে উঁকি দিতে সুবিধে হয়।

যে সুঁয়াল দেখেছে, সে জানে বর্ষা পেরিয়ে, কার্তিকের শুরুতে জল কেমন স্বচ্ছ থাকে। যেহেতু এখন সদ্য চতুর্মাস পেরিয়েছে, তাই জলপ্রবাহ সহজে পা স্থির রাখতে দেয় না। পাহাড়ি রমণীরা যেরকম রৌপ্যমুদ্রার মালা পরে থাকে – কিছুদূর মালার সুতো, তারপর প্রথম মুদ্রা, আবার কিছুটা সুতো, ফের দ্বিতীয় রৌপ্যমুদ্রা – সুঁয়াল নদীও দেখতে অনেকটা তেমন। উৎস থেকে কিছুদূর নদীর মতো আকৃতি, তারপর প্রথম জলাশয়, প্রাকৃতিক সুতোর মতো নদী। এরপর দ্বিতীয় জলাশয়, নদী আরও কিছুটা এগোয়। এইভাবে এগিয়ে চলছে, যতক্ষণ না সুঁয়াল নদী কুশী নদীতে গিয়ে পড়ছে।

কেবল পান্ডের যজমানিরও খানিকটা এমন ধারাবাহিকতা আছে, যতদূর সুঁয়াল গেছে। পাড়ের উঁচু পাথর খণ্ড থেকে জলাশয়ে উঁকি মেরে দেখেন, গভীরে কাতলা আর শোল মাছের ঝাঁক বিচরণ করছে। ছোট ছোট মাছ তলায় শামুকের মতো বুড়বুড়ি কেটে জল থেকে বিঘত খানেক ওপরে লাফিয়ে ফের জলে পড়ছে। জলে বৃত্ত তৈরি হচ্ছে – উনি নিষ্পলক চোখে দৃশ্যটা দেখতে থাকেন। মনে পড়ে, ব্রতবদ্ধ হবার আগে জলাশয়ে মাছ ধরতে সমবয়সি শূদ্র ছেলেদের সঙ্গে তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বাড়িতে কেউ মাছ খেত না, তবু মাছ ধরার সে কী আনন্দ! … রামবাণের পাতা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে জলে ফেলা হত। সাবানের মতো ফেনা হত জলে … অর্ধমূর্ছিত মাছ পাক খেত জলের ওপরে। করতালু মেলে ধরতেই হাতে এসে পড়ত। কিসনরামের সঙ্গে তাঁর বয়সের পার্থক্য বেশি নয়। কিসনরাম মাত্র দু-তিন বছরের বড় অথচ কেবল পান্ডের তুলনায় ওকে অনেক বেশি বুড়ো দেখায়। পঁয়ষট্টি পার করেও পান্ডের প্রশস্ত কপালের তিলক বলিরেখায় ডোবে না, অন্যদিকে কিসনরামের কোমর ঝুঁকে গেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে কিসনরামকে দেখছেন। একই অরণ্যের বৃক্ষের একসঙ্গে আকাশে উঠে যাওয়ার মতো। কিসনরামের বাপের ছিল তিনটে বউ সহ বৃহৎ পরিবার। খাওয়া-পরা তাই ঠিকমতো জুটত না। অন্যের ঘরে মজুরির বোঝা দিনরাত কাঁধে চেপে থাকত। পান্ডের মনে পড়ে না, কিসনরামের চোখেমুখে কখনও কৈশোরের চাঞ্চল্য কিংবা তারুণ্যের উদ্দামতা দেখেছেন কিনা। যখনই ওকে দেখেছেন – হয় লাঙল, নয় কাস্তে হাতে কাজে ব্যস্ত।

গাঁয়ের স্কুল থেকে মিডল পাশ করে কেবল পান্ডে প্রথমে মামার কাছে নৈনিতালে, পরে সেখান থেকে বাগদত্তার বাবার কাছে বেনারসে পড়তে যান। নৈনিতাল থেকে হাইস্কুল, বেনারস থেকে শাস্ত্রী পাশ করে ফিরে আসেন। ছোট ভাইরা তখনও লেখাপড়া করছে, বাবা অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। যজমানি ক্ষেত্র বেশ বড়ো আর তা সামলানো – আর্থিক আর নৈতিক উভয় দিক থেকেই আবশ্যিক।

শিক্ষা শেষে পাকাপাকিভাবে বাড়ি ফিরে আসার পর পান্ডে কিসনরামের মুখেই জানতে পারেন, এর মধ্যে ওর মা মারা গেছে। সেও মামার কাছে চলে গিয়েছিল। মামা পেশায় কামার, এদিকে কিসনরাম চাষবাস আর রাখালির কাজ ছাড়া কিছুই জানত না। গরম লোহা পেটাতে গিয়ে ভুল করে ডান হাতের আঙুল ছেঁচে ফেলেছিল। হাত অকেজো হলে, মামাও ওকে তাড়িয়ে দেয়। সেখান থেকে বউকে নিয়ে সোজা শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভবানীকে রেখে, ওকে একা বিদায় করল। ভবানী সম্পর্কে কিসনরাম তাঁকে শুধু বলেছে – ‘গোঁসাইজি, ডোমেরা আমার গিন্নিকে রেখে দিয়েছে’। বলেনি, নিজের মেয়েকে রেখে দিয়েছে।

ছেঁচে যাওয়া ডান হাতের তিনটে আঙুল সম্পূর্ণ অকেজো। বাকি দুই আঙুলে সোঁটা আর বাঁ হাতে লাঙলের মুঠো ধরে বলদ হাঁকতে থাকা কিসনরামের গলার আওয়াজ পান্ডেজি গাঁয়ের কাছে পৌঁছেই শুনেছিলেন। কাছে এসে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওর কুশল সংবাদ নেন, ‘আশীর্বাদ করি কিসনরাম, কেমন আছ? সব ভালো তো?’ কিসনরাম সমস্ত কথা যেন তাঁরই প্রতীক্ষায় বুকে চেপে রেখেছিল, সুযোগ পেতেই বেরিয়ে পড়ল। কথা বলার সময় ওর চোখ দুটো যেভাবে ভরে উঠতে থাকে, মনে হয় গভীরে চাপা বিষাদ উপত্যকার কুয়াশার মতো পাক খেয়ে খেয়ে উঠছে। চোখে যেন বাঁধ ভেঙে গুমরে ওঠা জলপ্রবাহ।

কিসনরামকে কাঁদতে দেখা এই প্রথম, নইলে ওর চোখে সবসময় এক ধরনের করুণ হাঁসি দেখেছেন। কঠোর পরিশ্রমের সময় ঘামে জবজবে ওর শরীর দেখে মনে হত যেন ত্বক দিয়ে অশ্রুপাত করছে।  পান্ডের মনে তখনও মাঝে মাঝে বিচিত্র ভাব উদয় হত, কিসনরাম অভিশপ্ত ইন্দ্র নয় তো! ওর সারা শরীরে তাই শুধু চোখ আর চোখ ফুটেছে। এমনভাবে ঘাম মুছত, মনে হত যেন চোখের জল মুছছে। এক দৃষ্টে ওর দিকে চেয়ে থাকলে, মুখটা কেমন নোনা নোনা লাগত।

খৈনির ঝাঁঝালো গন্ধটা ওর শরীরে তখন ছিল না। বেনারস থেকে ফিরে আসার পর কেবল পান্ডে দেখলেন – বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ফরসা বলিষ্ঠ দেহের তুলনায় কিসনরামের শরীরকে প্রকৃতি যেন লোহার মতো পিটে পিটে নিজের অনুকূলে গড়ে নিয়েছে। চাষাবাদ আর গাছ কাটা কিংবা পাথর ভাঙার সময় ও নিজেও যেন প্রকৃতিতে মিশে যেত। দৃশ্যটি পান্ডের বারবার মনে পড়ে। চোদ্দো বছর বয়সে বিয়ে হবার পর কিসনরাম দ্বিরাগমনে বউকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। পান্ডে তখন স্কুল থেকে ফিরছিলেন। রোগা শ্যামলা মেয়ে, গাঢ় রঙের ঘাঘরা আর গোলাপি সায়া পরনে, নিশ্চিন্ত মনে বিড়ি টানতে টানতে বরের পেছনে পেছনে আসছিল। কিসনরাম মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ‘ঠাকুর মশাই’ বলে প্রণাম করায় বউও বিড়িটা তড়িঘড়ি হাতের মুঠোয় ঘষে, পরক্ষণেই যন্ত্রণায় কেঁদে ফেলেছিল।

পান্ডেজির হাসি পেয়েছিল। পরিস্থিতি দেখে কিসনরামও মিটিমিটি হেসেছে – ‘গোঁসাই, আমাদের জাতে অল্পবয়সেই সবকিছু শিখে ফেলে মেয়েরা’। খানিকটা লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘শাস্ত্র মতে কত বয়স অবধি নিজেদের মধ্যে খোলাখুলিভাবে ঘর-গেরস্তির আলোচনা করা নিষেধ?’

‘শাস্ত্র’ কথাটা উচ্চারণ করার সময় কিসনরামের গলা সামান্য কেঁপেছিল। পান্ডে ছোট থেকেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, সহজেই বুঝে ফেলেন, কোন সেয়ানা কথা ওর মনে গেঁথে আছে। সরল স্বভাবের কিসনরামের প্রতি প্রথম থেকেই তাঁর সহানুভূতি ছিল, ওর বউকে চকিত দেখেও নিয়েছেন সমবয়সির কৌতূহলী দৃষ্টিতে। ধীরে ধীরে ওকে বলেছিলেন, ‘বুঝলে বন্ধু! আমি নিজেই এখনও সে শাস্ত্র পড়িনি। সংস্কৃত পড়ার জন্য বাবা কাশী পাঠাচ্ছেন। দশ বারো বছর পর বটুক শাস্ত্রী হয়ে ফিরে এসে তোমায় বলব এ ব্যাপারে শাস্ত্রে কী বলেছে!’

কথার শেষে দু’জনে একসঙ্গে হেসে উঠেছিলেন। কিসনরামের বউয়ের মাথায় তত্ত্বের ডালা ছিল – হলদে আঁচলে ঢাকা।  ওতে ছিল দ্বিরাগমনের লুচি, সঙ্গে আলু কিংবা পুঁইয়ের সবজি।

বছর কয়েক পর ক’দিনের ছুটিতে পান্ডে বাড়ি ফিরেছেন। কিসনরামকে তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন – ‘কিসন, তোমাদের ছেলেপুলে হয়েছে কি?’ উত্তর শুনে মনে হয়েছিল, সে আজও ওই দিনের প্রতীক্ষায় আছে, পান্ডে যখন ওকে শাস্ত্রে লেখা উত্তর জানাবেন। কাশী থেকে শাস্ত্রী হয়ে ফিরে আসার পরেও প্রসঙ্গটা তাঁর মনে পড়েছিল কিন্তু ওর বিয়োগান্ত গাথা শুনেই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। উপলব্ধি করেন, বউটি জ্বলন্ত বিড়ি হাতে না ঘষে এবার যেন কিসনরামের বুকে ঘষে নিভিয়েছে। ওর প্রতি সমবেদনা জানানোয় বউটি এখন বুঝি কোথাও অদৃশ্যভাবে উপস্থিত থেকে খিলখিল করে হাসছে। শৈশব অতিক্রান্ত হতে না হতেই বিয়ে হয়েছিল কিসনরামের, যুবক হতে না হতেই সম্বন্ধও ভেঙে গেল। কিসনরাম তখন একা। অনেকে বারণ করা সত্ত্বেও পান্ডের বাবা ওকেই হালচাষি রেখেছিলেন। পান্ডের বাবা মা কিসনরামকে বলেছিলেন – ‘কিসন, আগেরটা তো যেন বিশ্রাম নেবার জন্য ডালে বসামাত্র ফুরফুর করে উড়ে পালাল। তা তুমি কেন ওর জন্য মিছিমিছি বৈরাগী হয়েছ। শোনো, ফের বিয়ে করলে চাষবাস আরও ভালো সামাল দিতে পারবে। জোড়া ছাড়া বলদও মানায় না, তুমি তো হালচাষি! … ফের বিয়ে না করলে  ওকেই ফিরিয়ে আনো…’।

কিসনরাম ভালো করেই জানত হালচাষি একা ঠিক মতো খাটতে পারে না, তদুপরি ডান হাতটাও পুরো কাজের নয়। কিন্তু ভবানী? তার ফেরার সম্ভাবনা নিছক কল্পনাতেই ঘটতে পারে। হাতজোড় করে তাই সে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করেছিল। সৎভাইদের একজনকে হালচাষি রাখার কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল – ‘মা ঠাকরুন, আমি অভাগা, হাত থেকে ঝরে পড়া মাংসই ফিরিয়ে আনতে পারিনি। বুক থেকে যে ঝরে গেছে তাকে ফেরাব কী করে?’

কথাটা তখন সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। নারীর মন বড় কোমল হয় মায়ের মতো। স্বয়ং মা ঠাকরুন কুসুমাবতী কিসনরামের চোখের জল মুছে দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণী, তায় পুরুত বংশের বউ, নিজ হাতে শূদ্রের অশ্রু মুছে দিয়েছেন। ভৈরব পান্ডেজি সব দেখেশুনে মন্তব্য করেছিলেন – না, এটা মোটেই অশুচি হওয়া নয়। কেবল পান্ডে জিজ্ঞেস করায় কুসুমাবতীর চোখ ফের ভিজে উঠেছিল। বলেছিলেন, ‘সকলের দুঃখই একধরনের, কেবল। আমি শুধু ওর চোখের জলটুকুই মুছে দিতে পারি’। পায়ের তলার মাটি কপালে ঠেকিয়ে কৃতার্থ কিসনরাম তখন বলেছিল – ‘মা ঠাকরুন লোহার পাতে পরশমণি ছুঁয়ে দিয়েছো, আমার জন্ম-জন্মান্তরের সমস্ত পাপ ধুয়ে গেছে’। শূদ্র হয়ে জন্মালেও বড় বৈরাগ্য কিসনের মনে। ভবানী তো নিজের নাম বদনাম করে সাদাসিধে লোকটাকে শেষ করে দিয়েছে।

পান্ডে অনুভব করেন, কিসনরামের মনে হয়তো ভবানীর প্রতি অতিরিক্ত মোহ ছিল, তাই এখন অমন বৈরাগ্য। তখন ফি-সপ্তাহে ও পরনের কাপড় কাচত। খাওয়া-দাওয়া করত সময় মতো। জমিতে কাজ থাকলে, পান্ডের বাড়ি থেকেই খাবার যেত। কেবল পান্ডের স্ত্রীকে কিসনরাম সবিনয়ে বলত – ‘বউ ঠাকরুন, আমায় টাইম মতো রুটি পাঠিয়ো’।

একদিন মাঠের কাজ সেরে কিসনরাম সুঁয়ালের পাড়ে কাপড় কাচছে। পরনে শুধু নেংটি। সে যেন কীসের ধ্যানমগ্ন হয়ে হাঁটুজলে বকের মতো দাঁড়িয়ে। বাতাসের কাঁপনে, স্বচ্ছজলে ওর নেংটি উড়ুউড়ু করছে। সেই সময় যজমানি থেকে পান্ডে ফিরছেন। তাঁকে নদী পেরোতে দেখে, কিসনরাম তড়িঘড়ি জল থেকে তফাতে সরে দাঁড়াল পাছে ওর ছোঁয়া জল তাঁর গায়ে লাগে। পান্ডে যজমানি থেকে পাওয়া কয়েকটা মিষ্টি দিয়ে ওকে বলেন – ‘কিসন, মোটেই ভালো করে নি ভবানী। ও থাকলে রান্নাবান্না, কাপড় কাচা থেকে মুক্তি পেতে… মনে আছে, আমরা একসঙ্গে মাছ ধরতাম – এখন তুমি জল থেকে সরে দাঁড়িয়েছ কেন? এতদূর থেকে ছোঁয়া আমি মানি না’।

কিসনরামের দু’হাত জড়ো, ঠোঁটে মুচকি হাসি – ‘ঠাকুর মশাই, যেদিন মা ঠাকরুনের সোনার মতো হাতের স্পর্শ চোখে পেয়েছি, সেই থেকে বুকের জ্বালা অনেকটা কমেছে। নইলে কোথায় অচ্ছুত আর কোথায়…’।

বছর গড়িয়ে যায়। কেবল পান্ডের বাবা ভৈরব পান্ডে গত হয়েছেন, তারপর মা কুসুমাবতীও। কিসনরামের কোমরও বেঁকে গেছে, তবু লাঙল ছাড়ে নি। নিজে থেকে না ছাড়লে ওকে ছাড়ানো হবে না, কেবল পান্ডে ঠিক করেছিলেন। প্রয়োজনে দৈনিক মজুরি  দিয়ে চাষ করানো হত, তবু ওকে কেউ কিছু বলত না। কেবল পান্ডের স্ত্রী চন্দ্রা বউ ঠাকুরনও শাশুড়ির মতোই স্নেহময়ী। কিসনরাম তাই কৃতজ্ঞ চিত্তে বলে থাকে, ‘মা ঠাকরুনের দেহটাই শুধু গেছে, তাঁর আত্মা বউ ঠাকরুনের দেহে মিলেছে’। এমন কথা বলার পর প্রায়ই পান্ডের কাছে আত্মা পরমাত্মা সম্পর্কে সে নানা কথা জিজ্ঞেস করে – ‘ঠাকুর, শাস্ত্রে তো আত্মা পরমাত্মার মন্ত্র লেখা থাকে। আমি আপনার চরণের দাস, দু-চারটে মন্ত্র আমার অশুচি কানে পড়লে আত্মার ময়লা ধুয়ে যাবে। কী করব গোঁসাই, আনাজ খাওয়া পশু আমি …আপনার জন্ম-জন্মান্তরের দাস…দু চারটে এমন মন্ত্র বলুন ,শরণাগত কিসনের ফাটা কপালেও যেন…’। ‘যেন’র পরে কী, এ শুধু ওর চোখেই পাঠ করা যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে কথা পালটে জিজ্ঞেস করে – ‘ঠাকুর মশাই, মরার পর আত্মা কি পরলোকে যায়, নাকি ইহলোকেই ঘুরতে থাকে?’ শাস্ত্রমতে চুরাশি লক্ষ জীবজন্মের একটি প্রেতজন্ম – জানবার পর সে আরও জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠে, ‘আত্মার ইচ্ছে না থাকলে শুধু দেহের ইচ্ছেতে কি কেউ প্রেতজন্ম পেতে পারে?’

যজমানিতে যেতে না হলে পান্ডে সোজা মাঠে চলে যান। তিনি জানেন, চন্দ্রা বউ ঠাকরুন ওখানে থাকলে কিসনরাম মন দিয়ে কাজ করে। কিন্তু তিনি নিজে উপস্থিত হলে খৈনি খাবার অছিলায় কাছে এসে ও নানা কথা জিজ্ঞেস করে। আবোল-তাবোল কথা শুনেও পান্ডে কিসনরামের প্রতি কখনও কঠোর হতে পারেন না। বোঝা যায়, দিন দিন ও অন্তর্মুখী হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো এতটা গর্তে বসেছে যে, পুকুরে ডুবে থাকা মরা মাছের মতো কিছু একটা চকচক করে। পান্ডে ভাবেন, এটা কি ওর আসন্ন মৃত্যুর পূর্বাভাস!

স্ত্রী-সন্তানহীন পুরুষদের মুক্তি হয় না। তারা সারারাত মশাল হাতে বিদেহি আত্মারূপে দল বেঁধে ঘোরে – একথা পান্ডেই ওকে একদিন প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন। সেই সঙ্গে জানিয়েছিলেন, উচ্চবর্ণের মানুষ স্ত্রী  সন্তানহীন হলেও সহজে ভূত-প্রেত হয় না। কারণ শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে তাদের আত্মার সদ্‌গতি হয়। এসব শুনে কিসনরাম তাঁর কাছে সদ্‌গতি সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করেছে। কিছুদিন আগেই ফের জিজ্ঞেস করেছিল,  ‘যার প্রতি কামনা বাসনা থেকে গেছে, তার দেহে প্রেতরূপে প্রবেশ করা থেকে নিষ্কৃতির উপায় কী?’

কিসনরাম তাঁকে এও বলেছে, ঠাকুর আপনি আমার ইষ্টদেবতার মতো, আপনার কাছে কিছুই গোপন নেই। শরীরটা ইদানীং বড় দুর্বল লাগছে। ঠিক মতো খেতে পারি না। বায়ু-পিত্ত বেড়ে গেছে, ভালো ঘুম হয় না। সময় মতো চান করা, কাপড় কাচার শক্তিও আর নেই। খিদেয় যখন পেট জ্বলতে থাকে, হাঁপানিতে শরীর ভেঙে পড়ে, তখন শুধু নিজের গায়ের দুর্গন্ধ, প্রেতাত্মার মতো নিজেরই ছায়া ঘিরে ধরে। পাপী মন কিছুতেই বশে থাকে না গোঁসাইজি। যাকে জীবনে গালমন্দ করিনি, মরণকালে এসে তাকেই কীসব কুচ্ছিত গাল পাড়ি। মন ফাঁসির আসামীর মতো ধিক্কার দেয় – ‘কিসনরাম, তোর মতো ডোমকে ধিক…মরার কালে কেন তুই পিশাচ হয়েছিস! নিজের বউকে রাঢ়-পাতকী বলিস না রে কসাই… তবু ঠুঁটো আঙুল দুটো বিড়ির মতো কপালে ছ্যাঁকা দেয়। ওরে পাতকী। তুই আমার বুক না ভেঙে ফেললে এই বুড়ো বয়সে অন্য কেউ তো থাকত…। বলুন, গোঁসাইজি – আমি ভূত হয়ে গেলে কী হবে?’

‘কিসনরাম, ভবানীকে তুমি ভুলতে পারোনি, না! ও যা দাগা দিয়েছে, অন্য কেউ হলে নির্ঘাত আর একজনকে ঘরে এনে তুলত! তোমার ভালোবাসা কিন্তু একটুও কমেনি! তোমার ওসব গালাগাল ভূত-পিশাচের নয়, দুঃখী মানুষের’।

‘গোঁসাইজি, গাছের ডাল ভেঙে গেলে ফের গজিয়ে ওঠে, কিন্তু শিকড় উপড়ে গেলে কী হবে! যতদিন হাত-পা চলেছে, টাইম মতো পেটের আগুন নিবিয়েছি, জামা-কাপড় কেচেছি – এ জন্য যে পরে হয়তো আর পারব না। ভবানীর নামে গালি বেরোবে মুখ দিয়ে। ঠাকুর মশাই, আপনি তো ওকে পরির মতো আমার আগে পিছে উড়তে দেখেছেন! উড়ে বেড়ানো ওই প্রজাপতিকে হারানোর পর  অন্য মেয়েমানুষকে ঘরে আনলে মনে হত, ও সামনে পেছনে ঝাপটা মারছে…। ঠাকুর মশাই – তখন আপনিও বলতেন কী, সুনুয়া ডোমকে বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে ধরেছে। ওই রূপসী পরিকে আমি অত দূরে ওড়াতে চাইনি গোঁসাই যে দেখাই যাবে না …কপালে হাত ঠেকিয়ে দূর-দূর চেয়ে থাকি, দেখতে দেখতে ও একদিন আকাশের তারা হয়ে যাবে’।

পান্ডের মনে হয়েছিল, পুকুরের মাছের মতো চকচকে ওর গর্তে বসা চোখে অন্য কিছু নয়, কিসনরাম নিজেই ডুব দিয়ে আছে। হাতের চেটোয় বিড়ি ঘষে ফেলা কিশোরী ভবানীকে সঙ্গে নিয়ে ও শাস্ত্র বিধি জিজ্ঞেস করত – ‘ঠাকুর, শাস্ত্রে তো পরিবারের সম্পর্ককে জন্ম-জন্মান্তরের বলা হয়েছে। তাই না?’

কিছুদিন আগেই জিজ্ঞেস করেছে – ‘ঠাকুর, আজকাল যে যন্ত্রণা পাচ্ছি, তার কারণ …এই সংসারী কুটিল মনের বাসনা। ম্লেচ্ছ তো আগে থেকেই ছিলাম, গরুড় পুরাণ শোনার অধিকার আমার নেই। তাছাড়া শোনাবেই বা কে? মাঝেমধ্যে জঙ্গলে চোখ বুজে শুয়ে থাকি গোঁসাইজি, যাতে আকাশের গরুড় পাখি আমাকে মরা ভেবে মাথায় এসে বসে টিটকিরি করে…নিজের বিপদ নিয়ে আমার তেমন দুশ্চিন্তা নেই। শুধু এই ভয়, ভূত হয়ে গেলে কি ওর ওপর ভর করব! শুনুন ঠাকুর মশাই, সৎ মায়ের ওপর আমার বাপের আত্মা এসে ভর করে। ছেলে তাই ওকে গরম চিমটে দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়। নব্বই বছরের বুড়ি যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদে। ভয় হয়, ভবানীর ছেলেরাও যদি ওকে তেমনি ছ্যাঁকা দেয়। অধিকার থাকা সত্ত্বেও ওকে কখনও সামান্য কটু কথা বলিনি। ভেবেছি, যেতে দে কিসনরাম – উড়ে বেড়ানো মেয়ে… যেখানে মর্জি যেতে দে… তো মরার পর ওকে ছ্যাঁকা দিতে দেখব কী করে? আচ্ছা গোঁসাইজি, যদি কেউ নিজের চোখ দুটো খুবলে গরুড় পাখিকে দান করে তবে কি ভূত-জীবনে অন্ধ হয়ে থাকবে?’

পান্ডে অনুভব করছিলেন, কিসনরাম যতই মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে, ভবানী ততই রঙিন প্রজাপতির মতো ওর ভেতরে উড়ছে। এমন একটা বিভ্রমের দিকে ওকে নিয়ে চলেছে, যেখানে মনের ঝড়ঝাপটা প্রতিরোধ করার সামর্থ্য থাকে না। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, অন্ধ-বিশ্বাসী কিসনরাম সত্যি-সত্যি না আবার নিজের চোখ খুবলে ফেলে। ওর গর্তে বসা চোখে উঁকি দিলে, তাঁর মনে হয়, কিসনরাম গভীর তলদেশে মাছ ধরার জাল ছড়িয়ে দিয়েছে। ওর অতৃপ্ত কামনা-বাসনা ছটফট করছে সেই জালে জড়িয়ে। নিজেরই সৃষ্ট মায়াজালের ভেতরে তাই ও বারবার নিজেকে গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। ওর চোখের কোলে কুঞ্চন দেখে মনে হয়, জালের গিঁটটা শক্ত হয়ে গেছে। দড়ি বেয়ে নিংড়ানো জল পড়ছে। অমন চোখকে নিজের শরীরে সহ্য করা কী ভীষণ কঠিন – অন্যেরই যা সহ্য হয় না।

নির্বোধ কিসনরামের চোখের গভীরে অতল জলের মৃত মাছের মতো উজ্জ্বলতা দেখে যক্ষ-যুধিষ্ঠিরের গল্পটা পান্ডের মনে পড়ে। মনে হয়, কিসনরামের জিজ্ঞাসু চোখ উত্তর না পেলে তাঁকে ছাড়বে না। না জীবনে, না জীবনের পরে। কিসনরামকে তাই বলেছেন, ‘শাস্ত্রে এ কথাও লেখা আছে – পবিত্র মনে যে প্রায়শ্চিত্ত করে, মরার পর সে স্বর্গে যায়’।

কিসনরাম প্রশ্ন করতেই, পান্ডে এবার স্পষ্ট বলেন, ‘তুমি একটা সরল নির্বিরোধী মানুষ। তোমার মতো মানুষ ভূত হতে পারে না’। এতে কিসনরামের প্রশ্ন কমেছে বটে – কিন্তু অস্থিরতা কিংবা দুঃখ কোনোটাই কমেনি। মনের অস্থিরতাকে আগে নানা প্রশ্নে ভাগ করে নিত, এখন তা যেন পাথর থেকে ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়া জলের মতো ওর সমস্ত অস্তিত্বে জড়ো হচ্ছে। অন্যদিকে পান্ডের মনে হয়, অস্থিরতা না কমলে কিসনরামের মুক্তি সত্যিই কঠিন হবে। মৃতদেহ যদি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, তবু চিতার বাঁশে আটকে থেকে ওর অতৃপ্ত আত্মা উর্ধ্বমুখ করে ভাসবে। কিসনরামের দু’চোখে মৃত্যুর ছায়া। চোখ দিয়ে যার প্রাণ বেরিয়ে যায় তার মুখটা কী বীভৎস দেখায়!

সুঁয়ালের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্মৃতিমগ্ন পান্ডের মনে হচ্ছে, কেউ যেন তাঁর পিঠে ঝোলানো পুঁটলিটা নিচের দিকে টানছে। দূরের গাঁয়ে এক বৃদ্ধ যজমানের মৃত্যু হয়েছে। ত্রয়োদশীর দিন অশ্বত্থ স্পর্শ করিয়ে পান্ডে ফিরছেন। পুঁটলিতে যব-তিল ছাড়াও কিছু বাসন আছে। বাকি বাসনকোসন অন্ত্যেষ্টির দিন নিয়ে এসেছেন। আজ শুধু একটি করে ঘটি, বাটি আর থালা-চামচ এনেছেন।

কিসনরামের মৃত্যুর পর ওর সৎভাই, ঘরের সামান্য বাসনকোসনও হয়তো সরিয়ে ফেলেছে। নীচ স্বভাবের দরুণ, মৃত কিসনরামের নামে সে বাসনপত্র উৎসর্গ নাও করতে পারে। পান্ডের মনে পড়ে, চন্দ্রা বউ ঠাকরুন জলের যে ঘটিটা মাঠে নিয়ে যেত, কিসনরাম সেটা কখনও স্পর্শ করে নি। বউ ঠাকরুন ঘটি উপুড় করে দিত আর সে ডান হাতটা মুখের কাছে এনে ঢকঢক করে জল খেত। কেমন জন্ম-জন্মান্তরের মনে হত ওর পিপাসা। জল খাবার শব্দ স্পষ্ট শোনা যেত, গলার কন্ঠা দ্রুত ওঠানামা  করত। ভাবতে ভাবতে পান্ডের মনে হল, কিসনরাম বুঝি তাঁর পেছন পেছন হাঁটছে, পিঠে ঝোলানো ঘটিটা মুখের কাছে টানছে। পা দুটো সহসা ভারি ঠেকে। মনে পড়ে, এক যজমানের মৃত্যুর সময়ে নিছক সান্ত্বনা দেবার জন্য কিসনরামকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, সে মরলে উনি নিজের হাতে তর্পন করবেন। শুনে কিসনরাম কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল। ‘আপনার হাতের তর্পণে আমার মতো অভাগার সব পাপ মোচন হয়ে যাবে। কিন্তু গোঁসাইজি আপনার মতো পবিত্র ব্রাহ্মণের হাত থেকে তর্পণ পেয়ে যদি আমাকে কোনও দণ্ড পেতে হয়?’

পান্ডেও বিলক্ষণ জানতেন, কিসনরামের তর্পণ করা শাস্ত্র-বিরুদ্ধ। কিন্তু ওকে আশ্বস্ত করার এই একমাত্র উপায়। তাই বলেছিলেন, ‘জাতি হয় দেহের, বুঝলে কিসনরাম। দেহত্যাগের পর শুধু আত্মা থাকে। মনে রাখবে, আত্মা কখনও অচ্ছুত হয় না’। তবে যুক্তি তর্কে যাবার এখন অবসর কোথায়! মন এতটাই উদ্ভ্রান্ত যে, ও মরে গিয়ে থাকলে কি কথা রাখতে পারবেন।

কেবল পান্ডে তাই মনে মনে প্রার্থনা করছেন, আর যে-ই মরুক, কিসনরাম যেন না মরে।

গাঁয়ে এখন দু’জনের মৃত্যু আশঙ্কা প্রবল – একজন কিসনরাম। অন্যজন ওর সৎ মা।

কেবল পান্ডে এক মুহূর্ত সংকোচ বোধ করেন, তিনি কি মনে মনে প্রার্থনা করছেন, কিসনরামের বদলে ওর সৎমার মৃত্যুই কাম্য? পরে ভাবেন, নব্বই পেরিয়েছে। আজ নয় কাল যেতেই হবে।

ভারি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি শ্মশানে এসে পৌঁছান। সেখানে চিতার অবশেষটুকু জ্বলছে। মড়া পোড়ানোর লোকজন ফিরে গেছে। শ্মশান রীতিমতো খাঁ খাঁ। নদী স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে মুখর নিস্তব্ধতা যেন কারও চলে যাওয়ার বৃত্তান্ত শোনাচ্ছে। পান্ডে বাহ্যিক আচার-ব্যবহারে শূদ্রদের যেমন অচ্ছুত ভাবেন – চিন্তা-ভাবনায় ঠিক তা নয়। মা-বাবার কাছ থেকে সমবেদনা আর উদারতাই তিনি পেয়েছেন। তবে পরম্পরাগত সমাজে তাঁকে লোকাচার মেনে চলতে হয়। নিজস্ব ভাবনার সুযোগ সেখানে নেই। নির্জনে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর শরীরে এক ধরনের শিহরন হয়।

কিসনরামকে নিয়ে দুর্ভাবনা বেড়েই চলেছে। দূর থেকে জিজ্ঞেস করার যে সুবিধা ভাবা গিয়েছিল, সেটা আর নেই। পান্ডে জানতে আগ্রহী – কিসনরাম নাকি ওর সৎমা, আসলে কে মরেছে? নতুবা অন্য কেউ মরেছে কি? দূর থেকে শবটা চোখে পড়ে না। পুরোটা দাহ করে ফেলেছে। আধপোড়া শব ভাসিয়েও দিতে পারে। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবেন! নদীকে, নাকি অরণ্যকে? চারপাশে কেবল উপত্যকার অঙ্গ বস্ত্র ছড়িয়ে রয়েছে।

প্রবল কৌতূহলে পান্ডে খানিকটা এগিয়ে যান। মনটা বেশ অস্থির। আশঙ্কা পা দুটোকে ফিরিয়ে নিয়ে  যেতে চায়। মাঠে কাজ করছে এমন কেউ যদি তাঁকে শ্মশানে ঘুরতে দেখে, তাহলে কী ভাববে? অচ্ছুতের শবদাহের পর এখানে কী করছেন?  জিজ্ঞাসা তাঁর বিভ্রান্ত মনটাকে চারপাশে ঘুরিয়ে দেয়, যদি কোথাও কিছু অবশেষ … কিসনরামের সৎ মায়ের ঘাঘরা কিংবা সায়া দেখা যায়, তাহলে এটুকু বুঝতে পারবেন যে মহিলাই মরেছে। তাঁর আশঙ্কাও দূর হবে। তখনই একটুকরো কাপড় পায়ে এসে ঠেকে – পান্ডে চকিতে পেছনে সরে যান। দেখেন, অবিকল কিসনরামের মতো কালো দু-ভাঁজ টুপি – যা ও চন্দ্রা বউ ঠাকরুনের কাছ থেকে রুটি নেবার সময় পাত্রের মতো এগিয়ে দিত। না, টুপিটা চিনতে তাঁর ভুল হবে না। টুপিটা অন্যত্রও দেখেছেন।  কিন্তু কিসনরামের মাথা এই টুপি ছাড়া দেখেননি। ‘কিসনরাম! … ওম্‌ বিষ্ণু …’ কেবল পান্ডের মনে হয়, বাটির মতো প্রসারিত টুপিটার কাছে কিসনরামের প্রেতাত্মাও উপস্থিত। কাতর প্রার্থনার ভঙ্গিতে তাঁকে দেখছে, ‘ঠাকুর মশাই!’

‘হে রাম…!’ দুঃখে বিষাদে পান্ডের চোখ দুটো ভিজে ওঠে। সাপের মতো নড়তে থাকা আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হওয়ায় পা দুটো একেবারে হালকা লাগছে – যাবতীয় বিভ্রম থেকে এবার মুক্তি পেয়েছেন। কেবল পান্ডে এবার এগিয়ে যান গাঁয়ের পথ ধরতে। সুঁয়ালের তীর ধরে আরও কিছুদূর যেতে হবে – কিন্তু শ্মশান থেকে সামান্য চড়াইয়ে পৌঁছতেই পা দুটো ফের ভারি হয়ে ওঠে। মনে হয়, কিসনরাম পেছনে থেকে গেছে। টুপিটা প্রসারিত করে ও কী চাইছিল? শুধু চাইছিল, ওর যেন মুক্তি হয়। হয়তো মৃত্যুর সময়ে কাউকে বলেও গেছে, পান্ডেজিকে যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি কিসনরামকে তর্পণের আশ্বাস দিয়েছিলেন।

তাঁর মনে আছে, শেষ দিনগুলিতে কিসনরামের চোখে মুক্তির স্বস্তি খুব সামান্য ছিল না। মুক্তির আশ্বাসে নিশ্চিত হবার ভাব ওর মুখের কথা আর চলাফেরায় ফুটে উঠেছিল। ওকে আর আত্মপীড়িত নয় বরং প্রশান্তই মনে হত। জরাগ্রস্ত শরীরে সামান্য ছন্দও এসেছিল। কেবল পান্ডের মুখের কথা, শাস্ত্রবিধিমতে তর্পণ করে দেবেন শুনে কিসনরাম প্রকৃত বৈরাগীর মতো সৌম্য হয়ে উঠেছিল। এমনও হতে পারে ওর বিদেহী আত্মা এখানে খোঁজ করছে যে পান্ডে তর্পণ করেছেন কিনা! যতই এগোতে চান, মনে হয় – কিসনরাম তাঁকে পেছনে টানছে। এর থেকে মুক্তির উপায় ওর তর্পণ করা। সমস্ত দ্বিধা সংশয় থেকে মুক্তির এই একমাত্র পথ। আত্মীয়দের জানিয়ে কিছু করা যাবে না। এই সুঁয়াল উপত্যকার নির্জনে শুধু সেই ঈশ্বর সাক্ষী থাকবেন, যার কাছে সবাই সমান। কেউ ডোম নয়, কেউ ঠাকুর-ব্রাহ্মণ নয়। কিন্তু শ্মশানের কাছে কেউ তাঁকে তর্পণ করতে দেখে ফেললে, নিশ্চয়ই প্রশ্নবাচক চোখে তাকাবে। সে যদি গুজব ছড়িয়ে দেয়, লোভী ব্রাহ্মণ গোপনে শূদ্রের শেষকৃত্য করেছে!

সামান্য উৎরাইয়ে একটা সরু প্রবাহ সুঁয়ালে এসে মিলেছে। পান্ডে এগিয়ে এসে সঙ্গমের ধারে একটা  উঁচু পাথরের ওপর কাঁধের পুঁটলিটা রাখেন। পুঁটলি খুলতেই ভেতরের ঘটি অকস্মাৎ দৈব-প্রেরিতের মতো গড়িয়ে পড়ে। ভারাক্রান্ত মনে পান্ডে খানিকক্ষণ কিসনরামের সঙ্গে কাটানো শৈশব-স্মৃতিতে ডুবে থাকেন। অবশেষে জল ভরে, নদীর ধারে মাটি দিয়ে বেদি গড়ে, ওপরে ঘটিটা রাখলেন। আজীবন দান গ্রহণ করে আসছেন, আজ না হয় ভৃত্যের নামে নিজেই সামান্য দান করবেন। চিন্তা ভাবনায় উদার হতে হতে এও ভুলে গেলেন যে তিনি শূদ্রের তর্পণ করছেন। থালা, গেলাস, বাটি – পুঁটলি থেকে একে একে তিনি সব বের করেন। থালায় যব তিল রেখে কিছু কুশও তুলে আনেন। সব কিছু সাজিয়ে তর্পণ শুরু করার সময়, ‘কিসনরাম, প্রেত-প্রেতার্থ’ উচ্চারণ করতে গিয়ে পান্ডের ইচ্ছে হয়, পেছনে পড়ে থাকা ওর টুপিটা তুলে আনেন, যব তিল তাতেই অর্পণ করেন, ‘বিষ্ণু…বিষ্ণু…’

তর্পণ সেরে গাঁয়ের কাছে আসতেই কেবল পান্ডের হঠাৎ মনে পড়ে, কালই তাঁকে বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধ করতে হবে। ঠিক একদিন আগে শূদ্রের তর্পণ করার পর ধর্মপ্রাণ বাবার শ্রাদ্ধ। নিজের হাত দু’খানি দেখে পান্ডের মনে হয়, অশুচি হয়ে গেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে মুখের কাছে হাতের আঙুল ধরলে, যেন খৈনি ডলার গন্ধও পেলেন।

পান্ডে ভাবতে থাকেন, গোপনে শূদ্রের তর্পণ করার পর, বাড়ির লোকদের না জানিয়ে বাবার শ্রাদ্ধ করা উচিৎ হবে না। অচ্ছুতের প্রতি উদারতা সত্ত্বেও জাতিগত নিষ্ঠা আর গোঁড়ামি বাবার মধ্যে যথেষ্ট ছিল। যা শাস্ত্র-সম্মত, তাই মানবিক – এটাই তাঁর মত, আর তাই মেনে চলতেন। জীবনে শাস্ত্র-বিরুদ্ধ কোনও কাজ করেননি। তাই অশুচি হাতে বাবার শ্রাদ্ধ কীভাবে করবেন!

গ্রামের কাছে এসে কেবল পান্ডে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর ভয় করছে, শুদ্ধ মনে বাবার শ্রাদ্ধ করার জন্য সত্যি কথা বলতে হবে – প্রতিক্রিয়া যাই হোক। এতক্ষণে বোধহয় কিসনরামের মুক্তি হয়ে গেছে অথচ শূদ্র-তর্পণের অনুতাপ প্রেতাত্মার মতো তাঁকে জাপটে ধরেছে। কিসনরামের কথা মনে পড়ায়, মাথার ঘাম মুছতে মুছতে ফের শ্মশানের দিকে তাকান। মনে হয়, অস্তগামী সূর্য আর তাঁর মধ্যেখানে এখন নিজের আত্মাই ঝুলছে। পাকদণ্ডির পাশে বড় পাথরটায় জিরিয়ে নিতে খানিকক্ষণ বসলেন।

সৎমাকে পুড়িয়ে, অন্য রাস্তা ধরে ঘরে ফেরার সময় কিসনরাম কেবল পান্ডেকে পথের ধারে চিন্তামগ্ন বসে থাকতে দেখে, পরম শ্রদ্ধাভরে, ‘ঠাকুর মশাই’ বলে দণ্ডবৎ হয়ে ঝুঁকে পড়ে।

যেন মহাকাশ থেকে ভেসে আসা ডাক শুনে পান্ডে চকিতে চোখ তুলে তাকান – সামনে ন্যাড়ামাথা কিসনরাম! মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। পান্ডে অবাক বিস্ময়ে নিষ্পলক চেয়েই থাকেন। দু-হাত দণ্ডবৎ জড়ো করে কিসনরাম যথারীতি ঝুঁকে রয়েছে। ‘বেঁচে থাকো’ বলার জন্য হাত তুলতে গিয়ে কেবল পান্ডের মনে হয় নিজেকে আকাশে ঝুলে থাকা প্রেতাত্মার কবল থেকে মুক্ত করছেন।

Tags: , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ