গল্পের সময় – আপনি মূলত কবি। কবিতার পাশাপাশি আপনি গল্পও লেখেন। আপনি কবে থেকে গল্প লিখছেন?
কৃষ্ণা বসু – আমি আট বছর বয়স থেকে কবিতা লিখছি। প্রায় শৈশব থেকেই কবিতা লিখছি। আমি কবিতা আক্রান্ত। কোনও ঘটনার অভিঘাত আমার মধ্যে তরঙ্গ তৈরি করে এবং তা কবিতায় প্রকাশিত হয়ে যায়। কোনও অভিজ্ঞতা যা কবিতার আয়তনের চেয়ে বড় বলে মনে হয় তাকে গল্পে ধরি। আমি গল্প লিখছি বাইশ – তেইশ বছর বয়স থেকে। ভাল গল্প লিখে আনন্দ পাই। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই ভাল কবিতা লিখে। কবিরা যখন গদ্য লেখেন তখন তার একটা স্বাচ্ছন্দ্য থাকে। মায়া থাকে,মমতা থাকে।
গল্পের সময় – গল্প লেখেন কেন ? কিসের তাগিদে গল্প লেখেন ?
কৃষ্ণা বসু – কোনও অভিজ্ঞতা কোনও ঘটনা যখন আমাকে আলোড়িত করে তখন আমি কবিতা বা গল্প লিখি। কিন্তু কখন তা থেকে গল্প লিখব, কখন কবিতা লিখব তা বুঝতে পারি না। তবে গল্প লিখতে ভাল লাগে। কবিতা একটু সাংকেতিক, কবিতা একটু সূক্ষ্ম বেশি, কবিতা একটু প্রতীকী। গল্প আর কবিতাকে আমার পরিপূরক বলে মনে হয়।
গল্পের সময় -গল্পের মাধ্যমে আপনি কী সমাজকে কোনও বার্তা দিতে চান ? নাকি শিল্প সৃষ্টির তাগিদ থেকে গল্প লেখেন ?
কৃষ্ণা বসু – প্রতিটি মানুষেরই একটা জীবনদর্শন থাকে বলে আমি বিশ্বাস করি। লেখক না জানলেও লেখার মধ্যে তাঁর একটা জীবনদর্শন উঠে আসে। আমার সেই গভীর জীবনদর্শন যখন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায় তখনই তা গল্পের আকার পায়। চারপাশে যে বহমান জীবন, যাপিত জীবন, পরিচিত জীবন সেখানে অনেক ঘটনার কথা আমি শুনতে পাই, দেখতে পাই। সেগুলো গল্পে অনুদিত হয়ে আসে। কখনও কবিতায় ধরা দেয়। যদিও এটা নির্ভর করে অভিজ্ঞতা ও মেজাজের উপরে।
গল্পের সময় – কখনও কী এমন মনে হয় কবিতায় কিছু কথা বলা গেল না তার জন্যই গল্প লেখার প্রয়োজন হয়ে পড়ল ?
কৃষ্ণা বসু – ‘মেয়ে মানুষের লাশ’ নামে আমার একটি খুবই প্রচারিত কবিতা আছে। এই কবিতার যে মেসেজ তা গল্প, উপন্যাস সবেতেই অনুদিত হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে তা কবিতা হিসেবেই ধরা দিল।
গল্পের সময় – এই বিষয়টি নিয়ে আপনি গল্প লেখেননি ?
কৃষ্ণা বসু – এটা নিয়ে আমি গল্প লিখিনি; তবে মেয়েদের জীবনে হিংসা, অত্যাচার, অনাচার, তৃতীয় শ্রেনীর নাগরিক করে রাখার চেষ্টা এই সব কথা আমি গল্পে লিখেছি।
গল্পের সময় – গল্প কীভাবে লেখেন ? গোটা প্লট ভেবে নিয়ে লিখতে বসেন নাকি লেখা শুরুর পর তা নিজের গতিতে এগিয়ে চলে ?
কৃষ্ণা বসু – আমার গল্প শুরু হওয়ার পর তা আমায় টেনে নিয়ে যায়। আগে থেকেই এরকম একটা লিখব, এরকম ভাবে শেষ করব এমনভাবে লিখি না। আমি কিছুটা গ্রস্থ বা প্রভাবিত হয়েই লিখে চলি এবং পরিণতিতে পৌঁছোয়।
গল্পের সময় – গল্পের উপাদান আপনি কীভাবে পান ?
কৃষ্ণা বসু – উপাদান আমি আমার জীবন থেকে পাই। আমি মানুষের সঙ্গে মিশি। মত বিনিময় করি। আমার দীর্ঘদিনের অধ্যাপনা জীবন থেকেও আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমার ছাত্র–ছাত্রীদের থেকে অনেক কথা জানতে পারি। তাদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতাই আমার গল্পের উপাদান হিসেবে চলে আসে।
গল্পের সময় – আপনি লেখালিখি কখন করেন ? রাতে, ভোরে নাকি দিনের যে কোনও সময়ে ?
কৃষ্ণা বসু – কবিতা সবসময়েই অভিভূত অবস্থায় লেখা হয়। কবিতা কখন ধরা দেবে তা আমার জানা থাকে না। তবে গল্পের জন্য সময় দিতে হয়। মূলত গল্প আমি রাতের দিকেই লিখি। কখনও কখনও সভাসমিতিতে না গিয়ে দুপুর থেকে একটানা লিখে যাই। তবে রাতে যখন চারিদিক শান্ত হয়ে যায় তখন আমার লেখা দ্রুত গতিতে এগোতে পারে।
গল্পের সময় – কবিতা যে ভাবে মাথায় আসে গল্পও কী সেভাবে আপনার মাথায় আসে ?
কৃষ্ণা বসু – না সেভাবে আসে না। গল্প আর কবিতা দুটি আলাদা শিল্প। কবিতার ক্ষেত্রে কোনও অনুভূতি আমায় অধিকার করে নেয়, তারপর আমি কিছুটা অবিভূত, গ্রস্থ, আবিষ্ট হয়ে কলম টেনে নিই। কেউ আমার উপর ভর করে। লেখাটা তৈরি হতে থাকে। গল্পের মধ্যে একটা ভাবনা থাকে, দর্শন থাকে, চিন্তা থাকে, একটু পরিকল্পনা থাকে এবং একটা প্রবাহও থাকে। গল্পের সৃষ্টি একটা সচেতন চেষ্টার মধ্যে দিয়ে হয়। তবে গল্পও জীবনের সত্যকে ধরে, কবিতাও জীবনের সত্যকে ধরে। এই দিক থেকে দুটি শিল্পের মধ্যে একটা মিল আছে। জীবন–সত্যের গভীরতম উচ্চারণ হল কবিতা, জীবন সত্যের একটু বিস্তারিত উচ্চারণ হল গল্প।
গল্পের সময় – এখন মানুষের হাতে সময় কম, সে শশব্যস্ত তার গল্প পড়ার সময় নেই। আপনার অনুভব কী?
কৃষ্ণা বসু – আধুনিক মানুষ জীবিকার জন্য ছুটছে। এরই মধ্যে যাদের একটু অবকাশ আছে তারা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বিনোদনের দিকে ছুটছে। গল্প পড়ার লোক তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। কিন্তু সাহিত্য পড়ার লোক পৃথিবীতে চিরদিনই আছে, চিরদিনই ছিল, চিরদিনই থাকবে। আমি ২০১১ সালের ১৩ই অক্টোবর ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় ‘রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান’ এই বিষয়ে বলতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে দেখলাম ওখানে ট্রেনে বসে লোক বই পড়ছে, পার্কে বসে বই পড়ছে, এরোপ্লেনে বসে বই পড়ছে। অনেকেই গল্পের বই পড়ছে। খুব ভাল লেগেছিল। গল্পের একটা সাংঘাতিক টান আছে। যতই বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রচার বাড়ুক গল্পের চাহিদা কোনওদিন ফুরোবে না। তবে মানুষের সময় কমে গেছে। সামান্য রোজগারের জন্য তাকে অনেক ছুটতে হচ্ছে। অনেকে ১২ – ১৩ ঘন্টা খাটে। কখন গল্প পড়বে তারা ? এটা একটা উদ্বেগের বিষয়।
গল্পের সময় – এখনতো মানুষ সিরিয়াল দেখে। অনেকে সারাদিন সিরিয়াল দেখে। বাড়িতে মানুষ এলে বসিয়ে রেখে সিরিয়াল দেখে। এই সিরিয়ালেও তো গল্প থাকে। আপনি এ বিষয়ে কী বলবেন ?
কৃষ্ণা বসু – সিরিয়ালের গল্প সম্পর্কে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় আমি তখন একটা উপন্যাস শেষ করেছি। একটি চ্যানেল থেকে তিনটি ছেলে আমার কাছে এল। তারা বলল আপনার উপন্যাস নিয়ে আমরা একটি সিরিয়াল করতে চাই। আপনি অনুমতি দিন, আমরা একটু দরকার মতো চেঞ্জ করে নেব। আমি বললাম তা কী করে সম্ভব ? তা হলেতো সেটা আর আমার লেখা থাকবে না। এই টানাপোড়েনের পরই বিষয়টি বাতিল হয়ে যায়। সিরিয়ালের গল্পে আমাদের অভিজ্ঞতা মারাত্মক। দেখা যায় একটা যৌথ পরিবারে ২০ – ২৫ জন লোক মিলে কলহ করছে। আজ বাস্তবে যৌথ পরিবার প্রায় নেই, অথচ সিরিয়ালে তার ছড়াছড়ি। খবুই বিরক্তিকর। আমার মনে হয় ভাল গল্পকার, কথাকারকে দিয়ে সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখানো উচিত। যে দেশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জন্মেছেন সেখানে তো লেখকের অভাব নেই। ভাল লেখকদের দিয়ে সিরিয়াল লেখানো হোক। কুটকচালিকে ভিত্তি করে ঘরে ঘরে সিরিয়ালের এই লাগাতার প্রচার খুব উদ্বেগের বিষয়, চিন্তার বিষয়।
গল্পের সময় – ছোটদের জন্য লেখালিখিতে কতটা সময় দেন ?
কৃষ্ণা বসু – ছোটদের জন্য প্রায়ই ছড়া লিখি। ছোটদের জন্য গল্পও লিখি মাঝে মাঝে। গল্পের চেয়ে ছড়াই বেশি লিখি। তবে খুব বেশি ছোটদের জন্য লিখতে পারিনা।
গল্পের সময় – এতদিন ধরে লিখছেন। এমন কিছু আছে যা এখনও লেখা হয়ে ওঠেনি, মনের কোণে ইচ্ছে হয়েই জমে আছে।
কৃষ্ণা বসু – আমার মা কে নিয়ে একটা বড় লেখা লেখার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। আমার মা উত্তর কলকাতার মেয়ে। তখন উত্তর কলকাতা গ্রাম ছিল। আমার মা কে তার ১৪ বছর বয়সে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মা ক্লাসে ফার্স্ট–সেকেন্ড হতেন। এ বিয়ে মানতে পারেননি। পরে মা মহিলা সমিতি গড়েন। শ্বশুর বাড়ি থেকে প্রবল চাপ আসে। মা কিন্তু আর মাথা নোয়াননি। আমার জীবনে মায়ের অবদান অনেক। এমন প্রতিবাদী মহিলাকে নিয়ে আমি অন্য কিছু লিখেছি। কিন্তু একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে।
গল্পের সময় – এতটা সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে গল্পের সময়ের পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
কৃষ্ণা বসু – ধন্যবাদ গল্পের সময়কেও।
Tags: কৃষ্ণা বসু
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।