কবি যখন বনের পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়েই আকাশ লাল করে সূর্যাস্ত হচ্ছিল। অস্তরাগের সেই স্বর্গীয় সৌন্দর্যে মর্ত্যের কবি এতটাই অভিভূত যে, আর একটু হলেই এক নারীর সঙ্গে তাঁর দেহস্পর্শ ঘটে যেত। বনবাসী সমাজের সেই যুবতী তখন মাথায় জ্বালনের বোঝা নিয়ে সন সন করে হেঁটে আসছিল উলটো দিক থেকে। তার ঘাড় শুকনো ডালপালার ভারে ঝুঁকে থাকায় সে সামনের দিকটা ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না। আর কবি তো তাকিয়েছিলেন আকাশের দিকেই। তিনিই বা দেখবেন কী করে, সামনে কে আসছে ! বন থেকে কুড়িয়ে আনা ডালপালা যুবতীর মাথা ছাড়িয়ে তার দেহের চারপাশে যেন এক নিরাপত্তা বলয় রচনা করেছে। তাই লাগতে লাগতেও ধাক্কাটা শেষ পর্যন্ত লাগল না। কবি অন্তত যুবতীর দেহের কোনো স্পর্শ পেয়েছেন বলে মনে করতে পারলেন না। তবু তিনি যখন অপ্রতিভ, দুঃখ প্রকাশ করতে যাচ্ছেন প্রায়, শুনতে পেলেন : ‘মরণ ! কানা নাকি !’
এ – কথায় কবির রাগ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল কিন্তু নিসর্গপ্রিয় কবিদের মনে সহজে ক্রোধভাব আসে না। কবি বরং প্রথমে দুঃখিত, তারপর সেই দুঃখকে কৌতুকে রূপান্তরিত করে নিয়ে বললেন, ‘কানা নই গো, রঙ দেখছিলাম – আকাশের রঙ। এই রঙ যে দেখে না, সে তো চোখ নিয়েও দৃষ্টিহীন।’ মার্জিতভাষী কবি ‘কানা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি ; তবু কথাটা যে তার উদ্দেশেই, বুঝে নিতে মেয়েটির অসুবিধা হলো না। আর তার রাগ তখন মুহূর্তে কেমন বিষাদে পরিণত হলো। উদাসস্বরে মেয়েটি বলল, ‘কেমন করে দেখব ? আমার বোঝাটা কি তুমি নেবে, বাবু ?’
কবির গলার স্বর আবেগে কেঁপে উঠল। তিনি প্রথমে বললেন, ‘বাবু বোলো না’, তারপর অনভ্যস্ত হাতে যুবতীর মাথা থেকে জ্বালনের বোঝাটা কোনোরকমে নামিয়ে নিলেন ; এরপর মেয়েটি যেই সোজা গিয়ে দাঁড়িয়ে ‘তুমি পাগল না কি গো !’ বলে খিলখিল করে হেসে উঠেছে, কবির মনে হলো : ডালপালা সরিয়ে তিনি একটি পুষ্পকোরক উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। কী আশ্চর্য, সেই ফুলের রঙ কালো ; কিন্তু তার দলমন্ডল থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে এক রক্তিম আভা। কবি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, অস্তসূর্য বিদায়ের আগে যেন খুব সোহাগ করে মেয়েটির মুখে তার রঙ মাখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
কবি গাঢ় কন্ঠে বললেন, ‘তোমার মুখে অস্তরাগ ; চেয়ে দেখ তো, আমার মুখেও কি কোনো রঙ লেগেছে ? শুনে ‘রঙ – রঙ কোথায় রে, পাগল !’ বলে মেয়েটি যখন আবার হেসে উঠতে যাচ্ছে, কবি নিজের ইন্দ্রিয় সংযত করে বললেন, ‘হেসো না । তোমার ওই হাসি দেখলে আমি এবার সত্যি পাগল হয়ে যাব।’
মেয়েটির মুখে লাল আভার মতোই তখনো হাসি লেগে আছে ; অথচ তাকে কিনা হাসতে নিষেধ করা হচ্ছে। মেয়েটি অবাক হয়ে বনপথে এই অচেনা পুরুষের দিকে তাকিয়ে রইল আর কবি তখন তার দু–হাতের ভেতর মেয়েটির মুখ তুলে ধরেছেন। সেই মুখ এখন ভয়ে সাদা ; অথচ সাদার ওপর লালের ছোপ লেগে আছে। সে কি লাজরক্ত, নাকি ধর্ষণভয়ে ভীত ? শব্দের কারবারী কবি খুব সতর্ক হয়ে কাঁপতে কাঁপতে এইটুকুই বলতে পারলেন, ‘আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না।’ তারপর খুব কোমল করে মেয়েটির দু – গালে হাত রেখে সেই হাতের তালু নিজের চোখের সামনে মেলে ধরে দেখতে চাইলেন, তার হাতেও রঙ লেগেছে কিনা !
হাতের তালুতে রক্তরাগের কোন চিহ্ন নেই দেখে যখন বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন আর তার করবেষ্টন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে মেয়েটি দ্রুত মাথায় তুলে নিচ্ছে তার সেই ডালপালার বোঝা, অনেক আকাদেমি আর ভাষা–পরিষদের সম্মানভূষিত কবি নিচু হয়ে মেয়েটিকে সাহায্য করতে গেলেন। এবার তার দেহ, উন্নত স্তন কবিকে স্পর্শ করল ; কিন্তু পরাভববেদনায় কাতর কবি তাঁর স্নায়ুতে কোনো শিহরণ অনুভব করলেন না।
সারা গায়ে সূর্যের রঙ মেখে মেয়েটি যখন আবার হনহন করে হাঁটতে শুরু করেছে, কবি তখনো কিঞ্চিৎ নত হয়ে আছেন। অন্তরে – অন্তরে যে – যন্ত্রণা তিনি বোধ করেছিলেন, তার একটি প্রত্যক্ষগম্য কারণও তিনি এবার দেখতে পেয়ে গেলেন। শুকনো ডালপালার একটি কাঁটা কবির আঙুলে রক্তের টিপ এঁকে তাঁর সাময়িক চিত্তবিক্ষেপ, উচ্চাশা আর পরাজয়ের ক্ষতচিহ্ন রেখে দিয়ে গেছে।
[এই লেখাটির প্রথম কয়েকটি বাক্যে এক নাম না জানা বিদেশী ভূত ছিল। লেখার ছিড়ি দেখেই সে দৌড়ে পালিয়েছে। বাকি অংশটায় তাই আর তার ছায়া পড়েনি। ভূতেদের অবশ্য ছায়া থাকেও না।] – লেখক
প্রথম প্রকাশঃ ‘পরিকথা’ পত্রিকা, ডিসেম্বর,২০০৬। অন্তর্ভূক্ত হয়েছে লেখকের ‘কয়েকটি কথা একটি কাহিনি’ গল্প সংকলনে(সহজপাঠ,২০১৩)
Tags: পরাজয়, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।