ক্রিং .. ক্রিং .. ক্রিং .. টেলিফোনটা বেজে উঠলো। মাথার কাছে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠতেই ঘুম জড়ানো চোখে সচকিত ডাঃ বিকাশ মণ্ডল। ঘড়ি দেখলেন। বাজে রাত ২টো। এত রাতে কার কি হল? তড়ি ঘড়ি বিছানা থাকে উঠে ফোনটা ধরলেন ডাঃ মণ্ডল।
– হ্যালো? কে বলছেন?
– ডাক্তারবাবু! আমি তড়িৎ বলছি। বিবেকানন্দ আশ্রম থেকে। এত রাতে আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যে খুবই দুঃখিত। নিরূপায় হয়ে আপনাকে ফোন করছি। মাপ করে দেবেন।
– আরে না না। অত করে বলতে হবে না। ডাক্তারি পেশার সঙ্গে নিজেকে যখন জড়িয়ে ফেলেছি, তখন রাত বিরেতে রোগীর বাড়ি থেকে ডাক এলে বিরক্ত বোধ করলে চলবে কেন? এটা তো আমাদের কাজ গো।
– বলছি ডাক্তারবাবু। আমাদের আশ্রমে সারদা বিদ্যানিকেতন থেকে যে সব স্কুলের মেয়েরা এসেছিল, তাদের মধ্যে একজনের খুব শরীর খারাপ। কথা বলতে পারছে না। সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। খিঁচুনি হচ্ছে। হাতে পায়ে খিল ধরে যাচ্ছে। আমরা খুব ভয় পেয়ে আপনাকে ফোন করেছি। আপনাকে একবার আসতে হবে এখুনি।
– ঠিক আছে। তুমি ফোনটা রেখে দাও। গেটটা খোলা রেখো। আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে- এমনটা নির্দেশ দিয়েই বিছানা ছেড়ে চটপট জামা প্যান্ট পালটে নিলেন ডাঃ মণ্ডল। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন, কি হতে পারে? গতকাল তো ওদের আশ্রমে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে এসেছেন। ওরা এসেছে কলকাতা থেকে সারদা বিদ্যানিকেতন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে। বিবেকানন্দ আশ্রমে ভারত সরকারের একটা শিক্ষামূলক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে।
এখানে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আশ্রমে রেখে কয়েকদিনের জন্যে মূল্যবোধের পঠন-পাঠন শিক্ষা দেওয়া হয়। এর জন্যে ভারত সরকার থেকে ওই আশ্রম একটা কেন্দ্রীয় অনুদান পায়। ডাঃ মণ্ডল ওই আশ্রমের ট্রাস্টিবোর্ডের চিকিৎসক সদস্য। দিন- রাত যখনই হোক আশ্রমের আবাসিকবৃন্দ যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ে ডাঃ মণ্ডলের। হাসিমুখে পরিষেবা দেন বিনা পারিশ্রমিকে। তড়িৎ ওখানকার কেয়ার টেকার কাম ম্যানেজার। তড়িৎ সহ অন্যান্য কর্মচারিরা ডাক্তারবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ। যখনই সাহায্য চেয়েছেন ডাক্তারবাবু বিমুখ করেননি। গতকালও তো রাত্রে বিবেকানন্দ আশ্রমে গিয়েছেন। একটা গানের প্রতিযোগিতা হয়েছিল সারদা বিদ্যানিকেতনের ছাত্রীদের নিয়ে। পাঁচদিনের জন্যে ওরা এসেছে কলকাতা থেকে। প্রত্যেকেই দশম শ্রেণীর ছাত্রী। হৈ চৈ করে কেটেছে। কই কাউকে তো তখন অসুস্থ মনে হয়নি। তবে কি হল এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে?
কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তারবাবুর গাড়ি আসার শব্দ শুনে দারোয়ান গেট খুলে দেয়। ডাক্তারবাবু গাড়ি নিয়ে আশ্রমের ভেতরে ঢুকে যান। বিবেকানন্দ আশ্রমটা একেবারে গঙ্গার পাড়ে। প্রায় ১০-১৫ বিঘে জুড়ে। ঢোকার মুখে সুন্দর সুন্দর হরেক বাহারের ফুলের শোভা।
ডাক্তারবাবু আসতেই তড়িৎ তাঁকে নিয়ে সোজা চলল দোতলার হল ঘরে। ছাত্রীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে জটলা করছে। সকলের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। ঘুম ছুটে গেছে সকলের।
ডাক্তারবাবুকে একটা বেডের কাছে এসে দাঁড় করালো তড়িৎ । কয়েকজন বান্ধবী ঘিরে রেখেছে একটা মেয়েকে। মাঝে মাঝে কঁকিয়ে উঠছে সে। হাত পা শক্ত হয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। মুখ দিয়ে গোঙানির আওয়াজ বেরোচ্ছে মাঝে মাঝে। থরথর করে কাঁপছে সারা দেহটা। চোখে মুখে একটা অজানা ভয়ের ছাপ। ডাকলে কিছুই বলতে পারছে না। একটা অস্ফুট শব্দ বেরোচ্ছে মুখ থেকে।
বন্ধুদের সরিয়ে ডাঃ মণ্ডল ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগলেন মেয়েটিকে। ব্লাড প্রেসার মাপলেন। স্বাভাবিক রক্তচাপ। তবে নাড়ির গতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি। শ্বাস পড়ছে খুব জোরে জোরে। কথা বলছে না। এবারে পেছনে দাঁড়ানো বান্ধবীদের কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। কাল কত রাতে তোমরা ঘুমতে গিয়েছিলে? কি কি খেয়েছিলে? বাইরের কোন খাবার খেয়েছিলে কি না? এর আগে এ ধরণের লক্ষণ কখনো হতে দেখেছিলে কি না?
ছাত্রীদের কাছে থেকে তেমন কোন যুৎসই উত্তর পেলেন না ডাঃ মণ্ডল, যার সূত্র ধরে তিনি ওইরকম লক্ষণের কারণে পৌঁছতে পারেন।
এর মধ্যে একজন ছাত্রী বলে উঠলো,। কাল রাতে ঘুমতে যাওয়ার আগে একটা ভূতের গল্প হচ্ছিল। কে নাকি বলেছে, এখানে গঙ্গার ধারে ধারে অশরীরী আত্মা ঘুরে বেড়ায়। গঙ্গার হাওয়া খাওয়ার জন্যে।নিশি ভূত। মাঝে মধ্যে আশ্রমেও নাকি চলে আসে।
– তোমাদের মধ্যে এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল না কি? জানতে চাইলেন ডাক্তারবাবু। এসব কথার মধ্যেই কোথাও যেন একটা আলোর সন্ধান পেলেন তিনি। তড়িৎকে বললেন , তুমি একটা বড় কাগজের ঠোঙা আন তাড়াতাড়ি। তড়িৎ তো খুবই অবাক! ‘কাগজের ঠোঙা’ দিয়ে কি হবে রে বাবা! যাই হোক ডাক্তারবাবু যখন বলেছেন, তাঁর আদেশ শিরোধার্য করে অনেক খুঁজে পেতে রান্নাঘরে ডাল রাখার তাক থেকে পুরানো একটা কাগজের ঠোঙা আনল তড়িৎ।
– এই নিন, এটা দিয়ে চলবে?
ঠোঙাটা দেখে ডাঃ মণ্ডল বললেন, ঠিক আছে। এটা দিয়ে আপাতত কাজ হয়ে যাবে’। তারপ্রে জেটা করলেন, সেটা খুবই মজার ও অদ্ভূত ব্যাপার। ঠোঙার মুখটা নিয়ে সরাসরি মেয়েটির নাক ও মুখের মধ্যে চেপে ধরলেন। অন্যান্য ছাত্রী ও দিদিমণিরা এমন কি তড়িৎও খুবই অবাক। ওরকমভাবে চেপে ধরলে তো নিঃশ্বাস না নিয়ে মেয়েটা মরে যাবে? ভয়েতে আবার কিছুই বলতে পারছে না ডাক্তারবাবুকে। সবাই বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে রয়েছে ডাক্তারবাবু ও মেয়েটির দিকে। এরকম প্রায় মিনিট দশেক কেটে গেল। এরমধ্যে এক মজার ব্যাপার হল।
কিছুক্ষণের মধ্যে কাজলের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। হাত পায়ের শক্ত ভাবটা কেটে গেল। খিঁচুনি ও কাঁপুনি বন্ধ হয়ে গেল। চোখটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হল। চোখ খুলে দেখলো সকলকে। আরও অবাক কাণ্ড! ততক্ষণে ডাঃ মণ্ডল তার মুখ থেকে কাগজের ঠোঙাটা সরিয়ে নিয়েছেন।
আমার কি হয়েছে? সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? – জানতে চাইল কাজল
ডাঃ মণ্ডল তখন মুচকি হেসে বললেন, তোমায় ভূতে পেয়েছিল। ভূত ছাড়াতে ঠোঙা থেরাপি করেছি।
সবার মুখে কথা সরছে না। এরকমটা আবার হয় না কি? তাদের সকলের মুখের ভ্যাবাচ্যাকা ভাব দেখে ডাঃ মণ্ডল হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, কাজল তোমার কিছু হয়নি। তোমায় ভূতেও পায় নি। ভূতের গল্প শুনে তোমার ব্রেনের অবচেতন স্তরে একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, যার দরুন কিছু অস্বাভাবিক শারীরিক উপসর্গ শুরু হয়ে গিয়েছিল যেটা তোমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এটাকে আমাদের ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় ‘হিস্টোরিক এ্যাটাক’। উপরন্তু বেশি বেশি করে শ্বাস ছাড়ার জন্যে তোমার দেহ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বেরিয়ে গিয়েছিল বেশি পরিমাণে। ফলে রক্তের পি.এইচ মাত্রা বেড়ে গিয়ে ক্ষারীয় মাত্রায় চলে যাচ্ছিল। বেশি ক্ষারীয় মাত্রা আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে যার দরুন তোমার দেহে কম্পন হচ্ছিল আর খিঁচুনি শুরু হয়ে গিয়েছিল।
কাজলের নাক ও মুখের মধ্যে ঠোঙাটা চেপে ধরার জন্যে স্বভাবতই তোমাদের মনে হয়েছে কাজল শ্বাস নিতে পারছে না। তাই তোমাদের মনে খুব ভয় আর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল। আসলে তা নয়। কাজল শ্বাস নিচ্ছিল। যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাইরে বের করে দিচ্ছিল আমি সেটাকে ঠোঙার মাধ্যমে আবার দেহের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলাম। তাই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রাটা দেহের মধ্যে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়াতেই স্নায়ুতন্ত্রের অস্থিরতাটা কমে যায়। আর কাজলও সুস্থ হয়ে পড়ে। এতে ম্যাজিক কিছু নেই। সবই শারীর বিজ্ঞানের কৌশল প্রয়োগ মাত্র।
সব সময় রোগে যে ওষুধ দিতে হবে তার কোন মানে নেই। ঠোঙা থেরাপিতেও কাজ হয়। যাই হোক অনেক রাত হয়ে গেছে। ছাত্রীরা তোমরা সবাই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। তোমাদের ভয়ের কিছু নেই। সবাই ভালো থেকো। গুড নাইট, বলে ডাঃ মণ্ডল চলে গেলেন বিবেকানন্দ আশ্রম থেকে। ছাত্রীরা ও দিদিমণিরা সবাই অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলেন ডাঃ মণ্ডলের যাত্রাপথে।
Tags: নিশি পাওয়া, প্রদীপ কুমার দাস
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।