[১]
কালিদাস মাধ্যমিক (উচ্চমাধ্যমিক) বিদ্যালয়ে শুভম যেদিন অঙ্কের পার্টটাইম শিক্ষক হিসেবে জয়েন করল সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টির দাপট ছিল মনে রাখার মতন। সারা আকাশ কালো হয়ে রয়েছে, সঙ্গে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত আর উথাল-পাথাল ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডব। এত খারাপ আবহাওয়া বছরের এই সময়টা সচরাচর হয় না। কিন্তু হয়েই যখন গেছে তখন কি আর করা! প্রথম দিন, তাই যেভাবেই হোক হাঁটু-জল ভেঙে হাজির হল শুভম। তার ধারণা ছিল, এত দুর্যোগের দিনে খুব একটা কেউ আসবে না, স্কুল হয়ত তাড়াতাড়ি ছুটিও হয়ে যাবে। কিন্তু না, বিদ্যালয়ে পৌঁছে শুভম দেখল পরিস্থিতি তেমন নয়। প্রধান শিক্ষক বলে দিলেন,প্রতি ক্লাসে কম করে গড়ে পনেরজন ছাত্রছাত্রী উপস্থিত রয়েছে; সুতরাং, স্কুল চলবে যথারীতি। বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অশিক্ষক-কর্মীদের সাথে প্রাথমিক আলাপ করিয়ে দিলেন প্রধান শিক্ষক উমাপতিবাবু নিজেই। তারপর শুভমকে বললেন, ‘ ওকে মিস্টার ঘোষাল, নেক্সট পিরিয়ডেই আপনার প্রথম ক্লাস সেভেন-সি তে। আর আপনার পুরো সপ্তাহের রুটিনটা ওই মাধবী ম্যাডামের থেকে বুঝে নেবেন। ঠিক আছে? …ফাইন দেন, গুড লাক!’
হেডস্যার চলে যাওয়ার পরে দুই স্টাফরুমের সকলে এসে শুভমের সাথে নিজেদের মত আলাপ সেরে নিতে লাগল। ধীরে ধীরে ঘর একটু ফাঁকা হল, প্রার্থনার পরে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা চলে গেলেন প্রথম পিরিয়ডের ক্লাস নিতে। স্টাফরুমে রইলেন চারজন, শুভম, ইতিহাসের শিক্ষক নৃপেনবাবু, ফিজিক্সের কিঙ্কর স্যার আর স্ট্যাটিসটিকস-এর সেই মাধবী ম্যাডাম। শুভমকে রুটিন বুঝিয়ে তিনি সামান্য হেসে বললেন, ‘ যাও, প্রথম ক্লাসটা নিরাপদেই কাটবে। সেভেন-সি অঙ্ক নিয়ে একেবারেই ভাবিত নয়। বাট ভেরি ওবিডিয়েন্ট! … তা তুমি আমার চেয়ে অনেকটা ছোটই হবে, তাই ‘তুমি’ করেই বলছি, কিছু মনে ক’র না কিন্তু !’উত্তরে হাত নেড়ে শুভম অল্প হাসল বটে, তবে মাধবী ম্যাডামের ছাত্রদের প্রতি মনোভাবটা শুনে তার একটু রাগই হল। ভাবল, এই মানসিকতা নিয়ে কি পড়ান উনি? এইসব লোকদের জন্যই শিক্ষার এই হাল !
কিন্তু ক্লাসে গিয়ে শুভমের মাথায় পুরো আগুন লেগে গেল। এরা মানুষের বাচ্চা ? এদের চেয়ে কম জ্যামিতি কি কারো পক্ষে জানা সম্ভব? সেভেনে পড়ে, অথচ ত্রিভুজের নাকি তিনটে কর্ণ? ক্লাসের ফার্স্টগার্ল তো দাঁত বের করে বোর্ডে এঁকে সেটা প্রমাণ অবধি করে দিল! কয়েকজন আবার এসব ঝামেলায় না জড়িয়ে পিছনে বসে টিফিন খাচ্ছে এই সেকেন্ড পিরিয়ডেই। যাই হোক, আত্মসংযমবজায় রেখে শুভম বুঝল, সিলেবাসটা একটু এগিয়ে নেওয়াটাই বিবেচকের কর্তব্য, বাকি সব পরে ভাবা যাবে। তাই শুভম উপপাদ্য দুটো একবার করে বুঝিয়ে দিল; তারপর বিপরীত দিক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে নিজেই বোর্ডে একটা অঙ্ক শুরু করল, প্রশ্নমালার তিনের দাগ। কিন্তু সেখানেও ঝামেলা! এক্সট্রাটা নাগালের মধ্যে এসেও হাতে আসছে না! নিজে যখন ছাত্র ছিল তখন সে এটা করেছে বলেই তো মনে হচ্ছে, কিন্তু আজ শুভম প্রায় দশ মিনিট চেষ্টা করেও এক্সট্রাটার কূল পাচ্ছে না। সোজা এক্সট্রা, নির্দ্বিধায় জালি, কিন্তু তাও জ্বালাচ্ছে! এদিকে পিছনে একটা চাপা গুঞ্জন উঠেছে, নতুন টিচারের ক্লাস দেখতে হেডস্যারও যদি আচমকা এসে পড়েন তবে সেটাও খুব একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার হবে না। বাইরের বিরামহীন বৃষ্টির জল পেয়েই হয়ত শুভমের কানের পাশে একটা শীর্ণ ধারা ক্রমশ স্রোতস্বিনী হয়ে উঠতে চাইছে। শুভমের অস্বস্তিটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ছি ছি, লজ্জার ব্যাপার বৈ কি ! একটা ম্যাজিকের আশায় শুভম এদিক-ওদিক তাকাতেই তার নজর পড়ল ক্লাসের সামনের বারান্দায়; আর একটু অবাক হয়েই সে দেখল, দেওয়ালের ব্ল্যাকবোর্ডে তার হাতে আঁকা জ্যামিতিক ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝারি উচ্চতার একজন বছর ষাটের একটু ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত টাক-মাথা ভদ্রলোক। তার চোখে হাই পাওয়ারের পুরু চশমা, বাঁ কাঁধে একটা ঝুলন্ত কাপড়ের ব্যাগ, ডান হাতে ঝুলছে আধখোলা এক কালো রঙের পুরনো আমলের বিরাট ছাতা। লোকটা যেন তাকেই খুঁটিয়ে দেখছে, জগতে তার দেখার মত আর কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই। শুভমের চোখ তার দিকে পড়তেই তিনি হাতের ইশারায় শুভমকে ডাকলেন। শুভম মনে মনে প্রমাদ গুনে ক্লাসকে ‘এই, এক মিনিট’ বলে লোকটির দিকে এগিয়ে গেল। কাছে যেতেই ভদ্রলোক অদ্ভুত হেসে ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, ‘চেনা-চেনা মনে হচ্চে তো? হুম… কিন্তু যবেকার চেনা মনে হচ্চে, তবেকার মন নিয়ে দে’খ ! তবেই না হবে !’ কথাটা বলেই ভদ্রলোক হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। শুভম কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে লোকটির কথার অর্থ উদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টা করল। অবশেষে দু-তিন সেকেন্ডের মাথায় পিরিয়ড শেষের ঘণ্টা পড়তেই শুভম হাঁফ ছেড়ে মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে স্টাফরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল।
[২]
স্টাফরুমে গিয়ে শুভম দেখল, সেই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা অদ্ভুত লোকটি ঘরের কোণে রাখা একটা কাঠের চেয়ারে বসে কোলের উপর রাখা একটা মাঝারি মাপের খাতায় একমনে কিন্তু বেশ দ্রুততার সাথে পেন্সিল ঘষে চলেছেন। সোজা হয়ে বসে আছেন ভদ্রলোক, তার স্থির চোখদুটি জানান দিচ্ছে, যে নিজের কাজে তিনি পুরোপুরি মগ্ন হয়ে রয়েছেন। অবাক হয়ে শুভম তাকে দেখতে দেখতেই গিয়ে বসে পড়ল আরেকটা চেয়ারে; আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন কিঙ্কর চৌধুরী। কিঙ্করবাবুর সাথে শুভমের চোখাচোখি হল; একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে শুভমের পাশের চেয়ারটা প্রায় নিঃশব্দে টেনে নিয়ে তাতে বসে পড়লেন। শুভম ওই লোকটির দিকে ইশারা করে বলল, ‘ উনি কে ? আর ওভাবে বসে…’
কিঙ্করবাবু তাকে মাঝপথে থামিয়ে খুব চাপা গলায় জবাব দিলেন, ‘ উনি হলেন মুরারিবাবু, এই স্কুলের খুব পুরনো টিচার। সাইকোলজি পড়ান। কাছেই বাড়ি।যেদিন যখন ক্লাস থাকে তার একটু আগে আসেন। সকলের সিনিয়ার, এমনকি হেডস্যারেরও। তাই কেউ কিছু বলেন না। কারো সাথে বিশেষ কথাবার্তা বলেন না, একদম মিশুকে নন। এইভাবে বসে থাকাটা অবশ্য সাত-আট মাস ধরে দেখছি।তবে খবরদার, এই অবস্থায় ওনাকে কিন্তু একদম ডিস্টার্ব করবেন না! একদিন নৃপেনবাবু এই অবস্থা দেখে ভদ্রলোককে চিন্তাবশতঃ ঠেলে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তার শরীর খারাপ লাগছে কিনা। তা চোখ খুলে মুরারিবাবুর সে কি রাগ! নৃপেনবাবুকে যা-না-তাই বলে গালাগাল অবধি দিয়েছিলেন!ইংলিশও ঝাড়লেন! ধুতি পরলে কি হবে, ইংলিশটা উনি অনেকের চেয়ে বেশী জানেন ও ব্যবহার করেন। ভীষণ মুডি, খ্যাপাটে, তবে এমনি অবশ্য ভালো লোক, কিন্তু…’ বলে কিঙ্করবাবু তার ডান তর্জনী দিয়ে নিজের কপালের ডানপ্রান্তটায় বার তিনেক টোকা মারলেন। অর্থটা শুভম বুঝল। কিঙ্করবাবু আরেকটা ক্লাস নিতে চলে গেলেন। শুভমের আবার সেই ফিফথ পিরিয়ডে ক্লাস। ঘরে এখন শুধু শুভম আর চোখ-বোজা মুরারিবাবু। নিজের ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে শুভম সেই তিনের দাগের এক্সট্রাটা নিয়ে ফের বসল। আচ্ছা ধাঁধাঁয় ফেলেছে জিনিসটা! তৃতীয় প্রকারের একটা অঙ্কন দিয়ে এক্সট্রাটা চতুর্থবার শুরু করতে না করতেই কানের পাশে সেই ফ্যাসফেসে স্বরটা শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠল শুভম, ‘না, এভাবেও হবে না!’
শুভমের মাথা সামান্য গরম হয়েই ছিল, এবার সে একটু অসন্তুষ্ট গলায় বলে উঠল, ‘তা কি ভাবে হবে বলুন তো?’
মুরারিবাবু কিন্তু বিন্দুমাত্র চটলেন না, বরং গম্ভীরভাবে তার হাতের খাতাটা শুভমের সামনে মেলে ধরলেন। শুভম হতবাক হয়ে দেখল, খোলা খাতাটার সাদা পাতায় সে এতক্ষণ যে অঙ্কটার পেছনে পড়ে আছে সেটাই আগাগোড়া করা রয়েছে। একটু অপটু এবং অবিন্যস্তভাবে করা, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে শুভম প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি করে… মানে আপনি… ’
মুরারিবাবু এবার একটু হাসলেন, তারপর কিঞ্চিৎ অন্যমনস্কভাবেই বললেন, ‘এই আর কি; চেনা-চেনা লাগল…’
[৩]
কয়েক মাস পার হয়ে গেল। ইতিমধ্যে মুরারিবাবুর সাথে শুভমের সম্পর্কটা কিছুটা সহজ হয়েছে। অন্য কারোর সাথে কথা না বললেও তিনি যে শুভমকে দেখলে একটা সৌজন্যের হাসি হাসেন সেটা অনেকেরই চোখে পড়েছে স্টাফরুমে। কখনও কখনও ‘তুমি’ সম্বোধনে দু-একটা কুশল প্রশ্নও শুভমকে মুরারিবাবু করেছেন কয়েকজনের উপস্থিতিতে। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক তো বটেই। ইংলিশের রজতবাবু তো একদিন বলেই ফেললেন, ‘ মিস্টার ঘোষাল, ম্যাজিক-ট্যাজিক জানেন নাকি? মুরারিবাবু সবাইকে ছেড়ে আপনার প্রতি সদয় হলেন কেন বলুন তো? হোয়াট’স দ্য সিক্রেট স্যার?’
এর সদুত্তর শুভমেরও অজানা, কিন্তু সেদিনের সেই এক্সট্রার ব্যাপারটা তার মন থেকে এখনও যায় নি। ‘চেনা-চেনা লাগল’ মানেটা কি? অত সোজা? সে তো তারও অনেক গান চেনা-চেনা লাগে, তাই বলে কি সে হারমোনিয়ামে সেসব গান এক লহমায় বাজাতে পারবে? আর যদি ভদ্রলোক এর আগে কখনও অঙ্কটা করেও থাকেন, তাহলে সেদিন ক্লাসের বাইরে বা স্টাফরুমে সরাসরি জ্ঞানটা দিতে পারতেন, খামোখা এত নাটক কিসের? ব্যাপারটা সাধারণ নাও হতে পারে। দ্বন্দ্বটা শুভমের মনে থেকেই যায়।
শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে মুরারিবাবুকে পাশের চেয়ারে দেখে শুভম কপাল ঠুকে প্রশ্নটা করেই ফেলল ভদ্রলোককে। মুরারিবাবু কিছুক্ষণ শুভভমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিজেই বললেন, ‘চা চলবে?’ ইঙ্গিতটা ধরতে পেরে শুভম সম্মতি দিল। মুরারিবাবু বললেন, ‘বেশ,চলো তাহলে।’
স্কুলের বাইরেই ছোট একটা চায়ের দোকান। টিফিনের সময় এখানেই সব স্যারেরা এসে বসেন। আজ সবাই ভেতরে, তাই দোকানে চেনা লোক কেউ নেই।চায়ের ভাঁড়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে সেটাকে পাশে নামিয়ে রাখলেন মুরারিবাবু; তারপর শুভমকে বললেন, ‘ব্যাপারটা নিয়ে তুমি ভেবেছ আর তোমার মধ্যে জানার জেনুইন আগ্রহ আছে বলেই বলছি। তুমি এটা বিশ্বাস করতেও পার, নাও করতে পার। কারণ আমি যা বলব, সেটা সাইকোলজির কোন বইতেই তুমি পাবে না। এটার পুরোটাই আমার নিজস্ব ধারণা, এর সপক্ষে কোন প্রমাণ আমি নিজেও পাইনি; কিন্তু এমনটা যে বহুবার আমার সাথে হয়েছে সে কথা একেবারে নির্জলা সত্যি।’
শুভম চা খেতে ভুলে গিয়ে তাকিয়ে আছে মুরারিবাবুর দিকে। কি এমন বলবেন মুরারিবাবু যার জন্য এত ভূমিকা?
চায়ে দ্বিতীয় চুমুকটা দিয়ে মুরারিবাবু ফের বলতে আরম্ভ করলেন, ‘অনেক সময় কোন জিনিস বা কোন লোক বা কোন একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে তোমার চারপাশের সমস্ত সেট-আপটা দেখে তোমার কি মনে হয় না যে ওই জিনিস, ব্যক্তি বা ওই পরিবেশটা তুমি এর আগেও কোথাও দেখেছ? কি হয়, না হয় না?’
শুভম ঘাড় নেড়ে বোঝাল যে হয়। মুরারিবাবু যেন একটু উৎসাহিত হলেন। পা গুটিয়ে, গলাটাকে আরেকটু খাটো করে তিনি বলতে লাগলেন, ‘ হয় তো? বেশ… তো এবার আমি তাহলে নিজের ধারণাটার কথাতেই আসি। দে’খ, আমার অনুমান বলে যে আমাদের প্রত্যেকের ভেতর দুটো সদৃশ সত্তা থাকে। এক আমি, দুই আমার অলটার ইগো।প্রথমটা সাধারণত প্রকট, দ্বিতীয়টা প্রচ্ছন্ন। প্রথমজন, মানে যে সত্তাটি আমাকে এই ‘আমি’ বানিয়েছে সে সব কাজ করে আমার জন্ম থেকে আমি যে সব অভিজ্ঞতা বা নানাবিধ জ্ঞান অর্জন করেছি তার উপর এবং কোন বিষয় সেই সত্তাটির কাছে তখনি চেনা-চেনা লাগবে যখন সেটা সেই সব অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের প্যাটার্নের সাথে মিল খাবে। কিন্তু যে জিনিসটা আমি আগে দেখিনি সেটাকে কিভাবে আমার চেনা লাগছে বলতে পা’র? ’
শুভম কিছু বলার আগে নিজেই উত্তরটা দিয়ে দিলেন মুরারিবাবু, বললেন, ‘কেবল একভাবেই সেটা সম্ভব। আর সেটা হল– ওই জিনিস বা গোটা দৃশ্যটা তোমার সেই দ্বিতীয় সত্তা বা অলটার ইগোর অভিজ্ঞতার প্যাটার্নের সাথে যদি মিলে গিয়ে থাকে তবে। ঠিক কিনা? এবার আমার আর আমার অলটার ইগোর অভিজ্ঞতার প্যাটার্ন আলাদা কিভাবে হতে পারে? সেটা হওয়ার রাস্তাও একটা, অবশ্য এটাও আমার অ্যাসামশান, যে আমার প্রথম সত্তাটি তো আমার সাথে সাথে চলেছে জন্ম থেকে আজকের এই মুহূর্ত অবধি, কিন্তু আমার অলটার ইগো যদি ঠিক এর বিপরীতদিক থেকে অপারেট করে? মানে আমার প্রথম সত্তাটি আমার সাথে সাথে যদি জন্ম থেকে মৃত্যুর দিকে চলে তাহলে আমার অলটার ইগো চলা শুরু করবে আমার মৃত্যুর দিক থেকে। অবশ্য এই চলা মানে কিন্তু রেলগাড়ির চলা নয়, চলা মানে এখানে অপারেট বা ফাংশান করা। অর্থাৎ, প্রথম সত্তা যেখানে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে চলেছে, প্রতিদিনের প্রতিটা ঘটনাকে তার সাথে জুড়তে জুড়তে, মেলাতে মেলাতে চলেছে; সেখানে ওই দ্বিতীয় সত্তাটি অলরেডি মৃত্যু পর্যন্ত আমি যা যা দেখব বা করব বা শুনব সব জেনে-বুঝে বসে আছে। যখন দৈবক্রমে বা অন্য কোন অজানা কারণে ওই দ্বিতীয় সত্তাটি প্রথমটির উপর প্রাধান্য পেয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য,তখন সেই মুহূর্তে কোন জিনিস বা দৃশ্য, যেটা প্রথম সত্তার এখনও চোখে পড়েনি, সেটা আমার বা আমাদের চেনা-চেনা মনে হয়। কেননা সেটা যে আমার নজরে পড়বে বা আমার দ্বারা কৃত হবে সেই ব্যাপারটা তো ওই দ্বিতীয় সত্তাটি অলরেডি জানে এবং ওই নির্দিষ্ট মুহূর্তে ওই সত্তাতাই আমি। কি, বুঝলে ব্যাপারটা?’
শুভম ঠিক কি বলবে বুঝতে পারল না। চারপাশের পুরো জগতটাই কেমন যেন বেতাল ঠেকছে তার কাছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি মুরারিবাবু সত্যিই ছিটগ্রস্ত? মুরারিবাবু কিন্তু বলেই চলেছেন,’আমার কি মনে হয় জান, এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু গবেষণা করলে এই জন্মান্তর, ষষ্ঠইন্দ্রিয় ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতেই পারে। এমনকি যদি আমরা এই দ্বিতীয় সত্তার সাথে যোগাযোগ করার প্রক্রিয়াটাকে মাস্টার করতে পারি তাহলে উই ক্যান ইভেন এস্কেপ আন-ন্যাচারাল অর অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ! কারণ ওই দ্বিতীয় সত্তা আগাম জানিয়ে দেবে কিভাবে কখন কোথায় আমাদের মৃত্যু হবে এবং সেটাকে আমরা সহজেই এড়িয়ে যেতে পারব একটু সতর্ক থাকলে। তাই না?’
শুভম এবার একটা প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু কিভাবে সেটা করা যাবে বলে আপনার মনে হয়?’
মুরারিবাবু একটু চিন্তিতভাবে বললেন, ‘গুড কোয়েসচেন, দেখ, যখনি আমার এরকম অচেনা জিনিস চেনা-চেনা লাগে তখনি আমি চোখ বন্ধ করে একটা সাদা পাতায় যা দেখছি সেটা আঁকতে থাকি তা যতই অদ্ভুত হোক না কেন, আর সমস্ত একাগ্রতা দিয়ে ভাবতে থাকি এর আগের মুহূর্তটা কি হবে। ‘আগে’ বলছি কেন বুঝেছ নিশ্চয়ই। যদি সেটাও দেখতে পাই তাহলে সেটাকেও এঁকে ফেলি। মানে যতটা দেখতে পাই আর কি! প্রথম প্রথম তো আধসেকেন্ডও দেখতে পেতাম না, এখন সাত-আট বছরের প্রচুর চেষ্টায় মিনিট খানেক দেখতে পাই। অনেক একাগ্রতা লাগে হে, সোজা নয়! আবার খালি দেখলে হবে না, আঁকাও চাই। তার জন্যেই তো এই খাতাটা বানিয়েছি। সবসময় কাছাকাছি রাখি।কখন কি দেখে চেনা-চেনা লাগবে কে জানে… তা এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে কি করে আমি তোমার ওই এক্সট্রাটা করলাম! ওটা আমার করারই কথা ছিল, বুঝলে কিনা?’
[৪]
এরপরে আরও তিন-চারমাস কেটে গেল। শীত পুরোদমে জাঁকিয়ে বসেছে। শুভম এর মধ্যে স্কুলের কাছেই একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে থাকার জন্য। রোজরোজ এতটা জার্নি করতে তার আর ভালো লাগে না। সপ্তাহের কোন কোন দিন রাতে সে ওখানেই থেকে যায়। বিশেষ করে সোমবার আর বুধবার তো থাকেই, কারণ ওই দুদিন সে ভাড়া করা ঘরটায় কিছু প্রাইভেট টিউশান আরম্ভ করেছে। স্কুলেরই ছেলেমেয়ে সব। নানান ব্যস্ততায় মুরারিবাবুর সেই অদ্ভুতুড়ে থিওরি শুভমের মাথা থেকে মুছেই গিয়েছে একরকম। মুরারিবাবুকে অনেকদিন স্কুলেও দেখেনি শুভম। মাঝে অবশ্য সে নিজেও চারদিন স্কুলে যেতে পারেনি ইনফ্লুয়েঞ্জা হওয়ায়। কিন্তু স্কুলে ফের জয়েন করার পরেও সে মুরারিবাবুর অনুপস্থিতিটা লক্ষ্য করল।
সেদিনটা ছিল শনিবার। হেডস্যার উমাপতিবাবু শুভমকে দেখে বললেন, ‘মিস্টার ঘোষাল, মুরারিবাবু প্রায় একমাস হল আসছেন না। কোন খবরও পাঠান নি, ছুটির দরখাস্তও দিয়ে যাননি। হাজারবার বলা সত্ত্বেও উনি ফোন ব্যবহার করবেন না। এদিকে পরীক্ষা এসে পড়ছে, সাইকোলজির সিলেবাস বাকি পড়ে আছে। অন্য টিচারও স্কুলে আর নেই ছাত্র কম হওয়ায়। তারপর মুরারিবাবুর উপরই পেপার সেট করার দায়িত্ব। তাই তার সাথে দেখা করা খুব জরুরি। এবার আমরা সকলেই জানি যে আপনার সাথে ওনার সম্পর্ক আর সবার চেয়ে সামান্য হলেও বেটার। সেজন্য আমি ঠিক করেছি আজ দুপুরে ছুটির পরে আপনি আমার সাথে মুরারিবাবুর বাড়িতে যাবেন। একা থাকেন, বয়সও হয়েছে; কিছু হয়েও তো থাকতে পারে! উনি সামনেই থাকেন, সাইকেলে মিনিট সাতেক লাগবে ম্যাক্সিমাম। ওকে?’
ভাঙাচোরা বড় রাস্তা থেকে ডান দিকের তিনখানা সরু গলি অতিক্রম করে শুভম আর উমাপতিবাবু যখন মুরারিবাবুর দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তখন বেলা প্রায় পড়েই গিয়েছে। বাড়ির সামনে একটা ছোট লোহার গেট, গেটের পরে চারটে সিঁড়ি উঠলেই কাঠের দরজা। একফালি হলুদ রোদ ঝুলে রয়েছে বাড়িটার ইট-বেরিয়ে-পড়া পশ্চিমের দেওয়াল থেকে। আশেপাশে অধিকাংশই নতুন বাড়ি, এই বাড়িটাই বোধহয় সবচেয়ে পুরনো এদের মধ্যে, একটু দেখতেও বেমানান। কলিং বেলের বালাই নেই, দরজায় ধাক্কা দিলেন উমাপতিবাবু।
‘ মুরারিবাবু বাড়ি আছেন?… ও মুরারিবাবু, দরজাটা খুলুন! আমি উমাপতিবাবু, স্কুল থেকে আসছি… মুরারিবাবু…’
প্রায় মিনিট খানেক পরে দরজাটা সামান্য ফাঁক করে মুখের অর্ধেকটা বের করলেন মুরারিবাবু। শুভমদের দেখে যে তিনি বেশ বিরক্ত হয়েছেন সেটা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট। একরকম বাধ্য হয়েই যেন দরজাটা খুলে ভেতরের দিকে হাঁটা দিলেন। শুভমরাও তাকে অনুসরণ করল।
ঘরে ঢুকে শুভম দেখল, সারা বাড়ির আলো জ্বলছে, এমনকি ঘরের একপাশ দিয়ে দোতলায় যাওয়ার জন্য যে সিঁড়িটা উঠে গিয়েছে সেটার আলোও জ্বালানো। ঘরে বেশ কিছু সাদা পৃষ্ঠা ছড়ানো, দোমড়ানো কাগজও পড়ে আছে অনেকগুলো। ছোট একটা টেবিল, দুটো কাঠের চেয়ার রয়েছে ঘরের মাঝখানে। তার পাশে রয়েছে একটা ছোট তক্তপোশ। তক্তপোশের উপরে রয়েছে দুটো পেন্সিল, একটা হাতঘড়ি আর মুরারিবাবুর সেই ছবি আঁকার খাতা। খাতাটা খোলা অবস্থায় উল্টানো রয়েছে, মুরারিবাবু হয়ত ওটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। একটা বই-ঠাসা পুরনো কাঠের আলমারি ছাড়া ঘরটায় আর তেমন কোন আসবাব চোখে পড়ল না শুভমের।
মুরারিবাবু তক্তপোশে গিয়ে বসলেন, শুভমরা বসল চেয়ারদুটোয়। বসার পরে শুভমের নজরে এল, তক্তপোশটার একপাশে একটা মাঝারি সাইজের টর্চ শোওয়ানো অবস্থায় রয়েছে। মুরারিবাবু কেমন উদ্ভ্রান্তের মত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শুভমদের দিকে, তার গালে প্রায় দুদিনের দাড়ি, চোখের নীচে বেশ কালি পড়েছে। একটু রোগাও দেখাচ্ছে ভদ্রলোককে।
উমাপতিবাবুই কথা শুরু করলেন, ‘…ইয়ে,আপনার শরীর ভালো তো?’
মুরারিবাবু জবাবে শুধু ঘাড় নাড়লেন। উমাপতিবাবু একটু জড়তার সাথে বললেন, ‘না… আপনি অনেকদিন স্কুলে আসছেন না, ওদিকে ক্লাস হচ্ছে না ছেলেদের… পরীক্ষাও তো প্রায় এসেই গেল…’
চোখে-মুখে হাত চালিয়ে মুরারিবাবু বললেন, ‘মাফ করবেন স্যার, আমি কিছুদিন স্কুলে যেতে পারিনি। আসলে একটা জরুরি ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। হঠাৎ করেই জড়িয়ে পরলাম। আপনাকে আমার জানানো হয়ে ওঠেনি, সে জন্য আমি দুঃখিত।’
শুভম খেয়াল করছিল যে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মুরারিবাবু এদিক-ওদিক তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শুভম কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
উমাপতিবাবু নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ তা কবে থেকে ফের আসতে পারবেন বলে মনে করছেন মুরারিবাবু?’
‘ দেখি, আমি এই বুধ…’ এতটা বলেই আচমকা থমকে গেলেন মুরারিমোহন সমাদ্দার। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তার দোতলার সিঁড়ির দিকে। তার দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে উমাপতিবাবু আর শুভমের চোখও সেদিকে গেল। দুজনেই অবাক হয়ে দেখলেন, সিঁড়ির প্যাসেজটায় যে আলোটাকে তারা ঢোকার সময় এবং কয়েক সেকেন্ড আগে পর্যন্ত জ্বলতে দেখেছিলেন, সেটা আর জ্বলছে না। বাইরের হালকা আলো আর ভিতরের গভীর অন্ধকার একটা রহস্যপূর্ণ আলোআঁধারি সৃষ্টি করেছে সেই জায়গাটায়। কয়েক সেকেন্ড কারো মুখেই কোন কথা নেই, সকলেরই চোখ আটকে রয়েছে সিঁড়ির প্যাসেজটার দিকে। আচমকা মুরারিবাবু ক্ষিপ্র গতিতে টর্চটা নিয়ে ধীর অথচ খুব সতর্ক পদক্ষেপে হাঁটা দিলেন অন্ধকার সিঁড়িগুলোর দিকে, যেন চুপিচুপি কাউকে ফলো করছেন; আর যেতে যেতে বললেন, ‘আপনারা এবার আসুন, আমি একটু কাজে ব্যস্ত আছি… চিন্তা করবেন না, তাড়াতাড়িই যাব। আপনারা আসুন, আসুন…’
সিঁড়ির বাঁকে মুরারিবাবু অদৃশ্য হয়ে গেলেন ধীরে ধীরে। হতভম্বের মত কয়েক পলক বসে থাকার পরে উঠে দাঁড়ালেন উমাপতিবাবু, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুভমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘চলুন তাহলে…’
‘হ্যাঁ’ বলে শুভম ঘর থেকে উমাপতিবাবুর পিছন পিছন বেরিয়ে প্রায় গিয়েই ছিল হঠাৎ কি মনে করে ‘স্যার, এক মিনিট’ বলে ঘরটায় ফিরে গেল। তক্তপোশের খাতাটা উলটে দেখতেই তার চোখ দুটো বেশ বড় হয়ে উঠল। খাতার শেষ-ব্যবহৃত পৃষ্ঠায় পেন্সিল দিয়ে যে দুটো মানুষের চেয়ারে-বসা অবস্থায় ছবি আঁকা আছে তাদের মধ্যে একজন যে সে নিজে আর অন্যজন যে উমাপতিবাবু এটা বুঝতে তার খুব অসুবিধা হল না।
বাইরে বেরোতেই উমাপতিবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘কি হল? কিছু ফেলে এসেছিলেন নাকি ?’
শুভম মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, ওই ওয়ালেটটা!’
[৫]
দুদিন পরের ঘটনা। সোমবার রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুভম বসেছিল তার ছাত্রছাত্রীদের জন্য পদার্থবিজ্ঞানের নোটস বানাতে। অঙ্কের সাথে সাথে ওটাও সে এখন পড়ায়, প্রাইভেট পড়ানোর বেলায় এই প্যাকেজটার বেশ দাম আছে। নিউটনের দ্বিতীয় সুত্র থেকে যেই না সে বলের পরিমাপ কিভাবে করা যায় সেটা ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করেছে অমনি তার কাঠের দরজায় জোরালো আঘাত পড়ল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শুভম দেখল, রাত বারোটা বেজে সতের মিনিট হয়ে গেছে। এত রাত্রে কে এল? কে আসতে পারে এটা শুভম ভাবতে ভাবতেই আবার শব্দ হল দরজায়। এবার শুভম সন্তর্পণে উঠে দরজাটা একটু আলগা করতেই ঝড়ের মত হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন স্বয়ং মুরারিবাবু! কিন্তু এ কি অবস্থা ভদ্রলোকের? চোখে চশমা নেই, ধুতির একটা দিক ঝুলছে, একটা পায়ে সামান্য খোঁড়াচ্ছেন এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে তার মাথার সাইডে ডানকানের উপরে বেশ গভীর একটা ক্ষত যেটা থেকে এখনও ভালই রক্ত ছুঁইয়ে পড়ছে। তার ফতুয়াতেও অল্প রক্তের দাগ লেগে আছে। শুভম কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তিনি হাত তুলে বললেন, ‘কিছু হয় নি, আমি ঠিক আছি। তুমি এখন চলো দেখি আমার সাথে!’
শুভম বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘এত রাতে কোথায় যাব স্যার? আর কেনই বা যাব? কি, গুরুতর কিছু হয়েছে নাকি?’
অধৈর্যভাবে মুরারিবাবু বললেন, ‘আহা! সে সব কথা যেতে যেতে বলছি। আগে চলো তো! তোমায় কিছু দেখানোর আছে। নাও, নাও, দেরি কর না, চলো, চলো!’
ভদ্রলোকের মরিয়াভাব দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে রাজী হল শুভম। ঘরে তালা দিয়ে একটা টর্চ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল মুরারিবাবুর পিছন পিছন। বাইরে ঘন কুয়াশা জমেছে, ভালো ঠাণ্ডা বোধ হচ্ছে শুভমের।কয়েকটা কুকুর দূরে ডেকে চলেছে অবিরামভাবে। সেইসব জনশূন্য রাস্তায় যেতে যেতে মুরারিবাবু সব কথা বলতে থাকলেন, ‘তোমায় সেদিন আমার ওই চেনা-চেনা লাগার যে থিওরিটা শুনিয়েছিলাম, আজ তার সপক্ষে অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি আর সেটাই দেখাতে তোমায় নিয়ে যাচ্ছি আমার বাসায়। গত প্রায় দুই মাস ধরে এর পিছনে আমি লেগেছিলাম। এর মধ্যে সেই দ্বিতীয় সত্তাটির উপর নিয়ন্ত্রন পাওয়ার জন্য আমি বেশ কিছু প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ফেলেছি, সুফলও পেয়েছি হাতেনাতে। সেই সব পদ্ধতির কথা আমার খাতায় লেখা আছে। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন আমি দেখলাম যে আমি সেই দ্বিতীয় সত্তাটির সাথে যতই যোগাযোগ করার চেষ্টা করি না কেন, সে আর কিছুতেই সাড়া দেয় না। এই কদিন কিন্তু ওই প্রক্রিয়াতেই তার নাগাল পেয়েছি, কিন্তু হঠাৎ আর পাচ্ছি না! কোথায় ভুল হচ্ছে ঠিক বুঝতেও পারছিলাম না। এদিকে আবার আরেক উৎপাত আরম্ভ হল তার পরদিন থেকে। সেদিন অনেক রাত অবধি লেখাপড়া করে সবে লাইট নিভিয়ে শুতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি অন্ধকার ঘরের একটা কোণা একটু বেশীই অন্ধকার বোধ হচ্ছে। ভালো করে ঠাহর করে তো প্রায় আমার মূর্ছা যাওয়ার যোগাড়! দেখি কিনা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে সেখানে! তড়িঘড়ি আলো জ্বালাতেই দেখি, না, কিচ্ছু তো নেই। সে রাতে আলো জ্বালিয়েই শুলাম। পরদিন চেয়ারে বসে বই পড়ছি, এমন সময় দেখি, পাশের প্রায়ান্ধকার ঘরে কে যেন পায়চারি করছে। আমার চোখের সামনে দিয়ে তার দেহের পিছনের অর্ধেক অংশ দেওয়ালের আড়ালে চলে গেল! দৌড়ে গেলাম ওই ঘরে, কিন্তু কিছুই নেই। সেদিন তোমরা যখন আমার বাড়িতে এলে ঠিক তার আগেই আচমকা আমি তোমাদের চেয়ারে বসা অবস্থায় দেখতে পাই, কিন্তু এবার একেবারে চোখের সামনে! খাতায় পরে সেই ছবিটা আমি এঁকে রাখি শুধুমাত্র কি কি দেখেছি তার রেকর্ডটা নির্ভুল রাখার জন্য। কোথায় ভুল হচ্ছে সেটা ভাবতে ভাবতেই তোমরা এসে হাজির। তা তোমাদের সাথে কথা বলার সময় আবার দেখি হঠাৎ করে সিঁড়ির আলোটা নিভে গেল, আর কে যেন ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। তোমাদের আসতে বলে টর্চ হাতে আমি তাকে অনুসরণ করলাম, কিন্তু আবারও বিফল হলাম। এবার রোখ চেপে গেল। যেই হোক, আবার যদি দেখতে পাই, ধরবই ধরব! কিন্তু আজ রাতে যেটা হল তার কল্পনাও আমি তখন করিনি। আজ এই ঘণ্টা খানেক আগে আমি আলো জ্বেলে শুয়ে আছি, হঠাৎ শুনি, কে যেন দোতলার ঘরে মেঝেয় পা টেনে-টেনে হাঁটছে। পায়ে চোট পেলে বা মচকে গেলে মানুষ যে ভাবে হাঁটে কতকটা সেইরকম। আমি টর্চটা হাতে নিয়ে এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। কয়েক ধাপ ওঠার পরেই আচমকা সব লাইট অফ হয়ে গেল। প্রথমে চমকে গেলেও পরে ওসব অগ্রাহ্য করে এগোতে লাগলাম। এবার কিন্তু ফল হতে থাকল আগের বারগুলোর চেয়ে একটু আলাদা। এবার আমি সিঁড়ির এদিক থেকে যতটা উঠছি সেও যেন ততটাই সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। কয়েক ধাপ আরও উঠে আমি তো থ !! একটা মূর্তি অন্ধকার সিঁড়ির ধাপে আমার দিকেই মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে! আমিও নড়ছি না, সেও নিশ্চল। এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানি না। একটা সময় প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় হয়ত টর্চটা তার দিকে তাক করে জ্বেলে ফেললাম, আর যা দেখলাম…’
বলতে বলতে মুরারিবাবু নিজের বাড়ির গেটটা ঠেলে খুললেন। সেই আওয়াজে চমক ভাঙল শুভমের, মুরারিবাবুর কথায় সে এতটাই সম্মোহিতের মত হয়ে গিয়েছিল যে সে কোথায় এসে পড়েছে তা নিজেই বুঝতে পারেনি। আচ্ছন্নভাবটা কাটলে সে প্রশ্ন করল, ‘কি দেখলেন স্যার?’
মুরারিবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন, তারপর তারদিকে তাকিয়ে চোখ জোড়া গোল করে বললেন, ‘দেখলাম, আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর কেউ নয়, সে স্বয়ং আমি!! ঠিক আমার এখনকার হাল, একটা পা একটু বাঁকিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, ধুতি খুলে এসেছে, কপাল ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। কি ভয়ানক দৃশ্য তোমায় কি বলব! আমি তো দেখে টাল খেয়ে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে সটান একেবারে নীচে। আর তাতেই এই দশা।’
দুজনেই এবার ঘরে ঢুকল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। মুরারিবাবু অন্ধকারেই বললেন, ‘টর্চটা নীচের দিকে মেরে দেখে দেখে সাবধানে এগোও!’
শুকনো গলায় শুভম এবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তারপর?’
মুরারিবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘ কি আবার? উঠে তোমাকে ডাকতে ছুটলাম। জগতে একমাত্র যার সাথে আমি আমার থিওরিটা শেয়ার করেছি সময় শেষ হওয়ার আগে তার হাতে প্রমাণটা তো তুলে দিতে হবে!’
শুভম এগোতে এগোতে এবার ওরা সেদিন যে ঘরে বসেছিল সেই ঘরে পৌঁছে গেছে। টর্চ দিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে সে বলল, ‘কি রকম প্রমাণ?’
মুরারিবাবু একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘একটা হল আমার খাতা যাতে তুমি সব ডিটেলিং পাবে। ওটা আমি তোমায় দিলাম, ফেলে দিও না কিন্তু! আমার কাজে না লাগলেও ওটা তোমার কাজে লাগতে পারে। আর …’
শুভম এবার সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘আর… আর কি?’
মুরারিবাবু যেন খুব ধীরে আর অত্যন্ত বিষণ্ণ কণ্ঠে বেশ দূর থেকে জবাব দিলেন, ‘আর এইটা!’
কথাটা শেষ হওয়া মাত্র সারা বাড়ির আলো যেন একসাথে জ্বলে উঠল। আর সামনের দিকে তাকাতে-না-তাকাতেই মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল শুভমের। তার ঠিক সামনে সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে পড়ে আছে মুরারিবাবুর মৃতদেহ। ঠিক যেভাবে শুভমের বাড়িতে তিনি কিছুক্ষণ আগে এসেছিলেন, ঠিক সেই অবস্থায় তিনি যেন চিত হয়ে শুয়ে আছেন বিস্ফারিত চোখে। মাথার পাশ দিয়ে একটা রক্তের ধারা মেঝেয় বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে এসেছে।কি বীভৎস দৃশ্য!! শুভম আর দাঁড়াতে পারল না, অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল সে।
পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসল। আর বসতে-না-বসতেই দুহাত ছিটকে সরে এল। তার সামনে এখনও মুরারিবাবুর বাসি মড়াটা হাঁ করে পড়ে আছে। পড়িমরি করে শুভম বাইরে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় লাগাল।সবাইকে খবরটা জানানো দরকার। একটা ব্যাপার খুব আশ্চর্য লাগছে শুভমের নিজের ক্ষেত্রে। এমন অভিজ্ঞতার পরেও তার মাথা কিন্তু দিব্যি সচল রয়েছে।বাড়ি পৌঁছে সে নিজের টেবিল থেকে ফোনটা তুলতে গিয়েই দেখল, ফোনের ঠিক পাশেই পড়ে আছে মুরারিবাবুর সেই খাতাটা। খাতাটা ফেলতে গিয়েও সে ফেলল না, রেখে দিল ড্রয়ারে। মুরারিবাবু বলেছিলেন, খাতাটা তার নাকি কাজে লাগবে। খাতাটা সরিয়ে রেখে সে ফোন করল উমাপতিবাবুর বাড়ির নম্বরে।
সবকিছু মিটলে শুভম একদিন ড্রয়ার খুলে খাতাটা বের ক’রে পুরোটা পড়ল। বারোআনাই সে বুঝল না, খালি শেষ পাতার একটা অংশে লেখা একটা লাইন তার খুব মনে ধর’ল; ইংরাজিতে লেখা আছে, ‘উই সুড নট লিফট দ্য ভেইল, লেট দ্য টাইম টেক কেয়ার অফ এভরি থিং ক্ল্যানডেসটাইন; ওনলি টাইম উইল মেক আস ইউনাইটেড অ্যাট দ্য রাইট টাইম’।
শুভমেরও এখন অনেক কিছু দেখে চেনা মনে হয়, আশেপাশে নানান আওয়াজও সে কখনও কখনও শুনতে পায়। কিন্তু কৌতূহল হলেও তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা সে একদম করে না। কারণ সে বুঝতে পেরেছে, বেশী চেষ্টা করলে হয়ত সে এমন কিছু দেখে বসবে যেটা সত্যিই তার কাছে প্রচণ্ড চেনা-চেনা মনে হবে। নিজের মুখের মত চেনা-চেনা।
Tags: চেনা-চেনা লাগে, পূষন
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।