ছবি অনেকটাই প্রতীকী। এক একজনের ছবি এক এক রকমের। প্রতিটি ছবির মধ্যে একটা সময় ঢুকে থাকে নিজের মত করে। তবে ছবিও যে হেঁটে যায় তার ছবি না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। পাশের গ্রামের ছবি পিসি। হ্যাঁ ওই নামে বেশী চিনি। টাইটেল টা বলা শক্ত, আসলে পাগলদের টাইটেল কোনোকালেই ছিল না। অবশ্য ঠিক কি কারণে পাগল বলা হয় সেটা আজও বুঝে উঠতে পারিনি। হয়ত মাথাগরম হলে মাঝে মাঝে উদোম খিস্তি দেয় তাই অনেকে পাগল বলতে পারে।
দরমার বেড়া, খুঁটিগুলোর পেটে আলসার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছবিপিসির ঘর। সত্যি বলতে কি নামী কোম্পানির সিমেন্টের ঘরবাড়ি হলেও এইভাবে টিকত কিনা বলা মুস্কিল। চিরাচরিত বর্শা নিয়ে বর্ষা বা বসন্তের শুঁয়াপোকারা যতই আক্রমণ করুক না কেন দীর্ঘদিন ছবিপিসিকে অনায়াসে সেইসব সামলে নিয়ে কাটিয়ে যেতে দেখেছি।
ঘর বাঁধার স্বপ্ন ছিল ছবিপিসির মনেও। কিন্তু বাপ মরল কমবয়সে, মাস ছয়েকের ব্যবধানে পেটের ভাইকে নিয়ে মা মরল রোড অ্যাক্সিডেন্টে। আত্মীয় বলতে তেমন কেউ ছিল না। ফলে ছবিপিসি হয়ে পড়ল একা। সান্ত্বনা দেবার লোকের অভাব এই দেশে কোনোকালেই ছিল না, সত্যি বলতে কি সাহায্যের অফার এসেছিল, কিন্তু ঘুরপথে। আসলে একলা মেয়েমানুষ দের কাছে চিরকালই রাত উদারহস্ত। কিন্তু না ছবিপিসি একলা হাঁটার মন্ত্রটি ভুলে যায়নি…
জীবনে অনেকসময় ভুলভাল বসন্ত আসে, ছবিপিসির জীবনেও এসেছিল। একলা যাপনের মধ্যেও মাধুকরী করতে করতে আলাপ সদাশিবের সঙ্গে। ওদের দেখা হত প্রায়ই ফিরে যাবার সময় গোলদিঘীর কাছে। তখন সূর্য অস্ত যেত পাখিদের ঘরে ফেরার মত করে….
যার যেদিন মাধুকরী কম জুটত সেটা পূরণ করে নিত ভাগাভাগি করে। এমনি করে দুজনের দূরত্ব দূরের রাস্তা দেখতে লাগল।
সদাশিবের বিয়ে হয়েছে দুবার। প্রথমবার বিয়ের পর দুটো বাচ্চা দিয়ে বউ চলে গেল। ডাক্তারের গাফিলতিতে ভুল ইঞ্জেকশনে।
সদাশিবের দ্বিতীয় বিয়ে সুখের হয়নি। দিনরাত খিটখিটানি লেগেই আছে। অভাবের সংসার, তার উপর ভেবেছিল এইবার বাচ্চাগুলোর মায়ের অভাব পূরণ হবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। বনি, রনিকে একদম দেখতে পারে না তাদের সৎমা।
সদাশিবের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ছেলে দুটোকে বিষ খাইয়ে নিজেও আত্মহত্যা করে কিন্তু ওদের নিষ্পাপ চোখ দুটোর মধ্যে মৃতা মাধবীকে খুঁজে পায়।
সদাশিব এসব কথা ছবিপিসিকে বলত। আরো বলত যে ছবিপিসির মতনই তার মাধবীকে দেখতে ছিল।
ইস যদি তোমাকে আমার বউ করতে পারতাম – একদিন মুখ ফসকে সদাশিব বলে ফেলে কথাটা। ছবিপিসির চোখেমুখে তখন একরাশ লজ্জা ছড়িয়ে পড়েছিল..
কিন্তু সমাজের বাঁকা চোখ তাদের এই প্রণয়কে মেনে নিতে পারে না। গ্রামের মাতব্বরেরা ছবিপিসিকে টিটকিরি দেয়, রসালো ইঙ্গিত করে। ওদিকে সদাশিবের বউও পিছিয়ে নেই। ঘরে ফিরলেই তুলকালাম গালিগালাজে ঝড় নামিয়ে দেয়। একদিন অবস্থা চরমে পৌছায়।অভিমানী সদাশিব পাকুড় গাছে গলায় দড়ি দিয়ে বসে।
ছবিপিসি এই ঘটনা মেনে নিতে পারে না। তারপর থেকে রেগে গেলেই আবোল তাবোল বকে।
বছর দুই পরে সদাশিবের বউ ভিনগাঁয়ের লরি ড্রাইভারের সাথে পালায়।
ছবিপিসি সদাশিবের ছেলে দুটোকে কয়েক হপ্তা নিজের কাছে রাখে। প্রথমে গ্রামের লোক আপত্তি করে। কিন্তু মাতৃত্বের স্নেহ জেগে ওঠা ছবিপিসি সেসবের তোয়াক্কা করেনি। কিন্তু যেদিন সরকারের লোক এসে রনি বনিকে হোমে নিয়ে গেল সেদিন ছবি পিসির শত অনুনয়েও চিঁড়ে ভেজেনি।
তারপর থেকে আরো একলা হয়ে যেতে থাকে ছবিপিসি। এখনো গোলদিঘীর কাছে হাওয়াদের ফিসফাস দীর্ঘশ্বাস নামে। সদাশিব যেন হাসে হাওয়ায় হাওয়ায়, পাতায় পাতায়। ছবিপিসিদের জীবনের গল্প কখনো শেষ হয় না। ছবিপিসি হাঁটতে থাকে একলা একলা অনেকটা পথ। হাতে মাধুকরী র চাল, ক্ষয়ে যাওয়া জামবাটি, ঘোলাটে চোখ, অথচ হাসিটি অমলিন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে হাসতে থাকে আর মাঝে মাঝে বলে ওঠে সব কপাল, কপাল পোড়া কপাল বাবা।
হাঁটতে হাঁটতে ছবিপিসির ক্লান্ত পা ঢিমে হয়ে আসে তবু চলার ছন্দটাই চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে…
Tags: চলচ্চিত্র, সৌমাল্য গরাই
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।