আবার সেই ছাতিম ফুলের সুঘ্রান। এই গন্ধটা নাকে এলেই আমি আর নিজেকে নিজের ভেতর পুরে রাখতে পারিনা। আমার ভাবনাগুলোতে কেমন জট পাকিয়ে যায় সুগন্ধী বাতাসে। বাস্তব জগত থেকে কেমন একটা স্বপ্নিল কল্প রাজ্যে ঢুকে পড়ি আচমকা।আমার অবস্থানটাই বদলে যায় দ্রুত। তখন নিজের পরিচয় সম্পূর্ণ ভুলে যাই আমি। কোথায় আছি, কোথায় যেতে চাই কিছুই বুঝতে পারিনা।
যেমন এখন, সিনেমা হলের অন্ধকারে আমি হারিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। অথবা বলা ভাল, আমি যেন অতল গভীর এক পুকুরে ডুবে যেতে থাকছি। আমার বাড়ির সামনে একটা পুকুর আছে। পুকুরটার চারপাশে সজনে আর গুলঞ্চ গাছ। সেই সব গাছের ঝরাপাতা ও ফুলের পাপড়িতে পরিপূর্ণ ঢেকে থাকে সবুজ জলরাশি। দোতলার বারান্দা থেকে মাঝে মাঝে পুকুরটা দেখি আমি। নিদাঘ তপ্ত পুকুর থেকে অদ্ভুত এক বিষাদী জলজ ঘ্রাণ আমি শুষে নিতে থাকি সমস্ত ইন্দ্রিয় ভরে। আমার ভাল লাগে। জলজ ঘ্রাণের বিষাদ আমার চূড়ান্ত ভাল লাগে।
আর এই ছাতিমের গন্ধ যখন আমার নাকে আসে, তখন লক্ষ্য করি আমার অস্তিত্বকে ওই পুকুরটায় ডুবে যেতে। আসলে পুকুরটাকে আমি দারুণ ভালবাসি। তাই জন্য, আমার সমস্ত ভাললাগা মুহূর্ততে আমাকে তলিয়ে যেতে হয় অতল সবুজ গভীরতায়।
আমি কেমন ঘামছি অস্বাভাবিক, এই হিমঘরের অন্ধকারে বসেও। গলা শুকিয়ে আসছে পিপাসায়। আমি বুঝতে পারছি আশ্চর্য এক শরীর জেগে উঠছে, আমার শরীর থেকে। এবার আমার তুমুল ভয় করছে। ঘৃণ্য শীতল পিচ্ছিল ভয়। যেমন ভয় জাগে, অনসূয়ার সান্নিধ্যে। আমার এখন তেমন ভয় করছে। শ্যাওলা রঙের ভয়। বর্ষার সময় আমাদের মফস্সলি রাস্তায় জল দাঁড়ায় হাঁটু সমান। আমার বাড়ির সামনের পথটা ডুবে যায় একদম, পুকুরের উপচে পড়া জলে। টানা বর্ষন চললে, আমার সদর দরজার সামনে চলে আসে পুকুর। দিন কয়েক আগেও এমন পরিস্থিতি হয়েছিল। এতে অবশ্য আমার কোনও অসুবিধা হয়না। কিন্তু এবার জল নেমে যেতেই আমার দারুণ ভয় লাগল।কারণ,আমার দড়জার সামনে দেখলাম, দীর্ঘ মৃত এক সাপকে। সাপটা কি ওই পুকুরের বাসিন্দা ছিল ? সাপটার মৃত শরীর থেকে আমি, অনুসূয়ার গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমার স্ত্রী অনুসূয়াকে চুমু খেতে গেলেই কেমন মৃত্যুর গন্ধ পাই, ওর শ্বাসবায়ুতে।
আমার নিশ্বাসে এখন আগ্নেয় লাভা। ছাতিম গন্ধের অনুষঙ্গে আমাকে ঘিরে ধরছে কাম। কিন্তু এই সুঘ্রানের উৎস কোথায় ? আমার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করতে থাকি আপ্রাণ। যথানিয়মে ব্যর্থ হতে থাকি বার বার। দীর্ঘ অনুশীলনে নিজের চেতনাকে পঁচিশ ভাগ জাগাতে পারি। বাকি পঁচাত্তর ভাগ কোন নিরুদ্দেশে হারিয়ে গেল, তা খুঁজে পাইনা।
আমার চোখ পর্দায় স্থির মেলা আছে। সিনেমাহলের শাব্দিক নির্জনতায় বসে আছি আমি। এবার খুব মন্থর অলস সরীসৃপ গতিতে আমার স্মৃতি সজাগ হয়ে আসছে, এবং আমি ছাতিম গন্ধের উৎসকে নিবিড় ভাবে খুঁজে পাচ্ছি।
আমি তোমাকে দেখছি রানি।
রানির শরীরে ছাতিমের সুগন্ধ।
।। দুই ।।
বিশাল পর্দা জুড়ে, তোমার শরীর। রানি, তুমি এখন প্রেম করছ শাহরুখের সাথে। সাগরের লোনা ঢেউ ছলকে যাচ্ছে তোমার আকাশনীল শাড়িতে। গহন মায়াতে কাঁপছে তোমার ধূসর চোখ। বাতাস ফেটে উড়ছে মেহেদী রাঙা দীঘল চুল। অনুরাগের ফেনায় ভিজে যাচ্ছে, তোমার সেই মারাত্মক হাসি। পেলব বাহুলতায় আঁকড়ে ধরছ , সুদর্শন নায়ককে। আর তোমার ওই আশ্চর্য মোহময় তরতাজা শরীর ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে একরাশ প্রজাপতি। তোমার শরীরের পরাগ চুরি করে, ওই প্রজাপতিরা ছড়িয়ে দিচ্ছে ছাতিম গন্ধ।
আমার চোখ তোমায় ছুঁয়ে দিচ্ছে। তুমি কি আমার স্পর্শ পাচ্ছ, রানি? তোমার উন্মুক্ত পিঠের ল্যাবণ্যে এখন, শাহরুখের হাত। বাসনার দ্যুতি এখন শাহরুখের হাসিতে।
আমার অসহ্য লাগে। আমি চোখ বুজে ফেলি। এই কারণেই তোমাকে আমি সিনেমাতে দেখতে চাই না, রানি। অন্য পুরুষের প্রেমের উত্তাপে, তোমাকে উষ্ণ হতে দেখলে আমার বুক পুড়ে যায়। তুমি একান্ত, আমার নিজস্ব নারী। ঈর্ষার রঙ কি ? আমার আবার ঈর্ষা জাগছে। আগুন রঙা ঈর্ষা। অথচ, অনুসূয়া যখন ওর ব্যাঙ্কের সহকর্মী প্রনবের সাথে বেড়াতে যায় তখন আমার মধ্যে কোনও ঈর্ষা জাগেনা। কারণ, আমাদের বিবাহিত জীবনের চার বছরের আয়ুতে – আমরা কেউ কারওকে ভালবাসতে পারিনি।
কিন্তু রানি, তুমি অনুসূয়া নও। তুমি আমার প্রেমিকা। প্রতিরাতে নির্ঘুম আমি, তোমার সাথে হারিয়ে যাই অনন্ত অজানায়। তোমার দুই স্তনবৃন্ত থেকে আমি পান করতে থাকি, জ্যোৎস্না। তোমার নাভিমূল থেকে উঠে আসে ঘুমন্ত তারাদের উত্তাপ। তৈলাক্ত উরুতে মাথা রাখলেই পৌঁছে যাই রামধনুর দেশে।
তোমার কি আমাকে পছন্দ হয়না, আমিও যথেষ্ট সুপুরুষ। আমার আটত্রিশের যৌবন এখনও ঘুমন্ত। তোমার আঙুলের স্পর্শে জাগাও আমাকে। আমার লোমশ বুকের খাঁজে খাঁজে শিশিরের মত ফুটে উঠছে, স্বেদবিন্দু। অন্য এক গোপন প্রত্যঙ্গ দৃঢ়তর, যার, চাপ অনুভব করতে পারছি চরম উল্লাসে। অনুসূয়া কাছে এলেই, এই দৃঢ় উত্থান শিথিল হয়ে যায়। অনুসূয়ার দৃষ্টিতে তখন কি তীব্র ঘৃণা, যা আমাকে আরও সংকুচিত করে দেয়। ওর দৃষ্টির সামনে নিজেকে বড় হীন লাগে। তবু হাজার প্রচেষ্টাতে অনুসূয়াকে ভালবাসতে পারিনা আমি।
অথচ রানি তোমার সান্নিধ্যে পাই ছাতিমের নৈসর্গিক সুগন্ধ। এবং তোমার ভাবনাতেই আমি দামাল পুরুষ হয়ে যাই। আমার রক্তে এখন আদিম নিষাদের উদ্দমতা। শাহরুখকে তীব্র আক্রোশে খুন করবার পরিকল্পনায় বিভোর আমি। আমার অস্থির হাত বেসামাল হয়ে আঁকড়ে ধরেছে, আমারই পাশে বসা অচেনা মানুষটার হাত। আর আমি বুঝতে পারি, আমার হাতের নীচে ধরা পড়েছে – কোনও সুন্দর মানবীর কোমল হাত। আমি বলিষ্ঠ চাপ দিতে থাকি ওই উষ্ণ ত্বকে। এবং ক্রমশ হাত ছেড়ে আমি এগিয়ে যেতে চাই আরও কোনও কোমল অঙ্গের প্রত্যাশায়। আমার নির্ভুল প্রত্যয় জন্মায় – আমি যেন রানিকেই স্পর্শ করছি। কিন্তু স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। অন্ধকার ভেদ করে সেই যুবতীর অন্য হাত আছড়ে পড়ে, আমার গালে। আদর নয়, থাপ্পর।
।। তিন ।।
কৌশিকের চোখে আমি ছাই রঙের অবিশ্বাস দেখেছিলাম সাত মাস আগে। সেদিন ওর কাছে আমি, তোমার কথা বলেছিলাম রানি। আমি তোমার প্রেমে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি – এই নিখাদ সত্য অকপটে জানিয়েছিলাম, আমার কলেজের সহকর্মী অধ্যাপক বন্ধু কৌশিককে। বলতে চাইনি। আসলে ভালবাসার ভারে আমার হৃদয় তখন ভঙ্গুর হয়ে আসছিল। কারওকে বলতে চাইছিলাম। কিন্তু কারও সাথেই তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই আমার। তবু কৌশিকের সাথে সামান্য হলেও কথা বলতে ভাল লাগে আমার।
জানো রানি, তোমার সাথে আমার ভালবাসার সম্পর্কের কথা শুনে কৌশিক অবাক হয়েছিল। ওর চোখে ঘনিয়ে এসেছিল ছাই রঙা অবিশ্বাস। যেন পর্দার নারীর সাথে প্রেম করাটা অপরাধ। সত্যি বলতে, কৌশিক নিশ্চিত ঈর্ষায় পুড়ছিল তোমার কথা শুনে। ও আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে। আমার নাকি বোধবুদ্ধি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। সেদিনের পর থেকে আমি আর কৌশিকের সাথে কথা বলিনি।
কলেজ যাই। কারও সাথেই তেমন হৃদ্যতা নেই, সুতরাং অকারণ কথা বলার প্রয়োজন হয়না। এরই মধ্যে একদিন ক্লাসরুম থেকে ছাতিম গন্ধর আভাস পাই। অঙ্কে ভুল করি। সন্ধানী দৃষ্টি মেলে খুঁজতে থাকি কামনার মহীরুহ। সন্ধানে সন্ধানে আবিষ্কার করি, তরুণী ছাত্রীটিকে। কৈশোর ছুঁয়ে আছে তার নাতিউচ্চ স্তনের শিখরে। তার অভিজাত চিবুকে আমি, তোমার আদল পাই রানি। গণিতের সব কৌশল আমি ভুলে যাই। ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। রোলকল করার কথাও মনে থাকে না। তরুণী নারীকে আমি মনে করি, রানি মুখার্জ্জী। সত্যি রানি, তোমার সান্নিধ্য নিয়ে আসে মেয়েটি। আমার আচরণে সমস্ত ক্লাস ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। আমি অপারগ, নিজেকে সংযত করতে পারিনা। এক সপ্তাহ চলে যায় এভাবেই। কিন্তু মেয়েটিকে আমার ক্লাসে আর দেখতে পাইনা। ছাতিম গন্ধ মিলিয়ে যায় ক্লাস রুম থেকে। তার পরিবর্তে বাতাস ছেয়ে যায় ব্যঙ্গ, উপহাস আর বাঁকা হাসির কূট শব পোড়া দুর্গন্ধে।
।।চার ।।
বিকেলে আজ ভীষণ বৃষ্টি হয়েছে। আকাশে এখনও হালকা পলকা মেঘ। তাও চাঁদ দেখা যাচ্ছে। যদিও তা গোলাকার নয়, বরং ক্ষয়ে গেছে তার বিপুল অংশ প্রায়। সামান্য কটা মাত্র তারা, হাতে গোনা যায় এমনই কম সংখ্যা। বাতাস তুষার শীতল। ঘুমন্ত পৃথিবীকে একা একা পাহারা দিচ্ছি আমি। আমার শরীরে কোনও আবরণ নেই এখন। খোলা আকাশের তলায় ছাদে আমার নগ্নদেহ শুয়ে আছে। আজ আমি স্বাধীন। অনুসূয়া নেই আজ। লিলুয়াতে গেছে। ওর মায়ের শরীর ভাল নেই। কবে ফিরবে, জানিনা। ফ্রিজে খাবার আছে। ইচ্ছে হলে খাব, না হলে হোটেল আছে। সমস্যা নেই কোনও। আজ আমি চুটিয়ে স্বাধীনতা উপভোগ করতে চাই। তাই আজকের রাতটায় আমার ঘুম আসছে না।
আমি এখন মনে মনে কবিতা লিখছি। কবিতা ব্যাপারটা আমার বেশ লাগে। যদিও আমার বিষয় গণিত, তবুও কবিতা আমার ভাল লাগতেই পারে। সময় সুযোগ পেলে আমি কলেজ স্ট্রিট চলে যাই, আর কিনে ফেলি অজস্র কবিতার বই। সব বই পড়ে ফেলতে পারি এমন নয়, বরং না পড়া বই পাহাড় প্রমাণ স্তূপ। অনুসূয়া প্রচন্ড বিরক্ত হয়, আমার এই অনাবশ্যক অপচয়ে। তবু ওকে লুকিয়ে কিনে ফেলি বইগুলো। সময় অসময়ে কবিতা আমায় সঙ্গ দেয়। সব কবিতা বুঝতে পারিনা। তবু পড়তে মন্দ লাগে না।
রানি, অনেক দিন পর আজ বাড়িতে বসে সিগারেট খেলাম জানো। আলমারির লকার থেকে তোমার সুন্দর ছবিটাও বার করেছি আজ। অনুসূয়া জানেনা, আমি তোমাকে ভালবাসি। অনুসূয়া ভাবতেই পারবে না, আমি তোমার ছবি লুকিয়ে রাখি লকারের গোপন আঁধারে। অনুসূয়া সিগারেট খাওয়া পছন্দ করেনা। কতদিন পর আজ বাড়ি বসে সিগারেট খেলাম।
এবার আমি ছাদ থেকে নেমে আসি শোবার ঘরে। ঝাঁপিয়ে পড়ি বিছানায়, এবং বালিশের তলা থেকে বার করে আনি তোমার ছবিটা। আমার পলক পড়েনা। রানি, তোমার ওই হাসি দেখতে দেখতে আমার যুগের পর যুগ কেটে যায়। তোমার ধূসর চোখের তারায় আমি বন্ধুতার সন্ধান করতে থাকি।তোমার অধরা লাবণ্যে আমার নির্জনতা ভেঙে যায়। আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পাই, তোমার ঈষৎ, ভাঙা ও ফাঁপা কন্ঠস্বর। আমি আশ্লেষে চুমু খেয়ে যাই তোমাকে।
বিছানা থেকে নামি একসময়। আলমারির লকারে হাত চালান করি। আমার হাতের পাতায় ভরে ওঠে ছাতিমের কামগন্ধ। ছোট বাক্স একটা। কন্ডোমের। বাক্সটার গায়ে, এক লাস্যময়ীর আধানগ্ন ছবি। মেয়েটি এক স্বচ্ছ আবরণে নিজেকে ঢাকতে চাইছে। কিন্তু, ওই পাতলা আড়ালে মেয়েটির সব গোপনতা সুস্পষ্ট। আমি ছবির মেয়েটাকে দেখতে থাকি আর ভেবে যাই তোমার না দেখা নগ্ন আড়াল বুঝি এমনই রমণীয়। রানি, আমার এখন এই নির্জনতায় তোমাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। আমি বিছানায় আশ্রয়ে ফিরে যাই আবার। কন্ডোমের বাক্সটা দেখতে দেখতে উত্তাল হই। আর অপূর্ব সংরাগে আত্ম মৈথুন শেষে ঘুমিয়ে পড়ি। চোখে লেগে থাকে, রানির চুম্বনরেণু।
।। পাঁচ ।।
তোমার সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল, চার বছর আগে এক শীতের বিকেলে। তখন আমার বিবাহিত সম্পর্কের বয়স মাত্র সাতদিন। এবং সেই সাতদিনে, আনুসূয়ার সাথে মত পার্থক্য হয়েছিল, চুয়াল্লিশ বার। আর সেইদিন আমাদের ঝগড়া হয়েছিল প্রথমবার। আমার সব মনে আছে। আমি সহজে কিছু ভুলি না।
যাইহোক, সেদিন বাড়িতে থাকতে ভাল লাগছিল না। অবসন্ন লাগছিল। আমার সিনেমা দেখার কোনও নেশা নেই। কিন্তু সেই মেঘলা শীতের বিকেলে আমি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। ছবিটার নাম কি ছিল ? সাথীয়া না সাথী? নায়ক যেন কে ছিল ?
সেদিন কেমন সব তালগোল পাকিয়ে গেল। সেদিনই প্রথম অনুভব করলাম, সোনালি এক ছাতিমের গন্ধ। তোমাকে দেখতে দেখতে আমি কেঁপে উঠলাম। তখন যদিও, তোমার নামটা জানতাম না আমি। জেনেছিলাম পরে। আমার ছাত্র নীলাঞ্জনের মুখে। সে তোমার যে কোনও ছবি অনেকবার করে দেখে। নীলাঞ্জনের চোখে আমি নীল রঙের মুগ্ধতা দেখেছিলাম। সে আমার প্রতিপক্ষ। তাকে একদিন আমি শাস্তি দেব। চরম কোনও শাস্তি। নীলাঞ্জন জানে না, রানি কেবল আমার। তাই না রানি, সত্যি বল – তুমি আমারই তো ?
প্রথমবার তোমার সাথে আলাপ হতেই বুঝেছিলাম, আমার প্রেম জাগছে। সে যেন খরশান অনুভূতি। আমার সমস্ত অবকাশে জড়িয়ে নিলাম, তোমাকে। আমার নিঃসঙ্গতা বোধ কমে গেল একদম। এই যন্ত্রণাদায়ক একাকিত্বে তুমি আমায় উপহার দিলে, সোনালি ছাতিম গন্ধ। সাঁতার জানি না, সমুদ্র কিনারায় বসে আছি চূড়ান্ত অবগাহনের প্রস্তুতি নিয়ে। কবে আমায় ডাকবে, রানি।
অনুসূয়া জানেই না, আমি কেমন ভালবাসতে পারি। কৌশিক বুঝবে না, প্রকৃত ভালবাসা মানে মানসিক রোগের উপসর্গ নয়। নীলাঞ্জন নির্বোধ। তাই সে জানেনা, রানিকে ভালবাসার যোগ্যতা তার নেই। কারণ, নীলাঞ্জনের শরীরে এখনও বয়ঃসন্ধির ঘোর।
শহরের দেওয়াল গুলোতে মাঝে মাঝে, তুমি অভিনীত সিনেমার বিজ্ঞাপন আটকে দেওয়া হয়। আমি সেই সিনেমাগুলো দেখার তাগিদ অনুভব করি না। কারণ শাহরুখ, অভিষেক আর আমির খানদের সাথে তোমার প্রেমজ দৃশ্য সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। রাতের পর রাত কেটে যায়। ঘুমন্ত অনসূয়ার পাশে আমি নির্জীব জেগে থাকি, আর ভাবি ওই সুদর্শন নায়কদের থেকে তোমাকে কেমন করে ছিনিয়ে আনব আমি। ভেবে যাই।
রোজ রোজ কলেজ যেতে আমার ভাল লাগে না। ডুব দিয়ে বাড়িতে বসে থাকি। অনসূয়া প্রনবের বাইকে চড়ে প্রতিদিন অফিস চলে যায়। নিরালা বাড়িতে, তোমার ছবির সাথে একা প্রহর কাটাই, রানি তুমি কেবল হাসতেই জানো ছবি হয়ে। অধরা অন্তরাল ভেদ করে তোমার বুকে মাথে রেখে ঘুমোতে চাই আমি। তোমার কোমর জড়িয়ে কোনও অজানায় উদ্দেশে পাড়ি দিতে চাই আমি। তোমাকে অর্জন করাই মোক্ষ আমার। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ, রানি।
।। ছয় ।।
এই পথে ছেয়ে আছে ছাতিম গন্ধ। এই পথ বড় নির্জন। পিচমোড়া পথের দুপাশে বিশাল বনস্পতির সমাহার। এই পথে হাঁটলে আমার মন শান্ত হয়ে যায়। তাই জন্য, নৌকা ভাড়া করে প্রায়ই ব্যারাকপুর চলে আসি। অনেকক্ষণ হাঁটি, সাজানো সবুজ অরণ্যের মাঝে বিছিয়ে থাকা পথ দিয়ে।
আজকের সান্ধ্যমুহূর্ত ভেজা ভেজা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার ছাতা নেই। বৃষ্টিতে ভিজতে আমি ভালবাসি। কিন্তু, এখন আমার বৃষ্টি ভাল লাগছে না। কারণ, ছাতিমের গন্ধ আমায় উদভ্রান্ত করছে। আবার আমি তলিয়ে যাচ্ছি, পুকুরের সবুজ অতলে। কোথা থেকে আসছে এই মাতালা সুগন্ধ।
রানি, তোমার অদৃশ্য উপস্থিতি আমাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে গহন জলতলে। আমি তো সাঁতার জানি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কি মরে যাচ্ছি। আবার সেই শ্যাওলা সবুজ ভয়টাকে টের পাচ্ছি আমি।
তবু ডুবতে গিয়েও ডুবে যাইনা। আমার চোখ আটকে যায়, অমলতাস গাছের তলায়। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। গাছের তলায়, সান্ধ্য শ্রাবণের আঁধার মেখে দাঁড়িয়ে আছ। অবিকল তুমি। রানি, সত্যি তো তুমি নাকি এ আমার ভুল ? নির্ভয়ে এগিয়ে যাই তোমার কাছাকাছি। ছাতিমের গন্ধে নিশ্বাস বুজে আসে। মেয়েটির চোখে হাসির বিচ্ছরন। ঠোঁটের ভাঁজে অবগাহনের আমন্ত্রণ।
আমি জানি, মেয়েটির সাথে, তোমার অনেক মিল। কিন্তু এই মেয়ে নিশ্চিত তুমি নও। মেয়েটিকে আমি স্পর্শ করি। ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে যাই রানির মায়ায়। ঝিরঝিরে বৃষ্টির পৃথিবীও ডুবে যায়।
Tags: অরিন্দম, হ্যালুসিনেশন
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।