রমনীমোহনের প্রাসাদোপম বাড়ির কারুকার্য করা বিশাল লোহার গেট, সেটা খোলা। তারপরে আবার একটা কোলাপসিব্ল গেট। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদু, অর্থাৎ চন্দ্রনাথ। অবশ্য সেটা এখন আর বোধহয় কেউ মনে রাখেনি। সবাই বলে চাঁদু। চাঁদু নিজেও জানে তাকে ঐ নামে সম্বোধনের সময় সবাই একটা তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত ছুড়ে দেয়। এটাও জানে পাড়ায় যে কোনো বাড়িতে সে অবাঞ্ছিত।
চাঁদু তাকিয়ে দেখছিল বাড়িটা। মস্ত গেটের দু-পাশে বোগনভলিয়ার ঝাড়, মেরুন রং এর। আসল বাড়িটা বেশ কিছুটা ভেতরে। গেটের মুখ থেকে লাল মোরামের রাস্তা চলে গেছে মস্ত গাড়িবারান্দা পর্যন্ত। লাল রাস্তার দুপাশ দিয়ে নিঁখুত সমান্তরাল সারি বাধা নানা রং এর মরশুমি ফুল। মসৃন ভেলভেটের মত সবুজ ঘাসের মাঝখানের এই রাস্তা ও ফুলের বাহার যে কোনো পথ চলতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করবেই।
চাঁদু দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। দারোয়ানকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে কিন্তু এখনো ভেতরে যাবার অনুমতি মেলেনি। গেটের অদূরে একটা বসার জায়গা রয়েছে। এদিক – ওদিক দেখে নিয়ে সেখানে বসে পড়ে চাঁদু একটা সিগারেট ধরালো।
দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। চাঁদু জানে আজ দুর্গাপুজোর অষ্টমী, তাদের পাড়ায় প্যান্ডেলে নিশ্চয়ই খুব হৈ চৈ চলছে। অনেকবছর আগে পুজোর সময় তার দামাল কৈশোরের আনন্দের দিনগুলি মনে পড়ছিলো। দুর্গাপুজো তখন বাতাসে আনন্দের একটা গন্ধ নিয়ে আসতো। হ্যাঁ, আনন্দেরও একটা গল্প মিশে যায় অন্ততঃ পুজোর বাতাসে। মন নেচে ওঠে শুধু অকারণ পুলকে। শুধু একটা দিন নয়। চাঁদুদের আনন্দ শুরু হতো অনেক আগে থেকেই।
ওদের পাড়ায় সেই সময় পুজো মানেই ভোম্বলদা, তার হাঁকডাক শুনলেই বোঝা যেত পুজো আসন্ন। দুর্গাপুজোর কাউন্ট – ডাউন শুরু। প্যান্ডেলের জন্যে বাঁশের কাঠামোর ওপরেই ওদের দাপাদাপি। নানারকমের কসরৎ দেখানো শুরু, বিশেষ করে কোনো কোনো বাড়ির জানলায় কোনো কিশোরীর মিষ্টিমুখ দেখতে পেলে। প্রতিমা আসবে কুমোরপাড়া থেকে। ভোম্বলদার নেতৃত্বে সবাই পরিকল্পনা করতো কেমন করে সেটা আনা হবে।
প্রতিমা নিয়ে আসার পর দুর্গার হাতের বর্শাসিক্ত অসুরকে দেখে কত মন্তব্য। মুখটা চেনা কারো সাথে মিলছে কিনা। চাঁদু, ওর দুই বোন, মা আর বাবা সবাই মিলে ভোরবেলায় মহালয়ার অনুষ্ঠান শুনতো। সেই সময় বাড়িতে শাসনের একটু শৈথিল্য থাকতো। তাই বন্ধুদের সঙ্গে চাঁদুও রাত জেগে দেখতো উপুড় করা অসংখ্য চুপড়ির ওপর চট দিয়ে পাহাড় বানানো আর তারপর সারারাত ধরে পাড়ার আর্টিস্ট ভাইডুদার আশ্চর্য তুলির টানে একটু একটু করে ফুটে উঠতো পাহাড়ের রূপ। চাঁদুর বিস্ফারিত চোখের পলক পড়তনা।
আপনি কাছাকাছি থাকুন। সাহেব এই সময় রোজকার পুজো সেরে নীচে নামেন।
দারোয়ানের কথায় বর্তমানে ফিরে আসে চাঁদু। হাতে ধরা সিগারেট শেষ, চাঁদু সেটা সন্তর্পনে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে রুমাল দিয়ে হাত আর মুখটা ভালো করে মুছলো।
অনেক কথা তার মনে ভীড় করে আসতে লাগলো। সবই দুঃখের, রাগের আর হয়তো অভিমানের। রাগতো তার নিজের ওপরেই বেশি। নাহলে একজন আদর্শবান সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের ছেলে হয়েও তার লেখাপড়া হলো না। এখন তো সে একজন পাকা মস্তান। লোকে বলে সে বাপের কু-পুত্তুর। তার বাবার মতন সজ্জন খুব বেশি দেখা যায়না। যে দু-চারজন মেধাবী ছাত্র তার কাছে বাড়িতে পড়তে আসতো তিনি তাদের কাছে টাকা পয়সা নিতেন না। বলতেন বিদ্যা বিক্রয় করেন না। ইস্কুলের বেতনেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তার মানে এই নয় যে স্ত্রী, এক ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে খুব একটা স্বচ্ছল ছিলেন।
চাঁদু ক্লাস টেনে দুবার ফেল করে নিজেই পড়া ছেড়ে দিল। বাবার কোনো কথাই শুনলো না। কিছুদিন পর থেকে তার সকাল থেকে আড্ডা, তাস – এইসব নিয়ে দিন কাটানো একঘেয়ে লাগছিল। এই অবস্থায় তার বন্ধু বান্ধব বদলে যেতে শুরু করলো। প্রথম প্রথম কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে, তারপর থেকে বিনা কারণেই মারপিট আর মস্তানির মধ্যে বেশ একটা উত্তেজনা থাকতো। সারাদিন বাড়িতে থাকেই না। যখন থাকে বাবার সঙ্গে বা মার সঙ্গে তর্কাতর্কি, চিৎকার। আস্তে আস্তে বোন দুটোর সঙ্গেও একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেলো। জীবনে যখন ধিক্কার জাগতে লাগলো সেই সময় চাঁদুর পরিচয় হলো ভবতোষ দত্তের সঙ্গে। সবাই জানে ভবতোষ দত্ত একজন অন্ধকার জগতের নেতা, প্রচুর পয়সা। চাঁদুর হাতেখড়ি নানা অসামাজিক কাজে। প্রথমে সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক, তারপর দলের সাথে তোলা আদায় করা। বেশ দুপয়সা হাতে আসে। তবে এটাও জানে ওর জন্যে ওর বাবা লজ্জায় কুঁকড়ে থাকেন। বেশ কিছুদিন আগে রিটায়ার করে এখনো পেনশন পাননি। সংসার চালাতে নাজেহাল। এদিকে মস্তান হিসেবে এলাকায় চাঁদুর বেশ নামডাক। একদিন ভবতোষ দত্তর হাত ধরে যে আবছা – অন্ধকার জগতে তার প্রবেশ ঘটেছিল, সেই জায়গাটাই তাকে খুব টানে। এখন তার নিজেরই একটি ছোট দল হয়েছে। সে বোঝে লোকের চোখে তাকে দেখলেই ভয় আর ঘৃণা উপচে ওঠে। সকলের চোখে সে অপাংক্তেয়, সমাজ, অন্ততঃ ভদ্রসমাজ তাকে ত্যাগ করেছে। চাঁদু নামটা কেউ আর বলেনা। বলে গালকাটা। পরিতোষ অর্থাৎ পরির দলের সঙ্গে একবার টক্কর লেগেছিল। তখন সেই অ্যাকশনের মধ্যে কেউ একটা বেকায়দায় ছুরি চালিয়েছিল। সেটা ওর গলায় না লেগে গালে লাগে। আজও সেই দাগটা থেকে গেছে। সেই থেকে তার নামটাই হয়ে গেছে গালকাটা। এলাকার সে এখন ত্রাস। এই বয়সেই কোনো অপরাধই তার বাকি নেই। পিস্তল সঙ্গে থাকলে ছুরি বা পেটো ছোঁড়ার খুব একটা দরকার হয়না। প্রায় ছ’ফিট লম্বা পেটা চেহারায় গালের ঐ ক্ষতটার চিহ্ন দেখলেই লোকে ভয় পেয়ে যায়।
দারোয়ানজি, আরো দেরী হবে?
রমনীমোহনের গেটের দারোয়ান একটু বিরক্ত হলো। সেটা বুঝতে পেরে চাঁদুর মাথায় রক্ত উঠছিল তবে সংযত হতেই হলো। ভবতোষ পইপই করে বলে দিয়েছে মাথা গরম না করতে। রমনীবাবুর অনেক রকমের ব্যবসা, ইদানিং প্রোমোটারিও শুরু করেছে। ভবতোষ বলেছে “ওর সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। আমি বলেছি লেখাপড়া খুব বেশি না করলেও তুই নানারকম সমাজসেবায় যুক্ত আছিস। তোর স্বভাব চরিত্র খুব ভাল। বয়স কম বলে অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়ায়, গায়ে জোর আছে বলে মারপিট করে ফেলিস – এইসব। এও বলেছি একটা চাকরি হলেই শান্ত হয়ে যাবি। এগুলো মনে রেখে কথা বলিস।”
আসলে অনেক ভেবেচিন্তে চাঁদু নিজেই একদিন বলেছিল, ভবতোষ দা, আর এসব ভাল লাগছেনা। ভবতোষ একটু অবাক। ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ তোর আবার কী হলো ? বেশ তো আছিস। না, বেশ নেই ভবতোষ দা। আপনি তো সব জানেন। আপনাকে তো সবই বলি। একটা চাকরি না হলেই নয়। ভবতোষ চুপ করে রইলেন। একটু পরে বললেন, তুই একটু দাঁড়া। একজনের সঙ্গে কথা বলি, দেখি কিছুক্ষণ পরে এসে বললেন, হয়ে যাবে, কথা হয়ে গেল। বেশি দূরে নয়। এখান থেকে পাঁচটা ষ্টেশন। ষ্টেশনে নেমে যদিও একটু সর্টকাট আছে তবে রাস্তাটা নিরাপদ নয়। তুই সোজা পশ্চিমদিকে হাঁটবি, কিছুদূর গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করবি, বাড়ি দেখিয়ে দেবে। সবাই একডাকে চেনে।
চাকরিটা হয়ে গেলে চাঁদু বেঁচে যায়। একটু একটু করে কঠিন হয়ে যাওয়া রুক্ষ জীবনটাতে কোথাও একটু নরম স্পর্শ নেই। বাবা কিছুদিন আগে মারা যাবার পর তাদের বাড়ির দৈন্যদশা যেন বেশি করে চোখে পড়ছে। মা’র সঙ্গে চাঁদুর অহরহ চিৎকার করে ঝগড়া হয়। উঠতে বসতে গঞ্জনা আর সহ্য হয়না। সে জানে বাবার অবর্তমানে সংসারের ভার কিছুটা তার নেওয়া উচিৎ ছিলো। সেটা স্বাভাবিক। দুবোন মাথায় মাথায়। তাদের বিয়ের ব্যাপারটাও ভাবা উচিৎ। কিন্তু জীবনের সবরকম উচিৎ কাজগুলোর থেকে তার দূরত্ব কয়েক যোজন। এই ক’বছরে সে শুধু মানুষের ঘৃণা কুঁড়িয়েছে। পরিচিতরা পাশ কাটিয়ে যায়। সবাই ভয় পায়। তবু খাবার সময়ে বাড়ি না এসে পারেনা। যখন খিদের প্রচন্ডতা তার অসহ্য মনে হয় তখন খাবারের সংস্থান তার মা কেমন করে কোথা দিয়ে করছে সে সব ভাবেনা বা ভাবতে চায়না। তখন শুধু খিদে, এক সর্বগ্রাসী খিদে তাকে ক্লান্ত করে। মা তাকে খাবার বেড়ে দেন নীরবে। খাবার সময় আঙ্গুল দিয়ে ভাত ভাঙার কথা মনে থাকেনা চাঁদুর। হাতের চেটো দিয়ে সবকটা ভাত গবগবিয়ে ভিতরে ঠেলে দেয় আর সেই হীনমন্যতার আবরণের মধ্যে তার মন অবসন্ন বোধ করে, তখনি তার বেকার জীবন, সংসারের কোনো কাজে না লাগা তার অর্থহীন উপস্থিতি আগে ভারাক্রান্ত করে তোলে মন। তখন সেই চরম হতাশায় অপরাধ জগতের হাতছানি তাকে নেশাগ্রস্তের মতন টানে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেলো চাঁদু অপেক্ষাই করছে। ভাগ্যিস একটা জুৎসই বসার জায়গা পেয়েছিল। অদূরে কোথাও পূজোর ঢাক বাজছে। এতক্ষণ তার সবচিন্তা অধিকার করেছিল তার ফেলে আসা কয়েকটা বছরের পরিস্থিতি। মনটা বিষণ্ণ লাগছিল। ভাবে সবটাই কি তার একার দোষে হয়েছে। খুব নিঃসঙ্গ লাগে মাঝে মাঝে। ভাবে এতটাই কি তার প্রাপ্য। মা’র বাক্যবাণ কিংবা বোনেদের ঘৃণামিশ্রিত অবজ্ঞা। কারণ তারা নাকি তাদের অ্যান্টিসোশ্যাল দাদার জন্যে বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাতে পারেনা – এসব তার মাথার মধ্যে কিলবিল করে ওঠে। তখন এগুলো ছাপিয়ে তাকে আকর্ষণ করে ভবতোষ দত্তের ঠেক যেখানে সে রাজা। যেখানে সবকিছুর প্ল্যান, হিস্সার কথা চলে নিচুস্বরে আর হাতে হাতে উঠে আসে গেলাস। আঃ কি উত্তেজনা, কি ফুরফুরে মেজাজ। শুধু তারই মধ্যে যখন পরিতোষের কথা মনে এসে যায় তখন মেজাজটাই বিস্বাদ হয়ে যায়। চিড়বিড় করে ওঠে মাথার ভেতর। তার অবচেতনের অন্ধকারে তার প্রবল প্রতিদ্বন্ধী পরির লাশটা নামিয়ে দেবার ইচ্ছেটা হাতে ধরা তরলে মিশে মাথায় খুন চাপিয়ে দেয়। শালা একদিন বলেছিল তোর বোনেদের কেউ বিয়েটিয়ে করবেনা। তোর জন্য ওদের গায়ে কলঙ্কের দাগ লেগেছে। কলঙ্কের দাগটা কেমন দেখতে চাঁদু জানেনা। কিন্তু এই কথাগুলো যখন তার মনে ছোবল মারে তখন একটা মোক্ষম বদলা নেবার ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে। পরির একটা বোন আছে। নীলিমা। কখনো কথা বলেনি শুধু দূর থেকে কয়েকবার দেখেছে। বয়স বাইশ তেইশ হবে। ভীষণ সুন্দর দেখতে। পড়াশুনাতেও খুব ভালো। সে ঠিক কী পড়ে বা কোথায় পড়ে চাঁদু জানেনা। শুনেছে খুব দেমাক, কারো সাথে বেশি কথা বলেনা। গনগনে উনুনের মতোন উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কোষে কোষে বদলা নেবার যে ইচ্ছেগুলো ফনা তোলে তাইতে দাঁতে দাঁত চিপে চাঁদু আপনমনে বলে একদিন যদি ওই নীলিমাকে বাগে পাই তাহলে ঝোপের আড়ালে নিয়ে যদি শালির কাপড় না খুলি তো …। প্রতিশোধের কল্পনায় তার চোখে আগুন জ্বলে।
বাবু ভেতরে যান। সাহেব ডেকেছেন।
বর্তমানে ফিরে আসে আবার। গেট পেরিয়ে লাল মোরামের রাস্তার ওপর দিয়ে সন্তর্পনে হাঁটতে হাঁটতে চাঁদুর বিস্ফারিত চোখ এক সুবিশাল ড্রয়িংরুমের ভেতরে আটকে গেলো। কি দারুন সাজানো। এক দেয়াল থেকে উল্টোদিকের দেয়ালের মেঝে পুরু কার্পেট দিয়ে মোড়া। দেয়ালে টাঙানো বড় বড় অয়েল পেন্টিং আর ঘরময় একটা মিষ্টি গন্ধ। একজন এসে বললো – বসুন। চাঁদু খুব সাবধানে একটা সোফায় বসলো।
একটু পরেই কাজ করা পাঞ্জাবী আর দুধসাদা পাজামা পরে ছুটির দিনের মেজাজে সামনে এসে দাঁড়ালেন রমনীমোহন। ভবতোষ তোমাকেই পাঠিয়েছে ?
চাঁদু ভয়ে ভয়ে বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার,
বেশ মোলায়েম হেঁসে রমনীমোহন বললেন, দাঁড়ানোর দরকার নেই। তোমার তো বেশ স্মার্ট চেহারা হে। ব্যায়াম ট্যায়াম করো ? ঠিক আছে এখন বোসো। কী খাবে বলো, কফি বা সরবৎ ? তুমি একটু অপেক্ষা করো, আসি একটু পরেই আসছি।
নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছেনা। এসব কী শুনছে ! এই সুন্দর সুন্দর কথা, এতো আপ্যায়ন। এই ছন্নছাড়া জীবনটা কি একটু ভদ্রস্থ হতে যাচ্ছেনা ? মায়ের গালাগাল, বোনদের অবজ্ঞা আর অন্য মানুষদের অসহ্য ঘৃণা থেকে কি এবার একটু মুক্তির হাওয়া ? দুটো মিষ্টির সঙ্গে একটা লম্বা গেলাস ভর্তি ঠান্ডা সরবৎ একজন তার কাছে রেখে গেলো।
চাঁদুর একা একা এই ঘরে থাকতে মনে পড়ছিল কত বছর হয়ে গেলো, এইরকম অষ্টমীর দিন ওর মা বলতো কখন সন্ধিপূজো আরম্ভ প্যান্ডেল থেকে খবর নিয়ে আসতে। চাঁদু কখনো অঞ্জলি দেয়নি কিন্তু প্রত্যেকবার সন্ধিপূজোর রাতে সবাইকে নিয়ে ঢাক বাজাতো আর ছিলো ভাসানের দিন নৌকায় চড়া। তখন সব প্রতিমাই নৌকো করে গঙ্গার ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ঘন্টা দুয়েক চলার পর গঙ্গাতেই বিসর্জন। তখন এটাই নিয়ম ছিলো।
এসব ভাবতে ভাবতে চাঁদুর মনটা হালকা হয়ে উঠলো। রমনীমোহন ঘরে এলেন। চাঁদু একটু হাসিমুখ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। অনেকক্ষণ ধরে ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠলেন- আচ্ছা তুমিই না গতমাসে আমার শপিংমল প্রোজেক্টের সাইট অফিসে হামলা করেছিলে, বোম্ মেরেছিলে তোলা আদায়ের হিসেব মেলেনি বলে ? স্কাউন্ড্রেল, কে তোমাকে ঢুকতে দিয়েছে ?চিৎকার করে দারোয়ানকে ডাকলেন। আরো চিৎকারে গর্জে উঠলেন-গেট আউট
এক হাজার বোল্তা যেন একসাথে হুল ফোটালো। অপমানে আর হতাশায় তার মুখ কালো হয়ে গেলো। প্রায় দৌড়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে একটু খোলা রাস্তায় দাঁড়ালো। প্রচন্ড রাগ আর উত্তেজনা নিয়ে পা বাড়ালো স্টেশনের দিকে। চারিপাশের অবিরাম জীবনপ্রবাহ ও কোলাহল পেছনে ফেলে একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে নির্জন রাস্তাটা ধরলো। ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে লাগলো চ্যালা চামুন্ডাদের মুখ, ভবতোষ দত্তর বড় বড় কথার ফুলঝুড়ি, পরিতোষের দলবল আর তার বোন নীলিমাকে বেইজ্জৎ করা – সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেলো।
হঠাৎ পেছন থেকে এক নারীকন্ঠ।
চাঁদুদা আপনি ?
চম্কে উঠলো চাঁদু। ভাবলো ঠিক দেখছে তো । এতো সেই নীলিমা, পরীর বোন। এ এইসময় এখানে কী করে এসে পড়লো। ভেতরে চিড়বিড়িয়ে উঠলো সদাজাগ্রত প্রতিশোধস্পৃহা। শিকার আজ হঠাৎ হাতের মুঠোয় নিজেই যেন ধরা দিল। মন স্থির করে ফেললো। মনে মনে বললো আজ বুঝবি কার পাল্লায় পড়েছিস। মনের ভেতর একটা সাপ ফনা তুলছে একটা জন্তু জাগছে আর সেই সঙ্গে সে কল্পনায় নীলিমার অনাবৃত শরীরটায় ঝাপিয়ে পড়ে পিষে ফেলতে চাইছে।
নীলিমা আবার বললো,একি চাঁদুদা, আপনি আমায় চিনতে পারছেন না ?
ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠছে চাঁদুর মুখ। ভাল লাগছেনা, একদম ভালো লাগছেনা এইসব পিরিতের কথাবার্তা। নেহাৎ জবাব একটা দিতেই হয় তাই ঠান্ডা গলায় বললো,তুমি কি আমায় ভালো করে চেনো ?
নীলিমা অবাক হলনা খুব। স্বাভাবিক একটা আন্তরিকতার সুরে হাসতে হাসতে কথা বলতে লাগলো। যেন অনেকদিনের চেনা বন্ধু, শুধু মাঝখানে কয়েকবছর দেখা হয়নি। সেই ভাবেই জবাব দিলো – কি বলছেন চাঁদুদা, আপনাকে তো আমি অনেকদিন আগে থাকতেই চিনি। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে ফুটবল খেলতেন আপনি। কি দারুন শট্ ছিলো আপনার পায়ে। জার্সি গায়ে দিলে কি স্মার্ট দেখাতো আপনাকে। আজকাল আর দেখতে পাইনা কেন ?
চাঁদু কি জবাব দেবে বুঝতে পারেনা। সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কোনমতে বলে ফেললো, সবাই আমাকে ভয় পায়। তুমি পাওনা ? নীলিমা খিলখিল করে হাসলো। আড়চোখে তাকালো চাঁদু। লক্ষ্য করলো নীলিমার হাসিটা বড় মিষ্টি, বড় নিস্পাপ। দুটো চোখ কথা বলে।
সে খুব সহজেই জবাব দিলো, ভয় পাবো কেন ? আপনাকে দেখতে পেয়েই তো এই রাস্তাটা ধরলাম। এইখানে একটা কাজ ছিল। তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। আজ অষ্টমী পুজোর জন্যে সবাই ব্যস্ত। ওদের বাড়ির পাশেই বিরাট একটা পুজো হয়। বারোয়ারী। সবাই ঐখানে। ঢাকের আওয়াজে কথা বলা বা শোনা যায়না। তাই বেশিক্ষণ থাকলাম না। তাই সোজা স্টেশনে গিয়ে লোকালটা ধরবো। এই রাস্তাটা বড় নির্জন, সঙ্গে চেনা কেউ না থাকলে গা ছম্ছম্ করে।
কথায় কথায় অনেকটা পথ পেরিয়ে এলো ওরা। নীলিমার শাড়ীর আঁচল হঠাৎ হঠাৎ দম্কা হাওয়ার ধাক্কায় চাঁদুর গায়ে লাগছিলো। সেই সঙ্গে মিষ্টি একটা সেন্টের বড় কোমল গন্ধ। চাঁদু আড়চোখে দেখলো দুই ভ্রু’র মাঝখানে ছোট্ট টিপে নীলিমার কপালটা বড় সুন্দর লাগছে । কানের পাশে কয়েকগুচ্ছ চুল অবাধ্য হলে সে হাত দিয়ে ঠিক করে নিচ্ছে। এতক্ষণ পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে নীলিমার শাড়ীর খসখস আওয়াজ, শ্বাস-প্রশ্বাসের সৌরভ আর তার পদশব্দের অনুচ্চারিত ধ্বনি – এইসব ভাবতে ভাবতে তারা প্রায় স্টেশনে পৌঁছে গেলো। যেখানে মাঠটা শেষ সেখান থেকেই সামনে স্টেশন দেখা যায়।
সেইখানে দাঁড়িয়ে চাঁদুর মুখের ওপর পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে নীলিমা বললো।
আবার করে দেখা হবে চাঁদুদা, কথা দিন। ফেলে আসা মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো চাঁদু। খোলা প্রান্তর জুড়ে রাশি রাশি কাশফুল হাওয়ায় দুলছে। মাথার উপরে নির্মেঘ শরতের ঘননীল আকাশ। মনে হচ্ছে সেখানে সে যেন লঘুপক্ষ গাংচিলের মতন স্বপ্নের দিগন্তে ভাসছে। চাঁদুর কল্পনা করতে ভাল লাগল হঠাৎ কোনো জাদুবলে চরাচর কাঁপিয়ে বৃষ্টি ছুটে আসছে। লক্ষ লক্ষ অশ্বারোহীর মতন আওয়াজ তুলে ভেসে যাচ্ছে মাঠঘাট প্রান্তর। ভালোবাসা সান্দ্র হয়ে উড়ছে মনের আগোচরে , বৃষ্টির ওপারে একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ফেলে আসা জীবনের জলছবিগুলি ।
Tags: অনিলেশ গোস্বামী, ক্যাক্টাস
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।