উইয়ের ঢিবি থেকে মাটি ভেঙে টিনের বালতিতে বোঝাই করতে করতে সুধাকৃষ্ণ বুঝে উঠতে পারছিল না কটা বাজে। গ্রাম–ভারতের যে মানুষেরা রোদের এগনো–পেছনো, তারা আর চাঁদের অবস্থানে বেলা রাত মাপে সুধাকৃষ্ণ তাদেরই একজন। অথচ আষাঢ়ের এই থমধরা মেঘলা সকালে এই বৃষ্টি, বৃষ্টি নয়, মেঘভাঙা ধারালো রোদ, কখনও আগলা–পাগলা হাওয়া – এমনই যখন চারপাশের প্রাকৃতিক খেলা; তখন ফণীমনসার প্রাচীন শিকড়ের পাশে ঝুলন –খেলার পাহাড় পাহাড় চেহারার লাল রঙের উইঢিবির মাটি হাতলভাঙা কাটারির মুখ দিয়ে নামিয়ে আনতে আনতে সুধাকৃষ্ণ প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘামছিল। পরনের রঙ ক্ষয়ে যাওয়া সবুজ হাফপ্যান্টের পাছায় শাদা সুতো, কালো সুতোর তালি, দুপকেটেই ফুটো। খালি গা বেয়ে নেমে আসা ঘামের নদী, নগ্ন পা আমাদের শিশুশ্রমিক বিষয়ক কোনো গুরুগম্ভীর সমীক্ষার দিকে আঙুল তুলে দেখাতে পারে।
যে বয়েসে কলকাতা আর তার গা–লাগোয়া মফস্বলের ছেলে–মেয়েরা পরিষ্কার বাহারি ইউনিফর্ম, বুকে ব্যাজ, জলের জায়গা, টিফিন বাক্স নিয়ে জুতো–মোজায় পা ঢেকে বাবা–মা, পৌছানোর জন্যে মাইনে করা পুরুষ বা নারীর সঙ্গে, নয়ত সুন্দর গাড়িতে স্কুলের পথে, সুধাকৃষ্ণরা তখন মাঠ ভাঙে, জঙ্গল পেরিয়ে যায়–খাদ্য অথবা ইউঢিবির খোঁজে।
ভোটার লিস্ট, রেশন কার্ড অথবা অন্য কোনো সরকারি নথিতে জেলা মেদেনীপুর, থানা পটাশপুর, গ্রাম খড়ুই – এভাবেই নির্দেশিত হয় সুধাকৃষ্ণ, তার আগের প্রজন্ম আরও আগের কেউ থাকলে তাদের ঠিকানা। ঘন সবুজের আশে পাশে ময়লা ডোবা, সেখানে ক্রমাগত সবুজ গুঁড়ি পানার বেড়ে ওঠা, আর মশার আঁতুড়ঘর। তারাই কাছাকাছি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আট–দশ ঘর শঙ্খ বণিক শিল্পীপরিবার। সারা দিনমান প্রাচীন পদ্ধতিতে শাঁখার আংটি। আর এই উইঢিবির মাটিতে এক নিজস্ব ফোক–ফর্মের পুতুল। উনোনে পুড়িয়ে তার ওপর গালার সাজ।
টিনের ফুটো হয়ে যাওয়া মাঝারি বালতি একটু একটু করে ভর্তি হয়ে আসে। অল্প দূরে দাঁড়ানো রামকৃষ্ণ। খালি গা। ছোট গামছা দিয়ে ঢাকা নিম্নাঙ্গ। ন বছরের দাদা সুধাকৃষ্ণর হাত ব্যাথা হয়ে গেলে বালতি বইবে রামকৃষ্ণ, তার বয়স সাত। বয়েসের তুলনায় দুই ভাই–ই ভারতীয় গ্রাম–সমাজের সামন্ততান্ত্রিক বিন্যাসের মতোই ক্ষয়িষ্ণু। সেই বহু পুরনো প্রচলিত ছড়া – ‘খায় দায় হাড়ে চোষে / বাড় নাই মোর কর্মের দোষে’ এদের ক্ষেত্রে একেবারেই উল্টে যায়। ধারাবাহিক অনাহার, অপুষ্টি নামে তাদের বাড় বাড়ন্তকে খেয়ে ফেলে। ‘কমপ্ল্যান’ বা ‘ইনক্রিমিন টনিক’ –এর বিজ্ঞাপন এদের চেহারার পাশাপাশি অবশ্যই ফুটে উঠতে পারে আদর্শ হাসির চিত্র হিসেবে।
মেঘালাগা আবছা আলোয় সুধাকৃষ্ণর ভোঁতা কাটারির ইস্পাত–রঙ ফলা, লালচে উইঢিবির বৃষ্টিভেজা মাটি, এই খনন–পর্বে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা শাদা শাদা উইপোকারা তাদের নিজস্ব রঙের মাত্রা নিয়ে ফুটিএ ওঠে এই প্রাকৃতিক ক্যানভাসে।
উই–মাটি ভর্তি বালতি নিয়ে ডানা পাশে অনেকটা হেলে অন্য হাত হাওয়ায় দুলিয়ে দুলিয়ে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে পিছল পথে হেঁটে যায় সুধাকৃষ্ণ। দু এক ফোঁটা আকাশজল তার মাথায়, শরীরের স্বেদবিন্দুতে ধীরে মেশে। পেছনে পেছনেই গামছা পরা রামকৃষ্ণ, হাতে লাল মাটি লাগা কাটারি এবং সেখানেও একটি দুটি উই। কিছুক্ষণ পর সুধাকৃষ্ণ বাঁ হাতে, রামকৃষ্ণ ডান হাতে ধরে নেয় বালতির হ্যান্ডেল। দু দিক থেকে। কাটারি ফেলা থাকে মাটির মাথায়। চলতে চলতে পরিশ্রমের ঘাম কপাল, নাকের পাটা, গাল ও বুক দিয়ে গড়িয়ে নামে। ধীরে, ধীরে।
বাড়ি ফিরলে ভুজা (মুড়ি) পাওয়া যাবে। আর সে ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে উপোসি পেটের ভেতর পাক মারে, মোচড় দেয় খিদের সাপ। মুখের ভেতর জল কাটে।
সবুজ গুঁড়িপানা ছাওয়া ডোবার পাশে এক ফালি উঠোন। তারপর মাটির উচু বারান্দা। চারিখানি ঘর, খড়ের চালের। এই ঘরেই মোক্ষদা চন্দের চার ছেলের জীবনযাপন। বড় বৃন্দাবন, মেজো সনাতন, সেজো হরিধন, ছোট মথুরা। বৃন্দাবনের দুই ছেলে রামকৃষ্ণ, সুধাকৃষ্ণ। বৃন্দাবনের বউ আবার পোয়াতি। সনাতনের এক মেয়ে ঝুমকা, দুই ছেলে হরিদাস, ভক্তদাস। হরিধনের দুই মেয়ে শিবানী আর শেফালি, ছেলে হরেকৃষ্ণ। আবার পোয়াতি হয়েছে হরিধনের বউ। মথুরার সবে বিয়ে হয়েছে – তার বউও পোয়াতি।
খড়ুইয়ে জীবনে এই যে ডালপালা, তার রঙ প্রায় সবখানেই এক। হাঁড়ির একটি ফুটে ওঠা চাল টিপেই যেমন ভাতের বর্তমান ও ভবিষ্যত বোঝা যেতে পারে, তেমনি খড়ুইয়ের মোক্ষদা চন্দ আর তার ছেলের পরিবার এই অঞ্চলে জীবন-যাপনকে নিয়ে এক টুকরো নিটোল ছবি-ই।
হঠাৎ মেঘভাঙা ধারালো আকাশ-আলোয় চোখ ধাঁধায় উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা মোক্ষদার। শাদা থানে মোরা তার দীর্ঘ, একহারা, মেদহীন, ঋজু চেহারা উঠোনে এক বড় সড় গাছের পাশে। রক্তহীন ফ্যাকাশে শরীর, চামড়া মোড়া হাড়েরা বেশ ফর্সাই। চুল পাকেনি। কিন্তু দু চোখে পাতলা মাছের আঁশ-ছানি পড়েছে। বেঁচে থাকা চার ছেলে, এক মেয়ে, আর মরে যাওয়া স্বামী সুধাকর, আর অন্য পুত্র কন্যাদের জন্যে মাঝে মাঝেই ইদানীং আকুলিবিকুলি মোক্ষদার। মন খারাপ, চোখে জল,। বহু সন্তানের জননী এই নারী হালফিল কিছু মাথার গণ্ডগোলেও। কথাবার্তায় অসংলগ্নতা।
বড় মাটির দাওয়া, ঘর, খড়ের চাল আর এই আকাশ ও সবুজের চালচিত্রে আঁকা মোক্ষদা। যেন বা গ্রাম-ভারতের আবহমান প্রতিমাই। শুধু থানটি গায়ে জড়িয়ে তাঁর দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের ‘পথের পাঁচালি’র ইন্দির ও চুনীবালাকে একসঙ্গে মনে করিয়ে দিতে পারে। আর আজও তো ইন্দিরেরা গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরেই, চেহারা বা সামাজিক ভুমিকাতেও। কেবল মোক্ষদার পাক না ধরা দীর্ঘ অথচ গুছি কমে আসা কেশমালা আর দুপাটির প্রায় অটুট সব দাঁত তাকে শারীরিকভাবে ইন্দির থেকে আলাদা করে রাখে।
এই চোখকে গোলমালে ফেলাকে ডান হাতের পাতার কার্নিশ কপালে ফেলে আটকাতে আটকাতে মোক্ষদা তাঁর দৃষ্টির ফ্রেমে মাঠ ও সবুজ ভেঙে ভেসে আসা দুই নাতিকে আবিস্কার করে, এদের নামও তারই দেওয়া। সংসারে আর কোনও সিদ্ধান্ত সেভাবে গৃহীত না হলেও নামেও ব্যাপারে সব খানেই কেমন যেন মোক্ষদার জিৎ। ভগবানের নামে নামে নাতিদের নাম। মরার সময় ঠাকুর ভুলে গেলেও ওদের নাম তো মনে থাকবে। তাই ধরে ধরে ডাকাডাকি করেই শেষ পারানির গুনে দেওয়া – এমনই বিশ্বাস মোক্ষদার।
নিজের জন্ম, স্বামীর মৃত্যু, ছেলে মেয়েদের জন্ম – মৃত্যু- সবেতেই মোক্ষদা এবং মোক্ষদারা দিন নির্ণয় করে কোনো বৃক্ষের পতন, নদীর বান, ঝড় অথবা মড়ক–এর দিনটিকে মাথায় রেখে। অর্থাৎ, ‘যেবার বড় খোকা হল, সেবার সিঁদুরে আমগাছটা মুখ থুবড়ে পড়ল ঝড়ে’ – এমনই ভাবনা–রেখা। নাতি–নাতনিদের বেলাও তাই। যদিও ওদের কয়েকজনের কাগজে–কলমে জন্মের হিসেব রাখা আছে ওদেরই বাবা–মার কাছে। মোক্ষদার ভাবনা তার ধার দিয়েও যায় না।
মোক্ষদা জানে দুই নাতি এখন এই উই মাটি ভিজিয়ে দেবে মাটি ভাঙা কলসির পেটের ভেতর। আর হ্যান্ডেলভাঙা, ফুটো লোহার কড়ায়। তারপর খাঁকি–কাঁকর বেছে বেছে চটকাতে হবে মাটি, পুতুলের জন্যে।
বৌ–রা এখন ঘর–দোর ঝাঁটপাট দিচ্ছে। দালানও। এখন আর নিজের কোনো ঘর নেই মোক্ষদার। গরমে দাওয়ায় শোয়া। বেশি বর্ষায় আর শীতে রান্নাঘরে। ভিজে মাটির ওপরেই ছেঁড়া মাদুর, কাঁথাকানি রঙ–চটা প্লাস্টিক বিছিয়ে।
এই ভোর থেকেই অনেক নিকাছিকা কাজ বাকি। সংসারে তিন বেলা খেতে গেলে কিছু কাজ তো করেই দিতে হয়। এমনকি ক’বছর আগে নিজের হাতে পুতুল গড়ত মোক্ষদা। চোখের মনিতে তখনও ঝাপসা সর পড়েনি।
দুই নাতি যেন বা ক্লোজ আপ শট–এ সামনে এসে মূর্তি হয়ে গেল মোক্ষদার ঝাপসা দৃষ্টির পর্দা জুড়ে। মোক্ষদা হেসে কিছু বলার আগেই তারা বালতি নামিয়ে ডোবার পাড়ে গুঁড়ি পানা ঠেলে জলে হাত–পা ধুয়ে ক্ষুধা– সংহার পর্ব। সংহার নয়, হয়ত শুধু প্রলেপই। তবু ভুজা আর ঠান্ডা জল এই গরম আর পরিশ্রমের পর অমৃত।
উঠোনে পুতুল গড়তে নেমে পড়েছে মথুরা। খালি গা রঙিন লুঙ্গি। কালকে তৈরি করা উই মাটিতে ঘোড়া গড়বে। আর হাতি, হরিণ, জগন্নাথ–বলরাম–সুভদ্রা, ঘোড়া–সওয়ার মানুষ, গণেশ, আংঠা (নাড়ু) গোপাল– সবই স্থানীয় ফোক–ফর্মে। পাকা হাতে ঘোড়া গড়তে লাগে মিনিট দশেক, গণেশের জন্যে পনের মিনিট। এক বিঘৎ মাপের বড় পুতুল তৈরি করবে ছেলেরাই। এই পুতুলে গালা রঙের দায়িত্বও তাদের। আঙুল তিনেক মাপের পুতুল বাচ্চারাও গড়ে নেয়। মেয়েরাও।
মথুরার আঙুলের চাপে টানে মাটি মূর্তি পাচ্ছে। ঘোড়া, গণেশ, হাতি…। এই পুতুল যাবে বারিপদায় সোজা রথের মেলায়। তারপর বাইশ দিন ধরে মেলা। মেলায় কত কী যে ! বিক্রি হয়ে যাবে পাঁচ সাতশো হাজার টাকার পুতুলও। তালপাতার পেটিতে বোঝাই পুতুল যাবে ট্রেনে। ফিরে আসবে নোট, পয়সা। আর মেলা থেকে কেনা প্রয়োজন–অপ্রয়োজনের জিনিস।
এগরা, পটাশপুরে দুর্গাপুজোর মেলাতেও শঙ্খবণিক পাড়ার গালা–পুতুল। মানুষ কেনে। আর সেই পৌষ সংক্রান্তিতে সরশষ্কার মেলায়। পঁচেটের রাসমেলাতেও কিছু বিক্রি আছে। তখন মাঠে মাঠে ধানকাটা শেষ। মানুষের হাতে কাঁচা পয়সা। কিছু কিছু যা হোক কিনে ফুঁকে দাও হে টাকা–পয়সা।
মোক্ষদার এখনও মনে পড়ে পঁচেটের সেই রাস – উৎসবে ‘যুগীযাত্রা’, ‘মাইনভজা’। সারা রাত ধরেই প্রায় হ্যাজাকের নিচে যাত্রার আসর। ‘- হায় যুগী, তুমি মুরে ছেড়ি দ্যাও। ঘর্যে ছ্যালেপুলে, সোয়ামি, শাউড়ি, উড়ি সব আছে মূর। ছেড়ি দ্যাও। পায়ে পড়ি, ও রাঙা চরণে পড়ি গ।’
যুগীযাত্রার সেই কথা, গান, রঙ, স্মৃতি আলো সবই মোক্ষদার মস্তিষ্কের খোপে খোপে। কিছু জীবন্ত, কিছু বা মুছে যাওয়া। সুধাকরের সঙ্গে রাত, রাতভোর। যাত্রার আসরে যুগী কিন্তু এত আকুল প্রার্থনাতেও ছাড়ে না তরুণীকে। আর সেই তরুণীর স্বামী যখন আসে যুগীর কাছে, যুগী তাকে বানিয়ে দেয় ডালকুত্তা। কুকুর হয়ে হতমান মানুষটি ঘুরে বেড়ায় দেশে দেশে।
আর ‘মাইনভজা’ – তেও সেই মামী–ভাগ্নে–রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। কথা–বার্তা বাংলায়। গানের ভাষা ওড়িয়া। কিশোরী, যুবতী মোক্ষদার কত রাত যে গানের সুরে সুরে ভোরের পথে।
চারপাশের গড়খাইয়ের ভেতর দাসমহাপাত্রদের রাজবাড়ি, রাসমেলা। পাতা রাসমঞ্চে এসে বসলেন রাসমাধব। তারপর আশপাশের অনেক বাড়ি থেকেই গয়নাগাটি পরা রাধারানীকৃষ্ণ। কেউ সোনার, কেউ রুপোর, কেউ বা পাথেরের। নাকাড়া, শাঁখ, ঢোল, কাঁসি। পতাকা, রুপোর দণ্ড কাঁধে বাজনাদার। তারপর দাসমহাপাত্রদের বাড়ির মানী মানুষেরা।
বাজি আর বাজি। শব্দ আলো। আকাশের গায়ে আগুনের আলপনা। রঙ, রোশনাই। আগুনের ফুল, মানুষের চিৎকার। আর যত বিঁধে যাচ্ছে আদিবাসী মানুষের নিগ্রো–অস্ট্রিক চামড়ায়। শোলার পাখি আর ফুলের ডিজাইনে। সবং–এর মাদুর আর গালা–পুতুলের গায়ে। রঙ শুষে নিচ্ছে রঙকে…
স্মৃতির ঝাপটায় কোন পেছনে চলে যায় মোক্ষদা। সুধাকরের পাশাপাশি বসে দেখা মেলা আর মেলা, দাসমহাপাত্রদের শিব মন্দির, অন্য মন্দিরের মাথায় সার সার পেতলের কলসি – এসবই তার দৃষ্টি–ঝাপসা দু চোখের তারায় উজ্জ্বল জলছবি আর ভাবতে ভাবতে বেদনার গভীরেই আবগাহন শুধু।
উঠোনে এখন হঠাৎ রোদের যে ফুলকারি, তাতে মোক্ষদা আবিষ্কার করে সনাতনের মেয়ে ঝুমকা, কাঠে ভাত রান্নার পর যে কাঠকয়লা, তা মাটির ভাঙা কলসির তলায় রেখে তার আঁচে পুতুল পোড়াচ্ছে। রোদে শুকনো উইমাটির পুতুল এমনিই লালচে। পুড়ে পুড়ে আরও লালাভ হবে।
এই অভাব এবং পরিবার পরিকল্পনাবিহীন যৌনতার ভেতরেও ঝুমকা একটু সরল। তার প্রথম ঋতুদর্শন –পর্ব শেষ। বুকে স্তন–ফুলের আভাস। ফর্সা গাল লালচে চুল এবং মুখের কিশোরী লালিমায় এক আশ্চর্য মায়া। ফিরে বসে থাকলে পেছন থেকেও তাকে বেশ সুন্দরই দেখায়।
ছিটের লালচে ফ্রকের পিঠে বোতাম নেই। ভেতরে টেপ জামাও না। ঝুমকার ক্লাস সেভেন। পুতুলের সিজন। তাই যাওয়া নে। গালার লম্বাটে রঙিন টুকরো বাঁশের সরু ফাঁপায় গেঁথে একটু ঝুঁকে নিভু কাঠকয়লার আঁচে–কামড়ার আটকানো একটি পোড়ামাটির পুতুল।
আঁচে পুতুলটিকে গরম করতে গিয়ে ঝুমকা আরও ঝোঁকে। তার কানের পেতলের মাকড়িতে, ময়লা লাগা ফরসা ঘাড়ে মেঘলা আলো আটকে থাকে। দু হাঁটুর কাছাকাছি চলে আসে থুতনি এবং স্তন–ফুলের যে আতাস তার বৃন্ত হঠাৎ ছুঁয়ে যায় জানু। আর তখন কিছু শিহরণও।
বসার পিঁড়ি ছিল না। ফলে ঝুমকাকে তার নিজস্ব বিন্যাসে শরীর খেলিয়ে নিতে হয়। নিভে আসা কাঠকয়লার আগুন জলে ওঠে, খর হয় বাঁশের সরু চোঙা–লোলির ভেতর দিয়ে আসা ফুঁ–য়ে।
রঙিন গালা আগুনের স্পর্শে সুতোর চেহারা নেয় ধীরে। স্থানীয় ভাষায় নাম গুনা। এবং এই গালারা ক্রমাগতই তাদের গুনা ও রঙের ডিজাইনে পুতুলকে অলঙ্কৃত করতে ক্ষয়ে যায়।
কালো গালাতে ঘোড়া রঙ করে তার গায়ে জাল ও হলুদ গুনায় নকশা ফুটিয়ে তুলছে ঝুমকা। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছিঁড়ে ফেলতে চায় মোক্ষদাকে তার কৈশোরে, যৌবনে, পুতুল গড়ার দিনগুলিতে। কালো দিয়ে শুধু পুতুলের নিচেটুকু। আর ওপরে টকটকে লাল, হলুদ, সবুজ। এখন নাকি গালার দাম অনেক। আট-দশ টাকা সেরের গালা একশো টাকা কিলো। কীভাবে চালাবে পুতুল – কারিগর ! একটা পুতুল তো মেলায় বিক্রি হবে বারো আনা থেকে, বড় জোর তিন-চার টাকায় ! এভাবে পোষায় !
আর এমন ভাবনার ভেতর দিয়েই মোক্ষদা দেখতে পেল ছায়া ছায়া বারান্দায় বেশ বড়সড়, এবড়ো– খবড়ো শিল পেতে সেজো ছেলে হরিধন আর তার ছ মাসের পোয়াতি বউ সরলা শাঁখার আংটি ঠিক করার কাজে লেগে পড়েছে।
রোগাসোগা হরিধনের খালি গা, আট হাতি ছোট ধুতি গুটিয়ে পরা। এবং তা কিছু ময়লা ও বর্ষাজনিত দুর্গন্ধ–আক্রান্ত। জল দাও এবড়ো–খেবড়ো শাঁখের আংটি ঘষে ঘষে সমান কর। হরিধন প্রবলভাবে শাঁখের কাটা ফালি ঘষে যায় শিলের ওপর। কখনও উবু হয়ে, কখনও বা বাঁ পা–টি পিছনে সরিয়ে, ডান–পা সামনে এনে দেহবিন্যাসে তৈরি করে নিতে চায় কাজের সুবিধে।
সরলা, হরিধনের একটু ভারি হয়ে আসা বউ জলের ছিটে দেয় শিলের ওপর। আবার পরিশ্রম এবং ক্লান্তির শব্দ উঠে আসে। ক্রমাগত একই সুরে। মেঘলা মতন আলো হরিধনের শিরদাঁড়ায়, সরলার ভারি হয়ে আসা স্তন, পেট ছুঁয়ে মাটিতে নামে। কখনও বা তার গভীর চোখের কালো তারায় হারিয়ে যায়।
সরলা–হরিধনদের সংসারে এখন রান্নার তদারক করে বড় মেয়ে শিবানী। ‘ভাই হবে বলে’ সাময়িকভাবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখে। রান্নাঘরের আর অন্যান্য সাংসারিক পরিশ্রমের কর্ত্রী হয়ে ওঠে। ঝুমকার থেকে এক বছরের বড় শিবানীর মুখে ইদানীং প্রায় সময়েই এক টিপ টিপ রহস্যলেখা খেলা করে বেড়ায়। ‘ভাই কেন হয়’ – এমন নিলাজ প্রশ্ন ও উত্তরটি তার করায়ত্ত। এই যৌন শাসনহীন পারিবারিক স্থাপত্যে বিষয়টি সহজেই ‘পাবলিক’ হয়ে ওঠে।
শিবানী বড় এক ঘটি জল ও বাতাসা এনে রাখে বাবার জন্যে। পরিশ্রমী হরিধন এই মুছে যাওয়া আলোয় তার বড় কন্যেটিকে দেখে বুক ভরে তৃপ্তির নিশ্বাস টানে। তারপর বাতাসা ও জলের সাময়িক বিরতির পর আবার শাঁখ–পাথরে ঘষাঘষির শব্দ এই প্রায় নির্জন চরাচরে দু–একটি পাখির ডাক বা পাতা পড়ার ধ্বনিকে ছিঁড়ে দিতে দিতে মেঘের গায়ে মিশে যায়। সরলার জন্যে বাতাসা থাকে না। জল, শুধু জলই।
আর এভাবেই কোনো প্রাচীন বৃক্ষের পাশে প্রাচীনতর বৃক্ষ হয়ে যেতে যেতে মোক্ষদা তার প্রায় সমস্ত পরিবারেরই জেগে ওঠার পর কর্মকান্ডের, ভাত–ভুজা যোগাড়ের নানা অভ্যাস দেখতে দেখতে এই মাটির গভীরেই যেন শিকড় চারায়। তার দৃষ্টি কমে আসা চোখের মণিতে কোনো পাঠ–অভ্যাসের রেখা ফুটে ওঠে না। পেটের ধান্দা করতে করতে স্থানীয় একটি প্রবাদ–‘অ–আ–ক–খ / মা ডেকেচে ঘর চ’ – অমোঘ সত্যি হিসেবে এই ঘর, এই কর্ম –ব্যস্ততা, এই মেঘলা–আধাঁরের ক্যানভাসে ধারাবাহিক চিত্রমালায় এক অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
দুই
তারা দুজনে হাওড়া থেকে খড়্গপুর এসেছিল ট্রেনে। তারপর খড়্গপুর থেকে এগরা এসেছিল বাসে। ভাড়া ৫ টাকা ২০ পয়সা। তারপর এগরা থেকে খড়ুইবাজার। বাসভাড়া ৬০ পয়সা।
আকাশে মেঘলা মতন আলো এবং কখনও-সখনও বৃষ্টির পতন তাদের শহুরে শরীর, জিনস, বর্ষার ডাকব্যাক জুতো, ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডারের ব্যাগ, ডট পেন, নোট বই, আর জোরে হাওয়ার ঝাপটা এলে ফোল্ডিং ছাতা ঢাকা মাথা দুটিও ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
খড়ুইয়ের গালা–পুতুল আর তার শঙ্খবণিক শিল্পী চন্দরা যখন প্রায় ক্ষয়িষ্ণু স্পিসিস – এমন একটি খবর এই দুই শহুরে উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসা ‘ফ্রি লান্সার’ –কে উৎসাহিত করে। আর এখন সারা দেশ জুড়েই তো ক’দর ফোক আর্ট, ফোক কালচার, ট্রাইবাল সমস্যা – উৎসব, যৌনজীবন, হরিজনের ঘরপোড়া মুখের ভয় – আক্রান্ত ছবি। ভালো বাণিজ্য হয়। নানান কাগজের খাদ্য অনুযায়ী – যা কিনা সভ্য ভাষায় এডিটোরিয়াল পলিসি – একই মশলা বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি মাফিক সাজিয়ে দিতে পারলে ‘নগদনারায়ণ’ – এর অভাব হয় না।
ঘরপোড়া হরিজন রমণীর হাহাকার এবং তাদের অস্ট্রিক স্তন আর্ট ফিল্ম আর দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিকের একঘেয়ে রান্নাঘরে ভালো গরম মশালা। রঙিন দারিদ্ররেখায় ঢালাও অফসেট, সেলুলয়েড বাণিজ্য।
এই দুজনে–সবে তিরিশ পেরনো দীপন ও সৌরভ বিষয়টি সরল সত্যের মতোই ধরতে পেরেছে। ফলে দীপন তার নিকোম্যাট, অলিমপাস, কে থাউজেন্ডে রোলের পর রোল কালার ট্রান্সপারেন্সি এক্সপোজ করে। সৌরভ টেপ রেকর্ডার ও নোটবুকে আধুনিক সব্যসাচী। মন্দির, মসজিদ, কাঁচা রাস্তা বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত স্কুল পেরিয়ে হন্টনই শধু।
শঙ্খবণিক পাড়া, গালার পুতুল তার অবস্থান কী এই মেদিনীপুরে, পশ্চিমবাংলায়, ভারতবর্ষে ? অন্তত যেসব স্থানীয় মানুষের কাছে প্রশ্ন করা হয় – এ বিষয়টি নিয়ে, তাদের উত্তরে চোখের দৃষ্টিতে যেন এরকমই একটা পাল্টা প্রশ্নমালা।
এবং তারপর অনেক মাঠ, কাদা, ঘরবাড়ি, গোরু, বাছুর, সবুজ পেরিয়া মেঘলা ছায়ার নিচে মোক্ষদার পরিবারের কাছে।
এখন প্রায় বিকেল বিকেল। দুপুরের মেঘভাঙা রোদ মাঝে মাঝেই উকি দিয়ে যায়। দীপন আর সৌরভ তাদের এরকম নান ‘কাজ’ –এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সহজেই এ পরিবারের মেঘলা বারান্দায় চৌকির ওপর বসার অনুমতি পায়।
তারপর উঠোনে ঝুমকা, সুধাকৃষ্ণ, মথুরা – সারাদিনের বা আবহমানের পুতুল তৈরির ড্রেস রিহার্সালটি যেন বা স্টেজে দেখায়। গণেশ, জগন্নাথ, বলরাম – সুভদ্রা এবং ঘোড়সওয়ার।
দীপন লাইট মিটারে আলোর গভীরতা মাপে। ক্যামেরা সাজায়। ঝুমকার ফ্রকের ফাঁকে লেগে থাকা খালি পিঠ তাকে আরও বেশি বেশি ট্রান্সপারেন্সি – উদ্বুদ্ধ করে। মোক্ষদা, মথুরা, সনাতন, হরিধন বা অন্যান্যরা কখনও টেপ রেকর্ডারে, কখনও বা নোট বইয়ের ফাঁদে ধরা পড়ে।
নানা রকম মলাট, হেডিং ক্যাপশান ভেসে বেড়ায় দীপন ও সৌরভের সামনে। কাগজ অনুযায়ী মশালা। কোথাও ফোক–আর্ট, কোথাও দারিদ্র, সামাজিক বিন্যাস, শোষণ। কোথাও বা এখানকার নারীরা কেন এত উর্বর- বছর বিয়োনি, এমন সমীক্ষার নাম করে রঙিন যৌনতা। নানান মাপের স্টোরি, সেই অনুযায়ী পেমেন্ট।
হে ভারতবর্ষ, গ্রাম–ভারতে, তুমি এভাবেই ছুঁয়ে থাকো দারিদ্র। হতাশা, বঞ্চনা, শোষণ। হরিজনের ঘর পুড়ুক, আদিবাসী রমণী ধর্ষিতা, অপমানিতা হোক। আদিবাসী শিশু, পুরুষ, রমণী হয়ে থাক দায়বদ্ধ শ্রমিক। তার ‘স্বাধীনতা’, ‘চাকরির কোটা’ – সবই ছাপা থাক কাগজে–কলমে। আর আমরা সভ্যতার মুখশ্রী সংবাদপত্রে, সাময়িকপত্রে আর্টফিল্মে – এসব নিয়ে তুমুল বাণিজ্য করি। যত ঘর পোড়ে, তত ভালো ছবি। যত অনাহার অশিক্ষা, তত ভালো স্টোরি। রঙিন টি, ভি, টুথপেস্ট বা কনডমের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ক্রোড়পত্রে কালাহান্ডির খরা, বাঘৌরা, দালালচকের বর্ণহত্যা, আওরঙ্গাবাদে ভুমিসেনার প্রতাপান্বিত গণখুন। রঙিন বিজ্ঞাপন, রঙিন ছবি, রঙিন ক্রোড়পত্র – আহো মজা, কেয়া মজা।
এসব ভাবনার ডালপালা মেলে দিতে দিতে সৌরভ, দীপন দারিদ্র্যরেখাকে রঙিন করে ফুটিয়ে তোলার পরিকল্পনায় তাদের মস্তিষ্ক ও হাতের ব্যায়াম চালায়। ঝুমকার যৌবন–কুসুম, মোক্ষদার বার্ধক্য, শিশুশ্রমিক সুধাকৃষ্ণ – রামকৃষ্ণ,পারিবারিক বৃত্তির প্রতি সামন্ততান্ত্রিক আনুগত্যে থাকা সমস্ত চন্দ, চন্দরা – আলাদা আলাদা স্টোরি এলিমেন্ট হিসেবে নিজস্ব ভঙ্গিতে লিপিবদ্ধ, টেপবদ্ধ, ক্যামেরাবন্দী হতে হতে সময় অনেকটা বয়ে যায়।
ঐ দাওয়ায় চৌকিতেই ভুজা আর ছোলাভাজা। কাঁসার ঘটিতে জল। তারপর তাল ও খেজুর পাতার প্যাঁটরায় ন্যাকড়ার ভাঁজে ভাঁজে বন্দী যে আশ্চর্য গালা–পুতুলেরা, তাদের কিনতে চায় দীপন সৌরভ। নিজেদের সংগ্রহ তো বটেই। আর ছোট–বড় নানা কাগজের নিউজ এডিটর, ম্যাগাজিন এডিটর, মালিককে উপহার। স্টোরি – ছবির সঙ্গে ফাউ। আট আনা, বারো আনা, থেকে তিন/চার টাকার মধ্যে–মাপ আর রঙ অনুযায়ী। মেঘলা বিকেলের আলোয় তাদের গালা–রঙে চিকিমিকির আশ্চর্যময়তা।
একটিই হরিণ ছিল হরিধন–পরিবারের প্যাঁটরায়। আর কারোর কাছেই না। হলদের ওপর কালো ফুটকি ফুটকি–লাল শিং। চারপায়ে গতির মায়া। হরিণটি কিনতে চায় দীপন। দিতে রাজি হয় না কচি হরেকৃষ্ণ। বায়না করে। গোঁ ধরে। কাঁদে।
তার আগে চন্দ–পরিবারের সকলেরই নিজস্ব প্যাঁটরা থেকে পুতুল বেচার তাড়া। এবং ক্রমাগত গছাবার তাগিদে কেমন যেন আদেখলে ভিখিরিপনা। দীপন ও সৌরভের বিলিতি সেন্টের গন্ধমাখা জামা, ভারি মানি ব্যাগ – সবই এই দারিদ্র–খনির কাছে ধীরে টোপ হয়ে ওঠে। – ‘বাবু একটা পয়সা দাও গো’ –র বদলে একটা পুতুল কিছুটা যেন বিপন্নই করে তোলে। গলায় আটকে থাকে আতিথেয়তার ভুজা, ঘটির ঠান্ডা জল।
নিজেদের একস্ট্রা প্লাস্টিক ব্যাগে গালার – পুতুল সাজিয়ে নেয় দীপন, সৌরভ। আশেপাশে কিছু বাজে কাগজের গোঁজা।
একটি কাচের চৌকো চিমনি ঘেরা আলোয় – যেন বা কলকাতার কোনো প্রাচীন গ্যাস পোস্টের আলোর ঢাকনির মায়া সেই হ্যারিকেনে, নিজের দুপায়ের গোছ আর মাটির রাস্তার সামান্যটুকু আলোকিত করতে করতে শিবানীর ছোট বোন শেফালি তাদের–সৌরভ, দীপনকে খড়ুই বাজার থেকে বাসে ওঠার শর্টকাট রাস্তাটি দেখানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। তার অন্য হাতে একটি ছোট থলে।
গোটা পঞ্চাশ টাকার পুতুল কেনে দীপন–সৌরভ। চন্দরা ভাগ করে নেয় সেই টাকা। হরিধন শাঁখ – ঘষা পর্ব শেষ করে, থলি নিয়ে আরও আলো থাকতেই খড়ুই বাজার অভিমুখী। সম্ভবত কিছু সওদা আসবে। এবং সে অপেক্ষা করবে শেফালির জন্যে। তারপর ঐ আলোয় আলোয় ফিরে আসবে পিতা ও কন্যা।
দীপন–সৌরভের যাত্রাসঙ্গী বাস স্ট্যান্ড অভিমুখী শেফালি এই পুতুল কেনা–বেচায় তেমন ভূমিকা নিতে পারেনি। কিন্তু চলতে চলতে তার এই সহজ কিশোরীছন্দ এই দুই শহুরেকে অন্য তৃপ্তি দেয়।
আমাদের আবার ভাই হবে বলে দিদি স্কুলে যায় না – এমন সত্যটি শেফালি বড় অক্লেশে বলে। আর তারপর সহজ ভঙ্গিতে নিজের পিসাবাবুর কিস্যাটি শোনায়। স্থানীয় ভাষার খোল ভেঙে তাকে বের করে আনলে, বিষয়টি এরকম।
প্রথম বৌকে কেটে ভাসিয়ে দিয়েছিল পিসাবাবু পুকুরে। তখন তার দুই ছেলে, এক মেয়ে। আমার পিসিকে বিয়ে করল পিসাবাবু। পিসি তখন এতটুকুন, বাবার কাছে শুনেছি। সা–জোয়ান পিসাবাবুর ইয়া তাগড়া চেহারা, চওড়া মোচ। কী খেতে পারত বাবা। তারপর পিসিরও দুই ছেলে … এক মেয়ে…।
বালিকা অথবা কিশোরীর হাতে লন্ঠন দোলে চলার ছন্দে। সামান্য আলো পথটুকু আলোকিত করতে না করতেই তার দু পায়ে জড়িয়ে যায়। দীপন ও সৌরভ টর্চ বার করবে কিনা ভাবে, তারপর থেমে যায়।
শিবানীর ময়লা মতো গায়ের রঙ, কিশোরী বা বালিকা চোখের নিবিড় কৃষ্ণরেখা ততক্ষণে বাজার দীঘি টপকে আকাশের মেঘে মিশে গেছে।
পিসাবাবু তাড়িয়ে দিল পিসিকে। পিসি এখন কলকাতায় বাবুদের বাড়ি রান্না করে। এই রথে আসবে। প্রতিবারই আসে। আবার বিয়ে করেছে পিসাবাবু …। আর এই বর্ণনায় সাময়িক যতি টেনে, ছোট ব্যগটি হ্যান্ডেল গলিয়ে কনুয়ের ভারে ঝুলিয়ে হাতের বিশেষ মুদ্রায় কোনো কাঁচির আভাস দেখিয়ে, চোখে দাঁতে হাসি ও কৌতুকের রহস্যময় ক্ষণ – বিদ্যুৎরেখা টেনে বলে, তারপরও পিসাবাবুর বাচ্চা হয়েছে। খি–খি, হি – হি। কিশোরী, বালিকা অথবা যুবতী হাসিতে আকাশ, মাঠ, চরাচর ভাঙে।
দীপন এবং সৌরভও হয়ত বা একটু নার্ভাস হয়েই সিগারেট ধরিয়ে ফেলে। তাদের শহুরে খোলামেলা আড্ডা, টিভি বা সফট এবং হার্ড পর্নোকে ছাড়িয়ে শেফালির এই পিসাবাবুর – কিস্যা মাথার ভেতর ঝিম নেশা এঁকে দেয়।
ভেসকটমির পর পিসাবাবুর ছেলে হয়, এই সহজ তথ্যে, স্বাভাবিক রসিকতায় তাদের নাগরিক সত্তার আমুল নড়ে ওঠে। আর আকাশে তখনই মুহূর্তের জন্যে দু–এক ফোঁটা জলে বৃষ্টির আগাম সংকেত দেয়।
কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে খড়ুই বাজার কাছাকাছি। সেখানে আলো ও জটলা। শব্দের ধ্বনি – প্রতিধ্বনি।
থলের ভেতর থেকে খুব সহজভাবে সেই হরিণটি বার করে শিবানী। তারপর লন্ঠনের আলোয় তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পণ্য করে তোলে। যেমন সস্তা গণিকা পল্লীর মৃত–মাংস নারীরা তাদেরই মাংসে কুপি অথবা হ্যারিকেনের আলো ফেলে ফেলে …।
অবাক হয়ে দীপন ও সৌরভ হরিণ দেখে। শেফালির চোখেও কী আকুতি। ওগো নাও – হরিণ নাও।
কেরোসিন – আলোয় তার চারপায়ে ছুটে যাওয়া। হলুদ শরীরে কালো ফুটকির বিদ্যুৎ এবং রক্তাভ শিঙে আদিমতা, আদিমতাই। অথচ কী মায়া জানে!
সেই রোরুদ্যমান বালককে মনে পড়ে এবং চন্দ পরিবারের পুতুল–প্যাঁটরা গুলি। একি তবে শেফালির গোপন রোজগার ? দীপন সৌরভ অন্ধকারে এ ওর মুখ তেমন স্পষ্ট দেখতে পায় না। এবং শেফালিও অনেকটাই মুছে যাওয়া ছবি। পাঁচ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় সৌরভ অথবা দীপন। তার কম তাদের হাতে ওঠেনি। হরিণ হাত বদল করে।
শেফালির কাছ থেকে পয়সা ফেরত পাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। ভিখিরি কি কিছু ফেরত দিতে পারে ? দারিদ্র্যের অন্ধকার যে সব খেয়ে নেয়।
খড়ুই বাজারে এগরার বাস তখন হর্ন দিচ্ছে।
[ গল্পটি প্রমা, শারদীয় ১৯৮৭ তে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকের আনুমতিক্রমে ‘গল্পের সময়’-এ প্রকাশ করা হল।]
Tags: কিন্নর রায়, গল্প, রঙিন দারিদ্ররেখা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।