বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় যে যত পড়ে, সে তত মূর্খ হয় – কলেজ স্ট্রিটের দেওয়াল থেকে উড়ে এসে যখন আমাদের বালুরঘাট কলেজেরও দেওয়ালে ফুটে উঠল, তখন যে ঝাঁকটি বেরিয়ে পড়ল গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরতে, আমি ছিলাম তাদেরই একজন। আমি অবশ্য তখন ছাত্র নই। বুর্জোয়া কেমিস্ট্রি অনার্সের বুর্জোয়া সাম্মানিক স্নাতক। মা – বাবা গত, দাদার সংসারে বেকার ভাইটি। এমএসসি পড়ব কী, বুর্জোয়া শিক্ষায় ! চক্কর দিচ্ছিলাম, আজ শিলিগুড়ি, কাল সোজা শ্যামবাজার। কলেজ স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিটের দু – একটা মেসে আমার ঠেক ছিল। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, কিন্তু একটু – আধটু লিখতাম। গল্প। নতুন গল্প, শাস্ত্র বিরোধী – এসবের খোঁজ–খবর ছিল। ওই কায়দা ফলিয়ে দু–চারটে গল্প আমার তখন বের হয়েছিল সংক্রান্তি, নিষাদ, গল্পসরণী এসব লিটল ম্যাগাজিনে। আমার কলকাতার বন্ধুরা ভাস্কর, তুষার, সুব্রত, কৃপাসিন্ধুরা কবিতা লিখলেও, জীবনে একটাও পদ্য লিখিনি আমি। তো, এসে গেল চলো–চলো গ্রামে চলো-র সময়। হাওয়া বাতাসের কী একটা ঘুরপাক দিয়ে উঠেছিল সে– সময়। পার্টি বলেছিল, এটা রেখে দাও। বুদ্ধিজীবী কমরেডেরও নিরাপত্তা দরকার। কাগজে মুড়ে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। দাদা – বউদির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ ছিল না। কিন্তু একদিন অকারণে বউদি আমার ড্রয়ার ঘাঁটতে গিয়ে মেশিনটা দেখতে পেয়ে আঁতকে চোখ কপালে তুলল। তারপর ধাতস্থ হয়ে সারা পাড়া মাথায় করে সে কী বিলাপ – ‘তুমি কি তোমার দাদার হাতে হাত–কড়া পরাবে !’ তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম – কমিউনিস্ট হওয়ার একটি প্রাথমিক ও আবশ্যিক পদক্ষেপ, গৃহত্যাগ।
যাদের গা থেকে ছাত্রগন্ধ যায়নি, সে দলে আমি ছিলাম মৃদু অগ্রজ। তাছাড়া কলকাতা যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আছে আমার। পার্টি আমাকেই বলেছিল, নিয়ে যাও। নর্থ বিহারগামী চারজনের দলটিকে আগলে নিয়ে আমিই বালুরঘাট থেকে কলকাতাগামী নৈশবাসে উঠি। ১৯৬৮ সালের বিজয়া দশমীর সন্ধেয়। অদূরে আত্রেয়ী তীরে অনেক ঢাক বাজছিল। লিলি এসেছিল বাসস্ট্যান্ডে। ওকে বলেছিলাম, চিন্তা করো না। খোঁজখবর দেওয়ার চেষ্টা করব। ঠিক ফিরে আসব একদিন। মন বলেছিল, আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে !
ধর্মতলা পৌঁছে সময় খরচ করতে আমরা দুটো দলে ভাগ হয়ে ওই চত্বরের সিনেমা হলে ম্যাটেনি শো, ইভিনিং শো–তে হিন্দি ছবি দেখি। কী ছবি মনে নেই। আসলে ঢুকেছিলাম তো। রাতে হাওড়া থেকে নর্থবিহার এক্সপ্রেস ধরি। আমহার্স্ট স্ট্রিট মেসের বিজু আগেই টিকিট কেটে রেখেছিল। সে–ই জানিয়েছিল, আসানসোলে আরও দু–জন কমরেড যোগ দেবেন।
অনেক রাতে ট্রেন আসানসোল পৌঁছোতে, ও হরি ! দু–জনের একজন তো মোরব্বা। ‘আরে মোরব্বা’ – উল্লাসে আমি চেঁচিয়ে উঠতেই, সে চোখে – মুখে নিষেধের ভঙ্গি করে। ট্রেনের সিটের নিচে ব্যাগ ঢুকিয়ে আমাকে বাথরুমের দিকে টেনে নিয়ে বলে, ‘খবরদার এখন থেকে আমার আসল নাম কখনো বলবি না। আমি এখন ‘সবুজ’। শুধু ‘সবুজ’।
এরকম নাম বদলানো, ছদ্মনাম – এসব আমাদের পার্টিতে হরবকত। আমিও কি তখন জানতাম, সেই যে আমাদের পার্টির সেক্রেটারিয়েটে ছিলেন খোকন সমাজদার, তিনি আসলে আবদুল আজিজ, আসামের করিমগঞ্জ থেকে শিলিগুড়িতে এসেছিলেন। কিংবা চন্দননগরের ভট্টাচার্য বাড়ির জয়ন্তদা, সবাই তো তাঁকে জানত ‘মৈনুদ্দিন’ নামে। মোরব্বা বলায়, মনে হল কী যেন ওর ভালোনাম, ভুলেই গিয়েছিলাম। ‘মোরব্বা’ নামটা আমিই দিয়েছিলাম। সিউড়ি থেকে ফি বছর আসত মায়ের সঙ্গে বালুরঘাটে মামারবাড়িতে। স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটিতে, পুজোর ছুটিতে। মিলন সংঘ ক্লাবের মাঠে আমরা দুই বালক একসঙ্গে সাইকেল চালানো শিখেছিলাম। ওর মা কৌটো ভরে নিয়ে আসতেন বিচিত্র সব মোরব্বা। কুমড়োর মোরব্বা, পেঁপের মোরব্বা, গাজরের মোরব্বা, শতমূলী মোরব্বা। শেকড়ের মোরব্বা খেয়ে বড়োই আশ্চর্য হয়েছিলাম। সেই সূত্রে ওকে আমরা ‘মোরব্বা’ বলে ডাকতাম। ক্লাস এইটে আত্রেয়ী এপার – ওপার করে আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল মোরব্বা।
সেই মোরব্বা আমাদের সঙ্গে ট্রেনে ! আমার বিপুল আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু সে উল্লাস দেখানো চলবে না। দূরের ট্রেনে যাচ্ছিলাম, কেন যাচ্ছি, কী উদ্দেশ্যে তা নিয়ে যাতে কারো কোনো সন্দেহ না হয়। সে–জন্য কৌশলও তৈরি ছিল। আমাদের সঙ্গে ছিল বালুরঘাট পলিটেকনিকের যে হিন্দিভাষী ছাত্রটি, কমরেড রামাশ্রয়, আমরা তার বন্ধুরা যেন চলেছি তার বিয়েয়, তার দেশের বাড়িতে। বিবাহের একটি নিমন্ত্রণপত্র সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল হিন্দিতে কিষেণগঞ্জ থেকে ছাপিয়ে। ট্রেনে রামাশ্রয়কে বিয়ের ব্যাপারে মাঝে–মাঝে ঠাট্টা ফুক্কুড়ি করছিলাম – সহযাত্রীরা যাতে কোনো সন্দেহ না করেন। তা সত্ত্বেও একজনকে যেন কেমন–কেমন লাগছিল। মাঝবয়সি, হাওড়া থেকে ওঠা ভদ্রলোক হাসি–হাসি মুখে নানারকম তত্ত্বতালাশ করছিলেন আমাদের। কে কী পড়াশুনো করি, বালুরঘাটে কোথায় থাকি ? বিশেষত আমাকে ঘিরেই তাঁর অধিক কৌতহল। কেননা হংস মধ্যে বকের মতোই লাগছিল আমাকে। আঠারো–কুড়িদের ভেতর চব্বিশ। অনেক রাতে ট্রেনে যখন আমাদের কয়েকজন ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে, তখন দেখলাম লোকটা ছোট্ট নোটবুকে কী যেন লিখছে। ব্যাপারটা সন্দেহজনক মনে হল। লোকটা সত্যিই ডাবর কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ ? মুঙ্গের যাচ্ছে ?
যাক, শেষ পর্যন্ত কিছু ঘটেনি। বেগুসরাইয়ের আগে আমরা অবশ্য হাতিদা স্টেশনে নেমে পড়লাম। পার্টি বলেছিল, ওই স্টেশনেই নামতে। আমাদের নিতে এসেছিলেন কমরেড কেপি। কৃষ্ণপ্রসাদ মিশ্র। পরে মিশিরজি নামে জাহানাবাদ, ভোজপুর জেলায় বিখ্যাত হয়েছিলেন। হাতিদা স্টেশনেই কমরেড কেপি–কে বলেছিলাম ট্রেনের এই অতি কৌতূহলী সহযাত্রীটির কথা। শুনে কেপি বললেন, হতে পারে আপনাকে মার্ক করেছে। আপনাকে অন্য কোথাও শেলটার দিতে হবে। গোটা দলটার সঙ্গে, মোরব্বার সঙ্গে, আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল পরদিন। বাসে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল পাটনা।
তারপর পাটনায় আমি কোথায় ছিলাম, কতদিন ছিলাম, কতদিন পর কলকাতায় ফিরলাম, কলকাতায় ছিলাম কোন শেলটারে – সেসব বিস্তারিত বলার দরকার নেই।
১৯৭০ সালের মার্চ মাসে উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর জেলায় ভূস্বামীদের হাভেলিতে কৃষকেরা অগ্নিসংযোগ করেন, লুঠ করেন শস্যভান্ডার ও অস্ত্রশস্ত্র। উভয়পক্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হন। পার্টি বলেছিল উত্তর প্রদেশের কৃষকদের অভ্যুত্থান–আকাঙ্ক্ষা বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে দিতে। এই উদ্দেশ্যে আমি রওনা হই।
ওই বছর ৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় বিহারের ভোজপুরে আরা শহরের পাকরি চকে এক সংঘর্ষে (আমাদের ভাষায় ফেক–এনকাউন্টার) আমাদের চার কমরেড শহিদ হন। ৭ এপ্রিল ট্রেনে মোকামা রেল স্টেশন থেকে কেনা পাটনার হিন্দি দৈনিক জাগরণ–এ নিহত চারজনের ছবিতে বিহারের তিনজনের নামের পর অজ্ঞাত পরিচয় চতুর্থ জনকে তৎক্ষণাৎ চিনে ফেলি, মোরব্বা ! আমাদের মোরব্বা ! ট্রেনেই আমি হাহাকার করে উঠতে পারতাম; কিন্তু পার্টি আমাদের দুঃখ, শোক, কষ্ট–এসব নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিয়েছিল। সে – সময় মোবাইল তো নয়ই, টেলিফোন করারও তেমন সুবিধা ছিল না। উত্তর প্রদেশের জালাউন শহরটি থেকে কীভাবে মাসাধিক কাল পরে মোরব্বার মৃত্যুসংবাদ তৎকালে ভ্রাম্যমাণ পার্টি নেতৃত্বকে জানিয়েছিলাম, তাও বিস্তারিতভাবে জানানোর দরকার নেই। পার্টি বলেছিল, মোরব্বার মৃত্যুসংবাদ গোপন রাখতে।
মোরব্বা জীবিত, সে বেঁচে আছে। পার্টি চেয়েছিল। আমি পার্টির সেই চাওয়া হাসিল করে চলেছি।
Abhinandan.
amake ki Mone Pare?
Bidisha.
এই তো গত বছর যেদিন ফোনে রামকুমার জানাল, আমার শেষ চিঠি ও অন্যান্য চিঠিপত্র উপন্যাসটি এবারের সাহিত্য অকাদেমি পেয়েছে, তার ঘন্টা খানেকের মধেই ই–মেলে পেলাম এই অভিনন্দন বার্তা। আমি, চিরন্তন বসু যে ধরনের লেখালিখি করি, তাতে আমাকে ঠিক জনপ্রিয় লেখক বলা যায় না তবে একটা পাঠক-পাঠিকা মহল আছে যাঁরা জনপ্রিয় লেখকদের তেমন পাত্তা দেন না, তাঁরা আমাকে নিয়ে ঈষৎ নাচানাচিই করে থাকেন। তাঁরা সংখ্যায় দুশো – তিনশো হলেও, তর্কপ্রিয় বাঙলি দলের। এ দলের কয়েকজন প্রাবন্ধিকও আছেন যাঁরা গত কয়েক বছর আমার গল্প উপন্যাস নিয়ে প্রবন্ধ–ট্রবন্ধ লিখছিলেন। সভা–সমিতিতে আমি খুব একটা যাই না। কলকাতায়ও খুব একটা নয়। বাইরে, এমনকী পাড়াতেও আমাকে লোকে মনে করে খুব গম্ভীর। শুধু লিলি আর আমাদের মেয়ে শিঞ্জিনী জানে এই বাষট্টি – তেষট্টি বছর বয়সেও আমি কতটা ফাজিল। ই-মেল পেয়েই মেয়েকে ডাকলাম, দ্যাখ, দ্যাখ, তোর মা আমাকে কী মনে করে, অ্যাঁ! মেয়ে বলল, ইল্লি, তোমার ফ্যান! মেয়েটাকে ডাকো একদিন, কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে আসুক। দেখে মা জ্বলুক। গজগজ করুক। সই করে বই দাও। বাপ-বেটির উল্লাসে লিলি ছুটে এসে ই-মেল দেখে বলল, ঢং! শিঞ্জিনী বলল কলকাতায় বইমেলায় সেই যে মেয়েটা অটোগ্রাফ নিল, তুমি নাম জিগ্যেস করলে, সেই মেয়েটাই নয় তো? সেই জন্যই হয়তো লিখেছে, মনে আছে আমাকে? সেদিন আরও কয়েকটা ই-মেল এল। ফোন এল বেশ কয়েকটা। কিন্তু বিদিশার অভিনন্দন বার্তায় ‘মনে আছে আমাকে’? এই সকাতর জিজ্ঞাসাই মন ছেয়ে রইল আমার। পুলিশের তাড়া খাওয়া কত রাত্রির কত আশ্রয় মনে পড়ল। বিদিশা কি সেসব পরিবারের কেউ? কোনো কমরেডের বোন?
ভুলেও গেলাম কয়েকদিনের মধ্যে ওই ই-মেলের কথা।
বিজু নিয়ে গিয়েছিল আমাকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। বাগবাজারের গলির ভিতর যুগান্তর অফিস। এই অফিসে একসময় আমাদের মুখপুত্র দেশপ্রেমী-র সম্পাদক মনোজ দত্ত কাজ করতেন। সর্বানন্দদা কাজ করতেন। শ্যামল তখন অমৃত সাপ্তাহিকটি দেখছেন। আমাকে পেয়েই বললেন, জেল ডায়েরি লিখুন না, আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন নিয়ে? শহিদ হয়েছেন যেসব নেতারা, মনোজদা… ওঁদের কথা? বিজু বলল, ও গল্প লিখত। শ্যামল বললেন, দারুন। তাহলে আসুন না একদিন আমার বাড়িতে।
কাশীপুরে যেখানটায় আমার পুরোনো বন্ধু তুষার, ফাল্গুনিদের বাড়ি, তার কাছেই সরকারি আবাসন। ওঁর স্ত্রী লুচি-ফুলকপি খাওয়ালেন। তখনও যত্রতত্র ভোজনং, শয়নং অভ্যাসটা জায়নি। গোগ্রাসে খাওয়া দেখে কেন জানি না শ্যামল বললেন আপনি উপন্যাস লেখারই লোক। আমি কিন্তু দুটো গল্প দিলাম। শ্যামল বললেন লেখক হিসাবে আপনার নামটা চলবে না। মাইকেল ছাড়া মধুসূদনকে মানায় না। আপনি আবার মধুসূদন বড়াল। উহু, এ-নামে কোনো লেখক হতে পারে না। ছদ্মনাম নিন। আমি মেনে নিলাম। পার্টিজীবনে আমাদেরও তো কত ছদ্মনাম। খোকন সমাদ্দার, মৈনুদ্দিন, সবুজ সেন…। মোরব্বার ভালো নামটা মনে পড়ল আমার, সিউড়ি জেলার স্কুলে যে নাম ছিল তার।
চিরন্তন বসুর দুটি গল্প এই শিরেনামে ১৯৭৮ সালের অমৃত পত্রিকার একটি সংখ্যাতেই একসঙ্গে আমার দুটি গল্প চেপে দিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। নতুন লেখক দের নিয়ে অমৃত পত্রিকায় এ-ধরনের অভিনব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলাচ্ছেন তখন তিনি। আমি সে পরীক্ষায় উতরে গেলাম। এক পাঠক চিঠি লিখলেন এই লেখকের একগুচ্ছ গল্প ছাপা হোক। সেবার অমৃত ও যুগান্তর-এ শারদ সংখ্যায় যথাক্রমে আমার গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হল। নিজের লেখক জীবনের উত্থান বিষয়ে এর চেয়ে বেশী বলা সমীচীন নয়, বিশেষত এই ষাটোর্ধ বয়সে। তবু বলা প্রয়োজন শ্রীমতি নীলাঞ্জনা মুখোপাধ্যায় এক অধ্যাপিকা, আমেরিকায় পড়ান, আমার ট্রেন আসছে না কেন? উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এ বিষয়ে পেঙ্গুইন-এর সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যেদিন প্রয়াত হন, সেদিন আমি ঢাকায়। কবি আল মাহমুদের বাসায় টিভিতে এ-সংবাদ শুনে আমারা দু-জনই শোকগ্রস্ত হই।
লিলির বিষয়ে কিছু বলতে হয়। সেই যে উত্তর বিহার যাওয়ার সময় বালুরঘাটের বাস স্ট্যান্ডে ও দেখা করতে এসেছিল, তারপর আমাদের দেখা হয় ১৯৭৩ সালে বহরমপুর জেলে। মাসে অন্তত দুবার জেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত ওই সাহসিনী। বহরমপুর ওর পিসিরবাড়ি। এটাই হল সুবিধা। জরুরি আবস্থায় শেষ দিকটায় খুশি ভরা মুখে সে এসে জানায়, আলিপুরদুয়ারে গার্লস হাই স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছে সে। ইংরেজির টিচার। আমি ওকে বলি, তাহলে আমাকে আর কিছু করতে হবে না বলো? ১৯৭৮-এর গোড়ায় জেল থেকে যেদিন বেরোলাম, লিলির সঙ্গে দাড়িয়ে ছিলেন ওর দাদা আর পিসি-পিসেমশাই। তিনদিন পরে সন্ধ্যায় বালুরঘাটে আত্রেয়ী নদীতীরে লিলি আমার গালে কাদা লাগিয়ে দেয়, আমি ওকে জলে ভিজিয়ে দিই। এ বিবাহে শুকতারাটি সাক্ষী থাকে। আলিপুরদুয়ারে শামুকতলা রোডে লিলি বাসা ভাড়া নিয়েছিল। বালুরঘাটে দাদা আমাকে সমাদর করেই আমাদের পৈত্রিক বাড়ির আমার অংশটি ছেড়ে দিয়েছিল।
পার্টিতে তখন যতজন, তত টুকরো। মন বলেছিল, যেন পার্টি বলেছিল, তুমি লেখো। লিখতে শুরু করেছিলাম। আবার সেই কলকাতা যাতায়াত, কলেজ স্ট্রিট পাড়া, অমৃত অফিস, লিটল ম্যাগাজিন, চলছিল আমার টক্কর। বালুরঘাটের ওসি আমাকে বললেন, কেমন আছেন? নেতা বনে-যাওয়া তেলকলের মালিক বঙ্কুবাবু, তিনিও ডেকে বললেন, ভালো আছেন তো? খবর- টবর কী? বাসে উঠেছি অচেনা একজন বললেন, যাচ্ছেন কোথায়? শেষে আমি আলিপুরদুয়ারে লিলির কাছে গিয়ে থাকতে লাগলাম। লিলির দাদা, পিসি, পিসেমশাই ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ডেকে সই-সাবুদ করিয়ে বললেন ওই আত্রেয়ী-বিবাহ আমরা মানি না। বুঝলাম, সমাজবদল এক ইঞ্চিও ঘটেনি।
বছর চারেক হল হুগলীর শ্রীরামপুর শহরের অদূরে হাওয়াখানা গ্রামে আমি ছোট্ট একটি বাড়ি করেছি। আমার মেয়ে শ্রীরামপুরে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল, সেই সূত্রে শ্রীরামপুর। হাওয়াখানা গ্রামের অদূরে বেগমপুর, বড়া – তেভাগার কৃষক আন্দলনের অন্যতম তীর্থস্থান। আমি ধানের গন্ধের ভেতর থাকব। বেগমপুরে শিল্পী গোবর্ধন আশ থাকতেন। মেয়েকে দেখতে, আমার আকর্ষণেও লিলি আলিপুরদুয়ারের স্কুলের ছুটি – ছাটা ছাড়াও আচমকা–আচমকা চলে আসত। হতেও পারে আমাকে পাহারা দিতে। শিক্ষিকার চাকরি থেকে অবসরের পর লিলি বরাবরের জন্য এখানে চলে এসেছে। আমাদের এদিকটায় দোয়েল, বুলবুল, খঞ্জনা, মাছরাঙা ইত্যাদি পাখিরা রয়েছে। আমি সাতরকমের প্রজাপতি দেখেছি।
এই সেদিন লিলিই বলল, আলিপুরদুয়ারের অনুষ্ঠানটায় এবার তোমাকে যেতেই হবে। আমাদের রমলাদি খুব করে বলেছেন। মেয়েদের কলেজটা তো নতুন, তুমি দেখোইনি। যাও, যাও প্লিজ। কুরিয়ারে আসা কার্ড ও চিঠিটা দেখলাম, বিবেকানন্দ কলেজে বাংলা সাহিত্য বিষয়ক সেমিনার। ফোনও করলেন দু – তিনজন। অনেকদিন পর একটু বালুরঘাটও ঘুরে আসা যাবে। দাদা – বউদি যথেষ্ট বুড়ো হয়েছে, দেখে আসব।
বিবেকানন্দ কলেজে আলোচনাচক্রে মঞ্চে বসতেই পাশে – বসা মহিলা বললেন, জানতাম তুমি আসবেই। আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ঠিক শুনলাম তো ? ‘তুমি’ সম্বোধন করলেন ? ভদ্রমহিলার বয়স ষাট ছুঁই – ছুঁই হবে, এই বয়সে অপরিচিত সমবয়সিরা কেউ তুমি–তুমি বলে ! অধ্যক্ষ ভাষণ দিচ্ছিলেন। তারই ভেতর পার্শ্ববর্তিনী ফের বললেন, অনেক বদলে গেছ, জঙ্গলে, জেলে একেবারে হতকুচ্ছিত হয়ে গেছ তুমি ! বলে, মৃদু হাসলেন। নভেম্বর মাসে নর্থবেঙ্গলে আমি ঘামতে থাকলাম। এরপর তিনি বলতে ওঠায় আমি জানতে পারলাম, মহিলার নাম বিদিশা রায়চৌধুরী, বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ান। দেশে এলে শিলিগুড়িতে বোনের কাছে আসেন। সেই সুযোগে আলিপুরদুয়ারে টেনে এনেছে বিবেকানন্দ কলেজ।
বিদিশার পর বলতে গিয়ে বক্তব্য বড়োই এলোমেলো হয়ে গেল আমার। এরপর অন্যান্য বক্তারা বলছেন যখন, তখন আমি ভাবছিলাম এই বিদিশাই কি অভিনন্দন জানিয়েছিলেন আমাকে ? কিন্তু এই মহিলাকে তো আদৌ চিনি না আমি।
বিবেকানন্দ কলেজের সাহিত্য বিষয়ক সেমিনার বেলা একটায় শুরু হয়ে শেষ হল বিকেল চারটে নাগাদ। এরপর এই সেমিনারে আসা দুই তরুণ অধ্যাপক বালুরঘাট কলেজের অতীশ বিশ্বাস আর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশুমান ধর আমাকে ধরল। আলিপুরদুয়ার শহর একটু ঘুরিয়ে দেখাবার জন্য। অতীশ শ্রীরামপুরের ছেলে, আমার লেখালেখি নিয়ে সে কয়েকটা তাত্বিক প্রবন্ধ লিখেছিল। অংশুমান বর্ধমানেরই ছেলে, আমাকে নিয়মিত চিঠিপত্র দেয়। ওদের নিয়ে বক্সা ফিডার রোড ধরে রিকশায় বক্সা জঙ্গলের দিকে ঘুরে আসব, যাব কালজানি নদীর পাড়ে – এসব ভাবছি যখন, কী কান্ড ! জুটে গেলেন ওই প্রগলভা বৃদ্ধা। রুমানিয়ায় থাকার জন্যই হয়তো লাল টুকটুকে গাল, এককালে রূপসীই ছিলেন বোঝা যায়। আবদার ধরলেন, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব, চিরন্তন।
আমি একেবারে হেনস্থায় পড়ে গেলাম যখন অতীশ, অংশুমান একটা রিকশায় উঠে বসল। আরেকটায় উঠে বুড়ি আমাকে ডাকল, এসো চিরন্তন।
একটুও মনে নেই আমাকে ? মনে নেই সিউড়ির সোনতোড় পাড়া ? ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে সতীঘাটে তুমি যে আমাকে শুনিয়ে গাইতে ‘এ যুগেতে লেনিন জানায় মাও – এর গলায় আহ্বান’–মনে নেই তোমার ? মনে নেই ? হাওয়ায় হু – হু করছিল কালজানি নদীর পাড় ? বিদিশা বুড়ির এসব এলোমেলো প্রশ্নের মতো হাওয়া। আমি বুড়ো – চিরন্তন জবাব দেওয়ার বদলে মুখ দিয়ে এমন স্বর বের করছিলাম, যার অর্থ হ্যাঁ – ও হতে পারে, না – ও হয়।
রাতে বিবেকানন্দ কলেজ আমাদের থাকার জন্য যে ব্যবস্থা করেছিল, সেই গেস্ট হাউসে সবার আলাদা – আলাদা ঘর। টানা করিডোর। ঘুম আসছিল না। অনেক রাতে করিডোরের রেলিং – এ ঠেস দিয়ে সিগারেট খাচ্ছি। যা ভেবেছিলাম, কোণের দিককার দরজা খুলে গেল। বিদিশা এলেন। লিলিকে ফিরে গিয়ে সব বলব। বলব যে তুমিই ঠেলেঠুলে আলিপুরদুয়ার পাঠিয়েছিলে। বিদিশা এসে পড়লেন একেবারে নিঃশ্বাসের আওতায়। মুখে সেই প্রশ্ন, ভুলে গেলে চিরন্তন ? রেলিং–এ রাখা আমার হাতের ওপর তাঁর হাত কাঁপছে। সে কম্পন কতকাল আগের এক কিশোরীর। ওই থরো–থরো হাতের উষ্ণতা পাওয়ার কথা আমার নয়, আসল চিরন্তন বসুর, মোরব্বার।
পার্টি বলেছিল, মৃত্যু সংবাদ গোপন রাখবে। সে জীবিত। আমি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি।
লেখাটি ‘নতুন গল্পপত্র’ ,শারদ সংখ্যা,২০০৯ তে প্রথম প্রকাশিত
Tags: গল্প, পার্টি বলেছিল, মৃদুল দাশগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।