লিচু গাছের নীচে আধ শোয়া হয়ে ঝিমোচ্ছিল নিশিকান্ত। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ। শুকনো হরিতকির মতো পাতলা চেহারা। কোমর থেকে গোড়ালি ঢাকা চেক লুঙ্গি। খালি গা। ধারালো চোখ। বাঁশ ডগলার মতো মাথা ঝুঁকে, লিচু তলায় বসে আছে। বসে আছে মানে মতলব ভাঁজছে। লোকে আড়ালে বলে আড় কাঠি। আড়কাঠি মানে ‘সাপের হাঁচি বেদে চেনে’। সেটা হলো সাপের গর্তের আশ পাশে বেদে এলে সাঁপ তখন হ্যাঁচ্ছো করে। সেই হ্যাঁচ্ছো বেদে শুনতে পায়। সিঁদ কাঠি, চাবি কাঠি, কলকাঠির থেকেও আড় কাঠি ভীষণ ফেরোশাস্ । বেঘোরে জানটাও যেতে পারে। নিশিকান্ত গাছ তলায় কিংবা ঘরের তক্তপোশে নয়ত মাটি শুঁকে সে বলে দিতে পারে, এই গেরামে কার হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। কার কড়ায় কি তরকারি, কার ঘরে হাঁড়ি চাপেনি। যেন পাঁচ মাইল দূরে তার ছিপের সুতো। অত দূরে তা সে পুঁটি, মোরলা, পাঁকাল, রুই, মিরগেল, কাতলা যে মাছই টোক্কর মারুকনা কেন ফতনা নড়া, জলের কালারিং কিংবা জল নড়া দেখে বলে দিতে পারে বাতাসী, লেবু, ভোলা, মেনিদের সাইকেলের ফিরি কেটে গেছে। মানে প্যাটেল ঘুরছে-চেনও ঘুরছে কিন্তু চাকা গড়াচ্ছে না। আর সেয়ানাগুলোর সাইকেলে হ্যানডেল আছে তো সিট নেই। কার সিট আছে তো বেরেক নেই। কার আবার রিঙের এসপোক কেটে গেছে। তাদের সামনের চাকার এদিকে মাথা টলমল তো পেছনের চাকা অন্যদিকে মাথা নাড়ছে। খানিকটা হাঁচকা হেঁচকি করে যাচ্ছে।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ক্যাবল চাঁদ পড়তো পড় নিশিকান্তর সামনে। দিনের দিনই সে ফাঁদে পড়ে গেছে। ক্যাবলা চাঁদের হাতে বাটি। এবার দাও ফিরিস্তি। কথার প্যাঁচে প্যাঁচে ও কথার নাড়িকে-ভুঁড়ি টেনে বার করে ফেলবে। তার পর নাড়ীটাকে চেপে চেপে ষষ্টি পূজো, অন্নপ্রাশন, বিয়ে, ছাদ্দো, চন্ডিপাঠ, বাস্তু সাপ, মনসা পূজো সব কিছুকে ঘেঁটে ফেলবে। এমনিতে ঢোঁড়া হলে কি হবে? উল্টোদিকে ও তেত্রিশ কোটি দেবতার দেবতা। তখন অতো দেবতার জন্য নকুল দানা না কিনে, একটা বাতাসায় নিশিকান্তর পূজো হয়ে যাবে। অন্য দেবতা যদি রাগ করে বেগড়বাঁই করে ও তাকে ফেলে দেবে জলে। বলবে যা শ্যালা পুকুরের পাঁক খেগে যা।
লিচু গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে নিশিকান্ত বলে উঠলো কিসের তোর ফুড়তি র্যা ………. গলা ছেড়ে গান গাইছিস তানা না, নানা না। পকেটে নেই চারা আনা, পাঁপড় ভাজা খাবোনা। এবার সে ক্যাবলার মুখে চোখ বুলিয়ে বলে উঠলো, বাটি নিয়ে তেল আনতে যাচ্ছিস কি ভেজে খাবি? আলু, বেগুন, পটল না কাঁচকলা? ক্যাবলার গানের মধ্যে ঢুকে পড়লো ধোঁয়া, বালি, জংধরা পেরেক, ভাঙা কাঁচ, নোংরা আবর্জনা। নিশিকান্তর কথায় দাঁতের ধার। শরীরটাকে কামড়ে ধরে। কিন্তু এত সহজে ওর ফাঁদে পা দেবেনা ক্যাবলা। বললো দাসেদের আমতলা দিয়ে ঘরে যাচ্ছিনু। একটা হনুমান নাফ মারলো। আটটা চ্যাটুজ্জে আম পড়লো। আমগুলোকে আমি মাটি থেকে কুইড়ে, হমুমানটাকে বলনু বন্ধু আবার তুমি কালকে এসো। হমুমানটা আমায় দাঁত খিঁচলো। বললো পালা। আমি বলনু যাচ্ছি। না গেলে তুমি যদি আমার ঘাড়ে নাফ মেরে চারটে চড় হাঁকাও, আমি মাটিতে পড়ে চ্যাটনি হয়ে যাবো। তাহলে আমার আম দিয়ে মসুর ডাল খাওয়া হবে না। হুমমানটা বীর। মেদীটা অন্য ডালে বসেছিল। ও ধরবে বলে নাপপে ও ডাল থেকে এ ডালে চলে এসেছে। তেখনই দোল খেয়ে আমগুলো পড়ে গেলো মাটিতে।
নিশিকান্ত বললো আটটা আমের ওজন তা পেরায় তিন কেজির ওপর।
হিঁগো দাদা বেশি হবে তো কম নয়। পিল্লাই পিল্লাই আম।
নিশিকান্তর ছিপের ফতনা তখন দোল খাচ্ছে জলে। মাছটা বঁড়শির কাছে এসে ভাবছে ঠোক্কর মারবো-না পাইলে যাবো। বেরেনটা মাঝে মাঝে কাজ করছে। মাঝে মাঝে ফেল করছে। একটু মিচকি হেসে নিশিকান্ত বললো তুই অতগুলো আমাকে কুচচে-একশো তেল দিয়ে আমতেল করবি?
এতক্ষণ ক্যাবল চাঁদের দমটা আটকে দিয়েছিল-নিশিকান্তর কথায় খুলে গেলো। খানিকটা উৎসাহ নিয়ে বললো তুমি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছো। আসলে তুমি হলে জলে ভাসা সুরজু, চাঁদ, তারা। একটায় আমতেল, দুটো ডালে। বাকিগুলো পুইড়ে নুন দিয়ে সরবোত। জষ্টি মাসের তাতে আমপোড়া মানে ভেতর ঠান্ডা। ভেতর গরম মানে যত রকমের বেগড়বাঁই। কথাগুলো বলতে পেরে ক্যাবল চাঁদের চোখে হু হু হাওয়া।
কান খাড়া করে শুনছিলো নিশিকান্ত। তারপর গম্ভীর ভাবে বললো – বলে যা। আমার কান আছে শুনি আর চোখ আছে দেখি। এমন কথায় বুকের দোলনায় একটা দড়ি ছিঁড়ে গেলো ক্যাবল চাঁদের। আমতা আমতা করে বললো তুমি তো সব জানো – আমার জীবনটা এতো অভাবের এতো দুঃখের, কাঁটা নটেরও অতো কাঁটা নেই।
তোর কাঁটা নটের শেকড় সমেত আমি চিববে খেয়ে ফেলবো।
শিউরে উঠলো ক্যাবল। বললো তুমি আমায় চিববে খেয়ে ফেলবে?
তোকে নয়। তোর ঢপের কাঁটা নটের গল্পকে। এরপর চোখ তুলে বললো আমায় কি ভাবিস তুই। আমি একটা গরু? কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলে ক্যাবলা। মনে মনে বলে উঠলো তোমার শিঙ দেখেই আমি অজ্ঞান। তাড়া করলে – ন্যালা টপকাতে গিয়ে বুকের হাড় ভেঙে শুয়ে থাকতে হবে।
।। দুই ।।
ক্যাবল চাঁদ দেখতে পেলো তার গানের কথাগুলো আতপ চাল-তিল-কলা দিয়ে পিনডি চটকে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বুকের ওপর পর্যন্ত সত্যি কথাগুলো উঠে এসেছে। ওগরাতে যেটুকু সময়। পরিষ্কার আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দমকা বাতাস টের পেলো। একটু পরে ওই চার পাঁচ মাইল দূর থেকে ধেয়ে আসা ঝড়ের ধাক্কায় সে উড়ে যাবে। নিজেকে কোনো মতে সামলে বলে উঠলো, চার পাঁচ দিন ঘরে তেল নেই। বামার দোকানে যাচ্ছিনু যদি ধার পাই – তাহলে সরষের তেল, আদা আর একটু জিরে নিতুম। মুখ ফস্কে আদা আর জিরের কথা বলে ফেলে দু’পাটি দাঁত কামড়ে ধরলো জিবকে। কিন্তু কথা ফস্কে গেছে। তখন মুখে বঁড়শি আটকে জলের মধ্যেই থাকো।
নিশিকান্ত ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে বললো তাই বল – আজ তাহলে অনেক কিছু? এরপর আড়চোখে ক্যাবলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো আমার কাছে গোপন করছিস কেন? বলনা বামার দোকানে পেঁজ নিবি, নঙ্কা নিবি, রসুন নিবি, তবে তো কাঁচা থেকে পাকায় জমবে।
হাত দুটো একবার ওপরে তুলে – আবার নামিয়ে ক্যাবলা বললো কি যে বলো তুমি? ঘরে একটা দানাও নেই – যে নুন ছইড়ে চাডডি খানিক ভাত খাবো। আবার কথার ভুল। মাথার ভিতরে শিরশির। বলা উচিত ছিলো দুটিখানি। নিশিকান্তর মুখে দেঁতো হাসি। বললো তুই মাথায় ড্যাঙা হলে কি হবে, তোর মুখে এখন সবে মাত্র বোল ফুটেছে – কথা পরিস্কার হয়নি।
হাতের চেটো, পায়ের চেটো আর কানদুটো গরম হয়ে উঠলো ক্যাবল চাঁদের। লিচু গাছের নীচে ঝপ করে বসে ভাবতে থাকলো। এরপর নিশিকান্ত বলবে জানিস ক্যাবলা তুই হলি চিতিবোড়া। কেমন আসতে আসতে হাঁটিস? একবার কাছে আয় – তোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিই। ওমা এই তাতের মাসে যখন আম পাকলো, জাম পাকলো, ক্যাঁটালের কোষ ধরলো, অথচ তোর গা কি ঠাণ্ডারে? আবার উল্টোদিক থেকে যখন টানছি তখন কেমন খসখস। মাছের আঁশের মত লাগাছে। ডুব গেলে কি মাছ খাস? বলবে দাঁড়া একটু উল্টে দিয়ে দেখি। তারপর ন্যাজ থেকে পেটের তলা দিয়ে হাত চাইলে বলবে আই বাপ – এদিকটা আরো ঠান্ডা রে? মনে হচ্ছে এই মাত্র সঙ্গম করে উঠে আসছিস? তোর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে আমার শীত করছে। বলবে চলে যা ….. তবে রাগ করে কামড়ে দিসনা যেন? তুই তো আর শাঁকামুটি নোস যে মুখ দিয়ে কামড়াবি আর পেছন দিয়ে বিষ ঢালবি? তোর আবার বিষ নেই। হেঁ …….. হেঁ ………..
একটা জোরে দম নিয়ে নিজের পিঠ চাপড়ায় ক্যাবলা। কথা বলতে সে পারুক বা না – পারুক অপরের কথার ভাবটাকে বুঝে নেবার ক্ষমতা রাখে সে। সেই কারণে ক্যাবলা কথা শোনেনা। কেউ হয়ত খুব খাতির করে কথা বলছে অথচ তার মনের প্যাঁচে ফুলুরি ভাজা হচ্ছে। ফুলুরিটাকে ভেঙে আবার লাল করছে। এই দেখতে পাওয়ার জন্য তার আলাদা একটা চশমান আছে। সেই চশমাটা অন্য কেউ দেখতে পায় না। মনে মনে নিশিকান্তর জন্য হাসি পায়। ওর জন্য কিছু কথাকে তুলে রাখে সে। সেগুলো হলো বোড়া সাপে কামড়ালে গোটা গোটা কুমড়ো খেতে হবে। না খেলে গা খসখস। পিঁয়াজের খোসার মত চ্যাকলা-চ্যাকলা। গা ফাটবে – সেখান দিয়ে রস বেরুবে। বিছেনের ক্যাঁতা, বালিশে গন্ধ ছড়াবে। বোড়ার বিষ ধীরে ধীরে ওঠে। বোড়ার বিষ শরীলে ডিপ ফ্রিজে থাকে – বছরে একবার দুবার পাল্লা খুলে বেইরে আসে। এরপর খানিকটা রাগ হয় ওর। বলে, লোককে তো খুব ভ্যাঙাও। আমাকে বলবে – বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে বলবে, তোকে আমি ভালবাসি বলে গায়ে পিঠে হাত বুলোচ্ছি। অন্য কারুর চোখে পড়লে জান নিংড়ে দিতো। যখন তখন বেইরে পড়িসনি। যাহোক কিছু আহার করে ডোবার ঝোড়ে গা ঢাকা দে। বেশি আলো হওয়া খেতে ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরিস নি।
এবার ক্যাবলা নিজেকেই একটা চাঁটি মেরে বলে উঠলো আমার যে নটে গাছ, সে কোথায় থাকে তুই জানিস? সারা জীবন ঘুঁটে ফেললেও তাকে পাবিনা। ওর অন্তরের আলো শূন্যে ভাসতে থাকে। তারপর দেখা হয়ে যায় নটে গাছটির সাথে। ওকে দেখে গাছটি বলে এসো এসো কতদিন পরে তুমি এলে।
তোমাকে একটা কথা বলতে এলুম
কি কথা তোমার?
কদিন আগে শ্মশানে গিসলুম। একটা মড়াকে রাখা হলো। আগুন জ্বললো। তারপর দেখি শ্মশান যাত্রীদের মধ্যে কেমন নিস্তব্ধতা। সবাই ভাবছে – এই তো জীবন। এই লোকটা যখন বেঁচে ছিলো মারামারি, পেটাপেটি রক্তপাত কতো কাণ্ডই না করেছে। সবাই কেমন উদাসীন। ভাবছে জীবন মানে শেষ পর্যন্ত এই। তারপর যখন দাহকার্য মিটে গেলো বাইরে বেরিয়ে একজন তার পাশের লোককে বলছে তুই যে বিলডিং করবি, আমার দিকে থেকে দশহাত ছেড়ে দেওয়াল তুলবি। শেষ পর্যন্ত ওখানেই দু’জনের মধ্যে খুনোখুনি হবার জোগাড়।
নটে গাছের গায়ে আর একটা কাঁটা ফুটলো।
।। তিন ।।
ক্যাবল চাঁদ প্রায় বলেই ফেলেছিল তুমি কতো বড় স্যাকরা তা আমি জানি। মদনবাবু তোমাকে একটা পেরাইভেট ইসকুল পাটটে ছিলো চাকরির জন্য। নেতা পাটটেছে শুনে মালিক বললো আজ থেকেই রয়ে যাও। তুমি পেরায় নাপপে উঠে বলেছিলে আজ থেকেই? তিনি বলেছিলেন তোমার জন্য কি আমি তক্তপোশ, বিছানা, বালিশ তৈরি করে মশারী খাটটে রেখে দিয়েছি। চাকরি করবে। একটা দরখাস্ত লেখ। তুমি বলেছিলে আপনি লিখে দেন। তোমার কথায় তিনি ভুরুমুরু কুঁচকে বলেছিলো সে কি হে! তুমি করবে চাকরী আর আমি লিখে দেবো? লোকটা তোমার হাতে একটা কাগজ ধইরে বলেছিলো, কলম আছে – তো না সেটাও দিতে হবে? তুমি পাথরের মত দাঁইড়ে ছিলে। তোমার রকম দেখে সেই লোকটা বলেছিল দেখে তো মনে হয়, তুমি একজন বীর্যহীন বেঁটাছেলে। তা কি হয় – লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েছেলে দেখো?
তুমি বলেছিলে নুককে নুককে আমি মেয়েছেলে দেখি, এটা ঠিক কথা। বাছ বিচার করিনা। ছোট বড়ো নানান সাইজের দেখি। তবে আমি মোটেই বীর্যহীন নই। মানে ওই অভাবে দুঃখে শুককে গেছে। লোকটা বলেছিল যখন শুককেই গেছে তখন আর গলিয়ে লাভ নেই। মেয়েছেলের সঙ্গে যুঝতে গেলে কতো বীর্য চাই তা কি জানো? আরে বীর্যটাই তো এনার্জী। এনার্জী নেই মানে ঠাকুর জলে। লোকটা বলেছিলো যে বেদেনায় লাল নেই তার কোনো দাম নেই। লোকটার অস্পর্ধা দেখে তুমি মনে মনে বলেছিলে, তোর মত আমি তিন বেলা খেতে পেলে মাটি কামড়ে সোনা করে ফেলতুম। বলেছিলে চাকরিটা পেলে কোনো পেরজাপতি মেয়েকে গান শোনাতুম।
।। চার ।।
গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো ক্যাবলচাঁদ। কিছুক্ষণের জন্য ঘুমটা হলেও, ঘুমের মধ্যে কোনো চিন্তা ছিলো না। চোখ খুলতেই ও দেখতে পেলো নিশিকান্তর জুলজুল চোখ। চোখ দুটো ওর তারার মত আকাশ থেকে ঝুলছে। অদ্ভূত আগুন এই আলোয় দিনে এবং রাতে নিশিকান্তর ছায়া নেই। ছায়া নেই তার শরীরের সামনে কিংবা পিছনে। উদাসীনতা চেপে ধরে তাকে। নিশিকান্তর স্বরূপ সে চেনে। নিস্তার নেই তোমার ক্যাবল চাঁদ। লোকটা পেচু নিতে পারে। যেখানে তুমি দাঁড়াবে সেখানে ও থামবে। যে ঘরে ঢুকবে ও সেখানে বসবে – শুয়েও পড়তে পারে। হায়রে ক্যাবলা পাখি-মুখে করে ত্যালাকুচো ফল এনে, নিশিকান্তর পাখিকে বলছো খাও। এবার নিশিকান্ত ওর আসল মূর্তি ধরে বললো তুই অনেকক্ষণ ধরে ভ্যানতাড়া করছিস। তোর গা দিয়ে ভকভক করে মাছের গন্ধ বেরুচ্ছে। তুই কি ভাবছিস আমায় ধোঁকা দিয়ে চলে যাবি?
ক্যাবলা মাথা চুলকায়। তোমায় আমি ধোঁকা দিতে পারি? তুমি আমায় শুধু মুদু সন্দেহ করছো।
আচ্ছা ক্যাবলা তুই বল তোরা মায়ে বেটায় ভাত মাছ সাঁটাবি। আর আমি দুপুর বেলা একটা নিমকি কিনে ঠাকুমা দিদিমার মত আঙুলে চাপ দিয়ে ভেঙে, দু’গেলাশ জল খেয়ে ঢেকুর তুলবো? ধর্ম্ম বলে তো একটা জিনিস আছে – না নেই? মহাভারতে ধর্ম্মরাজ হলো যুধিষ্ঠির। ধর্ম্ম রাজের তো একটা কুকুর ছিলো রে। তুই আমাকে একটা কুকুরই ভাব। ধর্ম্মরাজের কুকুর কি রেঁধে খেতো?
ছিঃ ছিঃ। কি যে বলো তুমি? একথা শোনাও মহাপাপ।
তুই ঠিক বলেছিস। তবে কি জানিস কানা মনে মনে জানা। এবার কাঁসর ঘন্টার মত বেজে উঠলো নিশিকান্ত। ঝনঝন তার গলা। লিচু গাছের গোড়া থেকে উঠে বললো দেখি তোর হাতখানা?
দেখো দিকিনি। পরাণ ঠাকুর হাত দেখে বলেছিলো নটারিতে তোর হয় তক্তবোস না হলে জলচৌকি লাগবে। সে পেরায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। তুমি ঠিক করে বলো দেখি পকেট চিরুনি না ধুঁধুঁলের ছাল লাগবে?
ক্যাবলার কথায় নিশিকান্তর চোখের আলো গেলো বেড়ে। বললো ন্যাকামি বন্ধ কর। আমাদের আবার ভবিষ্যৎ? যে দিনটা আজ সেটাই কাল, পরশু …… কোনো হেলদোল নেই। এবার সে ক্যাবলার বাঁ হাতটা খপ করেক ধরে নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকতে থাকলো। শুঁকতে শুঁকতে বললো উঁহু মোরলা নয়। পুঁটি নয়। ট্যাংরা-রুই-মিরগেল, কাতলাও নয়। এতো চিংড়ি মাছের গন্ধ রে। বল তুই চিংড়ি মাছ ধরিসনি?
ক্যাবলা পড়লো ফাঁপড়ে। তুমি যদি বলো আমি চিংড়ি ধরেছি তাহলে বলার কিছু নেই।
কি আর বলবি তুই – তোর বলার কিছু আছে? ক্যাবল চাঁদ বুঝতে পারলো সে নিশিকান্তর বঁড়শিতে ঝুলে গেছে। নিশিকান্ত বললো তুই যেভাবে মিথ্যেকে সাজাচ্ছিস – তোর নটে গাছ জানতে পারলে তার কাঁটা ঝরে যাবে। ক্যাবল চাঁদের সারা শরীর জ্বালাজ্বালা করে উঠলো। নটে গাছকে কেউ উপহাস করলে সে সহ্য করতে পারে না। নটে গাছ ওর প্রাণ। যদি সে জাহাননামেও যায় তবু সে নটে গাছের সঙ্গে দেখা করবে। চোখ দুটো ওর জলে ডুবে গেলো।
বুকের জোর দিয়ে নিশিকান্ত বলে উঠলো দেখি তোর ডান হাতটা?
ডান হাতটা আবার কি হবে?
কোশচেন করিস না। যা বলছি শোন। ক্যাবলা ওর ডান হাতটা এগিয়ে দেয়। ক্যাবলার হাতটা শুঁকতে শুঁকতে নিশিকান্ত বলে উঠলো, এই হাতে তোর মাংসের গন্ধরে। হাত শুঁকতে শুঁকতে নিশিকান্ত বললো উঁ-হু-গেড়ি নয়-ঝিনুক নয় – শামুক নয় – কাঁকড়া নয়। তবে কি? ও পেয়েছি। ঠোঁটে ওর দুষ্টু হাসি। বললো কোথায় পেলি? পেরানিটা কি ড্যাঙায় উঠে ডিম পেড়ে পাতা চাপা দিচ্ছিলো? না পুকুর-ডোবা-ন্যালা থেকে?
গোঁত করে একটা ঢোক গিলে ক্যাবলা বললো কি যে বলো?
হই হই করে হাসতে হাসতে নিশিকান্ত বললো মনে হচ্ছে শূন্যে ডিগবাজি খাই। তিড়িং করে লাফ মেরে আবার বসে পড়লো লিচু গাছের গোড়ায়। শিকড়ের ফাঁক থেকে একটা পাঁইট বার করে অনেকটা মদ ঢেলে দিলো গলায়। তারপর চোখ দুটোকে টান টান করে বলে উঠলো, তুই কি ভাবিস আমি কিছু বুঝি না? নিশিকান্তর মূর্তি দেখে ভয় পেলো ক্যাবলা। যদি প্রতিহিংসা জেগে ওঠে, সর্বনাশ হতে পারে। ওর থেকে কয়েক পা সরে এসে ক্যাবল বললো আমি বলতে পারি – তুমি কিছু বোঝনা?
নিশিকান্তর চোখে তখন রঙ লেগেছে। পেটে মদ ঢুকতেই ওর শক্তি আর গলার জোর বেড়েছে কয়েক ধাপ উঁচুতে। ওই মূর্তি সহ্য করতে পারেনা ক্যাবলা। বলে তুমি চেল্লামেল্লি করোনা। পাঁচকান হলে আমার বিপদ। বামাল সমেত ধরা পড়ে যাবো।
এটা যেন তোর মনে থাকে।
মনে আবার থাকবে না? ঠাণ্ডা উচ্চারণ ক্যাবলার গলায়।
নিশিকান্তর কঠিন চোখ। মনে রাখিস, তুই যদি ভোঁদোড় হোস – আমি নেউল। তুই যদি মাছ মেরে খাস – আমি গোখরো, কেউটে মেরে তার রক্ত খাই। এরপর আবেগ ঝরে পড়লো নিশিকান্তর গলায়। ফোটা পদ্মফুলের ভিতর যে নরম স্পর্শ, তেমনই ওর গলা। বললো আমাদের পোড়া কপালে এক-আধদিন আমাবস্যের চাঁদ ওঠে? বলনা এতো সোনাদানা কোথা থেকে কুইড়ে পেলি? এই গেরামে তো কেউ দান ধ্যান করেনা। ওই তো সব। রাজা ধন ছড়ায় – আর যা পড়ে রানিমা কুইড়ে নেয়।
।। পাঁচ ।।
ক্যাবল চাঁদ ডুবে গেল আপন কথায়। বললো কাল চাঁদ উঠেছিলো। অতো বড় চাঁদ উঠেছে আকাশে – ঘরে ঘুমোই কি করে? ভাবনু কোথায় যাই? মন বললো বোস পুকুরে চল। জলের চাঁদ আরো সুন্দর। ঝলমল সোনার আলো। মাটি গাছের পাতা পুকুরের জল খানা খন্দ ডোবা মাঠের আল ঝকঝক করছে। অতো আলোয় পাখিরাও ঘুময়নি। দু’একটা এই গাছ থেকে ওই গাছে সেই গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যাচ্ছে। কথা বলছে। এতো আলো দেখে চিংড়িরা উঠে এসেছে পাড়ে। আলোর মধ্যে লটোপুটি খেয়ে দাড়া নেড়ে গান ধরেছে।
জল থেকে কাছিমটাও উঠে এসেছিলো ডাঙায়। সে তার ছোট ছোট পা দিয়ে পেট চুলকে সেতার বাজাচ্ছিল। ব্যাঁ-আ-ঞ-বিম-বিম …….. কচ্ছপের সেতারে গান ধরলো এক বুড়ো চিংড়ি।
মাটি কেন পাহাড় হলো, সেই কথাটাই বলি / সাধ মেটে না – সাধ মেটে না – পিঁয়াজ গাছে কলি / তারার আলো জোনাক আলো – বকুল ফুলের দুল / কেঁচোর পুতুল ছোট পায়ে – পার হয়ে যায় বাঁশের পুল / ছাঁচি কুমড়ো ছাঁচি কুমড়ো – কোথায় শুতে যাবি / তেঁতুল পাতার ঝাল হয়েছে – পেট ভরে খাবি।
তারপর শুরু হয়ে গেলো ওদের ছোটাছুটি – কান্নাকাটি। বাবাগো মাগো বাঁচাও। বুড়ো চিংড়িটা কাঁদলোনা, পালালোনা। বললো তোমরা সব শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো জলে। দেরি করোনা যে ধরা পড়বে তার মৃত্যু অবধারিত। আমি তখন টপাটপ করে পনের ষোলটাকে ধরে গামছায় বেঁধে হ্যা হ্যা করে হাসছি, আর বলছি প্রতি পূর্ণিমাতে খাই কাঁচকলার বড়া। এবার মুখের অরুচি কাটবে। এই কান্নাকাটিতে কাছিমটা ভ্যবাচ্যাকা মেরে দাঁইড়ে পড়েছিল। বডিটাকে ঘুইরে জলের দিকে যে হাত পাঁচেক যাবে, সেটা তো অনেক টাইমের ব্যাপার। আমমোও দেখতে পাইনি। মাছ নিয়ে যখন ঘরের দিকে পা বাইড়েছি, তখনই পায়ের ধাক্কা খেয়ে পেরানিটা গেলো উল্টে। ওকে গামছায় বেঁধে বলেছিনু বারে বোস পুকুর। তারপর ওর গায়ে হাত বুলতে বুলতে বলেছিনু, কদিন আমার ঘরে জিরোবি চল।
মা বলেছিলো পূর্ণিমের রাতে মাছ ধরেছিস – কি জানি বাপু? ওই বুড়িটাকে দেখতে পাসনি তো?
কোন বুড়ি? কথাটা বলতে গিয়ে বুকের মধ্যে ছাঁক করে উঠেছিলো। মা বলেছিলো – তোর ঠাকুরদার যে টাকুরদা তার আমল থেকে এক বুড়ি আসে। পূর্ণিমার ছলছল জ্যোৎস্নায় কখনো নদীর ধারে কখনো পুকুর পাড়ে। সাদা থান কাপড়ে ঢাকা। পা অব্দি খোলা চুল। চোখ দুটো তার জ্বলে।
ঢোক গিলে ক্যাবলা বলেছিলো তারপর?
তারপর সে আগুন জ্বালে। তখন পুকুরের মাছ, নদীর মাছ উঠে আসে ডাঙায়। জেলেরা জাল ফেলে একটা পুঁটিও পায়না।
আমি বলেছিনু খুব ভালো কথা। ওই রকম মেছো বুড়ি যদি পাই, তাহলে খুব মাছ খাওয়া যাবে। মাছ খাওয়া হয় কোথায়?
মা বললো সে কথা নয়। বুড়ির আকর্ষণ লাগলে কেঁপে জ্বর আসবে। তখন শিউলি পাতা-ফুল-ফল-ছাল-শেকড়-বেটে খাওয়ালেও জ্বর ছাড়বে না। বেঘোরে ভুল বকবি বুড়ির সঙ্গে। তুই বাবা বসির আলির কাছে গা টা ঝেড়ে আয়।
মাকে বলেছিনু – এমন একটা ঠাকুমাকে যদি পাই, যে জোছনায় আগুন জ্বাইলে মাছ পুইড়ে খায় – তাকে বলবো ঠাকুমা, কতো আর আলোনা খাবে? তুমি যদি খানিকটা মাছ দাও, তোমাকে নুন দেবো। নঙ্কা দোব – তেল দোব। কড়া দোব, খুনতি দোব।
মা বলেছিল তোকে যদি বলে জানিস আমি কে?
আমি হই হই হেসে বলতুম তুমি মরা ভূত, আমু হলুম জ্যেন্ত ভূত।
এরপর একটু জিরিয়ে – দম টেনে বলে উঠলো আজকে সহদেবের আটটা নারকেল গাছে নারকোল পেড়ে দিয়েছি। দুটো নারকেল আর আশি টাকা দিয়েছে। বামার কাছে পঞ্চাশ টাকা বাকি। ওই টাকাটা মিটটে দিয়ে ত্রিশ টাকার তেল, আলু আর মশলা নেবো। আর বসলে হবে না। নিশিকান্ত বললো নারকেল কোরা, আলু দিয়ে চিংড়ি….।
দস্তার বাটি বাজিয়ে পথে নামলো ক্যাবলা।
তানা নানা-তানা নানা – পকেটে নেই চার আনা / হাসি খুশি কিনবো না – পাঁপড় ভাজা খাবোনা / তানা নানা – তানা নানা – গরীব পাখি উড়বে না / জোনাকিরা জ্বলবেনা – নানা নানা নানা / কানা বেগুন আট আনা – সরষের তেল বারো আনা / পিঁয়াজ রসুন আদা জিরে – হলুদ নিয়ে ষোল আনা / মিহিদানা গড়াবেনা – কুলপি মালাই গলবে না / শিকের হাঁড়ি ছিঁড়বে না – আমের ভেঁপু বাজবে না / তানা – নানা – তা – না ……….
বামার দোকানে সত্তদা আনতে চলেছে ক্যাবল চাঁদ। নিশিকান্তর মনে হলো চাঁদের সঙ্গে আকাশের তারা, জোনাকি, মাটির প্রদীপও চলেছে। দেখতে দেখতে মায়াময় হয়ে উঠলো ওর মন। মনে হলো যে জিনিসটায় মানুষ আশা করে আছে সেখানে যদি ও ভাগ বসায় ঋণ হয়ে যাবে। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো নিশিকান্তর। কেরো খাবার থেকে ফুগলে খানিকটা বখরা নেওয়া, সেটা হলো নিজেকে নীচোয় নামানো। এর জন্য ফেতি কুকুরের মতো ল্যাং-ল্যাং করে ওদের বাড়িতে যেতে হবে। চাঁদের মনে কষ্ট হবে। তখন নটে গাছে আর একটা কাঁটা ফুটবে। এভাবে ঘাই মারাটা মহাপাপ। মরলে নরকেও জায়গা হবে না।
সে কি ওর চাঁদকে কিছুই দিতে পারেনা? হক্কাইয়ের থেকে কিছু দিয়ে খাওয়ার আলাদা একটা মজা আছে। ঘরে কেজি খানেক চাল ছাড়া আর কিছু নেই। নিশিকান্ত চাল কটা আনতে ওর ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে।
Tags: গল্প, নটে গাছ, পঙ্কজ চক্রবর্তী
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।